২০০৬ এবং ২০১৩ সাল :: সরকারী দল বনাম বিরোধী দল
লিখেছেন লিখেছেন আবরার ৩১ মার্চ, ২০১৩, ০৩:৪১:৫৮ দুপুর
২০০৬ সাল এবং ২০১৩ সালের সরকার বনাম বিরোধী দলের ভুমিকায় খুব পার্থক্য নেই । তবে দাবীর পার্থক্য , কর্মসুচীর মাত্রা এবং মোকাবিলা - দমনের প্রক্রিয়ায় কিছুটা ভিন্নতা আছে । উভয় পক্ষের একগুয়েমীর ধরন ধারন হুবুহু এক । '' জনগণের ক্ষমতা '' জনগণকে ফেরত দেয়ার নামে ২ পক্ষ '' জনগণের সাথে করা চুক্তি '' [ গণতন্ত্র ] ছিন্ন ভিন্ন করে দিলেন । জনগণ বাধ্য হয়ে '' রয়েল বেঙ্গল টাইগার '' কে অভিন্দন জানালো । তৎকালীন বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ ''টাইগার '' কে বললেন --- আপনারা আমাদের আন্দোলনের ফসল , সব বৈধতা---দায়মুক্তি দেয়া হবে '' । তথা কথিত '' টাইগার '' গণতন্ত্রের বিচ্যুত রেলগাড়ি নিয়ে আজানা পথে পাড়ি দেয় । আমানিশার ঘোর অন্ধকারে রেললাইন হারিয়ে যায় । সর্বশেষ '' U '' টার্ন এবং একজিট লাইন নিশ্চিত করন সমঝোতা হল দায়মুক্তি দাতার [ আওয়ামী লীগ ] সাথে । এখন দেখছি ২০১৩ সালের '' গনতন্ত্রের রেলগাড়ি '' আরো ভয়ঙ্কর আকৃতিতে ২০০৬ এর দিকে ধাবিত হচ্ছে ।
*
************** ২০০৬ সাল ********************
ক্ষমতায় ৪ দলীয় জোট সরকার । প্রধান মন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া । ক্ষমতার শেষ বর্ষ । তত্ত্বাবোধায়ক সরকার বিধান ছিল । বিরোধী পক্ষ আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দলের আপত্তি ২ ব্যক্তিকে নিয়ে । নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আব্দুল আজিজ এবং সাম্ভাব্য তত্ত্বাবোধায়ক প্রধান বিচারপতি কে এম হাসান এর অধীনে নির্বাচন না করা এবং প্রতিরোধের ঘোষনা দিলেন তারা । বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ বললেনঃ
১] তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং নির্বাচন কমিশন সংস্কার করেই এ দেশে নির্বাচন হতে হবে । তা না হলে কোন নির্বাচন জনগন মানবে না । [২৯/৬/২০০৬ ]
২] এক অবরোধ কর্মসুচীতে সংঘর্ষে ২ জন লোক মারা যায় । এর প্রতিবাদে হরতাল দিয়ে তিনি বলেন '' যত হত্যা , তত হরতাল '' । [৩/৭/২০০৬ ]
৩] বিচারপতি কে এম হাসান ক্ষমতা নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম গঞ্জ এবং জেলা উপজেলা হতে নৌকার বৈঠা , লগি , লাঠিসোঁটা নিয়ে ঢাকায় চলে আসবেন । আমরা দেখব হাসান - আজিজ মার্কা সরকার কিভাবে চলে । সে দিন দেখিয়ে দিব কত ধানে কত চাল ।[১৮/৯/২০০৬ ]
এই বক্তব্যের প্রতিফলন ২৮/১০/২০০৬ তারিখে রাজপথে ঘটেছিল । লগি - বৈঠার নির্মম তান্ডব দেশের মানুষ প্রত্যক্ষভাবেই দেখেছিল । সেদিন লাশের উপর নৃত্য করেছিল আজকের শাহাবাগ নেতা বাপ্পাদিত্য চক্র ।
তৎকালীন প্রধাণ মন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেনঃ
============================================
১] আমাদের উন্নয়ন কর্মকান্ড দেখে বিরোধী দল বুঝতে পেরেছে যে , আগামী নির্বাচনেও জনগণ আমাদেরকে ভোট দিবে ।তাই তারা আন্দোলনের নামে দেশে বিশৃংখলা সৃষ্টি করছে ।জ্বালাও পোড়াও ভাংচুর করছে । এই হচ্ছে বিরোধী দলের রাজনীতি । [ ৩/৫/২০০৬ ]
২] তারা মানেন কি মানেন না , তাতে কিছু যায় আসে না । কে এম হাসানই হবেন প্রধান উপদেষ্টা । [ ৫/৯/২০০৬ ]
আসলে যারাই ক্ষমতায় থাকেন তারা বাস্তবতা সহজে বুঝতে চান না । বুঝেন অনেক পরে । সাদ্দাম হোসেন , হোসনি মোবারক , গাদ্দাফিরাও বুঝতে অনেক দেরী করেছিলেন । কিন্তু ততক্ষনে যে দেশের কি ক্ষতি হয়ে যায় তা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ বাসীরা উপলব্ধি করেন বলে মনে হচ্ছে না । এইবার চোখ রাখুন ২০১৩ সালের দিকে ।
***********২০১৩ সাল **********
২০০৬ সালের বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ এখন প্রধান মন্ত্রী । তাদের শেষ বর্ষ । এক খোঁচায় তত্ত্বাবধায়ক বিধান বাতিল করে দিলেন । দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন করার সিদ্ধান্তে এখনও দৃঢ় আছেন । ১৮ দলীয় জোট সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না । তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে হবে এবং নির্বাচনে সেনাবাহীনিকে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে নিয়োগ দেয়ার দাবী পুরন না হলে তারা নির্বাচন বয়কোট এবং প্রতিরোধ করবে । এখন সরকার প্রধান শেখ হাসিনা ওয়াজেদ কি বলেন ? তিনি বলেন ------দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে । সংবিধানের বাইরে যাওয়া যাবে না । অনির্বাচিত সরকার চাই না । তিনি আরো বলেন ---------
১] হত্যাকান্ডের দায় বিরোধী নেত্রীকে নিতে হবে । দেশের মানুষ শান্তিতে থাকুক , বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাড়াক , এটা বিরোধী দলীয় নেত্রী চান না । [১৭/৩/২০১৩ ]
২] আর মানুষ পোড়াবেন না , গাড়ি ভাঙ্গবেন না । দেশের মানুষকে শান্তিতে থাকতে দিন । [ ২৮/৩/২০১৩ ]
সরকার প্রধানের সাফ সাফ কথা --- তত্ত্বাবধায়ক সরকার হবে না । দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে । বিরোধী দলের মানা না মানায় কিছুই আসে যায় না । ক্ষমতাসীনদের বক্তব্যের ধরন ধারন হুবুহু একই । তেমন পার্থক্য নেই । সবাই সমান । এই প্রেক্ষাপটে বিরোধী নেত্রী কি বলেন -----------------------------------------
1] আমি স্তম্ভিত , আমি ক্ষুব্ধ , আমি গভীরভাবে মর্মাহত । মনে হচ্ছে ভিন দেশী হানাদাররা দেশের মানুষের উপর গণহত্যা চালাচ্ছে । দেশ আজ মহাসংকটে । রক্তপিপাসু খুনি সরকারের পদত্যাগ চাই । [ ১/৩/২০১৩ ]
2] খুনি সরকারের সাথে কথা বলে লাভ নেই । আমরা গোলামী নয় , স্বাধীনতা চাই । বিধর্মী - নাস্তিক এই সরকার ক্ষমতায় থাকলে দেশ ধবংস হয়ে যাবে । [ ১৭/৩/২০১৩ ]
২০০৬ এবং ২০১৩ সালে সরকারী দল বনাম বিরোধী দলের বক্তব্যে খুব পার্থক্য নেই । নতুন করে যুক্ত হয়েছে '' পুলিশের কাজে বাধা '' রাষ্ট্রদ্রোহীতা '' সরকারের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র '' যুদ্ধাপরাধ বিচার বানচালের ষড়যন্ত্র '' উন্নয়ন কাজে বাঁধা '' ইত্যাদি । প্রতিপক্ষকে ঘায়েল এবং বাইরের শক্তির দৃষ্টি আকর্ষন করতে নিজের নাক কাঁটার ধারা অব্যাহত আছে । রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অশুভ উদ্দেশ্যে হিন্দু এবং তাদের বাড়ি ঘরে -মন্দিরে হামলা আগের মতই চলেছে । এই দুই সময়ের সরকার এবং বিরোধী পক্ষের রাজনীতি বিকশিত না হয়ে বিনাশের ভয়াল চিত্র ফুটে উঠেছে ।তবে অতীত বর্তমানে কিছু মৌলিক পার্থক্য দেখা যাচ্ছে । যেমন -------
১] অতীতের কোন সরকার জননিরাপত্তার স্বার্থে নির্বিচারে গুলি চালায়নি । উচ্চ পর্যায়ের কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তি '' দেখা মাত্র গুলি '' করার হুকুম দেয়নি । আজ কোর্ট - আদালতের পরিবর্তে রাস্তায় পুলিশকে বিচারিক ক্ষমতা দেয়া হল যাতে অপরাধ প্রমান ছাড়াই গুলি করে শাস্তি হিসাবে কবরে পাঠিয়ে দেয়া যায় ।
২] মাত্র কয়েক দিনে ১৭০ জন মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা দেশ স্বাধীন হয়ার পর এই প্রথম ।
৩] জনতার হাতে একসাথে ৬জন পুলিশের মৃত্যু এই প্রথম ।
৪] রাজপথের আন্দোলন গ্রামে গঞ্জে যে ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এবং ব্যাপকভাবে সাধারন নারী-পুরুষের অংশ গ্রহন অতীতে দেখা যায়নি ।
৪] এক সাথে ৫ লক্ষাধিক মানুষ গণগ্রেপ্তার এবং পুলিশী নির্যাতনের ভয়ে বাড়ি ছাড়া যা অতীতে দেখা যায়নি ।
৫] অতীতের কোন সরকার নারীদের মিছিলে গুলি চালায়নি । অথচ এবার পুলিশ তাদের মিছিলে গুলি চালিয়ে তাদেরকে হত্যা করেছে ।
৬] নিরীহ মসজিদের ঈমাম , মাদ্রাসার শিক্ষকের দাড়ি ধরে ঠান্ডা মাথায় গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে পুলিশ ।[ মাওলানা আব্দুস সালাম -মানিক গঞ্জ ] । [ ৫/৩/২০১৩ ]
৭] অতীতের কোন সরকার ইসলামী দল নির্মুল , আলেম-ওলামা হত্যা , ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধকরনের উদ্যোগ গ্রহন করেনি । কিন্তু এখন সে আয়োজন চলেছে ।
৮] দেশের সর্বত্র পুলিশের গণগ্রেপ্তার অভিযানে সরকার দলীয় ক্যাডাররা সস্রভাবে অংশগ্রহন করেছে যা অতীতে কল্পনাও করা যায়নি ।
৯] দেশের একাধিক স্থানে পুলিশ রাতে গ্রেপ্তার অভিযান চালাতে গিয়ে প্রচন্ডভাবে বাঁধা এবং প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে ফেরত এসেছে । ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে । এজাতীয় ঘটনা পুর্বে ঘটেনি ।
১০] রাজনৈতিক নেতা কর্মীকে চোরের মত রশিতে বেঁধে , হাত কড়া পড়িয়ে , ধুর্ধষ ডাকাত-ফেরারী আসামীর মত ডান্ডা বেড়ি লাগিয়ে কোর্টে হাজির করার নজির এই প্রথম দেখা গেল ।
১১] রাস্তা ঘাটে দাড়ি-টুপি ধারী মানুষকে ব্যাপকভাবে হয়রানি এবং মারধর করা হচ্ছে । এই জাতীয় লোক নিরাপদে চলাফেরা করতে পারছে না । পুলিশ রাস্তা ঘাটে তল্লাশী চালাচ্ছে ।
১২] পর্দানশীল নারীদেরকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডের নামে নির্যাতন এবং জেল খাটানোর নজির অতীতে ছিল না ।
১৩] ২০০৬ সালে বিরোধী দলীয় নেতারা ছিলেন মুক্ত । আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক মরহুম আব্দুল জলিল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের মত ৩০/৪০ টা মামলায় হয়রানি হয়ে জেলে ছিলেন না । তিনি ছিলেন মুক্ত ।
১৪] অতীতের কোন সরকার নাস্তিক , ধর্মবিদ্বেষীদের নগ্নভাবে আস্রয়-প্রস্রয় সহ সার্বিক সহযোগীতা করেনি ।
১৫] একসাথে ১৪৮ জন নেতা কর্মীর বিরুদ্ধে [ বিএনপির ] মামলা, চার্জসিট দাখিল এবং তা আমলে নেয়ার মত ঘটনা ২০০৬ সালে বা অতীতে কোন সরকারের আমলে ঘটেনি । তা আজ ৩১/৩/২০১৩ তারিখে ঘটেছে ।
১৬] দেশের বৈধ নিবন্ধিত সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী বৃহত্তম ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামীর সমস্ত নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা , ৩০ হাজার গ্রেপ্তার [ ৭/৮ হাজার বর্তমানে জেলে ] , রিমান্ড , নির্যাতন চলেছে যা অতীতে কোন সরকারের আমলে হয়নি ।
আজ সর্বক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে । আক্রমনাত্মক বক্তব্য দিয়ে জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢালা হচ্ছে । সময় দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে । ২০০৬ সালের তথাকথিত সুশীলরা মুখে তালামেরে ঘরে বসে আছেন । তাদের একটি অংশ শীততাপ হল রুমে '' বিশাল ভোজ সভায় '' পুরানো কাসুন্দি কপচাইলেন শুধু । দেশের করুন পরিস্থিতে তারা ভয়ানক ভাবে নীরবতা পালন করেছেন ।
সব সরকারই পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে । তাতে পুলিশের একটি অংশ আজ রাজনৈতিক ক্যাডারে পরিনত হয়েছে । পুলিশকে মানুষ তাদের বন্ধু মনে করে না । কারন পুলিশও কোন নিয়ম কানুন মানছে না । গুটি কতেক অতিউতসাহী পুলিশের কারনে গোটা পুলিশ প্রশাসন বিব্রতকর অবস্থায় আছে । পুলিশ প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে গেছে । দেশের সর্বত্র পুলিশ আতংক বিরাজ করছে । তাদের ভিতরে অর্থ বাণিজ্য চলেছে ব্যাপকভাবে । রাজনৈতিক নেতা কর্মী এবং নিরীহ সাধারন মানুষও হয়রানীর শিকার । গাছের -গাড়ির - কুকুর-বিড়ালের মুল্য থাকলেও মানুষের জীবনের কোন মুল্য নেই । মানুষ নিরাপদে হাটতে এবং নিজ ঘরে ঘুমাতে পারছে না । ব্যবসায়ী মহল হতাশা , আতংক এবং অস্বস্তিতে আছেন । শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধবংসের দ্বার প্রান্তে । এই জন্যে দায়ী কে ? তা জনগন জানতে চায় না । জনগণ চায় শান্তি , চায় স্বস্তি , চায় জান-মালের নিরাপত্তার গ্যারান্টি ।
বিষয়: বিবিধ
১৩৫১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন