সমাজের কড়িকাঠে বলি হচ্ছে নারী!

লিখেছেন লিখেছেন পত্রিকার পাতা থেকে ১৩ নভেম্বর, ২০১৩, ১১:১৯:৫৩ সকাল



আমাদের সমাজ ব্যবস্থা যুগ যুগ ধরে সব অভিযোগ নারীর উপর দিয়ে আসছে। তাদের কাছে নারী একটি অবলা বস্ত্ত। নীরবে সব সহ্য করে বলে ঝামেলা ছাড়াই নারীর কাছে একের পর এক দোহাই দিয়ে আসছে। আর নারীকে করে রাখছে ঘরকুনো। বাইরে পৃথিবী থেকে রাখছে অনেক দূরে। কিন্তু বাস্তব চিত্র কি এমন? কখনো নয়। এটা আমাদের পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থা আর কুসংস্কার ও অজ্ঞতার ফল। তাহলে প্রশ্ন এভাবে আর কত দিন চলবে?

দৃশ্যপট- এক

সব নারীর মত গায়ে লাল বেনারসী জড়ালো রুম্পা। আজ তার বিয়ে। সানাইয়ের ধ্বণি তার কানের চেয়ে হৃদয়কে পাগল করে তুলছে। একজন বাঙালি নারী হিসেবে নতুন জীবনের আনন্দের প্রত্যাশাটুকু অনেক। পারিবারিক কোন সমস্যা ছিলো না রুম্পার জীবনে। সন্ধ্যায় বরযাত্রী আসবে। বিয়ে বাড়িতে লোকজন ভরপুর। বিয়ের আর কয়েক ঘন্টা বাকি। হঠাৎ ফোন আসলো বরযাত্রীর একটি গাড়ি সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে তিনজন মারা গেছে। শুরু হলো হট্টাগোল। বর নিরাপদ থাকলেও অনেক বাধ্য করে রুম্পাকে বিয়ে দেওয়া হলো। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো স্বামীর ঘরে রুম্পার সুখ নিয়ে। প্রথম দিন বরের পরিবার থেকে কথা উঠলো মেয়েটি অপয়া। এখন প্রশ্ন হলো সড়ক দূর্ঘটনায় তিনজন মারা গেল। এখানে মেয়েটার দোষ কোথায়? এমনও তো হতে পারে, এটা বর পক্ষের কোন পাপের ফল!

দৃশ্যপট- দুই

উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে একদিন ডাক্তার হবে সালেহা। ৭ম শ্রেণীতে পড়ে। লেখাপড়ায় বেশ মেধাবী। ছোটবেলা থেকে কখনো কোন ক্লাশে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে নি। সব কিছু ঠিকঠাক মত চলছে। বিপত্তি ঘটলো গ্রামের অশিক্ষিত কিছু নষ্ট মানুষ নিয়ে। সালেহার বাবাকে বুঝালো, ‘মেয়ে বড় হইছে। বিয়ে দাও। লেখাপড়ার কি দরকার। ঐটা হলেও কি, না হলেও কি। রান্নাঘরে বাসনই মাজবে। আমার পোলা সবে বিদেশ থেকে ফিরলো। তুমি যদি রাজি থাকো তবে আগামী শুক্রবারে বিয়ের কাজি ডাইকা নিয়ে আসি।’ ঐদিকে সালেহার দাদীও বেশি জোর করছে সালেহার বাবাকে, ‘আমাকে একটি নাতনি। জামাই দেখে মরলেও। যেন শান্তি। আমাদের আমলে এত লেখা পড়া ছিলো না। এইটা না করেও আমি তোদের মানুষ করছি না।’ সালেহার আর লেখাপড়া হলো না। নষ্ট মানুষের কান কথায় আর দাদীর অকেজো ইচ্ছা পুরণের জন্য জন্য বলি হতে হলো সালেহাকে। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন সংসার ঘরের চারদেয়ালে এখন ঘুরপাক খাচ্ছে।

দৃশ্যপট- তিন

সখিনার বিয়ে হলো আজ প্রায় পাঁচ বছর হলো। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তার কোলজুড়ে নেই একটি সন্তান। গত চার বছর ধরে স্বামীর ঘরে ‘বন্ধ্যা মহিলা’-র বদনাম শুনতে শুনতে কান পচে গেছে তার। তবুও ছাড় নেই। মাঝে মাঝে স্বামী আরেকটা বিয়ে করার হুমকিও দেয়। আবার কখনো তালাক। কিন্তু কি আর করবে সখিনা। নীরবে সব অত্যাচার সহ্য করছে। একটি সন্তান হচ্ছে না বলে সব দোষ এখন সখিনার ঘাড়ে। এখন প্রশ্ন হলো চিকিৎসা শাস্ত্র বলে সন্তান না হওয়ার জন্য নারীর পাশাপাশি পুরুষরাও দায়ী হতে পারে। অথচ পুরুষের দোষটা একটি বারের জন্য কেউ খতিয়ে দেখে না।

দৃশ্যপট- চার

নাবিলা এইচ এস সি পাশ করেছে। প্রবাসী এক ছেলের সাথে তার বিয়ে হলো। দিন যাচ্ছেই ভালো। সুখের সংসার। এক বছর পর নাবিলার একটি পুত্র সন্তান হয়। ডাক্তারি পরীক্ষায় দেখা গেল সন্তানটির শরীরে এইচ আইভি ভাইরাস আছে। শুরু হলো নাবিলার উপর অত্যাচার। ‘তুই অসতী। কার সাথে তোর সর্ম্পক ছিলো আমাকে বল।’ স্বামীর এমন কথাবার্তায় শেষ পর্যন্ত সে সিদ্ধান্ত নেয় জীবন দিয়ে দিবে। কিন্তু এরই মধ্যে ডাক্তারী আরেক পরীক্ষায় দেখা গেলো মূল এইচ আইভি ভাইরাস আসলে তার স্বামীর দেহে। ঐটা জানার পর বর তার দোষ ঢাকার জন্য নাবিলাকে বলে, ‘তোমার সাথে থেকে থেকে আমার হয়েছে।’ তারপরও সব দোষ নাবিলার। চলছে অত্যাচার নির্যাতন।

দৃশ্যপট- পাঁচ

দেশে এমন কোন ঘর নেই যে ঘরের বৌকে একটিবারের জন্যও যৌতুকের কথা শুনতে হয়নি। হোক সেটা উচ্চ শিক্ষিত ঘর কিংবা মধ্যবিত্ত কোন পরিবার। ফারজানা বেশ লেখাপড়া করা মেয়ে। অর্নাস শেষ করে মাস্টার্স করছে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে। স্বামীও বেশ উচ্চ শিক্ষিত। তাই সে বিয়েতে নেয়নি কোন যৌতুক, নেই যৌতুকের প্রতি তাদের লোভ। তবুও ছেলের অনুপস্থিতে ছেলের পরিবারের যেকোন কারো কাছে শুনতে হয় যৌতুকের কথা। অথবা বাইরে থেকে কেউ দেখতে আসলেই বলে মেয়েকে বাপ-মা কি কি দিয়েছে? এভাবে শুরু হয় যৌতুকের আগ্রাসন। একজন নারী যতই শিক্ষিত হোক, তবুও তাকে এই প্রশ্নের সম্মূখীন হতে হয় এক সময়। এখন প্রশ্ন হল যে ব্যাধি আমাদের প্রতিটি রক্ত কোষে কোষে মিশে আছে, তা এত সহজে যাবে কি করে? যে শিক্ষক ক্লাশে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেন যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি। যৌতুক দেওয়া ও নেওয়া দন্ডনীয় অপরাধ। আবার সেই শিক্ষক বাসায় গিয়ে নিজের বৌয়ের গায়ে হাত উঠান শুধু যৌতুকের জন্য। তাহলে এই সমাজে পরিবর্তন আসবে কি করে?

আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। উপরে দৃশ্যপটগুলো মোটেও কাল্পনিক নয়। কারো না কারো জীবনের সাথে এর মিল রয়েছে। এমন ঘটনাগুলো আমাদের দেশের আনাচে কানাচে ঘটে আসছে। নারীর উপর সব অপবাদ চাপিয়ে দেওয়ার দিন শেষ করতে হবে। আমাদের সমাজের এমন নোংরা রূপের কারণে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে অনেক মেয়ের জীবন। সুতরাং নারীর উপর অপবাদ দেওয়ার আগে একটি বারের জন্য বিবেচনা করুন হয়তো অন্য ফল বের হবে।

সমাজের কড়িকাঠে বলি হচ্ছে নারী!

সনেট দেব

বিষয়: বিবিধ

১৫৯৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File