শহীদ রাহাত: আমাদের প্রেরণা- মাহমুদুর রহমান দিলাওয়ার ॥

লিখেছেন লিখেছেন ফুয়াদ আহমেদ ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০১:০৪:৩৭ রাত



২৫ ফেব্র“য়ারী। সকাল ১১ টা ৪০ মিনিটে আমার মোবাইলে একটি এসএমএস এলো। প্রিয় ভাই সুলতান আহমদ লিখেছেন, ‘আস্সালামু আলাইকুম। রাহাত ভাইয়ের শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি হয়েছে! দোয়া করুন। ফী আমানিল্লাহ।’

আমি তখন প্রতিষ্ঠানে পাঠদানে ব্যস্ত। বেলা ১টা ২ মিনিটে প্রিয় ভাই সুলতানের আরেকটি এসএমএস পেলাম। এসএমএস পড়ে আমি স্তম্ভিত! বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম!! দ্রুত ক্লাস রুম থেকে অফিসে ঢুকলাম। কিছুক্ষণ চেয়ারে বসে থাকলাম। একজন শিক্ষক কিছু জানতে চাইলেন, কথা বলতে পারলাম না। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রিয় ভাই তানভীর আহমদ রনি একই রকম এসএমএস পাঠালো। ১০/১৫ মিনিট পর মোবাইল হাতে নিলাম। শহীদ রাহাতের প্রিয় দায়িত্বশীল টিপু ভাইকে ফোন দিলাম। সালাম বিনিময় হলো। আর কোন কথাবার্তা হলো না, শুধু কান্নার আওয়াজ শুনলাম! শুধু এতোটুকু বললাম, আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবেন, রহম করবেন-ইনশাআল্লাহ। পরে শহীদের আরেক দায়িত্বশীল আব্দুর রাজ্জাক ভাইয়ের সাথে কথা বললাম। খোঁজ-খবর নেয়ার চেষ্টা করলাম।

জোহরের নামাজ আদায় করে মদীনা মার্কেটে আসলাম। সেখানে দেখা হলো শহীদের দায়িত্বশীল মনোয়ার ভাই, তার প্রিয় বন্ধু সানি সহ অনেক দ্বীনি ভাইদের সাথে। শহীদের একান্ত সাথীরা গলায় জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করলো। সবার চোখে পানি। সান্ত্বনার বাণী যেন আজ হারিয়ে গেছে! তাদের কিছু বলতেও পারলাম না। নীরবে নিভৃতে সবার আবেগ শুধু অবলোকন করলাম। কুরআন খতম হয়েছে, দোয়া মোনাজাত হলো।

শহীদের একান্ত সাথী হুমায়ুন ভাইকে নিয়ে আসরের নামাজ আদায় করলাম কায়েস্থরাইল জামে মসজিদে। যে মসজিদে আমার প্রিয় ভাই শহীদ রাহাত নিয়মিত নামাজ আদায় করতেন। কেননা মসজিদের পাশেই প্রিয় ভাইয়ের বাড়ি। নামাজের পর দেখা হলো শহীদের শ্রদ্ধেয় দায়িত্বশীল নুরুল ইসলাম বাবুল, নজরুল ইসলাম সহ তার একান্ত সহকর্মীদের সাথে। এর পর শহীদের বাড়িতে গেলাম। সন্ধ্যা ৭ টা পর্যন্ত অবস্থান করলাম।

সন্ধ্যা ৬ টা ২৬ মিনিটে বাড়িতে পা রাখলেন শহীদ আলী আজগর খান রাহাতের গর্বিত পিতা সুলেমান খান এবং গর্বিত মাতা নূরজাহান বেগম। তারা গতকাল তথা ২৪ ফেব্র“য়ারী যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রিয় সন্তানকে দেখার জন্য এসেছেন। তারা ঢাকায় পৌঁছে এ্যাপোলো হসপিটালে প্রিয় সন্তান রাহাতকে দেখতে যান। এরপর আজ সকালে রওয়ানা হন সিলেটে বাড়ির উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে তারা জানতেন না কিংবা তাদের জানানো হয়নি, তাদের প্রাণপ্রিয় সন্তান এই দুনিয়ার জীবন থেকে ইন্তেকাল করেছেন। বাড়িতে আসার পর পরই তারা অবহিত হলেন। তখন কী বেদনাময় দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়!

১৬ ফেব্র“য়ারী সকাল ১০ টা ৪৫ মিনিটে মীরবক্সটুলায় ইসলামী ছাত্রশিবিরের মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন মহানগর শিবির নেতা শহীদ রাহাত। মিছিলটি মীরবক্সটুলা হয়ে নয়াসড়ক পৌঁছার পথে পেছন থেকে মিছিলকারীদের হামলা করে পুলিশ। এক পর্যায়ে পুলিশের ছুঁড়া বুলেট এফোড় ওফোড় করে শহীদ রাহাতের বুক। বুকের বাম পাশ দিয়ে বুলেট প্রবেশ করে পিঠ দিয়ে বের হয়ে যায়! মাটিতে লুটিয়ে পড়েন মেধাবী ছাত্রনেতা আলী আজগর খান রাহাত। শহীদ রাহাতের সহযাত্রীরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। অভিজ্ঞ ডাক্তাররা তাকে দ্রুত ঢাকায় পাঠানোর পরামর্শ দেন। এরপর এয়ার এম্বুলেন্সে তাকে ঢাকায় পৌঁছানো হয়। শাহাদাতের পূর্ব পর্যন্ত তিনি ঢাকাস্থ এ্যাপোলো হসপিটালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছিলেন।

সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানার অন্তর্গত কায়েস্থরাইল এলাকায় শহীদ রাহাতের জন্ম। ৩ ভাই ও ৪ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। সবার স্নেহাস্পদ, সবার কলিজার টুকরো ও অতিপ্রিয়। তিনি মদন মোহন কলেজের একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি অনার্স ৪র্থ বর্ষের পরীক্ষা সম্পন্ন করে ফলপ্রার্থী ছিলেন।

ছোট বেলা থেকেই তিনি কথাবার্তা, আচার-ব্যবহারে মার্জিত চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। নামাজী ও পরহেজগার ছিলেন। এমনকি ১৬ ফেব্র“য়ারী যেদিন তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন, সেই দিনও তিনি নফল রোজা রেখেছিলেন। তার এক প্রবাসী নিকটাত্মীয় আবেগ জড়িত কন্ঠে আমাদের বললেন, ‘রাহাতকে কোন দিন নামাজ কাজা করতে দেখিনি। এমনকি সে নিয়মিত তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতো, নফল রোজা রাখতো।’

সকল প্রাণীকেই একদিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। এটা চিরন্তন সত্য নিয়ম। পৃথিবীর মায়া ছেড়ে সকল মানুষকেই একদিন পাড়ি জমাতে হবে পরকালীন ভূবনে। নাস্তিকদের এ বিশ্বাস না থাকলেও ঈমানদাররা তা দৃঢ়ভাবেই অনুভব করে ও বিশ্বাস করে। মৃত্যু মানুষকে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, দুনিয়ার মায়ামোহ, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য থেকে বঞ্চিত করে। মানুষ হারিয়ে যায় সুন্দর পৃথিবীর বসবাস থেকে। তবে মৃত্যু মানুষকে মানুষের হৃদয়ে আজীবন বাঁচিয়ে রাখতে পারে। সেই মৃত্যু সৌভাগ্যের; সেই মৃত্যু শাহাদাতের।

শহীদ রাহাত নিয়মিত কোরআন-হাদীস ও ইসলামী সাহিত্য পড়তেন। ইসলামের সকল বিধিবিধান মেনে চলার চেষ্টা করতেন। দৃঢ় ঈমানের অধিকারী প্রিয় এই ভাইটি ইসলাম ও মুসলমানদের নিয়ে কোন ষড়যন্ত্র বরদাশত করতে পারতেন না। তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ছিলেন। অত্যন্ত সাহসী ছিলেন। সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের জন্য তিনি দৃঢ়তার সাথে ভূমিকা পালন করতে কুন্ঠাবোধ করতেন না। তিনি সব সময় শাহাদাতের মৃত্যু কামনা করতেন। যার কিছু বাস্তব প্রমাণ ফেসবুকে পাওয়া যায়।

আহত হওয়ার আগের দিন অর্থাৎ ১৫ই ফেব্র“য়ারী তিনি স্ট্যাটাস লিখেছিলেন, ‘আজ সারা বাংলাদেশে শহীদ হওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে.. হে আল্লাহ! তোমার অতি নগণ্য একজন বান্দা হিসেবে আমায় তুমি কবুল কর..’। ১৩ ফেব্র“য়ারী লিখেন, ‘এসো এসো এসো বন্ধু-কোরআনের পথে করি সংগ্রাম, বাতিলের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলি, উড্ডীন করি আল্লাহর নাম...’। ১২ ফেব্র“য়ারী লিখেন, ‘আল্লাহ তুমি আমাকে দ্বীনের পথে শহীদ হওয়ার তৌফিক দাও.. আমীন।’ ১১ ফেব্র“য়ারী লিখেন, ‘একটাই কামনা, একটাই স্বপ্ন, একটাই চাওয়া, একটাই মুক্তির পথ-শহীদী মরণ’। ১০ ফেব্র“য়ারী লিখেছেন, ‘দিন এলো আবার রক্ত ঝরাবার, জীবন দিয়ে শহীদ হয়ে বিজয় নিশান উড়াবার।’ ৭ ফেব্র“য়ারীর স্ট্যাটাস-‘মরতেই হবে যখন শহীদী মরণ দিও আমারে’। ৬ ফেব্র“য়ারী লিখেন, ‘শাহাদাত আমার অতীব্র তৃষ্ণার পানি, পেছনে ফেরার কোন পথ আমি খোলা রাখিনি...ইয়া আল্লাহ! তুমি কবুল কর।’ ৩ ফেব্র“য়ারী লিখেছেন, ‘আল্লাহকে যারা বেসেছে ভালো, দুঃখ কি আর তাদের থাকতে পারে/ যারা লয়েছে মুখে কোরআনের বাণী, লয়েছে মুখে হাদীসের বাণী, হতাশা কী আর তাদের থাকতে পারে! সামনে বাড়ালো পা যারা আজ নতুন পৃথিবী গড়তে / জানাতো আছে তাদের সবার কতো যে হবে লড়তে...’।

হে আল্লাহ! আমার প্রিয় ভাই আলী আজগর খান রাহাতকে কবুল কর। সর্বোচ্চ মর্যাদা দাও। তার রেখে যাওয়া কাজ যেন আঞ্জাম দিতে পারি, সেই তৌফিক দাও। আমীন ॥







বিষয়: বিবিধ

৩৩৭৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File