ঘুরে এলাম 'দ্য হোয়াইট ল্যান্ড'

লিখেছেন লিখেছেন উমাইর চৌধুরী ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ০২:০৮:২৬ দুপুর

(ছবি আপলোডে সমস্যার কারনে আপাতত এই লিংকে যেয়ে ছবিসহ লেখাটা পড়তে পারেন, পরে সময় করে ছবিগুলো লাগিয়ে দিব এখানে ইনশাআল্লাহ)

নতুন সেমিস্টারের শুরু, বেশ ফুরফুরে মেজাজেই আছি বলা চলে। কদিন আগেই ইস্ফাহান সফর থেকে ফিরলাম। এক সপ্তাহ ক্লাসের পর আবার সফরের সুযোগ মিলল। বিশ্ববিদ্যালয় বিদেশী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আয়োজন করেছে পিকনিকের। খুব বেশী দূরে না, কাছেই। শিরায থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে সেপিদন। শিরায ফারস প্রদেশের রাজধানী আর সেপিদন হচ্ছে ফারস প্রদেশের আরেকটা কাউন্টি/জেলা। ফারসিতে সেপিদন মানে হচ্ছে 'দ্য হোয়াইট ল্যান্ড'। প্রতি বছর শীতে এ এলাকায় এত বেশী তুষারপাত হয় যে পুরো অঞ্চল সাদা ধবধবে হয়ে যায়। ইরানের দক্ষিণাঞ্চল তুলনামূলক গরম প্রকৃতির, শীতে তুষারপাতও সেভাবে দেখা যায়না। যেমন শিরাযে গত দুবছর আমি তুষারপাত দেখিনি অথচ শিরায থেকে মাত্র ৮০ কিলোমিটার দূরে এই সেপিদনে নিয়মিত ভারী তুষারপাত হয়। এ কারনে এখানে জগরোস পর্বতশ্রেণীর ঢালগুলোতে গড়ে উঠেছে ইরানের দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বিখ্যাত স্কি রিসোর্ট এবং শীতকালীন পিকনিক স্পটগুলো।

আমরা খুব ভোরেই রওনা দিলাম। ইরানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পিকিনিকে সাধারণত ছাত্র-ছাত্রী একসাথে যায়না কখনই। সে প্রথা অনুযায়ী ঠিক হল আমরা মানে ছাত্ররা বৃহস্পতিবার যাব আর ছাত্রীরা যাবে পরদিন শুক্রবার একই জায়গায়। ছাত্রীদের সাথে বিবাহিত ছাত্ররাও যাবে তাদের ফ্যামিলিসহ। আমরা সকাল সাড়ে নটার দিকে রওনা দিলাম। আমরা ছিলাম প্রায় ৫০ জন, বিভিন্ন দেশের। বাসেই সকালের নাস্তা কমপ্লিট হল। পনির,রুটি, কেক আর জুস।

১১ ই ফেব্রুয়ারী। পারসিয়ান ক্যালেন্ডারের তারিখ অনুযায়ী ২২ বাহমান। ইরানের ইসলামী বিপ্লব বার্ষিকী। মানুষ এদিন রাস্তায় নামে বিপুল পরিমানে। ইরানে কোন রাজনৈতিক মিছিল-মিটিং চোখে পড়েনা বছরের দুটো দিন ছাড়া। একটা এই ২২ বাহমান এবং আরেকটা রমজানের শেষ জুমুআ, কুদস দিবস। শহরের কেন্দ্রস্থলের বড় সড়কগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে র‌্যালির কারনে। আকাশে কিছুক্ষণ পর পরই হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছে। শহর থেকে বের হতে বেশ দেরী হয়ে গেল। কয়েক স্তরের নেরাপত্ত্বা বেষ্টনী শহরের প্রবেশপথগুলোতে। সেসব চেকপয়েন্টগুলোতে সতর্ক অবস্থায় দাড়িয়ে আছে পুলিশ,প্যারা মিলিটারী, মিলিশিয়া এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী বাসিজদের সদস্যরা। এদের বেশীরভাগই নিরস্ত্র অবস্থায় অথবা হালকা অস্ত্রে সজ্জ্বিত। সবশেষ মানে শহরে ঢোকার প্রথম পয়েন্টে চোখে পড়ল ইরানের এলিট ফোর্স 'সেপাহ'/ রেভ্যুলশনারী গার্ড বাহিনীর সদস্যদেরকে। একমাত্র এদেরকেই ভারী এবং উন্নতমানের অস্ত্রসহ দেখলাম। এদের চলাফেরা, পোষাক আশাকে আসলেই একটা এলিট এলিট ভাব। ইরানীদের ভাষায়, 'ইরানের সবকিছু যাদের হাতে তারা হচ্ছে এরা'।

সকালের ঝরঝরে রোদ। আশপাশের লোকালয় আর মানুষ-গাড়ির ভীড় আর চোখে পড়ছেনা, শুধূই ধূসর প্রান্তর আর দূরের পর্বত শ্রেণী। মানে আমারা ততক্ষণে শহর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। দুই লেনের অনওয়ে রাস্তায় বাস চলছে ১০০ কিলোমিটার/ঘন্টা গতিতে। শিরায থেকে সেপিদন ৮০ কিলোমিটার হলেও বাসে প্রায় ঘন্টা দুয়েকের রাস্তা। কারন ভয়ংকর পাহাড়ী রাস্তা পেরিয়ে উঠতে হয় সমূদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উপরে, ভাগ্য খারাপ হলে রাস্তাতেই দেখা মিলবে ভারী তুষারপাতের সাথে। কিছুক্ষণ পরই রোদ উধাও হয়ে গেল। ছোট্ট একটা পাহাড়ী গ্রাম্য এলাকা পার হতে না হতেই দেখলাম বাতাসে ছোট ছোট তুলা সদৃশ বস্তু উড়ে বেড়াচ্ছে। হ্যা, এর মানে আমরা সেপিদনে প্রবেশ করছি।

আর কিছুদূর যেতেই যা দেখলাম তা অবিশ্বাস্য। আশপাশের অবস্থা এবং আবহাওয়া ১৮০ ডিগ্রী টার্ন নিল যেন হঠাৎ। তাপমাত্রা শূন্যের নিচে। কোথায় রোদ আর কোথায় কি, এ যে শুধুই বরফ আর বরফ। যতদূর চোখ যায় সফেদ শুভ্র প্রান্তর। গাছ-পাহাড়-বাড়ি সবাই একরঙা হয়ে গেছে। সাদা লেপের নিচে ঢুকে পড়েছে সবকিছু যেন! আল্লাহর সৃষ্টি কতই না চমৎকার, আমাদের কল্পনাকেও হার মানায়!

রাস্তায় বেশ জ্যাম। ছুটির দিন হওয়ায় প্রচুর মানুষ আসছে। তাছাড়া ইরানের দক্ষিণের মানুষ তুষার দেখতে পায়না সাধারণত, তারা সবাই এই সেপিদানে ভীড় করে শীতকালীন এন্টারটেইমেন্টের জন্য। পিকনিক সিজন হবার কারনে বিপদজনক এ রুটে কিছুদূর পরপরই ইমার্জেন্সি পয়েন্ট, সেসব স্থানে পুলিশ আর এম্বুলেন্স দাড়িয়ে আছে। কোথাও কোথাও পুলিশের হাতে দূর থেকে স্পিড মাপার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং ক্যামেরা। স্পিড লিমিট ক্রস করা কিংবা গাড়ী চালানো অবস্থায় মোবাইল ব্যবহার করতে গেলে 'জরিমানার' কথা দশবার ভাবা লাগবে।

সেপিদান স্কি রিসোর্টে পোছুলাম আমরা দুপুর ১২ টার দিকে। বাস থেকে নামতেই মনে হল যে উত্তর/দক্ষিণ মেরুতে চলে এসেছি বোধহয়! আমাদেরকে মোট চারঘন্টা সময় দেয়া হল ঘুরে দেখার জন্য। স্কি রিসোর্ট হলেও স্কির আশেপাশে ভীড়া সম্ভব না। কারন এটার জন্য প্রশিক্ষণ থাকা লাগে, বিপদজনক খেলা। হাত-পা ভাংগার হার খুব বেশী। পিকনিকে আগত মানুষের মধ্যে অনেককে দেখলাম স্কির যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছে। বিশেষ করে স্কিতে মেয়েদের আগ্রহ চোখে পড়ার মত। টেলিকেবিনে করে বহূদূরে ওই উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছুতে হবে এবং সেখান থেকে স্কি করে নেমে আসতে হবে নিচে। স্কি দেখার জন্য কিছুটা উপরের দিকে যেতে হবে, পায়ে ফুটবল খেলাজনিত ইনজুরি নিয়ে সেদিকেও আর যাওয়া হলোনা। অগত্যা নিচের দিকেই বরফের মধ্যে হাটাহাটি আর ছবি তুলে কিছু সময় পার করলাম। হাটু ডুবা তুষার আর প্রচন্ড ঠান্ডা প্রথমে ভাল লাগলেও আধাঘন্টা যেতে না যেতেই মনে হল যে একটু গরম কোথাও যাওয়া দরকার। হাত আর পা জমে যাচ্ছে। হাতমোজা না আনার কারনে বরফ ছুড়াছুড়ির খেলা থেকেও বিরত থাকতে হল।

একটা ক্যাফেতে ঢুকলাম কজন মিলে। সবকিছুর দাম পর্বতের মতই। তবুও কি করার। এ ঠান্ডায় একটু কফি না হলে আর চলছেনা। কফি আর স্যুপের অর্ডার দিয়ে শুরু হল গল্প। সিরিয়া আর তাজিকিস্তানের বন্ধুদের প্রশ্ন বাংলাদেশ নিয়ে। ক্যাফেতে যা হয় আর কি। ভূগোল, মেডিসিন থেকে শুরু করে রিলিজিওন-পলিটিকস পর্যন্ত আলোচনার গন্ডি। বাহিরে তূষারপাতের মাত্রা বাড়ছেই, বাড়ছে ভারী-ঠান্ডা বাতাস।

যোহরের নামায শেষে ফিরলাম বাসের কাছে। পুরো রিসোর্ট ততক্ষণে ফাঁকা প্রায়। এভাবে তুষারপাত চলতে থাকলে রাস্তা চলাচলের অনুপোযোগী হয়ে যাবে সন্ধ্যার আগেই। এখানে দু একটা চড়া দামের হোটেল ছাড়া থাকার কোন জায়গা নাই। মানুষ সে ভয়েই দ্রুত রওনা দিয়ে দিচ্ছে। দুপুরের আয়োজন সিম্পল। টুনা মাছ, ভাত, রুটি আর কোল্ড ড্রিংকস। বাহিরে প্রচন্ড ঠান্ডার কারনে বাসের ভেতরেই খাওয়া-দাওয়া সারতে হল। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা রওনা দিলাম শিরাযের দিকে। বাসের ভেতরে হিটার চলছে। প্রচন্ড ঠান্ডার পর এ উষ্ণতা ঘুমের জন্য অনুকূল। ড্রাইভার একটা কমেডি মুভি ছেড়ে দিল। কেউ ঘুমুলো আর কেউ সিনেমা দেখায় যোগ দিল।

আসার যাত্রাটা বেশ কঠিন ছিল। কারন প্রচন্ড তুষারপাতের কারনে রাস্তায় বরফ জমে পিচ্ছিল হয়ে গেছে। আমরা বহু উঁচু থেকে নামছি নিচের দিকে। ফিজিক্সের আইন অনুযায়ী এখানে একটু এদিক ওদিক হলেই ভয়াবহ কিছু ঘটে যেতে পারে। রাস্তায় গাড়ির লম্বা লাইন। ঘন্টায় তাদের গতি ১৫/২০ কিলোমিটারের বেশী না। কেউ কেউ একটু কিছুদূর যেয়েই ব্রেক কষে দাড়িয়ে পড়ছে ভয়ে। দাড়িয়ে পড়ার পরও পিছলে চলে যাচ্ছে কিছুদূর। কিছু গাড়িকে দেখলাম চাকায় আলাদা ভাবে শেকল মুড়িয়ে দিয়েছে যাতে পিচ্ছিল রাস্তায় ঘর্ষণটা আরো ভালো হয়। সম্ভবত গাড়ির হিটিং সিস্টেম ভাল না হওয়ায় কিছু ফ্যামিলি গাড়ি রাস্তার পাশে পার্ক করে বাহিরে এসে কাঠ-খড়ি জ্বালিয়ে হাত-পা গরম করছিল। আল্লাহ আল্লাহ করছিলাম। সড়ক বিভাগের কিছু গাড়ি কিছুক্ষণ পর পরই বালু ছিটিয়ে দিচ্ছে এ মাথা থেকে ও মাথা। কিছু কিছু জায়গা এত উপরে যে কুয়াশার মত অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিল আশপাশ তখন, মনে হচ্ছিল মেঘের রাজ্যে ঢুকে পড়ছি। যাবার সময় যেটুকু রাস্তা আমরা আধাঘন্টায় পার হয়েছি আসার সময় সে রাস্তা পার হতে সময় লাগল প্রায় দুই ঘন্টা। মাগরিবের আজানের সময় আমরা অনেকটা সমতলে নেমে এলাম। বাসে গতি বাড়ল, তখন আমরা পার হচ্ছি সেপিদান কাউন্টির ক্যাপিটাল, মানে আরদেকান শহর। ছোট্ট শহরটা নিরব-নিস্তদ্ধ। সবাই বুঝি এই ঠান্ডায় জমে গেছে। তাছাড়া ছুটির দিন হওয়ায় সব বন্ধ। শুধু ফেরার রাস্তায় গাড়ি চোখে পড়ছে।

রাত আটটার বাজার কিছু আগে বহুদূরে দিগন্তের কাছে কিছু আলোক রেখা চোখে পড়ল। রাস্তার পাশে ডিসটেন্স মার্কারে দেখলাম শিরায তখনও ২৫ কিলোমিটার। শিরায আর তুষার একসাথে যায়না। শিরাযের দেখা মিলতেই তুষার মিলিয়ে গেল হাওয়ায়। এত সাদা, এত তুষার সব উবে গেল কোথায় যেন! শহরে প্রবেশ করার সময় দেখলাম এদিকে কিছুটা বৃষ্টি হয়েছে। পথ-ঘাট ভেজা। শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত আমাদের ডরমিটরী পর্যন্ত যেতে যেতে সে বৃষ্টিও নাই হয়ে গেল। একেবারে শুকনো পথ-ঘাট! আলহামদুলিল্লাহ আমরা ভালভাবেই আবার ফিরে এলাম ।

বিষয়: বিবিধ

২৭৭৬ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

359401
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ বিকাল ০৫:৫৩
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : চমৎকার লিখাটির জন্য অনেক ধন্যবাদ। এই এলাকার কথা প্রথম শুনলাম। ছবি গুলি আপলোড করা গেলে আরো ভাল হতো।
২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ রাত ০৯:৪৮
299045
উমাইর চৌধুরী লিখেছেন : https://www.facebook.com/umayir09/posts/1094182127269029 এই লিংকে গেলেই সব ছবিগুলো পেয়ে যাবেন, Happy আপনাকেও ধন্যবাদ ।
359438
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ রাত ১১:২৯
আবু জান্নাত লিখেছেন : ভ্রমন কাহিনী আমার খুব প্রিয়, যখন অনলাইনে কোন ভ্রমন কাহিনী পড়ি, সাখে সাথে গগল ম্যাপ থেকে ঠিক ঐ স্থান থেকে ঘুরে আসি। এবারও তাই করলাম। দারুন লাগলো আপনার ভ্রমন।

২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ রাত ০৯:৪৯
299046
উমাইর চৌধুরী লিখেছেন : ধন্যবাদ। Happy
ছবিগুলো দেখেছেনতো? না দেখে থাকলে এখুনি এ লিংকে চলে যান। https://www.facebook.com/umayir09/posts/1094182127269029
359455
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সকাল ০৫:২৪
আকবার১ লিখেছেন : চমৎকার লেখা। আমরা তো বরফের মধ্যে
আছি। ২৪ ঘন্টা হিট পাম্প চলছে। মার্চের
আগে বরফ থেকে মুক্তি পাচ্ছি না।
২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ রাত ০৯:৫০
299048
উমাইর চৌধুরী লিখেছেন : মাশাআল্লাহ! দেখেন জমে যেয়েননা আবার! ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য। Happy

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File