গল্পঃ “জীবন জীবনের জন্য-Life is For Life”
লিখেছেন লিখেছেন উমাইর চৌধুরী ১০ জুন, ২০১৪, ০৫:০০:০৬ বিকাল
দীর্ঘ ২ মাস পর এইচ এস সি পরীক্ষা শেষ হল। ছুটি কিভাবে কাটাবো বুঝতে পারছিলাম না। পরীক্ষার মধ্যে কত কিছু চিন্তা করতাম। এই করব সেই করব। আর পরীক্ষা শেষে দিনের বেশির ভাগ ঘুমিয়েই কাটাচ্ছি। ভাবলাম নানার বাড়ি বেড়াতে যাব। বাড়িতে মা আর ছোট বোন রিতু আছে । তাদের সাথে নানার বাড়ী গেলে মন্দ হয় না। কাজ নাই তাই হুমায়ন আহমেদের হিমু পড়ছিলাম । ভাবলাম হিমু হয়ে গেলে মন্দ হয়না। সারাদিন খালি পায়ে ঘুরব। কেউ কিছু বলার থাকবে না। কোন পড়াশুনা থাকবে না। একদিন বিকেল গেলাম মাঠে খেলতে। একটা ক্রিকেট ম্যাচ ছিল । আমরা সবাই ক্রিকেট খেলছিলাম। রবিউল বল করছিল, শাকিল উইকেট কীপার আর আমি ব্যাট করছি। আরো দশ বারো জন খেলছিল কিন্তু তাদের চিনতে পারছিনা। হঠাত দেখি আমাদের পাশের বাড়ির শামিম দৌড়ে আসছে। তাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। শামিম আমাদের সাথেই এবার পরীক্ষা দিল। খুব ভাল ছাত্র কিন্তু গরীব। তার বাবা ২ বছর আগেই মারা গেছে। খুবই ভদ্র ছেলে। রবিউল বল করা বাদ দিয়ে তার দিকে তাকাল । আমরাও খেলা থামালাম।
শামিম বলল, “আমার মা খুব অসুস্থ । আজকেই অপারেশন । তোমাদের কিছু হেল্প লাগবে।”
হেল্প কথা শুনেই টাকার কথা মনে হল। মনে হয় শামিম তার মায়ের জন্য অপারেশনের টাকা চাইবে। পকেটে হাত দিয়ে দেখি ১০০ টাকা। ভাবছি দিব কি দিব না এমন সময় শাকিল প্রশ্ন করল। “কিসের হেল্প?” শামিম বলল, ‘তোমাদের কারো রক্তের গ্রুপ কি AB+ পজেটিভ?’ । এই বলে সে আমাদের সবার দিকে তাকাল। এবার আমি দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লাম। কারণ আমার রক্তের গ্রুপ এবি পজেটিভ। এখন আমি যদি আমার রক্তের গ্রুপ বলে দিই তবে রক্ত দিতে যেতে হবে। আমার রক্ত দেয়ার কথা মনে পড়েই গা শিউরে উঠলো। ভাবলাম এবি পজেটিভ কম রক্তের গ্রুপ কারো না কারো থাকবে । তাই চুপ থাকলাম । খেলার মাঠে সবাই বলল তাদের রক্তের গ্রুপ ভিন্ন। শামিমের মুখটা নীল হয়ে গেল যেন। এই বুঝি কেদে ফেলবে কিন্তু কাদছে না লজ্জায়।
রবিউল আমাদের সবাইকে আমাদের বলল, ‘দেখ তোদের কারো রক্তের গ্রুপ মিললে এখুনি বল বা তোদের কোন আত্মীয় যদি থাকে ।’
শাকিল বলল “আমার বড় মামার রক্তের গ্রুপ মনে হয় এবি পজেটিভ। ”
আমি হাফ ছেড়ে বাচলাম। শামিম শাকিল কে নিয়ে চলে গেল তার মামার খোজে। শামিম কে দেখে কিছুটা মায়া লাগছিল । কিন্তু মায়া করে তো লাভ নেই। রক্ত দিতে গিয়ে আমার যদি কিছু হয় এই ভেবে চুপ রইলাম।
খেলা শেষ হয়ে গেল। রবিউল আর আমি গেলাম মাঠের ধারে খুব ক্লান্ত হয়ে গেছি। রুমাল দিয়ে ঘাম মুছছি এমন সময় রবিউল আমাকে প্রশ্ন করল, “তোর রক্তের গ্রুপ কিরে?” আমি এই প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। কিছুটা ইতস্তত বোধ করে বলে ফেললাম,
“এবি পজেটিভ” ।
রবিউল হতভম্ভ হয়ে বলল, “তাইলে তখন বললি না ক্যান যে তোর এবি পজেটিভ।”
আমি বললাম,
“ভয় করছিল”
“কিসের ভয়?”
“রক্ত দিলে যদি আমার কোন ক্ষতি হয়। আমি যদি ক্রিকেট খেলতে না পারি । তাছাড়া সামনে অ্যাডমিশন। রক্ত দিলে যদি ঠিকমত পড়াশুনা না করতে পারি?”
“ধুর , রক্ত দিলে এসব কিছু হয় না। তাছাড়া আমাদের এক ব্যাগ রক্ত দিলে যে রক্ত যায় তা এ সপ্তাহেই নতুন ভাবে তৈরি হয়ে যায়। তাছাড়া ১২০ দিন পর পর আমাদের শ্বেত রক্ত কণিকা নষ্ট হয়ে আবার নতুন ভাবে আপডেট রক্ত চলে আসে। তাই রক্ত দান করলে আমাদের শরীরের ক্ষতি তো হয় না বরং লাভ হয়।”
“তুই যে এতো লেকচার ঝারছিস নিজে কখনো রক্ত দিয়েছিস?”
“হ্যা। দুই বার। আবার লাগলে আবার দিব”
আমি রবিউলের কথা শুনে বেশ অবাক হলাম। এতটুকু বয়সে দুইবার রক্ত দিয়েছে তাও কিছু হয়নি!! আমি বললাম,
“রক্ত কত বছর থেকে দেওয়া যায়?”
“১৮ বছর থেকেই দেওয়া যায় । যদি শরীর স্বাস্থ্য ভাল থাকে তবে ১৭ বছর থেকেও দেওয়া যায়।”
যাই হোক আমি বাড়ি চলে আসলাম ।এতো চিন্তা করার কি আছে। শামিমের মাকে রক্ত দিয়ে আমার কি লাভ। ওরা কি আমাদের বিপদে রক্ত দিবে। এই সব ভেবে নিজের মনকে বোঝালাম। কোনদিন আমার আত্মীয় স্বজনদের কেউ বিপদে পড়লে তখন রক্ত দিব এই প্রতিজ্ঞা করলাম।
পরদিন সকালে উঠে মায়ের ডাক শুন্তে পেলাম। মায়ের কাছে যেয়ে বললাম, “কি হয়েছে মা?”
মা বলল, জানিস শামিমের মা মারা গেছে?
আমি হতভম্ভ হয়ে গেলাম। ইতস্তত হয়ে বললাম , “কিভাবে মারা গেছে?”
মা বলল, “গতকালকে শামিমের মায়ের অপারেশন ছিল। কিন্তু দুই ব্যাগ রক্ত লাগতো। এক ব্যাগ ম্যানেজ হলেও আরেক ব্যাগ রক্তের জন্য নাকি মারা গেছে!”
এ কথার শোনার পর আমার মাথা ঘুরতে লাগল। মনে হতে লাগল যেন আমি নিজেই শামিমের মাকে হত্যা করেছি। সকাল ১০টায় শামিমের মায়ের জানাজা। আমি গেলাম না। ছাদে বসে থাকলাম। শামিম, শাকিল, রবিউল এদের কাউকে আমার মুখ দেখাতে পারব না। নিজেকে এতো অপরাধী আগে মনে হয়নি। আমার এক ব্যাগ রক্ত পেলে হয়ত শামিমের মা বেচে যেত । পরদিন বাড়ি থেকে বের হলাম। রাস্তায় শাকিলের সাথে দেখা।
তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “কি খবর শাকিল, সেদিন তোর মামা রক্ত দেয়নি?” শাকিল বলল, “আসলে মামা সেদিন অসুস্থ ছিল বলে যায়নি ।”
শাকিলের মুখেও কিছুটা লাজুক ভাব করছিল। শামিমের মার জন্য কিছু না করতে পেরে তারও মন খারাপ ।
এরপর প্রায় ১ বছর কেটে গেল। শামিমের মায়ের কথা প্রায় ভেলেই গেছিলাম। শামিম পড়াশুনা ছেড়ে এখন একটা দোকানে কাজ করে। আমি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি এমন সময় দিনকাল ভালই চলছিল। ক্যাম্পাসে যায়। বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারি। মাঝে মাঝে রাত করে বাড়ি ফিরি। একদিন হঠাত আমার মায়ের কল ।আমি ক্যাম্পাসে ছিলাম। আমার মা কাদতে কাদতে বলল আমার বোন রিতু নাকি অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি আমার ফ্রেন্ডের বাইকটা নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে চলে গেলাম। দেখি আমার ছোট্ট বোনটার মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। দ্রুত অপারেশন করতে হবে আর ‘ও’ পজেটিভ রক্ত লাগবে । আমি আমার যত পরিচিত আছে সবার কাছে কল দিলাম কিন্তু কোথাও এই গ্রুপের রক্ত পেলাম না। আমি এলাকায় বাড়ি বাড়ি খোঁজ নিলাম । কিন্তু সবার রক্তের গ্রুপ ভিন্ন। নিজের রক্তের গ্রুপ ‘ও’ পজেটিভ হলে দরকার হলে দুই ব্যাগ দিয়ে দিব এমন মনে হচ্ছিল । শামিমের কথা মনে পড়ল। তার কেমন কষ্ট হয়েছিল তা কিছুটা হলেও অনুভব করতে পারছি। মনে হচ্ছে আমার অপরাধের সব শাস্তি আজ পাচ্ছি। রবিউলকে কল দিলাম । সে জানালো শামিমের রক্তের গ্রুপ নাকি ‘ও’ পজেটিভ । তাড়াতাড়ি শামিমের কাছে গেলাম। শামিমকে বলার সাথে সাথে সে রাজি। তাকে নিয়া হাসপাতালে গেলাম। সে রক্ত দিল। আমার বোনটা বেচে গেল। শামিমকে ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষা খুজে পেলাম না। শুধু তাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাদলাম। সে বলল,”আমি জানি বিপদের সময় রক্তের মূল্য কত। লাখ টাকা দিয়েও তখন রক্ত পাওয়া যায় না। আমি যে কষ্ট পেয়েছি আমি চাইনা আর কেউ তার প্রিয় মানুষকে হারিয়ে ততটা কষ্ট পাক।”
সেদিনকার সেই ঘটনা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। আমি প্রতিজ্ঞা নিলাম যতদিন আমার জীবন আছে মানুষের জন্য কিছু করে যাব। আমি রবিউল, শাকিল ও শামিমকে নিয়ে একটা মিটিং করলাম । আমি তাদের একটা প্রস্তাব দিলাম। আমি এলাকার যুবকদের নিয়ে একটা সংগঠন করব যা বিনামূল্য প্রয়োজনের সময় রক্ত দান করবে। সবাই আমাকে সমর্থন জানালো । রবিউলকে বললাম আমাদের এই রক্ত দান সংঘের নাম কি হবে?
সে প্রস্তাব দিল “জীবন জীবনের জন্য-Life is For Life” দিলে কেমন হয়?” আমরা সবাই
তাতে সম্মতি দিলাম। খুব সুন্দর নাম। আমাদের কাজ শুরু হয়ে গেল। আমাদের প্রথম কাজ আমাদের বন্ধুদের রক্তদানের গুরুত্ব সম্পর্কে বোঝানো। এজন্য আমরা নিজেরা এ সম্পর্কে পড়াশুনা করলাম। আমরা ঠিক করলাম আমরা ৪ জন প্রথমে নিজেদের ৫ জন করে বন্ধুকে আমাদের সংঘের সদস্য বানাবো ও তাদের রক্তদান সম্পর্কে ভুল ধারণা দূর করব। অনেকেই মনে করে রক্ত দান করা মানে যেন কিডনি দান করা। আসলে এরকম কিছুই না। কিডনি দান করলে তা আর সৃষ্টি হয় না। কিন্তু রক্ত এক সপ্তাহেই নতুনভাবে তৈরি হয়ে যায়। ৫ দিনের মধ্যে আমাদের ৪ জনের ৫ জন করে বন্ধু মিলে মোট ২৪ জন সদস্য হয়ে গেল। আমাদের সবার দায়িত্ব হলো কমপক্ষে ৫ জনের কাছে রক্তদানের গুরুত্ব বোঝানো ও আমাদের সংঘের সদস্য করা। এছাড়াও সবাই তাদের পরিবারের বাবা,মা,ভাই-বোন,মামা,চাচা সবার রক্তের গ্রুপ জেনে নিজের কাছে সংরক্ষণ করে রাখে। এভাবে একদিন একজন মধ্য বয়স্ক লোক আমাকে কল দিল ।
লোকটা বলল, “সিফাত বলেছেন?”
আমি বললাম, “জি আমিই সিফাত” ।
লোকটা বলল, আমার ১০ বছরের একটা মেয়ে আছে। মেয়েটার থ্যালোসেমিয়া রোগ আছে। প্রতি ২ মাস পর পর রক্ত দেয়া লাগে। তার ‘এবি’ পজেটিভ রক্ত লাগবে।কিন্তু কোথাও খুজে পাচ্ছি না। আপনাদের কাছে কি এই গ্রুপের কেউ আছে ?”
আমি বললাম, “হ্যা আমার রক্তের গ্রুপ এবি পজেটিভ। আমি নিজে রক্ত দিব।”
আমি দৌড়ে হাসপাতালে গেলাম। প্রথমবার রক্ত দান করলাম । এক অন্য রকম অনুভুতি। মেয়েটা ও তার বাবা কৃতজ্ঞার যে দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকাল তা আমি কোনদিন ভুলতে পারব। নিজের রক্ত দিয়ে আরেকজনের সাহায্য করার যে অনুভূতি তা বলে বোঝানো সম্ভব না। এরপর যখনই সুযোগ পেয়েছি তখনি রক্ত দান করেছি।
আমাদের “জীবন জীবনের জন্য” এর যাত্রা সামনে এগিয়ে চলল। এখন প্রায় ১০০০ জন সদস্য আছে । পজেটিভ নেগেটিভ সব রক্তের গ্রুপের সদস্যই আমাদের কাছে আছে। প্রতিদিন কিছু না কিছু মানুষ রক্তের খোঁজ নিতে আমাদের কাছে আসে। শামিমের মাকে কোন সাহায্য করতে পারি নি । তার মত হাজারো মায়ের দোয়া এখন আমাদের সাথে আছে। মানুষের জন্য কিছু করে যাওয়াতেই তো আমাদের জীবনের সার্থকতা।
--------------------------------------------------------------------------------
কাল্পনিক গল্প তবে অনেকের বাস্তবতার সাথে মিলে যেতে পারে। আসুন আমরা আর কিছু না দিয়ে হলেও মাঝে মাঝে রক্ত দিয়ে অপরের সাহায্য করি। আসুন আমরা রক্ত নিতে নয় বরং দিতে শিখি
গল্পের লেখক আমি না, আমার ভাগ্নে সিফাত আমির
মূল লেখাটা এখানে https://www.facebook.com/icsamir/posts/732734420124379
বিষয়: সাহিত্য
১২০৫ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধন্যবাদ।
জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষনীয় গল্পটি শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ।
খুবই ভালো লাগলো। অসাধারণ সুন্দর একটা মেসেজ দিয়েছেন। অনেক অনেক ধন্যবাদ।
অজান্তে গড়ে উঠে বন্ধুত্ব
তা হতে পারে অপ্রত্যাসিত কোন ব্যক্তির
সাথে , সময়ের প্রয়োজনে জীবনের
বাস্তবতায় আবার তার বিচ্ছেদ ও ঘটে ,
প্রয়োজনের তাকিদে অনেক
দূরে চলে গেলেও যেনো মুছে না ফেলি সৃতির
পাতা থেকে কেউ কাউকে ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন