ডাক্তার বাবা ও তার মেয়ের গল্প #সত্যিঘটনা
লিখেছেন লিখেছেন উমাইর চৌধুরী ১৬ এপ্রিল, ২০১৪, ০৮:১৮:১৯ রাত
'বাবা সামনে রবিবার আমার জন্মদিন, মনে আছে তো? এবার কিন্তু আমাকে আর মামনিকে নিয়ে পাহাড়ে ঘুরতে বেরুতে হবেই, কোন কথা শুনবনা !'
'হ্যা মা ঠিকাছে, তাই হবে। এবার ঐ দিনটা হসপিটালে যাবোনা, তোমাদের সাথেই মজা করে কাটাবো।'
তবুও অবিশ্বাসের চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে ফাতেমা, ভাবছে বাবা তো এত সহজে রাজী হবার পাত্র না। শিরাজ ইউনিভার্সিটি অফ মেডিকেল সাইন্সেস এর বিখ্যাত নিউরোসার্জন ডাক্তার আলী রেজার একমাত্র মেয়ে সে। সামনে রবিবার তার ছয় বছর বয়স পূর্ণ হবে। বুদ্ধি হবার পর থেকে যে কটা জন্মদিন সে পালন করেছে প্রতিটাতেই বাবা ছিল অনুপস্থিত।
গতবছর এই দিনে সব রেডী, বাবাও হসপিটাল রেখে চলে এসেছেন। ফু দিয়ে মোমবাতি নেভাতে যাবে এমন সময় বাবার জরুরী ফোন এল। বুশেহর থেকে এক রোগী এসেছে, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ। ডাক্তার রেজাকে জরুরীভাবে তলব করেছে সাদী হসপিটাল। সে অস্থাতেই মোবাইলে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেলেন তিনি। পরে মেয়েকে সরি বললেও ১ সপ্তাহ রাগ করে ছিল সে। তার কোনভাবেই বুঝে আসেনা একটা মানুষের কি এত কাজ থাকতে পারে যে মেয়ের জন্মদিনটাতেও সে বাড়িতে থাকতে পারেনা !
যাক এবার বাবা কথা দিলে ফাতেমা মনে মনে বেশ প্রশান্তি পেলো।
ডাক্তার রেজা সাধারণত খুব রাত করে বাড়ী ফেরেন। কয়েকটা হসপিটালে রোগী দেখতে হয় তার। আর শিরাজেই ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় বিখ্যাত হসপিটালগুলো, তাই রোগীর সংখ্যাও প্রচুর এখানে। প্রায়ই ব্রেইন স্ট্রোক-রক্তক্ষরণ এরকম জরুরী রোগী আসে। তখন কর্তব্যবোধ এবং মানবিক দাবীর কাছে ঘুম-আরাম হার মেনে যায়।
শনিবার একটু তাড়াতাড়িই রাত ১১ টার দিকে বাড়ি ফিরলেন তিনি। পরদিন মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে বের হতে হবে সকালেই, সারাদিন ঘুরে দুপুরের খাবার নিজেরাই কোন পাহাড়ে বা পার্কে রান্না করবেন । অনেক মজা হবে এবার, এই রসকষহীন জীবনের প্রভাব মেয়েটার উপরেও পড়ছে। যথেষ্ট সময় দেয়া হয়না তাকে, প্রায় দিন রাতটাতেই ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখটা দেখা হয় শুধু । প্রতিদিন দুপুরে হসপিটালে খাবার সময় একবার ফোন করেন তিনি ফাতেমাকে।
'মা খেয়েছো তো?'
'হ্যা বাবা খেয়েছি, কিন্তু তুমি?'
'আমিও খেয়েছি মা, আজ স্কুল গেছিলে? কেমন হলো ক্লাস'
'হ্যা, ভালই'।
এই হলো প্রতিদিনের গৎবাধা দুলাইন কথা বাবা-মেয়ের।
ইরানে শুক্রবার সরকারী ছুটি, কিন্তু তার ছুটি নাই। পুরো ফারস প্রোভিন্সে যতগুলো মেডিকেল ইউনিভার্সিটি আছে সেগুলোতে প্রায়ই তাকে সেমিনার আর কনফারেন্সে যেতে হয়্ সাধারণত এগুলো শুক্রবারেই পড়ে।
রবিবার ভোর ৫ টাই ঘুম খেকে উঠে গেলেন ডাক্তার আলী রেজা, নামাজ পড়ে গোসল করে রেডী হতে হতে দেখলেন মা-মেয়ে রেডী হয়ে তাকে তাগাদা দিচ্ছে বারবার।
সব জিনিশ একে একে গাড়িতে তুুললেন তিনজন মিলেই।
কাবাব বানানোর জন্য সাইজ করে কাটা মুরগীর মাংশ, কিছু চাউল, রুটি সাথে চুলা বানানোর জিনিশপাতিও নিয়ে নিলেন।
ডাক্তার রেজা নিজেই ড্রাইভ করছেন গাড়ী, ফাতেমা বসেছে সামনে বাবার পাশে আর তার মা পিছে। ফাতেমা এত আনন্দিত যে কিছুক্ষণ পরপরই বাবার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে আর বলছে, 'দুস্তেত দরাম বাবা, খেইলি দুস্তেত দরাম'/তোমকে খুব ভালবাসি বাবা, খুব । সর্বশেষ কবে সে এভাবে পিকনিকে বাবা-মা কে একসাথে পেয়েছে মনে পড়ছেনা তার।
সাড়ে সাতটা, সকালের শিরাজ মোটামুটি ব্যস্ত, সবাই নিজ নিজ কর্মস্থলের দিকে ছুটছেন। ডাক্তার আলী রেজা গাড়ি ছুটালেন শিরাজ থেকে ত্রিশ মিনিটের দূরত্বে অবিস্থিত পারস্য সাম্রাজ্যের একসময়ের গর্ব ফারসেপোলিসের দিকে। শিরাজের অদূরে মারভদাস্ত শহরের উপকণ্ঠে জায়গাটা। পিকনিক করার মতো সুন্দর বনও আছে খানিকটা পাশেই।
ফারসেপোলিসে পৌছে তিনজন মিলে ঘুরলেন প্রথমে পুরোটা। ইসলাম আসার পূর্বে বেশ কজন ইরানী বাদশাহর নওরোজকালীন রাজধানী ছিল এটা। গ্রীক বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের আক্রমনে বিধ্বস্ত হয় পারস্য। বিভিন্ন প্রাসাদ-শহরের মতো এই ফারসেপোলিশকেও গুড়িয়ে আগুন লাগিয়ে দেয় গ্রীকরা। তারই অবিশষ্ট পড়ে আছে এখন। তবে সরকারের সদিচ্ছা আর প্রচুর খরচের দরুণ আভ্যন্তরীন এবং আন্তর্জাতিক পর্যটকদের অন্যতম প্রিয় জায়গা হয়ে উঠে এটা। সব দেখা শেষে মেয়েকে নিয়ে পাহাড়ে উঠেলেন পারস্য সম্রাট দারিয়ুসের সমাধি দেখতে। নামার সময় ফাতেমা আর নামবেনা। পা ব্যাথার ছুতো দেখিয়ে বাবার কাধে চড়ে বসল সে।
রোদ তেতে উঠেছে, রান্না-বান্নার পালা এবার। সবকিছু গাড়ি থেকে নামিয়ে পাশের ছোট্ট কৃত্রিম বনটাতে ঢুকলেন সবাই। শুরু হলো আয়োজন।
কাবাব আগুনে দিতে যাবেন এমন সময় ফোন আসল ডাক্তার রেজার ফোনে।
খুব জরুরী, একজন অল্প বয়সী রোগী এসেছে পাশের ছোট শহর ইয়াসুজ থেকে। তাকে এখুনি শিরাজে ফিরেই অপারেশন থিয়েটারে ঢুকাতে হবে। জুনিয়র একজনের কাছে সংক্ষেপে সব শুনে দেখলেন বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম।
ডাক্তার রেজা পড়লেন দোটানায়। একদিকে একমাত্র ছোট্ট মেয়েকে দেয়া কথা আর অন্যদিকে মরণাপন্ন এক রোগী। কোনটা করবেন তিনি ।
ডাক্তার রেজা মেয়েকে আস্তে করে ডেকে নিলেন, মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন
'দেখো মা, এখন তোমাকে একটা কথা বলব। খুব মনযোগ দিয়ে শুনবে কিন্তু'।
'কি কথা বাবা?'
'আমাকে হসপিটাল থেকে ফোন করেছিল, এমন একজন রোগী এসেছে যে আমার মতই এক বাবা। যার তোমার মতই একটা মেয়ে আছে। খুব খারাপ অবস্থা তার। আমাকে জরুরীভাব যেতে হবে, হয়তো আল্লাহ চাইলে বেঁচেও যেতে পারেন।
আর আমি এটা ক্যানসেলও করে দিতে পারি, গেলাম না। তোমার সাথেই থাকলাম, মজা করলাম।
কোনটা করা উচিৎ হবে তুমিই বলো, তুমি যেটা বলবে সেটাই হবে' ।
বাবার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ফাতেমা ছোট্ট করে জবাব দিল,
'বাবা তুমি রোগীটার কাছে যাও।'
ডাক্তার রেজা রওনা দিলেন গাড়ী নিয়ে। মারভদাস্তেই রেখে গেলেন স্ত্রী-মেয়েকে। তাদেরকে ট্যাক্সি নিয়ে রওনা দিতে বললেন। কারণ সব কিছু গুছিয়ে গাড়িতে তুলে সবাই মিলে রওনা দেবার মতো সময় হাতে নাই। চল্লিশ মিনিট পরেই তাকে সাদী হসপিটালে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে যেতে হলো।
অপারেশন চলল দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টা। খুব জটিল অবস্থা, সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। সন্ধ্যায় আরেক জায়গায় রোগী দেখে বাড়ী ফিরলেন রাতে। যথারীতি মেয়ে ঘুমুচ্ছে।
পরদিন হসপিটাল থেকেই স্ত্রীকে ফোন দিয়ে বললেন মেয়েকে চেম্বারে নিয়ে আসতে। হঠাৎ এমন কি কারণ যে মেয়েসহ হসপিটালে যেতে হবে বুঝে উঠছিলেন না ডাক্তার রেজার স্ত্রী।
যা হোক মেয়েকে নিয়ে হসপিটালের গেটে ঢুকতে যাবেন এমন সময় হঠাৎ একজন বিশালদেহী মানুষ ফাতেমাকে একরকম ছিনিয়ে নিয়ে কোলে তুলে নিল। তাকে নিয়ে হসপিটালের গেটেই নাচানাচি শুরু করে দিল, চুমোই চুমোই ভরে দিচ্ছিল ছোট্ট খুকীর গাল। সে লোকের চোখে পানি, কিছুক্ষণ আনন্দ করতেই সে হু হু করে কাঁদতে লাগল। ফাতেমা এরকম অদ্ভূত অবস্থায় পড়ে ভয় পেয়ে নিজেও কান্না শুরু করলো।
হতবিহবল ফাতেমার মা কিছুই বুঝতে পাছিলেননা ঘটনা কি, কিছুক্ষণ পরে দেখলেন কিছুদূরেই ডাক্তার রেজা দাড়িয়ে মিটমিট করে হাসছে।
পরে ডাক্তার রেজা চেম্বারে বসে মা-মেয়ের কাছে ক্লিয়ার করলেন সব। ঘটনা হচ্ছে সেই রোগীর জ্ঞান ফিরেছে এবং সে আলহামদুলিল্লাহ সেরে উঠছে। জ্ঞান ফেরার পরই পুরো ঘটনাটা তিনি রোগীর ফ্যামিলিকে বলেছেন। বলেছেন ডাক্তারদের জীবন আর পরিবারের অল্প কিছু ঘটনা। সব শুনে আনন্দে রোগীর ভাই ডাক্তারকে দিয়ে তার মেয়েকে ডাকিয়ে আনে হসপিটালে। সে নাকি ফাতেমাকে দেখবেই। ফাতেমাকে পেয়ে মনে হলো সে আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। ব্যাচারা কেঁদে ফেলেছে আনন্দে, ছোট্ট একটা মেয়ের এত বুদ্ধি হতে পারে ! কিভাবে ফাতেমাকে খুশী করা যায় সে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছিল বারবার সে।
'তাহলে বলো তো মা, সেদিন আমি যদি তোমার সাথেই থেকে যেতাম তাহলে তুমি বেশী খুশী হতে নাকি চলে আসাতে যে একটা পুরো কান্নারত ফ্যামিলিকে খুশী করার তৌফিক আল্লাহ দিলেন সেটা বেশী আনন্দদায়ক তোমার কাছে?'
ছোট্ট মাথার ফাতেমার জবাব, 'চলে আসাটাই ভাল হয়েছিল বাবা, আমাদের মজার চেয়ে এই মজাটা অনেক দামী..অনেক..অনেক..আমি আর কখনো বলবনা কেন তুমি হসপিটালে দিন-রাত পড়ে থাকো। তোমাকে আর দোষ দিবনা কখনও বাবা, সত্যি বলছি... !'
ডাক্তার রেজা মুচকি হেসে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, 'কোরবনেত বেরাম আজিজাম'/ তোমার জন্য কুরবান হয়ে যাবো প্রিয় !
১৫ এপ্রিল '১৪, শিরাজ
বিষয়: Contest_father
৬৩৮৮১৪ বার পঠিত, ৪০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন