এরদোগানের বিস্ময়কর সাফল্য :মাসুম খলিলী
লিখেছেন লিখেছেন উমাইর চৌধুরী ০১ এপ্রিল, ২০১৪, ০২:১৯:৪৮ দুপুর
তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রজব তাইয়েব এরদোগান বহুল আলোচিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিস্ময়কর সাফল্য লাভ করেছেন। রাজধানী আঙ্কারা বৃহত্তম শহর ইস্তাম্বুলে ক্ষমতাসীন একেপির মেয়রপ্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। ২০০৯ সালের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যেখানে একেপি ৩৮.৯ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, সেখানে গত শনিবারের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ইসলামপন্থী দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) ৪৩.২ শতাংশ ভোট পেয়েছে। দলটি ৪৯টি শহর/প্রদেশের ৫৬০টি জেলায় জয়ী হয়েছে। অন্য দিকে প্রধান দুই বিরোধী দল কামালপন্থী কট্টর সেকুলারিস্ট রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি) ১৩টি শহর/প্রদেশের ১৬০টি জেলায় জয়লাভ করেছে। তৃতীয় বৃহত্তম দল ন্যাশনালিস্ট অ্যাকশন পার্টি (এমএইচপি) আটটি শহর/প্রদেশের ১০৬ জেলায় জয়ী হয়। কুর্দিদের রাজনৈতিক দল পিস অ্যান্ড ডেমোক্র্যাসি পার্টি (বিডিপি) ১০টি শহর/প্রদেশের ৬৪টি জেলায় জয়লাভ করে। বিরোধী দল সিএইচপি এবার স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিস্ময়কর ফলাফল করবে বলে ধারণা করা হলেও বাস্তবে তাদের ভোটসংখ্যা আগেরবারের ২৩.২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৬.২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আর এমএইচপির ভোট ১৬.১ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৭.৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। সে তুলনায় বিডিপির ভোটসংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। চূড়ান্ত হিসাবে কিছুটা তারতম্য হতে পারে। আর আসনপ্রাপ্তির হিসাবেও কিছুটা পরিবর্তন আছে। একেপি ৪৪.১৩, সিএইচপি ২৮.৯৮ ও এমএইচপি ১৫.৯৫ শতাংশ আসন পেয়েছে।
এবারের স্থানীয় সরকার নির্বাচন ছিল প্রধানমন্ত্রী এরদোগানের জন্য গণভোটের মতো। এ নির্বাচনে জয়ী হওয়া-না-হওয়ার সাথে এরদোগানের ক্ষমতায় থাকা প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত না থাকলেও তিনি নির্বাচনের আগে ঘোষণা দিয়েছিলেনÑ এবারের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে একেপি হেরে গেলে এরদোগান রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াবেন। এক বছরের বেশি ধরে এরদোগান তুরস্কের রাজনীতিতে অত্যন্ত কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ছিলেন। গেজি পার্কে তার সরকারের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়। পরে এই বিক্ষোভ তুরস্কের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। সর্বশেষ এরদোগান ও তার সরকারের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হয়। একপর্যায়ে তার মন্ত্রিসভার সিনিয়র তিন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত থাকার সরাসরি অভিযোগ ওঠে এবং তিন মন্ত্রীতনয় ও একেপি-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীসহ একই দিনে ৫৪ জনকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়। এতে তিন মন্ত্রী তাদের পদ থেকে সরে দাঁড়ান। দুর্নীতির এ অভিযোগ প্রধানমন্ত্রী এরদোগানের পরিবার পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে। প্রায় নিয়মিতভাবেই এরদোগানের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দুর্নীতি ও অন্য অভিযোগ নিয়ে রেকর্ড টুইটার, ইউটিউব ও ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যমে প্রকাশ হতে থাকে। শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমে এসব ফলাও করে প্রকাশ হয়। ইসলামিক স্কলার হিসেবে পরিচিত ফতেহ উল্লাহ গুলেনের হিজমত আন্দোলন সরাসরি এরদোগানবিরোধী তৎপরতায় যুক্ত হয়ে পড়ে। একসময় একেপির মিত্র হিসেবে পরিচিত গুলেন আন্দোলনের সদস্যরা সরকারের বিচার বিভাগ, পুলিশ ও গোয়েন্দা দফতরের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে অনুপ্রবেশের সুযোগ নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে এসব তৎপরতায় ইন্ধন দিচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠে। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী এরদোগান ও একেপি সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারবে কি নাÑ এ নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়।
এরদোগান এই পরিস্থিতি শক্ত হাতে মোকাবেলা করেন। তিনি উল্লেখ করেন, একটি চক্র ‘রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র’ সৃষ্টি করে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে হুমকির মধ্যে ঠেলে দিতে চায়। এর সাথে যুক্ত রয়েছে আমেরিকার পেনসিলভেনিয়ায় স্বেচ্ছায় নির্বাসনে থাকা ফতেহ উল্লাহ গুলেনের আন্দোলন। তারা সামাজিক গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের স্পর্শকাতর নানা বিষয়ে প্রচারণা চালিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে হুমকির মধ্যে ফেলতে চান। এ নিয়ে তুরস্কের রাজনীতিতে গত তিন মাস ব্যাপক উত্তাপ-উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সর্বশেষ তুর্কি সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট একটি বৈঠকে গোপন রেকর্ড ইউটিউবে প্রকাশ করে দেয়া হলে সরকার এ সামাজিক গণমাধ্যমটি তুরস্কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর আগে সরকারের কথিত বিভিন্ন দুর্নীতির রেকর্ড প্রকাশ করার কারণে টুইটারও নিষিদ্ধ করা হয়। এসব রেকর্ডের মধ্যে এরদোগানের কথিত সেক্স টেপও রয়েছে। এরদোগান ও একেপি এসব রেকর্ডকে কৃত্রিমভাবে তৈরি এবং ভুয়া বলে জনগণের কাছে তুলে ধরে তা বিশ্বাস না করার আহ্বান জানায়।
স্থানীয় সরকার পরিষদের নির্বাচনে একেপির ভোটসংখ্যা আগেরবারের চেয়ে ৪ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রমাণ হয় জনগণ এরদোগানের ওপর আস্থা রেখেছেন। এবারের স্থানীয় সরকার পরিষদের নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেছে তুরস্কের এশিয়া ও ইউরোপ উভয় অংশের ব্যাপক এলাকায় একে পার্টি জয়লাভ করেছে। আগেরবারের চেয়ে শুধু অধিক ভোট ক্ষমতাসীন দল পেয়েছে, তা-ই নয়; একই সাথে তাদের জয়ী হওয়ার আসনের সংখ্যাও বেড়েছে। নির্বাচনের কয়েক দিন আগ থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল একেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেতে যাচ্ছে। তবে তুরস্কের বৃহত্তম নগরী ইস্তাম্বুলে ও রাজধানী আঙ্কারায় একেপি প্রার্থীদের জয় নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছিল। এর মধ্যে ইস্তাম্বুল ছিল এরদোগানের নিজস্ব এলাকা। তিনি এখানকার মেয়র হিসেবে তার রাজনৈতিক জীবনের মূল অভিযাত্রা শুরু করেন। তিনি ও তার স্ত্রী এবারের স্থানীয় সরকার পরিষদের নির্বাচনে ইস্তাম্বুলেই তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন।
ইস্তাম্বুলের ৪৮ শতাংশের ভোট পেয়ে একেপি প্রার্থী কাদির টোপবাস মেয়র হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। অন্য দিকে রাজধানী আঙ্কারায় ইব্রাহিম মেলিহ গুককেক ৪৫ শতাংশ ভোট পেয়ে মেয়র পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। ইস্তাম্বুলে ভোটের প্রাথমিক ফলাফলে বিরোধী সিএইচপি প্রার্থী কিছুটা অগ্রগামী থাকলেও পরবর্তীপর্যায়ে একেপি প্রার্থীর ভোট বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিরোধী দলের জন্য সান্ত্বনা হলো তারা তৃতীয় বৃহত্তম নগরী ইজমিরে তাদের আসন ধরে রাখতে পেরেছে। এ শহরে তাদের প্রার্থী আজিজ কোকাউগলো ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে মেয়র পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। কামালপন্থীদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এ শহরে জয়লাভের জন্য ক্ষমতাসীন দল ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু তারা শহরটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সফল হয়নি। তুরস্কের এবারের স্থানীয় পরিষদ নির্বাচনে পাঁচ কোটি ২৭ লাখ ভোটারের চার কোটি ২৫ লাখের বেশি ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। এবারের রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে ভোটারদের মধ্যে আগ্রহ খানিকটা বেশি দেখা যায়।
স্থানীয় পরিষদ নির্বাচনের পরপরই প্রধানমন্ত্রী এরদোগান জয়লাভের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, যারা রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র তৈরি করার অপচেষ্টা চালিয়েছিল তাদের প্ররোচনাকে জনগণ বিশ্বাস করেনি। তুরস্কের প্রভাবশালী দৈনিক এবং একেপির বিরুদ্ধে বেশ আগ্রাসী ভূমিকা পালনকারী হুররিয়াত ডেইলি নিউজ তাদের মূল্যায়নে উল্লেখ করেছেÑ প্রধানমন্ত্রী এরদোগানের বিরুদ্ধে যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল তার ৫০ ভাগ যদি অন্য কোনো গণতান্ত্রিক দেশে উঠত তাহলে সেখানকার সরকার ভেঙে পড়ত। এরদোগান জনগণকে তাদের বিরুদ্ধে প্রচারণায় বিশ্বাস না করতে যে আহ্বান জানিয়েছিলেন, তাতে সাড়া দিয়েছে দেশের মানুষ। এ কারণে প্রধান কোনো শহরে একেপির বিপর্যয় ঘটেনি। বরং তাদের আসনসংখ্যা আগেরবারের চেয়ে বেড়েছে। এবারের নির্বাচনে বিরোধী দল সিএইচপি এবং দলের নেতা কেমাল কিলিকদারুগলু সর্বোচ্চপর্যায়ের প্রচারণা চালিয়েছেন। দলের প্রার্থীদের বিজয়ী করার জন্য তিনি জনপ্রিয় ও অপেক্ষাকৃত উদার ব্যক্তিদের বেছে নেন। প্রচারণার সময় তিনি বলেছেন, বিশ্বের সবচেয়ে নিকৃষ্ট এক ব্যক্তি এরদোগান তুরস্ক শাসন করছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, বিরোধী দলের এ প্রচারণা কোনো সাফল্য আনতে পারেনি। বরং সিএইচপি দেশের একটি অংশে ক্রমাগতভাবে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। দক্ষিণ-পূর্বের কুর্দিপ্রধান এলাকাগুলোতে তাদের প্রাপ্য ভোটের সংখ্যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ১ শতাংশের নিচে রয়েছে। অথচ ক্ষতাসীন একে পার্টি সারা দেশেই মোটামুটিভাবে ভোট পেয়েছে। যেসব আসনে তাদের প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন, সেখানেও একেপির ভোট একেবারে অনুল্লেখযোগ্য নয়।
প্রধানমন্ত্রী এরদোগানের জন্য গণভোট হিসেবে খ্যাত এবারের স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে তার দলের বিজয় তুরস্কের রাজনীতিতে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। আগামী আগস্টে দেশটিতে প্রথমবারের মতো প্রত্যক্ষ ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা। এ নির্বাচনে এরদোগান প্রার্থী হওয়ার কথা আগেই ঘোষণা করেছেন। তিনি এরই মধ্যে তিন দফা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছেন। সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী তিনি চতুর্থবার আর প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। অন্য দিকে একেপির অন্য প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুলের আরেক দফা প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বাধা রয়েছে। এবারের এরদোগানবিরোধী প্রচারণার একটি লক্ষ্য ছিল আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যাতে তিনি প্রার্থী হতে না পারেন। আর একেপির নেতৃত্ব এরদোগানের হাত থেকে অন্য নেতার হাতে চলে যায়। এ ক্ষেত্রে গুলেন আন্দোলনের একটি পরিকল্পনার বিষয় নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছে। এ পরিকল্পনায় একেপির নেতৃত্ব থেকে এরদোগানকে অবসর নিতে বাধ্য করে তার স্থলে আবদুল্লাহ গুলকে প্রতিস্থাপিত করার কথা বলা হয়। আবদুল্লাহ গুল এক মেয়াদ ক্ষমতা থাকার পর দলের নেতৃত্ব চলে যাবে আমেরিকায় প্রবাসে থাকা ফতেহ উল্লাহ গুলেনের হাতে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এরদোগানকে হত্যা করার একটি গোপন পরিকল্পনাও ফাঁস হয়েছে। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী এরদোগানকে অস্ত্রোপচারের একটি নির্দিষ্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হবে। সেখানে বিশেষ ধরনের ওষুধ প্রয়োগে তার মৃত্যু ঘটানো হবে। কিন্তু এর সব কিছু গোপন রাখা হবে। সেখানে অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসক হিসাবে বাছাই করা হয় গুলেন আন্দোলনের আস্থাভাজনদের। পুরো বিষয়টির সাথে তুরস্কের গোয়েন্দা বিভাগের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা যুক্ত ছিলেন। এর মধ্যে একজন শীর্ষ কর্মকর্তা এ পরিকল্পনা তুরস্কের জন্য ভয়ঙ্কর হতে পারে মনে করে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর গোচরে আনেন এবং তার অস্ত্রোপচারের জন্য ভিন্ন একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া। এতে মৃত্যু ঘটানোর একটি ভয়ঙ্কর চক্রান্ত থেকে তিনি রক্ষা পান। এ পরিকল্পনা পরে প্রকাশ হয়ে গেলে সেই গোয়েন্দা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বেশ কিছু গোপন রেকর্ড প্রকাশ করে দেয় গুলেন অনুসারীরা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কঠোর পদক্ষেপের কারণে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা গুলেনপন্থীরা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বেশি দূর এগোতে পারেনি। গুলেন আন্দোলনের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিতি টুডেজ জামান পত্রিকায় এরদোগানের প্রাণনাশের ষড়যন্ত্রের বিষয়টিকে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য একটি পরিকল্পিত চক্রান্ত বলে চিহ্নিত করা হয়। তবে স্থানীয় সরকার পরিষদ নির্বাচনের ফলাফলে মনে হয়েছে জনগণ এরদোগানকে নানামুখী ষড়যন্ত্রের শিকার হিসেবে বিশ্বাস করেছে। তার নেতৃত্বের বলিষ্ঠতাকে তারা স্বাগত জানিয়েছে। তারা আস্থা আনেনি কথিত দুর্নীতি কেলেঙ্কারির ওপর।
এবারের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে একে পার্টির জয়ের পর আগামী আগস্টে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে এরদোগানই যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, তা অনেকটা নিশ্চিত। এরপর ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সংসদ নির্বাচনের যে সূচি রয়েছে তাও এগিয়ে আনা হতে পারে। এরদোগান প্রেসিডেন্ট হলে সংসদ ও দলের নেতৃত্ব অন্য কারো হাতে চলে যাবে। এ ক্ষেত্রে আবদুল্লাহ গুল দলের নেতৃত্ব নিতে পারেন বলে একটি জল্পনা রয়েছে। কিন্তু গুলেন আন্দোলন ও সরকারের নানা নীতির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার মতের ব্যবধানের বিষয়টি অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। এ অবস্থায় একেপির নেতৃত্ব আবদুল্লাহ গুলের হাতে দেয়া হবে কি না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। আবদুল্লাহ গুলের বিকল্প হিসেবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেদ দেবগলু অথবা উপপ্রধানমন্ত্রী বুলেন্ট আরিঙ্ক আসতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিনি দলের মধ্যে বেশ প্রভাবশালী। তবে একেপির নতুন নেতা ও প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরো কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিজয়ের পর বিরোধী পক্ষ প্রেসিডেন্ট ও সংসদ নির্বাচনের জন্য তাদের কর্মপ্রক্রিয়া কী নির্ধারণ করেন তাও দেখার বিষয়। প্রধান বিরোধী দল সিএইচপির নেতা কামাল কিদারোগলু সংখ্যালঘু আলাবি সম্প্রদায়ভুক্ত। তিনি বিরোধী দলের নেতা হিসেবে উল্লেখযোগ্য কোনো কারিশমার পরিচয় দিতে পারেননি। এ অবস্থায় তিনি দলের নেতৃত্বে থেকে যাবেন কি না তাও এখন নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে শীর্ষ দুই বিরোধী দলের (সিএইচপি ও এমএইচপি) মধ্যে কোনো সমঝোতা যদি হয় তাহলে এরদোগানের পক্ষে একটি নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। যদিও এ দুই দলের আদর্শগত মতপার্থক্য এত ব্যাপক যে, তাদের মধ্যে কোনো ধরনের নির্বাচনী সমঝোতা এর আগে দেখা যায়নি। কুর্দিদের প্রধান দল বিডিএস এর বিরোধী দলের ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এরদোগান কুর্দি এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক সংস্কার পদক্ষেপ নিয়েছেন। কুর্দিরা এখন তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছেন। এ এলাকায় প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও কুর্দি ভাষা ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন পিকেকের সাথে সরকারের শান্তি আলোচনা বেশখানিকটা অগ্রসর হয়েছে। এ অবস্থায় একেপির পতন কুর্দিরা সমর্থন করবেন বলে মনে হয় না।
তুরস্কে এরদোগান ও একেপির টিকে যাওয়ার বিষয়টি আঞ্চলিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপরও প্রভাব ফেলবে। তুরস্ক ছিল আরব বসন্তের সমর্থনকারী অন্যতম প্রধান দেশ। মিসরে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মুরসির সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের ওপরে সর্বাত্মক দমনাভিযান চালানোর ব্যাপারে প্রকাশ্য বিরোধিতা করেছে তুরস্ক। এ অঞ্চলে মুসলিম ব্রাদারহুডের ব্যাপারে তুরস্ক, কাতার ও তিউনিসিয়ার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছে। অন্য দিকে মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম ব্রাদারহুডকে সর্বাত্মক দমন করার ব্যাপারে সক্রিয় সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আলজেরিয়াসহ কয়েকটি উপসাগরীয় দেশ। তুরস্কে এরদোগানের ব্যাপক জনসমর্থন এ ক্ষেত্রে একটা নতুন ভারসাম্য নিয়ে আসতে পারে। এরদোগান এরই মধ্যে ইরানের সাথে সম্পর্কে ভারসাম্য আনার উদ্যোগ নিয়েছে। ইসরাইলের সাথে ত্রাণবাহী জাহাজ ফটিলায় অভিযান চালানোকে কেন্দ্র যে তিক্ত সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, সেটিকে নমনীয় করার উদ্যোগ নিয়েছে আঙ্কারা। সৌদি আরবের সাথে সরাসরি কোনো তিক্ততায় জড়ানোর বিষয়টি তুরস্ক এড়িয়ে চলেছে।
সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে লড়াইরত বিদ্রোহীদের সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে এলেও তুরস্ক একটি রাজনৈতিক সমাধানের ব্যাপারে বরাবরই আগ্রহী প্রকাশ করেছে। এরদোগানের এ নীতি তুরস্কের জনগণের আস্থা অর্জন করেছে বলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতীয়মান হয়। সব কিছু মিলিয়ে তুরস্কের এবারের নির্বাচন এরদোগানের সামনে তার দেশকে আরো এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারে বড় ধরনের ম্যান্ডেট দিয়েছে। তবে এরদোগানের সামনে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। গত এক দশকে তিনি তুর্কি অর্থনীতিতে যে বিস্ময়কর জাগরণ ও অবকাঠামোর উন্নয়ন করেছিলেন, তার গতি এখন অনেকটাই স্থিমিত। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে টুইটার ও ফেসবুক বন্ধ করে দেয়া, ইন্টারনেট আইন, বিচার বিভাগের ওপর কর্তৃত্ব বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন পদক্ষেপে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এরদোগানের ব্যাপারে আমেরিকান নীতিনির্ধারকদের মধ্যে বিরক্তি ও সমালোচনা অনেক বেড়েছে। এসব কিছুর মোকাবেলা করে সামনে এগোতে হবে এরদোগানকে। এ পথে তার সাফল্যের সম্ভাবনা এবারের নির্বাচনের মাধ্যমে বেশখানিক বেড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতিতে সৌদি আরব ও ইরানের পাশাপাশি তুরস্কের একটি ভূমিকা আগামীতে আরো দৃশ্যমান হয়ে উঠতে পারে।
(নয়া দিগন্ত, ০১/০৪/২০১৪)
বিষয়: আন্তর্জাতিক
১১৫১ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন