"ডাকাত হলো ওলী"
লিখেছেন লিখেছেন এম এম নুর হোসাইন মিয়াজী ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০৩:৪০:৩৫ দুপুর
মুয়াজ্জিন মুসলিম উদ্দিন মাত্র ফজরের আজান দিয়ে মাইক বন্ধ করে পিছনে তাকাল। দেখে অচেনা এক মুসুল্লি হাজির। এত আগেভাগে সাধারনত কেউ আসেনা। আগন্তুক মসজিদের একটু ডান দিকে প্রথম কাতারে দাড়াচ্ছে। মাথায় পাগড়ী। মুখ ভর্তি লম্বা দাড়ী। গায়ে পরিপাটি জুব্বা। চেহারায় ঐশ্বরিক আলোকচ্ছটা ডিকরে পরছে। কিছুটা পরিচিত মনে হচ্ছে।
সময় মত ইমাম এলেন। জামাতের সাথে ফজরের সালাত সমাপ্ত হলো। সকল মুসুল্লি বের হয়ে গেলেও নবাগত মুসুল্লি বের হয়ে যায়নি। মসজিদের এক কোনে বসে প্রায় আধা ঘন্টা আল্লাহর জিকির করল। জিকির শেষে মুনাজাতে রবের সমীপে বিনীত ভাবে কান্নাকাটি করল। এরপর এলো বুড়ো মুয়াজ্জিন মুসলিম উদ্দিনের কাছে। "চাচা! ইশরাকের ওয়াক্ত হয়েছে "?
মুয়াজ্জিন তাকিয়ে আছে মুসিল্লির দিকে। তখনও অশ্রুভেজা গন্ডদেশ ষ্পষ্ট। মুসুল্লিকে চিনার চেষ্টা করছেন। হাতে ফুলের ঝাড়ু। যেহেতু আজ জুমুয়ার দিন। মসজিদ পরিষ্কার করতে হবে।
মুসলিম উদ্দিন মুয়াজ্জিন -কাম-খাদেম। চোখে কম দেখেন। নব মুসুল্লিকে চিনতে চেষ্টা করতে গিয়ে এশরাকের ওয়াক্ত হলো কিনা তা বলতে ভুলে গেলেন। হঠাৎ মুসুল্লি মুয়াজ্জিনের হাত থেকে ঝাড়ুটি নিয়ে বললঃ চাচা! আপনি বসেন! আজ আমি ঝাড়ু দিই। মুয়াজ্জিন বললেনঃ রাখেন! আগে আপনার পরিচয়টা জেনে নিই। বলতে বলতে মুয়াজ্জিন সাহেব মসজিদের ফ্লোরে বসে পরলেন। মুসুল্লিটিও বসল। এবার মুসুল্লি বললঃ মুয়াজ্জিন চাচা! আমি নূরা। নূরা ডাকাত।
নূরা ডাকাত নামটি শুনেই বুড়োর গা ছমছম করে উঠল। কারন, কয়েক বছর আগে নূরা ডাকাত আর লালচান ডাকাত ছিল এলাকার ত্রাস। চুরি, ডাকাতি, খুন এমন কোন অপরাধ নাই যা তারা করেনি। আজও লালচান জেলহাজতে। এদের অনেক অপকর্মের দৃশ্য ভেসে উঠল তার মনের পর্দায়। আজ সেই নূরা ডাকাত মসজিদে মুয়াজ্জিনের সম্মুখে। এরই মধ্যে নূরা ডাকাত বুড়ো মুয়াজ্জিনের পায়ে জড়িয়ে ধরে বললেনঃ হুজুর! আমি অনেক অপরাধের আসামী। আমার চেয়ে পাপী বোধহয় ছারে জাহানে নাই। আগে বুঝি নাই। ক্ষমতার দর্পে অন্ধ ছিলাম। এমন কোন অপরাধ নাই, যা আমি করি নাই। আমাকে মাওলায় মাফ করবে?
মুয়াজ্জিন সাহেব আচমকা অপ্রস্তুত ঘটনায় লজ্জায় সংকোচে পেছনে সরে গেলেন। জানতে চাইলেন, এ পরিবর্তন কিভাবে হলো?
নূরা বললঃ চাচা! তিন বছর পূর্বে এক রাতে যখন পুলিশ আক্রমন করল লালু (লালচান) আর আমার বাড়ীতে। লালু পালাতে পারেনি, গ্রেপ্তার হলো। আমি অল্পের জন্য গ্রেপ্তার হইনি, পালাতে সক্ষম হই। আমি চলে গেলাম খুলনায়। আপনার মত এক মুরুব্বীর বাড়ীতে মিথ্যা বানোয়াট অভিনয় করে অসহায়ত্ব প্রকাশ করলাম। সে মুরুব্বি খুব বুযুর্গ, সরল এবং দয়ালু। আমাকে আশ্রয় দিলেন। আমার যাওয়ার দু'একদিন পরেই মুরুব্বী যাবেন চরমোনাই মাহফিলে। আমাকেও দাওয়াত দিলেন। আমি ভাড়া টাকা নাই এ অজুহাত দিলাম। চাচা বললেন, বাবা! তোমার সব খরচ আমি দেব। আমি ইতস্থ করতে লাগলাম। কারন, একদিকে নিজের টাকা-পয়সা নাই, চাচার টাকা খরচ করাব? অন্যদিকে পীর-মুরীদী, নামায, রোযা ইত্যাদি আমার ভাল লাগেনা। কিন্তু চাচার কথা অমান্য করার হিম্মত হলোনা। রাজী হয়ে আরো অনেকের সাথে আমি আর চাচায় গিয়ে পৌঁছলাম চরমোনাই। যখন পৌঁছলাম তখন ছিল ফজরের ওয়াক্ত। গিয়েই শুনি আজান। এমন আজান আমার জীবনে শুনিনি। আজানের ধনীতেই আমি কাবু। শরীরের পশম দাড়িয়ে গেল। পা কেঁপে উঠল। বুকে শরু হলো ধরফড়ানী। চোখ ফেটে বেরিয়ে এলো কান্না। এরপর শুরু হলো আল্লাহর জিকির। অতঃপর কান্না চোখে সবার সাথে বহু বছর পর ফজরের সুন্নাত পড়লাম। হঠাৎ চাচা বললেনঃ "নূর মোহাম্মাদ! পীর সাহেব হুজুরকে দেখবে? ঐ যে হুজুরে ষ্টেজের দিকে যাচ্ছেন ফজর নামাজ পড়াতে"। আমি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি হযরত পীর সাহেব হুজুরকে। মন চেয়েছিল ছুটে যাই তাঁর কদম তলায়। বলি আমি মাওলার এক অপরাধী গোলাম। আমাকে একটু দুয়া করুন! না, যাইনি ধৈর্য ধরে বসেই রইলাম। কিন্তু চোখের পানি থামেন। যেন আগের চেয়ে গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। পীর সাহেব হুজুরের পেছনে ফজর সালাত আদায় করলাম। এত মিষ্টি মধুর ক্বুরআন আর কোনদিন শুনিনি। এরপর খুনখুনে এক বুড়া হুজুর সুরা হাশরের আখেরি তিন আয়াত তিলাওয়াত করলেন। সবাই এই হুজুরকে বললেন, "উজানীর হুজুর"। এ তিলাওয়াত যেন আরো মজা। এক ব্যক্তি একটি গজল গাইল "কত যত্নের পাখি তুমি কাজল বরণ টিয়া, সময় হলে যাইবা চলে এই দুনিয়ার সব থুইয়া"। এরপর বয়ান শুরু করলেন হযরত পীর সাহেব হুজুর নিজে। মনে হলো অপারেশন। আমার শরীরে ম্যালেরিয়া জ্বর, টিউমার, ক্যান্সার, ফোড়া হয়েছিল। আস্তে আস্তে অপারেশন হচ্ছিল। আজান, জিকির, তিলাওয়াত, গজল, বয়ান। বয়ানের অপারেশন ছিল এমন, নিজের জীবনের অপরাধের কথা স্মরণ করে মন চেয়েছিল নিজেই পুলিশের হাতে ধরা দিয়ে সাজা ভোগ করি। কখনো নিজের জুতা নিজের গালে মেরেছি। নিজেকে নিজে চড়-থাপ্পর দিয়েছি কত, তার ইয়ত্তা নেই। যাই হোক সেখান থেকে খাছ ত্বওবা করে টুপী, পাগড়ী, জুব্বা ব্যবহার শুরু করি। দাড়ী আর কাটিনি। নামায ছাড়িনি। দু'বেলা মাওলার জিকির করি। এ কথা বলে নূর মোহাম্মাদ আবার মুয়াজ্জিনের পা জড়িয়ে ধরে বলল, চাচা! আমাকে মাওলায় মাফ করবে? মুয়াজ্জিন সাহেব নূর মোহাম্মাদকে দু'হাতে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন আর বললেনঃ বাবা! আমিও সেই চরমোনাইর মুরীদ। বাবা! ভয় পেওনা! নৈরাশ হয়োনা। মাওলা রহমান, রহীম! আশা করি অবশ্যই মাফ করে দিবেন।
'তো বাবা! আপনাকে আবার পুলিশে ধরবেনা'?- মুয়াজ্জিন সাহেব বললেন। নূর মোহাম্মাদ বললেনঃ না, চাচা! সব মামলাই খারিজ হয়েছে। একটি বাকী আছে। তাও জামিন নিয়ে নিয়েছি। সমস্যা নাই। গতকাল লালমিয়ার জামিনের ব্যবস্থাও করেছি। সে বাড়ীতে এসেছে। নিয়্যাত আছে, ওরেও চরমোনাই নিয়ে যাব।
মুয়াজ্জিন সাহেব খুশী হলেন। দুয়া করলেন। দুয়া চাইলেন।
আমার প্রিয় বন্ধুরা!
দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধান মন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি, চেয়ারম্যান, মেম্বার, কোন পুলিশ, আইন, আদালত, জেলহাজত, সাজা কেউই একটা চোর, ডাকাত, খুনী, মদখোর, এমন কঠিন অপরাধীকে ভাল করতে পেরেছে আমার জানা নাই। বরং এ রকম অপরাধী বা তার চেয়েও কঠিন পাপীও আল্লাহ ওয়ালাদের সংস্পর্শে গিয়ে ভাল হয়ে গিয়েছে। এর অসংখ্য প্রমাণ অতীতেও ছিল, বর্তমানেও আছে।
'হেদায়েত' কোন পীর বুযুর্গের হাতে নেই। এমনকি হযরত নবী করীম সা. এঁর হাতেও হেদায়েত নেই। হেদায়েত দান করার মালিক এক মাত্র আল্লাহ তায়ালা। তবে আল্লাহ ওয়ালাদের সোহবাত, দ্বীনী নসীহত, আল্লাহর জিকির এগুলো হেদায়েতের উসীলা বা মাধ্যম।
আল্লাহ বলেন اتبع سبيل من اناب الي 'তার পথে চল, যে আমার লোক'!
তাই আসুন! হক্কানী আল্লাহ ওয়ালাদের সোহবাত এখতিয়ার করি।
বিষয়: বিবিধ
১৭৪৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন