আর কত দেবো, কত দিতে হবে?

লিখেছেন লিখেছেন এম এম নুর হোসাইন মিয়াজী ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৪:১২:৫৫ বিকাল

বেশ কয়েকদিন আগে প্রথম আলো’ ঘারানার লেখিকা নাজিয়া জাবীন, নারী-মঞ্চে তার একটি লেখা দেখেছিলাম এবং ভুলে গিয়েছিলাম। হয়ত কখনো আর মনে পড়তো না, যদি ড. মশিউর এমন স্মরণীয়, বরং অবিস্মরণীয় মন্তব্যটি না করতেন।

আবার আমাদের প্রধানমন্ত্রীর অর্থ-উপদেষ্টা ড. মশিউর-রহমান জ্ঞানী এবং অবশ্যই গুণী মানুষ, তিনি বলেছেন, সভ্য জাতি হিসাবে ভারতের কাছ থেকে ট্রানজিট-ট্রানশিপমেন্ট ফি নেয়া উচিত নয়। নিলে আমরা অসভ্য প্রমাণিত হবো।’ তার বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। সভ্য হওয়ার জন্য সবকিছু মুফতে বিলিয়ে দিতে হবে, এ সরল যুক্তিটি বিশিষ্ট-সাধারণ কারোই বোধগম্য হচ্ছে না।

কোন বক্তব্য আমার অপছন্দ হতে পারে, তবে আমি বিশ্বাস করি, যে কেউ যে কোন যুক্তিসঙ্গত মত পেশ করতে পারেন, সেটা তার গণতান্ত্রিক অধিকার। আবার যে কেউ যুক্তিসঙ্গতভাবে যে কোন বক্তব্য-মন্তব্যের প্রতিবাদও করতে পারেন। সেটাও তার গণতান্ত্রিক অধিকার। আশা করি ড. মশিউর-রহমান, যা বলেছেন বুঝে শুনে সুচিন্তিতভাবেই বলেছেন, তিনি যে পদ ও পদবি ধারণ করছেন, অন্তত তা এটাই দাবী করে।

আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব বিচলিত বোধ করেছি পত্রিকার পাতায় অর্থ-উপদেষ্টার মন্তব্যটি পড়ে। আর তাতেই মনে পড়ে গেলো ‘প্রথম আলো’র নারী-মঞ্চে প্রকাশিত নাজিয়া জাবীনের ভুলে যাওয়া লেখাটি। তিনি বেড়াতে গিয়েছিলেন ভারতে ত্রিপুরায় জম্পুই হিলে। ত্রিপুরা ভ্রমণ করে তার মনে হয়েছে, ‘আজও ত্রিপুরাবাসী আমাদের যুদ্ধকে স্মরণ করে, আমরাই স্মরণ করি না তাদের কথা যারা প্রতিবেশীর বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছিলো, আশ্রয় দিয়েছিলো, অস্ত্র-বস্ত্র-খাদ্য দিয়ে সাহায্য করেছিলো।’

জম্পুই হিলের সরকারী গেস্টহাউসে তিনি দেখা পেলেন সেখানকার সেবক পাহাড়ী অঞ্চলের বাসিন্দা রাংখুমা-এর। মধ্যবয়সী সুঠামদেহী রাংখুমা অবাক হয়ে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করলো, ‘আম্মা, আপনারা কি বাংলাদেশ থেকে আইছেন?’

আমার অবশ্য জানবার কথা নয়, রাংখুমা কি এভাবেই প্রশ্ন করেছিলো, না তার প্রশ্নের ভাষা ছিলো, ‘আম্মা আপনারা কি বাংলাদেশী?’, আর নাজিয়া জাবীন সেটাকে নিজের মত করে তরজমা করে নিয়েছেন? ঘটনা যাই হোক, বাংলাদেশী নারীকে কাছে পেয়ে রংখুমা আবেগাপস্নুত হয়ে বললো, ‘মাইজী, আমি মুক্তিযোদ্ধা। ৭১ সালে আমি যুদ্ধ করছি আপনার দ্যাশের লাগি।’

রাংখুমা মুক্তিযুদ্ধের অনেক গল্প করে, শেষে দুঃখ প্রকাশ করে বললো, বাংলাদেশের কেউ তার কোন খবর নেয়নি।

নাজিয়া জাবীন উঠে দাঁড়িয়ে তাকে শ্রদ্ধা জানালেন, আর সারা রাত জেগে রাংখুমার জন্য একটি কবিতা লিখলেন। ভোরে রাংখুমাকে সেই কবিতাটি উপহার দিয়ে অকৃতজ্ঞ জাতির পক্ষ হতে ঋণপরিশোধের কিছুটা চেষ্টা করলেন। নাজিয়া জাবীনের শেষ মন্তব্য, ‘যারা আমাদের জন্য এত করলো, তাদের জন্য আমরা কী করলাম?’

আমরা কী করিনি মিসেস নাজিয়া জাবীন? আমরা বেরুবাড়ী দিলাম এবং অঙ্গপোতা ও দহগ্রাম ফেরত প্রদানের ওয়াদাখেলাফি ভুলে গেলাম। নিজেদের নদী-বন্দর শুকিয়ে আমরা তাদের পানি দিলাম, এমনকি চুক্তিমত প্রাপ্য পানি না-পাওয়ার কষ্টও মেনে নিলাম। কাঁটাতারের উপর ফালানির ঝুলন্ত লাশ! তাও বন্ধুত্বের ‘দাম’ মনে করে শুধু অশ্রুপাত করলাম। ট্রানজিট-ট্রানশিপমেন্ট দিলাম। কথা ছিলো, কোটি কোটি ডলার ফি পাবো, গরীব দেশটা সিঙ্গাপুর হবে! সভ্য হওয়ার আশায় সে আশাও ত্যাগ করলাম। তবু কি বন্ধুর ‘অনুগ্রহ’-এর ঋণ শোধ হলো না? ত্রিপুরার মুক্তিযোদ্ধা রাংখুমা-এর জন্য নাজিয়া জাবীন কবিতা লিখেছেন, আমাদের অর্থ-উপদেষ্টার জন্য তিনি অন্তত একটি ছড়া লিখতে পারেন।

বিষয়: বিবিধ

১৩৪৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File