সমুদ্রগর্ভ থেকে জন্ম নেয়া এক প্রাচীন ভূ-খন্ডের নাম কাপাসিয়া
লিখেছেন লিখেছেন নেওয়াজ ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০২:০৯:৩৫ দুপুর
একটি দৈনিক থেকে সংগৃহীত লেখাটি খুব ভাল লাগল তাই শেয়ার করলাম আপনাদের জন্য
বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন ভূ-খন্ডগুলোর অন্তর্ভুক্ত কাপাসিয়ার সমগ্র অঞ্চল। কাপাসিয়ার শীতলক্ষ্যা নদী উঁচু-নীচু, লাল-বেলে মাটির উপর দিয়ে অতিক্রম করে ভাটির দিকে মেঘনা নদীর তীর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে। পন্ডিত-গবেষকদের ধারণা যে, দশ লক্ষ বছর পূর্বে বাংলাদেশের প্রাচীনতম ভূ-খন্ড হিসেবে কাপাসিয়ার ভীত রচিত হয়েছিল। পাঁচ লক্ষ বছর আগে প্রথম বরফ যুগে সমুদ্রের গর্ভ থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল এ অঞ্চলটি। বরফ যুগে সমুদ্রের পানি বরফ হয়ে আকাশে ওঠে যায় এবং বিশাল সামুদ্রিক হ্রদগুলো শুকিয়ে যায়। পন্ডিতদের ধারণা যে, সে সময় সমুদ্রের পানি অত্যন্ত নীচে নেমে গিয়েছিল। বৈজ্ঞানিকদের অভিমত, এ বরফ যুগটির স্থায়ীত্বকাল ছিল ৮০ হাজার বছর। তারপর শুরু হয় বরফগলা লাল পানির প্রবাহ। এ বরফ তিনটি বরফ গলা যুগের লাল পানির প্রবাহে সৃষ্ট মাটির স্তরগুলিও লাল হয়ে যায়। এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে এ প্রাচীন ভূ-খন্ডটি গভীর অরণ্য ও বনভূমিতে পরিণত হয়।
দীর্ঘ সময়ের মধ্যে অসংখ্যবার এসব বনভূমির বিবর্তনও ঘটেছে। ভূ-তাত্বিক স্তর বিন্যাসে জটিলতার দরুন এ অঞ্চলে ভূমির বিপর্যয় ঘটে। যার ফলে বনভূমির বিভিন্ন অংশ মাটির নীচে চাপা পড়ে যায়। চাপা পড়া বনভূমি হাজার হাজার বছরের ব্যবধানে পরিণত হয় কয়লায়। বিভিন্ন স্থানে পুকুর কিংবা কূপ খননকালে আজও এ অঞ্চলে কয়লার সন্ধান পাওয়া যায়।
কাপাসিয়া উপজেলার সাহার বিদ্যাকোট (দরদরিয়া) গ্রামের পশ্চিম অংশে ভাঙ্গন কবলিত শীতলক্ষ্যা নদীপাড়ে লাল মাটির ১০/১২ হাত নীচে কয়লায় পরিণত একটি বড় আকারের বৃক্ষ আবিষ্কৃত হয়। ১৯৭৮ সালে ঢাকা যাদুঘরের মহাপরিচালক ডঃ এনামুল হক ও প্রত্ন অনুসন্ধানী শফিকুল আসগর কয়লায় পরিণত হওয়া বৃক্ষটি দেখতে আসেন এবং বৃক্ষটির কিছু অংশ উদ্ধার করেন। এ ব্যাপারে ডঃ এনামুল হক অভিমত প্রকাশ করেন যে, লক্ষাধিক বছর ধরে মাটির নীচে চাপা পড়ে থাকায় বৃক্ষটি কয়লাকাষ্ঠে পরিণত হয়েছে।
দূর্গাপুর ইউনিয়নের রাণীগঞ্জ-তারাগঞ্জ এলাকায় শীতলক্ষ্যা ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গম স্থলে গড়ে উঠেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের অপরূপ লীলাভূমি বিশাল ধাঁধাঁরচর। ধারণা করা হচ্ছে শত শত বছর পূর্বে ঝড়-জলোচ্ছাস, ভূমিকম্প ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বড় বড় গাছপালা ভেঙ্গে নদীতে আছড়ে পড়ে এবং নৌকা-জাহাজ ডুবে শীতলক্ষ্যা-ব্রহ্মপুত্রের মিলনস্থলে এসে কিছু অংশ আটকে যায়। এভাবে আটকে পড়া গাছপালা নৌকা ও জাহাজের স্থানে বালি জমে জমে কালক্রমে চরের সৃষ্টি হয়। গত কয়েক বছর পূর্বে ধাঁধাঁর চরের উত্তর থেকে ড্রেজারের সাহায্যে বালি উত্তোলনের সময় পাইপের ভেতর দিয়ে বালি-পানির সাথে বড় বড় কয়লার টুকরো আসতে দেখা যায়। এলাকার লোকজন এসব কয়লা নিয়ে রান্নাবান্না করে এবং জ্বালানীর প্রয়োজন মিটায়। ধারণা করা হচ্ছে, ব্রহ্মপুত্র নদ ও শীতলক্ষ্যা নদীর মোহনায় আটকেপড়া বড় বড় গাছ চরের নীচে চাপা পড়ে কালক্রমে কয়লায় পরিণত হয়। দরদরিয়ায় মাটির নীচে সন্ধান পাওয়া কাঠ কয়লার সাথে ধাঁধাঁর চর সংলগ্ন দুই নদীর মোহনায় পাওয়া কাঠ কয়লার গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
২০০৪ সালে কাপাসিয়ার শীতলক্ষ্যা নদী তীরবর্তী দস্যুনারায়ণপুর গ্রামের বিশাল এলাকা প্রত্যুষে হঠাৎ ২০/২৫ ফুট নীচে দেবে যায়। মাটিতে বিশাল ফাটলের সৃষ্টি হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের বিশেষজ্ঞ শিক্ষকগণের তত্ত্বাবধানে দেবে যাওয়া মাটির নীচে অনুসন্ধান চালানো হয়। এ ব্যাপারে তাদের অভিমত ছিল এখানে প্রচুর পরিমাণে পীট কয়লা রয়েছে।
১৯৭৬-৭৭ সালে উপজেলার বারাব বাজারের মসজিদের কূপ খনন করতে গিয়ে ২২ হাত মাটির নীচে একটি বড় নৌকার সন্ধান পাওয়া যায়। বারাব মসজিদটি শাখা বানার নদের ভরাটের মধ্যে অবস্থিত। কূপ খননকারীরা নৌকার অংশ বিশেষ উঠাতে গিয়ে সেখানে একটি বিরাট হিজল গাছের সন্ধান পায়।
১৯৬৮-৬৯ সালে বারাব গ্রামের ৩/৪ কিলোমিটর দক্ষিণ পশ্চিমে পূর্ব লোহাদী গ্রামে জনৈক ব্যক্তির বাড়ীতে কূপ খনন করতে গেলে মাটির নীচে লালচে কালো রঙের ভারী পানির মতো এক প্রকার পানি পাওয়া যায়। এক সময় কূপ থেকে গ্যাসের মতো ধোঁয়া উঠতে দেখা গেলে ভয়ে গ্রামের লোকজন তাৎক্ষণিক কূপটি ভরাট করে ফেলে বলে জানা যায়।
১৯৮৫-৮৬ সালে চরখামের গ্রামের জনৈক ব্যক্তি পুকুর খনন করতে গেলে ৮/১০ ফুট মাটির নীচে পদ্ম ফুলের সারি সারি পাতা দেখা যায়। এলাকাবাসীর ধারণা, এখানে কোন এক কালে খাল-বিল কিংবা নদীর অস্তিত্ব ছিল। যা কালক্রমে মাটি ভরাট হয়ে গেছে।
ভূ-তাত্বিক বিবর্তনের কারণে বঙ্গোপসাগর হানা দিয়েছিল স্থলভাগে। বার বার হানা দিয়ে বঙ্গোপসাগর আবার সরেও গিয়েছিল নিজ স্থানে। আমাদের কাপাসিয়া অঞ্চলে অসংখ্য খাল, বিল, নদী-নালা, জলমহল, উঁচু টেক-টিলা রয়েছে। এসবই সমুদ্রের উদ্গীরণের ফসল। লক্ষ লক্ষ বছর পূর্বে সমুদ্রের গর্ভ থেকে কাপাসিয়ার লাল মাটির ছোট ছোট পাহাড়ের মত টেক-টিলা-উঁচু ভূমি খন্ডগুলি মাথা তুলে দাঁড়ায়। এসব উঁচু ভূমির আশপাশে বিস্তৃত ছিলো সমূদ্রের গভীর জলরাশি। এ বিশাল জলরাশির উপর বিক্ষিপ্ত অবস্থানে ছোট ছোট দ্বীপের মতো ভাসমান ছিলো এসকল উঁচু লাল মাটির টেকগুলি। তারপর লক্ষ লক্ষ বছর সমুদ্র ভরাট হয়ে অনেক দূরে সরে যায়। সমুদ্র দূরে সরে গেলেও রেখে যায় গভীর খাদ নামক সামুদ্রিক চিহ্ন। তারপর ধীরে ধীরে এক সময় গড়ে উঠে গভীর অরণ্য ভূমি-বন-জঙ্গল। এ ভূ-খন্ড থেকে সমুদ্র অনেক দূরে সরে গেলেও কাপাসিয়া অঞ্চলে উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে যায় শৗতলক্ষ্যা, বানার, ব্রহ্মপুত্রের মতো সু-সন্তান, খরস্রোতা নদ-নদী, বেলাইয়ের মতো বিল-ঝিল কিংবা অসংখ্য খাল ও জলমহল।
শীতলক্ষ্যা, বানার ও ব্রহ্মপুত্র এই তিনটি নদ-নদী দ্বারা কাপাসিয়া বেষ্টিত। বানার নদী প্রসঙ্গে যতীন্দ্র মোহন রায় তাঁর রচিত ‘ঢাকার ইতিহাস’- গ্রন্থে বলেছেন(পৃষ্ঠা-৩২), “বানার ব্রহ্মপুত্রের পূর্বদিকস্থ প্রবাহের একটি শাখা নদী মাত্র; উহাই লক্ষ্যা নদীর উর্ধ্বতন প্রবাহ। কিন্তু পূর্বে তাহা ছিলোনা। বহুকাল পূর্বে ইহা একটি স্বতন্ত্র নদী ছিলো। তৎকালে উহার উৎপত্তি স্থান ছিলো মধুপুর জঙ্গলের মধ্যবর্তী গুপ্ত বৃন্দাবনের সন্নিকটে। লাখপুর-রাণীগঞ্জের নিকটে এ নদীর সহিত লক্ষ্যা নদীর সঙ্গম ঘটিয়াছিল। এগারসিন্ধুর দক্ষিণ পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের নিম্ন প্রবাহ শুষ্ক হইয়া গেলে এই নদী তদীয় জলস্রোতের একাংশ ভৈরব বাজার অভিমুখে প্রেরণ করে এবং অপরাংশ রক্তবর্ণ মৃত্তিকারাশি ভেদ করতঃ নতুন প্রবাহ সৃষ্টি করিয়া ব্রহ্মপুত্রের সহিত বানার নদীর সংযোগ সাধন করিয়া দেয়। এই পয়ঃপ্রণালী স্রোতবেগ প্রবল থাকায় বানার নদীর উর্ধ্বতন প্রবাহ ইহার অংশীভূত হইয়া পড়ে। ফলে এগারসিন্ধু হইতে লাখপুর রাণীগঞ্জ পর্যন্ত সমূদয় নদীটি বানার নাম ধারণ করে।”
ষোড়শ শতাব্দীতে এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে কাপাসিয়ার পূর্বাঞ্চল দিয়ে প্রবাহমান ব্রহ্মপুত্র নদটি ভরাট হয়ে যায়। বর্তমানে ব্রহ্মপুত্র নদটি তাঁর গতি পরিবর্তন করেছে এবং শীতলক্ষ্যা নদী অনেক ক্ষীণ হয়ে গেছে। জেগে উঠেছে অসংখ্য চর।
কাপাসিয়ার একমাত্র জলমহলের নাম ঘোরস্বাব জলমহল। এর আয়তন ১২১ একর (৪৯ হেক্টর)। ঘোরস্বাব এই জলমহলটি এক সময়ের শাখা বানার নদীরই চিহ্ন বলে জানা যায়। এ জলমহলটিতে এককালে প্রচুর পরিমাণ ইলিশ পাওয়া যেত বলে কথিত আছে। টোক শহর কাপাসিয়া উপজেলার উত্তর সীমান্তে বানার ও ব্রহ্মপুত্র নদের সংযোগ স্থলের দক্ষিণ তীরে অবস্থিত। বানার নামক অন্য একটি নদীর অবস্থান পাওয়া যায়। এটি টোক শহরের একটু পশ্চিম পার্শে¦ উলসরা পচুবাবু জমিদারের বাড়ির কাছ হতে বড় বানার নদী থেকে কাপাসিয়া উপজেলার মূল ভূ-খন্ডে প্রবেশ করে। বর্তমানে লোহাদীর উত্তর পার্শ্বে যে লোহার পুল দেখা যায় তা শাখা বানার নদীর উপরে অবস্থিত। কামারগাঁও বাজারের কাছে ঘোরস্বাব জলমহলটি শাখা বানার নদীর চিহ্ন। বর্তমানে তা জলমহলে পরিণত হয়েছে।
কাপাসিয়া উপজেলার উত্তর সীমান্তে অবস্থিত ঐতিহাসিক টোক নগর অবস্থিত। ‘টোক’ ফার্সি শব্দ। টোক শব্দের অর্থ পোতাশ্রয়। পোতাশ্রয় হলো-সমুদ্রের তীরে জাহাজ রাখার নিরাপদ স্থান। ধারণা করা হয় যে, এক সময় টোক ছিল সমুদ্র বন্দর। ৬ষ্ঠ ও ৭ম শতাব্দীতে টোক অঞ্চল দিয়ে কাপাসিয়ায় মুসলমানদের আগমন ঘটে। এককালে টোক সামুদ্রিক বন্দরের সাথে আরবীয় বণিকদের আসা যাওয়া ছিল। এ পথ দিয়েই আরব বণিক ও আউলিয়া, দরবেশদের আগমন ঘটে কাপাসিয়া অঞ্চলে। ব্যবসা ও ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এসে তারা এদেশীয়দের সাথে সামাজিক ও বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। তাঁদের মাধ্যমে কাপাসিয়ায় ইসলাম ধর্মের প্রবর্তন হয়। অপরদিকে কাপাসিয়া উপজেলার দক্ষিণাঞ্চল তারগঞ্জ এলাকা দিয়ে শীতলক্ষ্যা নদী পথে ভারতের জৈনপুরের পীর ও আলেমগণ ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে কাপাসিয়ায় আগমন করেন। ১৮৭০ সালের দিকে ভারতের জৈনপুরের পীর মাওলানা কেরামত আলী (রঃ) নদীপথে বজরা (নৌকা) নিয়ে কাপাসিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন।
ব্রহ্মপুত্র, বানার, শীতলক্ষ্যা নদী ছাড়াও কাপাসিয়ায় পুরাতন লক্ষ্যা, আড়াল জুড়ি, পাথরদাড়া, আদিবানার, বড়ধারা নামে কিছু শাখা বা উপনদী রয়েছে। এসব নদীর পাশাপাশি কাপাসিয়ায় রয়েছে ৭৬টি খাল, ২০৪টি বিল, ১টি বাওর এবং অসংখ্য টেক-টিলা। এসবের অস্তিত্ব প্রমাণ করে লক্ষ বছর পূর্বে প্রাকৃতিক নিয়মেই সাগর গর্ভ থেকে সৃষ্টি হয়েছিল কাপাসিয়ার পুরো ভূ-খন্ড।
এককালে সাগর গর্ভ থেকে জন্ম নেয়া কাপাসিয়া গ্যাসের উপর ভাসছে বলে অনেকের ধারণা। ইতোমধ্যে এর অনেক প্রমাণও পাওয়া গেছে। কাপাসিয়া উপজেলার রায়েদ ইউনিয়নের বেলাসী গ্রামে, সিংহশ্রী ইউনিয়নের কুড়িয়াদী গ্রামে এবং বারিষাব ইউনিয়নের বর্জাপুর গ্রামে প্রচুর পরিমাণে গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। ২০০৫ সাল থেকে কাপাসিয়া উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গ্যাসের সন্ধানে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন এন্ড প্রোডাকশন কোম্পানী লিঃ (বাপেক্স) অনুসন্ধান চালায়। অনুসন্ধানে উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের তিনটি স্থানে গ্যাসের সন্ধান পাওয়া যায়। বাপেক্সের ধারণা উল্লেখিত তিনটি স্থানে ৫০০ বিলিন ঘনফুট গ্যাস মজুদ থাকতে পারে। তাছাড়া উপজেলার সনমানিয়া ইউনিয়নের আড়াল, চরসনমানিয়া, কড়িহাতা ইউনিয়নের চরখামেরসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের অস্তিত্ব রয়েছে বলে মানুষের ধারণা। বৃটিশ আমলে দূর্গাপুর ইউনিয়নের রাওনাট-বড়ব্রীজের পশ্চিম পার্শ্বে খালের জমিতে গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেলেও স্বল্প গ্যাস থাকায় এবং ব্যয়বহুল বলে উত্তোলনের ব্যবস্থা না করে তৎকালীন কর্তৃপক্ষ লোহার পিলারের সাহায্যে চিহ্ন দিয়ে রাখেন। আজও ধান ক্ষেতে সে পিলারের চিহ্ন দূর থেকে দেখা যায়।
কাপাসিয়া উপজেলার ভূমি সাধারণত বেলে মাটি, পলিমাটি, দো-আঁশ মাটি, কাদা মাটি দিয়ে গঠিত। ৪টি ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চল দিয়ে গঠিত কাপাসিয়া। এগুলো হলো মধুপুরের গড় অঞ্চল, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র পলল ভূমি, মিশ্র মেঘনা মোহনা এবং নব্য বহ্মপুত্র পলল ভূমি। এ ৪টি অঞ্চল যথাক্রমে উপজেলার শতকরা প্রায় ৭২.৯, ৭.০, ১.৪ ও ১৩.৬ ভাগ এলাকায় বিস্তৃত। তার শতকরা ৫.১ ভাগ বসতবাটি, পুকুর, জলাশয় ও নদীনালা ইত্যাদি।
কাপাসিয়ার ভূমিকে সামগ্রিকভাবে ভাওয়াল ও মধুপুর গড় এলাকা বলা হয়। অধ্যাপক দারা-শামসুদ্দিন-ভূ-তাত্ত্বিকগণের উদ্বৃতি দিয়ে বলেন যে, ‘উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্রভূমি, ঢাকা-ময়মনসিংহের গড় অঞ্চল এবং কুমিল্লার লালমাই উৎপত্তিগত দিক থেকে একই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। আনুমানিক দশ থেকে পনের লক্ষ বছর আগে সামুদ্রিক কিংবা জোয়ার ভাটার ফলে পরিবেশে কাদামাটির পলি সঞ্চিত হয়। সম্পূর্ণ ভাওয়াল-মধুপুর অঞ্চলটি বর্তমানে বিশাল চত্বরের আকার ধারণ করেছে। ভূ-তাত্ত্বিকগণ এর নাম দিয়েছেন ‘প্লাইসটেনিস চত্ত্বর’-যার অনুমানিক বয়স দশ লক্ষ বছর।”
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে কাপাসিয়া মহাস্থানগড় ও পাহাড়পুরের সমসাময়িক। সোনারগাঁও, বিক্রমপুর, সাভার ও ময়নামতির চাইতেও প্রাচীনতম জনপদ।
গাজীপুরের কাপাসিয়া-নরসিংদী দিয়ে বয়ে গেছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ। ১৭৭০ সাল পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ ময়মনসিংহ পেরিয়ে নরসিংদীর বেলাবর কাছে দক্ষিণ দিকে গিয়ে প্রাচীন সোনারগাঁ নগরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত ছিলো। সম্ভবত বড় ভূমিকম্প, বন্যা, প্লাবন, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর অব্যাহত নদী ভাঙ্গনের কারণে কোন কোন সময়ে কাপাসিয়া ও তার আশ-পাশ অঞ্চলে ভূ-প্রকৃতির বড় রকমের উলট-পালট ও পরিবর্তন ঘটে। ১৮৯৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের ফলে এ অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে, মাটির নীচে চাপা পড়ে যায় অনেক ইতিহাস ও সভ্যতার নিদর্শন।
ধারণা করা হয় যে, শীতলক্ষ্যা-ব্রহ্মপূত্র নদের তীরবর্তী জনপদ হিসেবে কাপাসিয়া, মনোহরদী, বেলাব, শিবপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছিলো সু-সভ্য মানুষের বসবাস। এ অঞ্চলে এক সময় গড়ে উঠেছিল নগর সভ্যতা। প্রাচীন গ্রীসের এথেন্স ও স্পার্টার মতো গড়ে উঠেছিল নগর রাষ্ট্র। নরসিংদীর বেলাবো-মনোহরদীর ওয়ারী-বটেশ্বরে মাটির নীচে আড়াই হাজার বছর আগের এক সভ্যতা আবিষ্কৃত হয়েছে। অনেকের ধারণা এ সভ্যতার সাথে কাপাসিয়ার টোক নগরের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। একসময় কাপাসিয়া এবং মনোহদী, শিবপুর, বেলাব অঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে ভৈরবের মেঘনা হয়ে এখানকার ব্যবসা বাণিজ্য সুদূর প্রাচ্যের জনপদ পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। ঐতিহাসিকদের ধারণা ব্রহ্মপুত্র নদ হয়ে বঙ্গোপসাগরের মধ্য দিয়ে চলত এ অঞ্চলের ব্যবসা বাণিজ্য।
মানুষের ধারণা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে শুরু করে ভূ-মধ্যসাগর অঞ্চলের সুদূর রোমান সাম্রাজ্য পর্যন্ত ‘ওয়ারী পটেশ্বর রাজ্যের এবং টোক শহর তথা কাপাসিয়া অঞ্চলের যোগাযোগ ছিলো।’ হয়তো একদিন আবিষ্কৃত হবে ওয়ারী-বটেশ্বরের মতো সমসাময়িক নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল কাপাসিয়ার টোক কিংবা কোন স্থানে।
লেখক : অধ্যাপক শামসুল হুদা লিটন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, তারাগঞ্জ কলেজ।
সাধারণ সম্পাদক, কাপাসিয়া প্রেস ক্লাব। একটি দৈনিক থেকে সংগৃহীত লেখাটি খুব ভাল লাগল তাই শেয়ার করলাম আপনাদের জন্য
বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন ভূ-খন্ডগুলোর অন্তর্ভুক্ত কাপাসিয়ার সমগ্র অঞ্চল। কাপাসিয়ার শীতলক্ষ্যা নদী উঁচু-নীচু, লাল-বেলে মাটির উপর দিয়ে অতিক্রম করে ভাটির দিকে মেঘনা নদীর তীর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে। পন্ডিত-গবেষকদের ধারণা যে, দশ লক্ষ বছর পূর্বে বাংলাদেশের প্রাচীনতম ভূ-খন্ড হিসেবে কাপাসিয়ার ভীত রচিত হয়েছিল। পাঁচ লক্ষ বছর আগে প্রথম বরফ যুগে সমুদ্রের গর্ভ থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল এ অঞ্চলটি। বরফ যুগে সমুদ্রের পানি বরফ হয়ে আকাশে ওঠে যায় এবং বিশাল সামুদ্রিক হ্রদগুলো শুকিয়ে যায়। পন্ডিতদের ধারণা যে, সে সময় সমুদ্রের পানি অত্যন্ত নীচে নেমে গিয়েছিল। বৈজ্ঞানিকদের অভিমত, এ বরফ যুগটির স্থায়ীত্বকাল ছিল ৮০ হাজার বছর। তারপর শুরু হয় বরফগলা লাল পানির প্রবাহ। এ বরফ তিনটি বরফ গলা যুগের লাল পানির প্রবাহে সৃষ্ট মাটির স্তরগুলিও লাল হয়ে যায়। এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে এ প্রাচীন ভূ-খন্ডটি গভীর অরণ্য ও বনভূমিতে পরিণত হয়।
দীর্ঘ সময়ের মধ্যে অসংখ্যবার এসব বনভূমির বিবর্তনও ঘটেছে। ভূ-তাত্বিক স্তর বিন্যাসে জটিলতার দরুন এ অঞ্চলে ভূমির বিপর্যয় ঘটে। যার ফলে বনভূমির বিভিন্ন অংশ মাটির নীচে চাপা পড়ে যায়। চাপা পড়া বনভূমি হাজার হাজার বছরের ব্যবধানে পরিণত হয় কয়লায়। বিভিন্ন স্থানে পুকুর কিংবা কূপ খননকালে আজও এ অঞ্চলে কয়লার সন্ধান পাওয়া যায়।
কাপাসিয়া উপজেলার সাহার বিদ্যাকোট (দরদরিয়া) গ্রামের পশ্চিম অংশে ভাঙ্গন কবলিত শীতলক্ষ্যা নদীপাড়ে লাল মাটির ১০/১২ হাত নীচে কয়লায় পরিণত একটি বড় আকারের বৃক্ষ আবিষ্কৃত হয়। ১৯৭৮ সালে ঢাকা যাদুঘরের মহাপরিচালক ডঃ এনামুল হক ও প্রত্ন অনুসন্ধানী শফিকুল আসগর কয়লায় পরিণত হওয়া বৃক্ষটি দেখতে আসেন এবং বৃক্ষটির কিছু অংশ উদ্ধার করেন। এ ব্যাপারে ডঃ এনামুল হক অভিমত প্রকাশ করেন যে, লক্ষাধিক বছর ধরে মাটির নীচে চাপা পড়ে থাকায় বৃক্ষটি কয়লাকাষ্ঠে পরিণত হয়েছে।
দূর্গাপুর ইউনিয়নের রাণীগঞ্জ-তারাগঞ্জ এলাকায় শীতলক্ষ্যা ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গম স্থলে গড়ে উঠেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের অপরূপ লীলাভূমি বিশাল ধাঁধাঁরচর। ধারণা করা হচ্ছে শত শত বছর পূর্বে ঝড়-জলোচ্ছাস, ভূমিকম্প ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বড় বড় গাছপালা ভেঙ্গে নদীতে আছড়ে পড়ে এবং নৌকা-জাহাজ ডুবে শীতলক্ষ্যা-ব্রহ্মপুত্রের মিলনস্থলে এসে কিছু অংশ আটকে যায়। এভাবে আটকে পড়া গাছপালা নৌকা ও জাহাজের স্থানে বালি জমে জমে কালক্রমে চরের সৃষ্টি হয়। গত কয়েক বছর পূর্বে ধাঁধাঁর চরের উত্তর থেকে ড্রেজারের সাহায্যে বালি উত্তোলনের সময় পাইপের ভেতর দিয়ে বালি-পানির সাথে বড় বড় কয়লার টুকরো আসতে দেখা যায়। এলাকার লোকজন এসব কয়লা নিয়ে রান্নাবান্না করে এবং জ্বালানীর প্রয়োজন মিটায়। ধারণা করা হচ্ছে, ব্রহ্মপুত্র নদ ও শীতলক্ষ্যা নদীর মোহনায় আটকেপড়া বড় বড় গাছ চরের নীচে চাপা পড়ে কালক্রমে কয়লায় পরিণত হয়। দরদরিয়ায় মাটির নীচে সন্ধান পাওয়া কাঠ কয়লার সাথে ধাঁধাঁর চর সংলগ্ন দুই নদীর মোহনায় পাওয়া কাঠ কয়লার গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
২০০৪ সালে কাপাসিয়ার শীতলক্ষ্যা নদী তীরবর্তী দস্যুনারায়ণপুর গ্রামের বিশাল এলাকা প্রত্যুষে হঠাৎ ২০/২৫ ফুট নীচে দেবে যায়। মাটিতে বিশাল ফাটলের সৃষ্টি হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের বিশেষজ্ঞ শিক্ষকগণের তত্ত্বাবধানে দেবে যাওয়া মাটির নীচে অনুসন্ধান চালানো হয়। এ ব্যাপারে তাদের অভিমত ছিল এখানে প্রচুর পরিমাণে পীট কয়লা রয়েছে।
১৯৭৬-৭৭ সালে উপজেলার বারাব বাজারের মসজিদের কূপ খনন করতে গিয়ে ২২ হাত মাটির নীচে একটি বড় নৌকার সন্ধান পাওয়া যায়। বারাব মসজিদটি শাখা বানার নদের ভরাটের মধ্যে অবস্থিত। কূপ খননকারীরা নৌকার অংশ বিশেষ উঠাতে গিয়ে সেখানে একটি বিরাট হিজল গাছের সন্ধান পায়।
১৯৬৮-৬৯ সালে বারাব গ্রামের ৩/৪ কিলোমিটর দক্ষিণ পশ্চিমে পূর্ব লোহাদী গ্রামে জনৈক ব্যক্তির বাড়ীতে কূপ খনন করতে গেলে মাটির নীচে লালচে কালো রঙের ভারী পানির মতো এক প্রকার পানি পাওয়া যায়। এক সময় কূপ থেকে গ্যাসের মতো ধোঁয়া উঠতে দেখা গেলে ভয়ে গ্রামের লোকজন তাৎক্ষণিক কূপটি ভরাট করে ফেলে বলে জানা যায়।
১৯৮৫-৮৬ সালে চরখামের গ্রামের জনৈক ব্যক্তি পুকুর খনন করতে গেলে ৮/১০ ফুট মাটির নীচে পদ্ম ফুলের সারি সারি পাতা দেখা যায়। এলাকাবাসীর ধারণা, এখানে কোন এক কালে খাল-বিল কিংবা নদীর অস্তিত্ব ছিল। যা কালক্রমে মাটি ভরাট হয়ে গেছে।
ভূ-তাত্বিক বিবর্তনের কারণে বঙ্গোপসাগর হানা দিয়েছিল স্থলভাগে। বার বার হানা দিয়ে বঙ্গোপসাগর আবার সরেও গিয়েছিল নিজ স্থানে। আমাদের কাপাসিয়া অঞ্চলে অসংখ্য খাল, বিল, নদী-নালা, জলমহল, উঁচু টেক-টিলা রয়েছে। এসবই সমুদ্রের উদ্গীরণের ফসল। লক্ষ লক্ষ বছর পূর্বে সমুদ্রের গর্ভ থেকে কাপাসিয়ার লাল মাটির ছোট ছোট পাহাড়ের মত টেক-টিলা-উঁচু ভূমি খন্ডগুলি মাথা তুলে দাঁড়ায়। এসব উঁচু ভূমির আশপাশে বিস্তৃত ছিলো সমূদ্রের গভীর জলরাশি। এ বিশাল জলরাশির উপর বিক্ষিপ্ত অবস্থানে ছোট ছোট দ্বীপের মতো ভাসমান ছিলো এসকল উঁচু লাল মাটির টেকগুলি। তারপর লক্ষ লক্ষ বছর সমুদ্র ভরাট হয়ে অনেক দূরে সরে যায়। সমুদ্র দূরে সরে গেলেও রেখে যায় গভীর খাদ নামক সামুদ্রিক চিহ্ন। তারপর ধীরে ধীরে এক সময় গড়ে উঠে গভীর অরণ্য ভূমি-বন-জঙ্গল। এ ভূ-খন্ড থেকে সমুদ্র অনেক দূরে সরে গেলেও কাপাসিয়া অঞ্চলে উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে যায় শৗতলক্ষ্যা, বানার, ব্রহ্মপুত্রের মতো সু-সন্তান, খরস্রোতা নদ-নদী, বেলাইয়ের মতো বিল-ঝিল কিংবা অসংখ্য খাল ও জলমহল।
শীতলক্ষ্যা, বানার ও ব্রহ্মপুত্র এই তিনটি নদ-নদী দ্বারা কাপাসিয়া বেষ্টিত। বানার নদী প্রসঙ্গে যতীন্দ্র মোহন রায় তাঁর রচিত ‘ঢাকার ইতিহাস’- গ্রন্থে বলেছেন(পৃষ্ঠা-৩২), “বানার ব্রহ্মপুত্রের পূর্বদিকস্থ প্রবাহের একটি শাখা নদী মাত্র; উহাই লক্ষ্যা নদীর উর্ধ্বতন প্রবাহ। কিন্তু পূর্বে তাহা ছিলোনা। বহুকাল পূর্বে ইহা একটি স্বতন্ত্র নদী ছিলো। তৎকালে উহার উৎপত্তি স্থান ছিলো মধুপুর জঙ্গলের মধ্যবর্তী গুপ্ত বৃন্দাবনের সন্নিকটে। লাখপুর-রাণীগঞ্জের নিকটে এ নদীর সহিত লক্ষ্যা নদীর সঙ্গম ঘটিয়াছিল। এগারসিন্ধুর দক্ষিণ পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের নিম্ন প্রবাহ শুষ্ক হইয়া গেলে এই নদী তদীয় জলস্রোতের একাংশ ভৈরব বাজার অভিমুখে প্রেরণ করে এবং অপরাংশ রক্তবর্ণ মৃত্তিকারাশি ভেদ করতঃ নতুন প্রবাহ সৃষ্টি করিয়া ব্রহ্মপুত্রের সহিত বানার নদীর সংযোগ সাধন করিয়া দেয়। এই পয়ঃপ্রণালী স্রোতবেগ প্রবল থাকায় বানার নদীর উর্ধ্বতন প্রবাহ ইহার অংশীভূত হইয়া পড়ে। ফলে এগারসিন্ধু হইতে লাখপুর রাণীগঞ্জ পর্যন্ত সমূদয় নদীটি বানার নাম ধারণ করে।”
ষোড়শ শতাব্দীতে এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে কাপাসিয়ার পূর্বাঞ্চল দিয়ে প্রবাহমান ব্রহ্মপুত্র নদটি ভরাট হয়ে যায়। বর্তমানে ব্রহ্মপুত্র নদটি তাঁর গতি পরিবর্তন করেছে এবং শীতলক্ষ্যা নদী অনেক ক্ষীণ হয়ে গেছে। জেগে উঠেছে অসংখ্য চর।
কাপাসিয়ার একমাত্র জলমহলের নাম ঘোরস্বাব জলমহল। এর আয়তন ১২১ একর (৪৯ হেক্টর)। ঘোরস্বাব এই জলমহলটি এক সময়ের শাখা বানার নদীরই চিহ্ন বলে জানা যায়। এ জলমহলটিতে এককালে প্রচুর পরিমাণ ইলিশ পাওয়া যেত বলে কথিত আছে। টোক শহর কাপাসিয়া উপজেলার উত্তর সীমান্তে বানার ও ব্রহ্মপুত্র নদের সংযোগ স্থলের দক্ষিণ তীরে অবস্থিত। বানার নামক অন্য একটি নদীর অবস্থান পাওয়া যায়। এটি টোক শহরের একটু পশ্চিম পার্শে¦ উলসরা পচুবাবু জমিদারের বাড়ির কাছ হতে বড় বানার নদী থেকে কাপাসিয়া উপজেলার মূল ভূ-খন্ডে প্রবেশ করে। বর্তমানে লোহাদীর উত্তর পার্শ্বে যে লোহার পুল দেখা যায় তা শাখা বানার নদীর উপরে অবস্থিত। কামারগাঁও বাজারের কাছে ঘোরস্বাব জলমহলটি শাখা বানার নদীর চিহ্ন। বর্তমানে তা জলমহলে পরিণত হয়েছে।
কাপাসিয়া উপজেলার উত্তর সীমান্তে অবস্থিত ঐতিহাসিক টোক নগর অবস্থিত। ‘টোক’ ফার্সি শব্দ। টোক শব্দের অর্থ পোতাশ্রয়। পোতাশ্রয় হলো-সমুদ্রের তীরে জাহাজ রাখার নিরাপদ স্থান। ধারণা করা হয় যে, এক সময় টোক ছিল সমুদ্র বন্দর। ৬ষ্ঠ ও ৭ম শতাব্দীতে টোক অঞ্চল দিয়ে কাপাসিয়ায় মুসলমানদের আগমন ঘটে। এককালে টোক সামুদ্রিক বন্দরের সাথে আরবীয় বণিকদের আসা যাওয়া ছিল। এ পথ দিয়েই আরব বণিক ও আউলিয়া, দরবেশদের আগমন ঘটে কাপাসিয়া অঞ্চলে। ব্যবসা ও ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এসে তারা এদেশীয়দের সাথে সামাজিক ও বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। তাঁদের মাধ্যমে কাপাসিয়ায় ইসলাম ধর্মের প্রবর্তন হয়। অপরদিকে কাপাসিয়া উপজেলার দক্ষিণাঞ্চল তারগঞ্জ এলাকা দিয়ে শীতলক্ষ্যা নদী পথে ভারতের জৈনপুরের পীর ও আলেমগণ ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে কাপাসিয়ায় আগমন করেন। ১৮৭০ সালের দিকে ভারতের জৈনপুরের পীর মাওলানা কেরামত আলী (রঃ) নদীপথে বজরা (নৌকা) নিয়ে কাপাসিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন।
ব্রহ্মপুত্র, বানার, শীতলক্ষ্যা নদী ছাড়াও কাপাসিয়ায় পুরাতন লক্ষ্যা, আড়াল জুড়ি, পাথরদাড়া, আদিবানার, বড়ধারা নামে কিছু শাখা বা উপনদী রয়েছে। এসব নদীর পাশাপাশি কাপাসিয়ায় রয়েছে ৭৬টি খাল, ২০৪টি বিল, ১টি বাওর এবং অসংখ্য টেক-টিলা। এসবের অস্তিত্ব প্রমাণ করে লক্ষ বছর পূর্বে প্রাকৃতিক নিয়মেই সাগর গর্ভ থেকে সৃষ্টি হয়েছিল কাপাসিয়ার পুরো ভূ-খন্ড।
এককালে সাগর গর্ভ থেকে জন্ম নেয়া কাপাসিয়া গ্যাসের উপর ভাসছে বলে অনেকের ধারণা। ইতোমধ্যে এর অনেক প্রমাণও পাওয়া গেছে। কাপাসিয়া উপজেলার রায়েদ ইউনিয়নের বেলাসী গ্রামে, সিংহশ্রী ইউনিয়নের কুড়িয়াদী গ্রামে এবং বারিষাব ইউনিয়নের বর্জাপুর গ্রামে প্রচুর পরিমাণে গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। ২০০৫ সাল থেকে কাপাসিয়া উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গ্যাসের সন্ধানে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন এন্ড প্রোডাকশন কোম্পানী লিঃ (বাপেক্স) অনুসন্ধান চালায়। অনুসন্ধানে উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের তিনটি স্থানে গ্যাসের সন্ধান পাওয়া যায়। বাপেক্সের ধারণা উল্লেখিত তিনটি স্থানে ৫০০ বিলিন ঘনফুট গ্যাস মজুদ থাকতে পারে। তাছাড়া উপজেলার সনমানিয়া ইউনিয়নের আড়াল, চরসনমানিয়া, কড়িহাতা ইউনিয়নের চরখামেরসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের অস্তিত্ব রয়েছে বলে মানুষের ধারণা। বৃটিশ আমলে দূর্গাপুর ইউনিয়নের রাওনাট-বড়ব্রীজের পশ্চিম পার্শ্বে খালের জমিতে গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেলেও স্বল্প গ্যাস থাকায় এবং ব্যয়বহুল বলে উত্তোলনের ব্যবস্থা না করে তৎকালীন কর্তৃপক্ষ লোহার পিলারের সাহায্যে চিহ্ন দিয়ে রাখেন। আজও ধান ক্ষেতে সে পিলারের চিহ্ন দূর থেকে দেখা যায়।
কাপাসিয়া উপজেলার ভূমি সাধারণত বেলে মাটি, পলিমাটি, দো-আঁশ মাটি, কাদা মাটি দিয়ে গঠিত। ৪টি ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চল দিয়ে গঠিত কাপাসিয়া। এগুলো হলো মধুপুরের গড় অঞ্চল, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র পলল ভূমি, মিশ্র মেঘনা মোহনা এবং নব্য বহ্মপুত্র পলল ভূমি। এ ৪টি অঞ্চল যথাক্রমে উপজেলার শতকরা প্রায় ৭২.৯, ৭.০, ১.৪ ও ১৩.৬ ভাগ এলাকায় বিস্তৃত। তার শতকরা ৫.১ ভাগ বসতবাটি, পুকুর, জলাশয় ও নদীনালা ইত্যাদি।
কাপাসিয়ার ভূমিকে সামগ্রিকভাবে ভাওয়াল ও মধুপুর গড় এলাকা বলা হয়। অধ্যাপক দারা-শামসুদ্দিন-ভূ-তাত্ত্বিকগণের উদ্বৃতি দিয়ে বলেন যে, ‘উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্রভূমি, ঢাকা-ময়মনসিংহের গড় অঞ্চল এবং কুমিল্লার লালমাই উৎপত্তিগত দিক থেকে একই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। আনুমানিক দশ থেকে পনের লক্ষ বছর আগে সামুদ্রিক কিংবা জোয়ার ভাটার ফলে পরিবেশে কাদামাটির পলি সঞ্চিত হয়। সম্পূর্ণ ভাওয়াল-মধুপুর অঞ্চলটি বর্তমানে বিশাল চত্বরের আকার ধারণ করেছে। ভূ-তাত্ত্বিকগণ এর নাম দিয়েছেন ‘প্লাইসটেনিস চত্ত্বর’-যার অনুমানিক বয়স দশ লক্ষ বছর।”
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে কাপাসিয়া মহাস্থানগড় ও পাহাড়পুরের সমসাময়িক। সোনারগাঁও, বিক্রমপুর, সাভার ও ময়নামতির চাইতেও প্রাচীনতম জনপদ।
গাজীপুরের কাপাসিয়া-নরসিংদী দিয়ে বয়ে গেছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ। ১৭৭০ সাল পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ ময়মনসিংহ পেরিয়ে নরসিংদীর বেলাবর কাছে দক্ষিণ দিকে গিয়ে প্রাচীন সোনারগাঁ নগরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত ছিলো। সম্ভবত বড় ভূমিকম্প, বন্যা, প্লাবন, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর অব্যাহত নদী ভাঙ্গনের কারণে কোন কোন সময়ে কাপাসিয়া ও তার আশ-পাশ অঞ্চলে ভূ-প্রকৃতির বড় রকমের উলট-পালট ও পরিবর্তন ঘটে। ১৮৯৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের ফলে এ অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে, মাটির নীচে চাপা পড়ে যায় অনেক ইতিহাস ও সভ্যতার নিদর্শন।
ধারণা করা হয় যে, শীতলক্ষ্যা-ব্রহ্মপূত্র নদের তীরবর্তী জনপদ হিসেবে কাপাসিয়া, মনোহরদী, বেলাব, শিবপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছিলো সু-সভ্য মানুষের বসবাস। এ অঞ্চলে এক সময় গড়ে উঠেছিল নগর সভ্যতা। প্রাচীন গ্রীসের এথেন্স ও স্পার্টার মতো গড়ে উঠেছিল নগর রাষ্ট্র। নরসিংদীর বেলাবো-মনোহরদীর ওয়ারী-বটেশ্বরে মাটির নীচে আড়াই হাজার বছর আগের এক সভ্যতা আবিষ্কৃত হয়েছে। অনেকের ধারণা এ সভ্যতার সাথে কাপাসিয়ার টোক নগরের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। একসময় কাপাসিয়া এবং মনোহদী, শিবপুর, বেলাব অঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে ভৈরবের মেঘনা হয়ে এখানকার ব্যবসা বাণিজ্য সুদূর প্রাচ্যের জনপদ পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। ঐতিহাসিকদের ধারণা ব্রহ্মপুত্র নদ হয়ে বঙ্গোপসাগরের মধ্য দিয়ে চলত এ অঞ্চলের ব্যবসা বাণিজ্য।
মানুষের ধারণা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে শুরু করে ভূ-মধ্যসাগর অঞ্চলের সুদূর রোমান সাম্রাজ্য পর্যন্ত ‘ওয়ারী পটেশ্বর রাজ্যের এবং টোক শহর তথা কাপাসিয়া অঞ্চলের যোগাযোগ ছিলো।’ হয়তো একদিন আবিষ্কৃত হবে ওয়ারী-বটেশ্বরের মতো সমসাময়িক নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল কাপাসিয়ার টোক কিংবা কোন স্থানে।
লেখক : অধ্যাপক শামসুল হুদা লিটন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, তারাগঞ্জ কলেজ।
সাধারণ সম্পাদক, কাপাসিয়া প্রেস ক্লাব।
বিষয়: সাহিত্য
১৩৯০ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কিছু জানতে পারলাম
কাপাসিয়ার ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে বিশদ গবেষনা প্রয়োজন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন