সময়...
লিখেছেন লিখেছেন লালসালু ২৫ জুলাই, ২০১৫, ০৪:২৬:৩৭ বিকাল
মেজর ইমতিয়াজ চার্টের দিকে চোখ বোলাচ্ছেন। আজই একটা দফা রফা হতেই হবে। উত্তরায় একটা ব্যাক্তিগত কাজ ছিল। তা সেরে এখন অপারেশনের অপেক্ষায় আছেন র্যাব হেডকোয়ার্টারের ইন্টেলিজেন্স উইং এর ডেপুটি ডাইরেক্টর মেজর ইমতিয়াজ।
রিয়াজ নামের এই লোকটির পেছনে সে প্রায় বছর খানেক লেগে আছে। কিন্তু কোনভাবেই তাকে ধরা যাচ্ছে না। ঘটনার সূত্রপাত প্রায় এক বছর আগে যখন মুক্তমনা ব্লগার অভিজিৎ রায় খুন হল। এক রেফারেন্স থেকে একটা স্ক্রীণ শট আসে। রিয়াজ নামের সেই লোকটার একটা ফেইসবুক স্ট্যাটাস। অভিজিৎ হত্যা কান্ডের প্রায় আধা ঘন্টা আগে স্ট্যাটাসটি পোষ্ট করা হয়েছিল। স্ট্যাটাস দেখে মনে হতে পারে এই লোক অভিজিৎ হত্যা কান্ড সম্মন্ধে আগে থেকেই জানে। তে শিউর বলা যাচ্ছে না। স্ট্যাটাসটি ছিল- আগামী এক ঘন্টার মধ্যে কেউ অই মেলার আশে পাশে যাবেন না। এরকম হাজার হাজার স্ট্যাটাস ফেইসবুকে পাওয়া যায়। এর মধ্যে কোন কোন ঘটনা কাক তালীয় ভাবে মিলে যেতে পারে। এছাড়া এই স্টেটাসের সাথে অভিজিৎ হত্যার কোন যোগ সূত্র নাও থাকতে পারে। উপর মহলের চাপে যখন অভিজিৎ হত্যা কান্ডের প্রতি সবাই মনযোগী হল তখন মেজর ইমতিয়াজের মনে হল এই রিয়াজ ছেলেটাকে একটু জিজ্ঞাসাবাদ করেই দেখা হোক। বলা তো যায় না, কখন কার কাছ থেকে কী তথ্য বের হয়ে যায়।
মেজর ইমতিয়াজকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সিগন্যাল কোর থেকে র্যাব এ ডেপুটেশনে পাঠানো হয়েছে। ৩৩ বছর বয়স্ক এই মেজর এখনো বিয়ে করেন নি। পরিবার থেকে বিয়ের জন্য প্রচন্ড চাপ দিচ্ছে। যখনই বিয়ের জন্য চাপ দেয়া হয় তখনই সে উত্তর দেয়- আর কটা দিন সময় দাও মা। মা বলেন “আমি কি নাতী নাতনীর মুখ দেখে যেতে পারব না?”
প্রশ্নটা ইমতিয়াজের মনে প্রভাব ফেলে কিন্তু সে মিতুর অপেক্ষায় আছে। মিতু যদি তাকে বিয়ে করতে রাজী হয়। কিন্তু ‘রাজী হয়’ পর্যন্তই তার ভাবনার জাল ছিড়ে যায়। মিতুর বাবা সেনাবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। পারিবারিক ভাবে অনেক প্রভাব প্রতিপত্তি। এই পরিবারের যত মেয়ে বিয়ে হয়েছে প্রত্যেকেই ধনী ব্যবসায়ীর ঘরে গিয়েছে। এছাড়া মিতু একটা সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। তার আলাদা একটা ডিমান্ড রয়েছে। অপর পক্ষে ইমতিয়াজের বাবা ছিলেন বিমান বাহিনীর নন-কমিশন অফিসার। মেজর ইমতিয়াজ ভাল করেই জানে সেনাবাহিনীর অফিসাররা নন-কমিশন অফিসারদের কোন চোখে দেখে। মিতুকে বিয়ের প্রস্তাব কখনো সাহস করে দেয়া হয় নি। ভয় লাগে, যদি রিজেক্ট করে! এর চেয়ে বড় ভয় হল যদি কোন ভাবে তার বাবা জেনে যায়! তাহলে তো চাকরির উপরে ইফেক্ট পড়বে।
ইমতিয়াজ ঘড়ির দিকে তাকায়। অপারেশনের এখনো এক ঘন্টা বাকী। অপারেশন স্থল উত্তরা মাসকট প্লাজার নিচ তলায় কুপারস এ। রিয়াজকে আজ টেকনিক্যালি কুপারস এ আনা হবে। সে কুপারস এর ঢুকলেই তাকে এরেস্ট করা হবে।
এর আগে গত বছর ইমতিয়াজ রিয়াজের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছিল। র্যাব অফিসে ডাক দিলে কেউ আসতে চাইবে না, এছাড়া ছেলেটার সম্মন্ধে তথ্য নেয়ার জন্য তার ফ্রেন্ড লিস্টে একজনকে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু রিয়াজ তার সম্মন্ধে কোন তথ্য দিতে নারাজ। ঐ স্ট্যাটাসটি সে পরে মুছে দিয়েছে। এতে ইমতিয়াজের সন্দেহ বাড়ে। যদিও ইমতিয়াজের টিম শিউর হয়ে গেছে কারা কারা খুনের সাথে জড়িত। এদের সাথে রিয়াজ নামের ছেলেটির কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু তবুও সে শিউর হতে চাচ্ছে স্ট্যাটাসটি সে কেন দিল।
রিয়াজ সম্মন্ধে ইমতিয়াজ যা জানতে পারল তা হল তার প্রোফাইল পিকচার যা দেয়া আছে সেটা তার আসল ছবি না। ফ্রেন্ড লিস্টের কাউকে সে কোন তথ্য দেয় না। রিয়াজের ফেইসবুক তিন জন ফ্রেন্ডকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। তারা কিছু বলতে পারেনি।
রিয়াজকে সরাসরি আলাপের জন্য র্যাব অফিস থেকে মেসেজ পাঠানো হয়েছিল, রিয়াজ সেই মেসেজের কোন উত্তর দেয় নি। এরপরে ইমতিয়াজ টোপ ফেলে।
রিয়াজ একদিন স্ট্যাটাস দেয় তার ওয়াল্টন সেটে কী যেন সমস্যা আছে। এর সমাধান কি কেউ জানে? বেশিরভাগ লোক কমেন্ট করেছিল “সার্ভিস সেন্টারে যান”। এর মধ্যে একজন মেসেজ করে “আমি ওয়াল্টন কাস্টমার কেয়ারে মিরপুর ১ নং এ দুয়ারীপাড়ায় চাকরি করি। আপনার সমস্যার সমাধান পেতে চাইলে সেট নিয়ে চলে আসুন।” রাফী নামের একজন মেসেজ পাঠিয়েছে, মূলত এটা ছিল র্যাবের আইডি। রিয়াজ মেসেজের রিপ্লাই দেয় “আমি আগামীকাল এগারোটায় আসছি।”
পরদিন দুয়ারীপাড়া ওয়াল্টন কাস্টমার কেয়ারের সামনে সাদা পোষাকের র্যাবের টিম বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়। রিয়াজকে সনাক্ত করা মাত্রই তাকে গ্রেফতার করা হবে।
এগারোটা পার হয়ে বারোটা বেজে গেল। কিন্তু রিয়াজ নামের কেউ এল না। হয়তো তার নামটা ছদ্ম নাম কিন্তু আজ কাস্টমার কেয়ারে যারা এসেছে তাদের কাউকে সন্দেহ করার মত মনে হল না। তবে র্যাব একটা কাজ করে রেখেছে। সেটা হল কাস্টমার কেয়ারে তিনটা সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়েছে। বারোটার সময়ে রাফীর আইডিতে মেসেজ আসে “আপনি যে র্যাবের লোক আগে জানলে রিপ্লাই দিতাম না।” এরপরে তাকে ব্লক করে দিল। আইডিটাও ডিএক্টিভ করে দিল। সেই থেকে ইমতিয়াজের সন্দেহ বেড়ে যায়। রিয়াজ কীভাবে জানতে পারল তারা র্যাবের লোক? জানার তো কোন প্রশ্নই আসে না। ইমতিয়াজ সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ দেখল। একজন লোককে তার সন্দেহ হল কারণ লোকটি দশ মিনিট বসে কাস্টমার কেয়ারে কথা না বলে চলে গিয়েছে। সবচেয়ে মজার বিষয় হল লোকটার চেহারা কোন ক্যামেরায় পরিষ্কার ধরা পড়েনি। সে ইচ্ছা করেই কোন ক্যামেরার দিকে তাকায়নি। তার মানে সে ক্যামেরাগুলোর লোকেশন জানে। কিন্তু ক্যামেরার লোকেশন শুধু সেখানকার কাস্টমার ম্যানেজার জানে। আগের দিন রাতে ক্যামেরা সেট করা হয়। আর কোন দিকে তাকালে ক্যামেরায় চেহারা দেখা যাবে তা তো কাস্টমার ম্যানেজারই জানে না। তার মানে র্যাবের ভেতর থেকে কেউ খবর পাস করেছে? তাহলে তো ছেলেটাকে এরেস্ট করা জরুরী। তাতে থলের বিড়াল বেরিয়ে যাবে। চেহারা না দেখা গেলেও একটা আকার আকৃতি বোঝা গেল। কিন্তু এরপরে তার খোঁজ অনেক দিন মিলে নাই।
প্রায় ছয় মাস পরে তার নতুন আইডি ট্রেস করা হয়। এবার পিছনে লাগানো হয় র্যাবের এক মহিলা অফিসারকে। টোপ হিসেবে সেই আদিম যুগের সিস্টেম ইউজ করা হয়। রিয়াজ মেয়েটির সাথে নিয়মিত চ্যাট করে। স্কাইপিতে একবার ভিডিও চ্যাট করে। এরপরে মোবাইল নম্বর লেন দেন করে। একদিন তারা সিদ্ধান্ত নেয় উত্তরা মাসকট প্লাজায় তারা দেখা করবে। সেটা মূলত মেজর ইমতিয়াজের তৈরি করা টোপ। র্যাবের যে মহিলা অফিসারটি রিয়াজের সাথে চ্যাট করে তার ছদ্ম নাম রূপা। সকাল দশটায় তারা কুপারস এ দেখা করবে। নয়টায় মেজর ইমতিয়াজ কুপারস এর সামনে হাজির হল। প্ল্যান মত কুপারস এর ভিতরে কাস্টমার বেশে দুই জন র্যাব সদস্য থাকবে। ইমতিয়াজ বাইরে গাড়ীতে বসে পুরো ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণ করবে। কুপারস এর বাইরে আট জনের একটা টিম অবস্থান নিবে।
এখনো এক ঘন্টা বাকী। সকালের নাস্তা এখনো করা হয় নি। কুপারস এ ঢুকে হালকা পাতলা কিছু খেলে ভাল হয়। এখানে গলা কাটা দাম রাখা হয়। দাম শুনলে ইচ্ছ হয় ধরে ক্রস ফায়ারে দিতে।
ইমতিয়াজ খাবার অর্ডার দিল। আশে পাশের সব টেবিল ফাঁকা। সবাই আরো আধা ঘন্টা পরে যার যার অবস্থান নিবে। ইমতিয়াজের সামনের চেয়ারে পঁচিশ ছাব্বিশ বছর বয়সী এক ছেলে বসল। ইমতিয়াজ বিরক্ত বোধ করল। সব টেবিলই খালি, শালায় এই টেবিলে বসল কেন? হঠাত এই ছেলেটাকে পরিচিত মনে হল। হ্যা, এই ছেলের গঠন, গায়ের রঙ সবই তো ছয় মাস আগে ওয়াল্টনের কাস্টমার কেয়ারের ছেলেটার সাথে মিলে যায়।
“কেমন আছেন স্যার?” ছেলেটি ইমতিয়াজের উদ্দেশ্যে বলল।
তার মানে ছেলেটি ইমতিয়াজকে চেনে! ইমতিয়াজের লোকজন এখনো আসেনি। ছেলেটি যখন ইমতিয়াজকে চেনে তাহলে অবশ্যই জানে ওকে গ্রেফতারের জন্যই এত প্রস্তুতি। তার মানে ছেলেটি কি প্রিপারেশন নিয়ে এসেছে? আশে পাশে কি তার লোকজন আছে! ভয়ের একটা ঠান্ডা স্রোত ইমতিয়াজের আশে পাশে বইল।
সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায় সে শিখেছে কীভাবে ভয় দূর করতে হয়। সে স্বাভাবিক গলায় পালটা প্রশ্ন করল “তুমি আমাকে কীভাবে চেন? আর তুমি নিশ্চয়ই জানো তোমাকে এখনই গ্রেফতার করা হবে।”
ছেলেটি মৃদু হেসে বলল “না স্যার, আমি আজ গ্রেফতার হব না।”
“তুমি এত কনফিডেন্স কীভাবে হয়েছ?”
“আমি ভবিষ্যৎ দেখতে পারি স্যার। বেশিক্ষণ না, এক ঘন্টার ভবিষ্যৎ।”
ইমতিয়াজ নিশ্চিত, ছেলেটি মিথ্যা কথা বলছে। রিয়াজ মনে হয় ইমতিয়াজের মনের কথা বুঝতে পেরেছে। সে বলল “সামনে গাড়ী পার্কিং এ এখন একটা নীল রঙ এর এক্স করোলা আসবে, তার পাশে দুই মিনিট পরে আসবে একটা কালো এলিয়ন......
“এরা সবাই তোমার লোক, সব সাজানো। তোমাকে গ্রেফতার করলেই......... রিয়াজের কথায় বাঁধা দিয়ে ইমতিয়াজ বলল।
“আপনার বাসা থেকে একটা কল আসবে, আপনার মা” কথা শেষ হতে না হতেই ইমতিয়াজের মোবাইলে একটা কল আসল। মা ফোন দিয়েছে। ইমতিয়াজের মুখ হা হয়ে আছে। ফোন রিসিভ করতে করতেই নীল গাড়ীটা পার্কিং করল।
“একটা কথা বলি স্যার? আজ আপনার জন্য খুব ভাল একটা দিন। কালো এলিয়নটাতে মিতু ম্যাডাম আসবেন। উনি আপনাকে দেখে কুপারসে আমার চেয়ারেই বসবেন। আপনি আজ ওনাকে অফার করুন, উনি রাজী হয়ে যাবেন, ওনার বাবাও। এই সুযোগ মিস করবেন না।” ইমতিয়াজ কথা গুলো শুনছিল আর এলিয়নটার দিকে নজর বোলাচ্ছিল। কালো রঙ এর একটা এলিয়ন পার্কিং এর জায়গা খুঁজছে। মাসকট প্লাজার সিকিউরিটি জায়গা করে দিচ্ছে। এলিয়ন থেকে সত্যি সত্যি মিতু নামল। তার মানে ছেলেটি সত্যি সত্যি ভবিষ্যৎ দেখতে পারে! এও কি সম্ভব? কিন্তু বাস্তবতা তো তার চোখের সামনেই। ছেলেটাকে কিছু বলতে গিয়ে দেখে সামনের চেয়ারে কেউ নেই। আশেপাশেও ছেলেটা নেই। এই ফাঁকে চলে গেল! ছেলেটির কথা সত্যি প্রমাণিত করে মিতু তার টেবিলেই তার সামনের চেয়ারে বসে একটা মুচকি হাসি দিল। তার মানে সব সত্যি!
আজ আসলেই মেজর ইমতিয়াজের দিন। আজ এই অপারেশনটায় সফল হতেই হবে।
বিষয়: বিবিধ
১৩৯৮ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তয় ভালো গল্প কিন্তু!
আপনার এ অপারেশনটাতে তো সফল হতে হবে!
মন্তব্য করতে লগইন করুন