ব্যর্থ মানুষের গল্প ৬
লিখেছেন লিখেছেন লালসালু ২৪ মার্চ, ২০১৫, ০৬:৩৩:৪৮ সন্ধ্যা
আল্লামা শফীর ডাকে ঢাকায় আলেম ওলামাদের একটি মহা সমাবেশ হয়ে গেল। সমাবেশ থেকে আলেম ওলামারা নাস্তিকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য কওমী মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষক নিয়ে একটা নতুন ব্যানারের ঘোষনা দিলেন যার নাম দিলেন ‘হেফাজতে ইসলাম’।
ঐ একই দিন সানজিদা জেল থেকে মুক্তি পেল। মঞ্জু এসে সানজিদাকে গ্রামের বাড়ীতে নিয়ে গেল। সানজিদার মুক্তির দুই দিন আগে সাথী মুক্তি পেল। সাথীর মুক্তির দিন তারা দু’জনে গলা জড়াজড়ি করে কেঁদেছিল। সাথী যাবার বেলায় বলেছিল “তোকে ছাড়ছিনা। আমার ভাইয়ার সাথে বিয়ে দিয়ে আজীবনের জন্য জেলখানায় পুরে রেখে দিব।” ইতিমধ্যে সাথী সানজিদাকে তুই তোকারি করে সম্বোধন করা শুরু করেছে। আসলে দুই জন লোক এক মাস একই রুমে থাকলে সম্পর্কটা খুব গভীর হয় যদিও দুই জন একই মানসিকতার হয়ে থাকে। সানজিদার মুক্তির দিন সাথী তার মাকে নিয়ে জেল গেইটে হাজির হল। মঞ্জু সাথীর পরিবারের ব্যবহারে মুগ্ধ হল।
সানজিদার গ্রেফতার হবার খবর প্রথম প্রথম তার মায়ের কাছে গোপনা রাখা হয়েছিল কিন্তু পরে তিনি কীভাবে যেন টের পেয়ে গেলেন। খবর শুনেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এখনো তি৯নি বিছানায় আছেন। সানজিদা যখন বাড়ী ফিরল তখন মাকে জড়িয়ে কান্না শুরু করল। মায়ের অবস্থা খারাপ, ওজন মনে হয় অর্ধেক হয়ে গেছে। চোখ কোটরে বসে গেছে। কথা বার্তা ঠিক মত বলতে পারছেন না। এমনিতেই বাবা মারা যাওয়ার পরে সানজিদার মা অনেকটা ভেঙ্গে পড়েন। তখন থেকেই শরীরটা খারাপ যাচ্ছিল। আর সানজিদার গ্রেফতারের খবরে তিনি শয্যাশায়ী হলেন এবং ওনার মনে হতে লাগল তিনি আর বাঁচবেন না। উনি প্রায়ই মঞ্জুকে বলতে লাগলেন “বেশিদিন মনে হয় আর বাঁচব না বাবা। সানজিদার বিয়েটা দিয়ে যেতে পারলে ভাল হত। তুই ছেলে মানুষ, সমস্যা হবে না কিন্তু সানজিদার কী হবে?” মঞ্জুও সিরিয়াস হয়ে পড়ল। মায়ের অবস্থা দেখেও শঙ্কিত হল। মায়ের যে অবস্থা তাতে কখন যে কী হয়! ওদের আর্থিক অবস্থা ভাল না। এছাড়া সানজিদা ভাল কোথাও চান্স পায় নি। সানজিদার বিয়ে হলে লেখাপড়ার তেমন কোন ক্ষতি হবে না। সানজিদা যদি মেডিকেলে চান্স পেত তাহলে মঞ্জু জীবনেও সানজিদার বিয়ের কথা ভাবত না। সানজিদার বিয়ের কথা ভাবতেই মঞ্জুর মনে হল শাহেদের কথা। বেচারা সানজিদাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। সানজিদাকে শাহেদ যে বাসায় দেখেছিল তা মঞ্জুর জানা ছিল না। (দ্বিতীয় পর্বে)। মঞ্জু জানে তার বোন অনেক সুন্দরী। সানজিদাকে শাহেদের ইউনিভার্সিটিতে পাঠিয়েছিল, সেখানে শাহেদ সানজিদার হাত আর চোখ দেখেছিল, কারণ সে হিজাব নেকাব মেইন্টেইন করে। মঞ্জু ভেবেছে শাহেদ হয়তো সানজিদার ব্যক্তিত্বের জন্য পছন্দ করেছিল তাই বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। শাহেস যে সানজিদার রুপ দেখে প্রথমে পাগল হয়েছিল তা মঞ্জু জানত না। তবে শাহেদের সাথে তার বোনের বিয়ে হলে ভালই হত কারণ তিনটি এক, শাহেদকে সে ছোট কাল থেকে চেনে, শাহেদ ভাল ছেলে। দুই, তাদের ছোট ফ্যামিলী, ছোট ফ্যামিলীতে বউরা শান্তিতে থাকে আর তিন, শাহেদদের আর্থিক অবস্থা ভাল। বোনের আর্থিক নিরাপত্তার কথা যে কোন ভাই ই ভাবে। শাহেদের পক্ষে সানজিদার জন্য বিয়ের প্রস্তাব শুনে মঞ্জু যেমন অবাক হয়েছিল তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছিল সানজিদার ঐ বিয়ের প্রস্তাব নাকচ করার জন্য। এমন ছেলেকে কি কেই মানা করে? যেখানে শাহেদকে ওদের পরিবার ছেলেবেলা থেকেই চিনে। ভাবছে এক বার সানজিদার সাথে এ বিষয়ে কথা বলবে। আবার ভাবে, নাহ যা হবার হয়েছে। এ নিয়ে আলোচনার কিছু নেই। কী কারণে সে বিয়েতে রাজী হয় নি সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যপার। প্রত্যেক মানুষেরই বিয়ের ব্যপারে স্বাধীনতা থাকা উচিৎ কারণ সংসারটা সে করবে।
হেফাজতের মহা সমাবেশের দিনেই সাথীর ভাই ডাক্তার আতিকের বিদেশে স্কলারশিপ কনফার্ম হয়। দুই মাসের মধ্যে তাকে ইংল্যান্ডে যেতে হবে। আতিকের মা বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন এই সময়ের মধ্যেই আতিকের বিয়ে দিবেন। আতিকের বিয়ের কথা বাসায় আলোচনা হতেই সাথী সানজিদার প্রসংগ আনল। সাথীর কাছে সানজিদার প্রশংসা শুনে আতিকের মায়ের ইচ্ছা হল সানজিদাকে দেখার। সমস্যা হল সানজিদাকে তার মা ঢাকায় আসতে দিচ্ছিল না। ঢাকায় গেলে আবার কোন বিপদ না হয়। এছাড়া সানজিদা দেখল তার মাকে এই অবস্থায় রেখে ঢাকায় যাওয়াটাও বোকামী। ঢাকায় থাকলে না হয় আতিকের মা সানজিদাকে কোন এক উছিলায় দেখে আসত। এখন যদি গ্রামে গিয়ে দেখে আসতে হয় তাহলে তো আনুষ্ঠানিকভাবে দেখে আসতে হবে। দেখে আসার জন্য আগে প্রস্তাব দিতে হবে। জেল গেইটে সাথী মঞ্জুর ফোন নম্বর রেখে দিয়েছিল। মঞ্জুর মা মঞ্জুকে ফোন দিলেন। মঞ্জু ফোন পেয়ে লজ্জিত হল এই কারনে তারই আগে ফোন দেয়া উচিৎ ছিল। কারণ তার বোন প্রায় মাস খানেক সাথীর সাথে একই সাথে জেলে ছিল। জেলে থাকা অবস্থায় সাথী সানজিদাকে সঙ্গ দিয়েছিল যা অনেক কাজে লেগেছে। আতিকের মা অনেকক্ষন মঞ্জুর সাথে কথা বলল। ফোন শেষে মঞ্জু বুঝল তারা পরোক্ষভাবে বোঝাতে চাইছে সানজিদাকে তারা দেখতে চায়। যদিও কথাটা সরাসরি বলেনি। মঞ্জুও সরাসরি উত্তর দেয় নি। ফোন রেখে মঞ্জু অনেকক্ষন ভাবে, আতিক সম্মন্ধে যা শুনেছে তাতে মনে হল ছেলেটা ভালই হবে। ডাক্তারী পাশ করে এখন উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে যাচ্ছে। ওদের পরিবার ইসলামিক মাইন্ডের যা সানজিদার জন্য ভাল। কারণ সানজিদাও একই মেন্টালিটির যদিও মঞ্জু সানজিদার পছন্দের সংগঠনকে পছন্দ করে না। মাঝে মাঝে ওর সাথে তর্ক করে। সেটাও তার ব্যক্তিগত ব্যপার। একই মেন্টালিটির দুই জন সংসার করলে ভালই হবে। এখন সানজিদা রাজী হলেই হল। মঞ্জুর কেন যেন মনে হল সানজিদা রাজী হবে কারণ ছোট কাল থেকে তার স্বপ্ন ডাক্তার হওয়া, বাবার স্বপ্নও এটা ছিল। নিজে ডাক্তার না হলেও ডাক্তার স্বামী পেলে হয়তো আফসোস কিছুটা কম হবে। এছাড়া শাহেদের ক্ষেত্রে মাও তেমন জোরাজোরি করেন নি কিন্তু এখন মায়ের যে অবস্থা তাতে মা জোর করে সানজিদাকে রাজী করাবেন। মঞ্জু মায়ের সাথে কথা বলে। মা শুনে একই সাথে খুশী ও অবাক হন- আমাদের মত গরিব ফ্যামিলী থেকে ওরা মেয়ে নিবে? মঞ্জু আতিকের মাকে ফোন করে “খালাম্মা আমাদের গরিবালয়ে একদিন বেড়াতে আসেন। খুব খুশি হব।” উদ্দেশ্য- আতিকের মায়ের সাথে মঞ্জুর মায়ের পরিচয় করিয়ে দেয়া এবং সানজিদাকে তারা যেন দেখে যেতে পারে। সব আনফিসিয়ালী করা হবে। ঘটা করে পাত্রী দেখলে যেভাবে হয় ঠিক সেভাবে দেখানো যাবে না। ভাবটা এমন যেন সাথীর মা তার মেয়ের সাথে এক মাস জেলে ছিল যেই মেয়ে সেই মেয়েকে দেখতে এসেছেন! কিন্তু ‘আনফিসিয়ালী পাত্রী দেখা’ অফিসিয়াল দিকে মোড় নিল যখন আতিকের মা এসে সানজিদার আঙ্গুলে আংটি পরিয়ে দিলেন। সাথী সানজিদাকে একা পেয়ে আতিকের ছবি দেখাল। আতিকের চেহারা সুন্দর, এছাড়া ডাক্তার মানুষ। সে তার পছন্দের ছেলেকে পেতে যাচ্ছে। সানজিদাও আংটি হাতে পেয়ে খুশী।
সানজিদাকে যখন আতিকের মা আংটি পরিয়ে দিচ্ছিল ঠিক সেই সময়ে শাহেদের ইউনিভার্সিটিতে ভিসি স্যারের রুমে ঘটছিল অন্য ঘটনা। ভিসি স্যার এমনিতেই বদ রাগী মানুষ। আজ শীতল চোখে শাহেদের দিকে চেয়ে রয়েছেন।
“তুমি নাকি আজকাল শাহবাগ বিরোধী প্রোগ্রামে যাচ্ছ?”
“জ্বী স্যার”
“চাকরির মায়া কি আছে?”
শাহেদ ভিসির কথায় শিউরে ওঠে। কী বলে? একটা আদর্শকে পছন্দ করলেই কি চাকরি চলে যাবে?
ভিসি স্যার বললেন “তোমার দেখা দেখি ইউনিভার্সিটির অনেকেই শাহবাগে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এমনকি অনেকে শাহবাগ বিরোধী মিছিলে যাচ্ছে। ক্যম্পাসে যে গণজাগরন মঞ্চ আছে তাতে এখন ছাত্ররা বসে না। অথচ গত সপ্তাহেও এখানে লোক যায়গা দেয়া যেত না।”
শাহেদ “এটা সারা বাংলাদেশের অবস্থা স্যার।”
কথাটা সত্যি হলেও ভিসি স্যারের গায়ে কাঁটা হয়ে বিঁধল “এত কিছু বুঝি না চাকরি বাঁচাতে চাইলে কালই শাহবাগে গিয়ে বক্তৃতা দিবে। আমি তোমাক আবারো মঞ্চে ওঠানোর ব্যবস্থা করে দিব।” বাইরে শাহবাগ বিরোধী মিছিল যাচ্ছে, শ্লোগান শুনে ভিসি স্যারের রাগ আরো বেড়ে গেল। হৈ চৈ হট্টগোল শোনা গেল। জানাল দিয়ে ভিসি স্যার দেখলেন মিছিল কারীরা গণ জাগরন মঞ্চ পুড়িয়ে দিয়েছে। তাতে তার ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা উৎসাহ দিচ্ছে।
শাহেদ “আপনি সত্যকে চাপা দিয়ে রাখতে পারবেন না স্যার।”
বিশ্বাবিদ্যালয়ের এক পরিচালকের রুমে ডাক পড়ল। বয়স্ক এই ভদ্রলোক শাহেদকে বললেন “তোমার কারনে আমাদের ইউনিভার্সিটি সরকারের রোষানলে পড়ুক তুমি কি চাও? হয় তুমি শাহবাগের পক্ষে কথা বল নইলে………….”
শাহেদ রিজাইন লেটার সাবমিট করে ইউনিভার্সিটি থেকে রিয়ে আসল। রাস্তা দিয়ে আরেকটা শাহবাগ বিরোধী মিছিল যাচ্ছিল, শাহেদ সেই মিছিলে যোগ দিল।
এ দিকে সানজিদার সাথে আতিকের বিয়ে দিন তারিখও ঠিক হয়ে গেছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল আতিক ও সানজিদা কেউ কেউকে দেখেনি। আতিকের ছবি সানজিদা দেখেছে কিন্তু সানজিদার ছবিও আতিক দেখেনি। বোন আর মায়ের মুখ থেকেই যা শুনেছে। যেহেতু আতিক ইংল্যান্ডে যাবে তাই তারা দ্রতু বিয়ের আয়োজন করার তাগাদা দিল। বিয়ের দিন তারিখ নিয়ে আলোচনার জন্য আতিকের বাবা এবার অফিসিয়ালী সানজিদাদের বাড়ী গেল।
চাকরি ছেড়ে দিয়ে শাহেদ একা হয়ে গেল। আগে ক্লাস করাতে গিয়ে সময় কাটত এখন আর সময় কাটে না। মাত্র দুই দিনেই সে হাঁপিয়ে উঠল। মাঝে মাঝে মনে হয় চাকরি ছেড়ে দিয়ে যে ভুল করেছে আবার মনে হয় সানজিদা যে আদর্শকে ঘৃণা করে সে কীভাবে সেই আদর্শ মেনে নেয়! সানজিদার খবর নেয়ার জন্য মঞ্জুকে ফোন দিতে ইচ্ছে করে কিন্তু লজ্জায় ফোন দেয় না। সানজিদাকে কি আবার প্রস্তাব দিয়ে দেখবে? তখন রাজী হয় নি তো কী হয়েছে? এখন তো রাজী হতে পারে! এইসব ভাবনা ভাবতে ভাবতে হঠাত একদিন মঞ্জুর ফোন পায় “দোস্ত আগামী ৫ই মে সানজিদার বিয়ে। তোর দাওয়াত রইল।”
শাহেদকে সানজিদার বিয়ের দাওয়াত দিতে মঞ্জুর খুবই খারাপ লেগেছিল। কিন্তু সম্পর্কটা এমনই যে বিয়ের দাওয়াত না দিলে কেমন হবে? জানে শাহেদ জীবনেও এই বিয়েতে আসবে না কারণ শাহেদ নিজেই চেয়েছিল সানজিদাকে বিয়ে করতে। কিন্তু মঞ্জুর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হিসেবে শাহেদকে বিয়ের দাওয়াত না দিলে নিজেকে অপরাধী মনে হবে। এছাড়া বিয়ের খবরের মাধ্যমে শাহেদকে জানিয়ে দিতে চাইছে “সানজিদার জন্য অপেক্ষা করে লাভ হবে না। তুমি অন্য দিকে দেখ।”
সানজিদার বিয়ের খবর শুনে শাহেদের মাথায় বাজ পড়ল। যে আশাটুকু শাহেদের মনে ছিল তাও নিভে গেল। পাত্রের যে খবর মঞ্জু দিল তাতে সানজিদা ভাল পাত্র পেয়েছে। মঞ্জু এখন বেকার, এছাড়া সব দিক দিয়ে আতিকের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা সানজিদা ঐ বিয়েতে রাজী হয়েছে। রাতে শাহেদ ভাত খেল না। খাবে কী করে? গলা দিয়ে খাবার নামবে না। সারা রাত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে কান্না কাটি করল। ওই মুহূর্তে মনে হল সৃষ্টি কর্তা তার কথা শুনছেন। ফজরের নামায মসজিদে গিয়ে পড়ল। মসজিদে যাবার সময় দেখল কারা যেন পোষ্টার লাগাচ্ছে। নামায শেষে মসজিদ থেকে বের হয়ে সেই পোষ্টার চোখে পড়ল।
“আগামী ৫ই মে হেফাজতে ইসলামের উদ্যোগে ঢাকা অবরোধ”
৫ই মে তারিখ দেখে শাহেদের কষ্ট আরো বেড়ে গেল। ঐ দিনই সানজিদার বিয়ে হবে। তার যে আশা ছিল তা শেষ হয়ে যাবে।
শেষ পর্ব
সানজিদা অন্যের হবে এটা শাহেদ ভাবতেই পারছে না। একবার ভাবে “সানজিদাকে ফোন করি” আবার ভাবে “নাহ বিয়ে তো ঠিকই হয়ে গেছে। এখন ফোন করলে শুধু জটিলতা বাড়বে। সবচেয়ে বড় কথা সানজিদার অমতে নিশ্চয়ই বিয়ে হচ্ছে না। এছাড়া সানজিদা হচ্ছে শাহেদের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর বোন। ফোন করলে মঞ্জু জানলে কী রকম দেখাবে?”
শাহেদ দিনের পর দিন রুমে শুয়ে বসে কাটায়। মা ব্যপারটা টের পায়। তিনি শাহেদের সাথে কথা বলেন। শাহেদের মা শাহেদের বাবার সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করে। শাহেদের বাবা এবার একটু সিরিয়াস হলেন।
আগের পর্বে বলেছিলাম মঞ্জুর মনে শান্তি নেই। সে ডাক্তার আতিকের স্থানে শাহেদকে দেখতে চেয়েছিল। সে সিদ্ধান্ত নেয় শাহেদের বিষয়টা নিয়ে একদিন সানজিদার সাথে আলাপ করবে। সময় কম, দ্রুত কথা বলতে হবে।
২০১৩ সালের ৫ ই মে। ফজরের নামাজের এক ঘন্টা আগে ঢাকার বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে হাজার হাজার ছাত্র বের হতে লাগল। কেউ যাচ্ছে গাবতলীর দিকে, কেউ যাচ্ছে উত্তরা আব্দুল্লাহপুরের দিকে কেউ যাত্রাবাড়ী কাঁচপুর ব্রীজের দিকে। উদ্দেশ্য ঢাকা শহর অবরোধ করা। তাদের নেতা আল্লামা শফীর তের দফা দাবী আদায়ের লক্ষ্যে এই আবরোধ। শাহেদ গেল গাবতলীর দিকে। গাবতলীর যেদিকেই তাকায় সেদিকেই হাজার হাজার মানুষ। সবার মাথায় টুপি পোষাক একই। শাহেদ সানজিদার কথা ভুলে গেল।
সারা দিন গাবতলীতে অবস্থান করার পর তাদের নেতাদের নির্দেশে সকলে মতিঝিল শাপলা চত্বরের দিকে রওনা হল। শাপলা চত্বরে লাখো মানুষের ভীড়। সবাই তাদের নেতা আল্লামা শফীর অপেক্ষা করছে। শফী সাহেব তখন লালবাগ মাদ্রাসায় অপেক্ষা করছিলেন। মতিঝিলে সমাবেশ চলছে আর সমাবেশের পেছনে পল্টনে পুলিশ র্যাব মুহুর্মুহু গুলি করছে। শাহেদ শঙ্কিত হল। গুলি করে ওরা সামনে এগোচ্ছে না কিন্তু গুলির মানে হল হুজুররা যেন দ্রুত শাপলা চত্বর ছেড়ে দেয়। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে গেল অথচ আল্লাম শফী এলেন না। শোনা গেল ওনাকে নাকি পুলিশ আসতে দিচ্ছে না। চারিদিকে হাজার হাজার পুলিশ র্যাব বিডিআর অবস্থান নিয়েছে। পরিস্থিতি যেকোন দিকে মোড় নিতে পারে। জনতা রাজপথ ছাড়বে না। শাহেদও তাদের সাথে ছিল। শাহেদ না খেয়ে ভোরে বাসা থেকে বের হয়েছিল। সারাদিনে পানি ছাড়া আর কিছু খায় নি। অনেক রাস্তা হেঁটেছে আজ, ক্ষিদেও লেগেছে। কিন্তু খাওয়ার উপায় নেই। রাত দশটা বাজে। এতক্ষনে মনে হয় সানজিদার বিয়ে হয়ে গেছে। বর যাত্রী হয়তো বউকে নিয়ে চট্টগ্রামের পথে রওনা দিয়েছে। আশেপাশে অনেক লোক রাস্তায় শুয়ে আছে, শাহেদও শুয়ে পড়ল। খুব ইচ্ছে হল সানজিদার সাথে কথা বলার। কিন্তু কীভাবে সম্ভব? একবার ভাবে মঞ্জুকে ফোন দিবে। মঞ্জুকে ফোন দেয়ার উদ্দেশ্যে ফোন বের করতেই দেখল অনেক গুলো মিসড কল!
মঞ্জুরই এগারোটা মিসড কল শো করছে। এর মধ্যে চার টাই মঞ্জুর! মঞ্জু আবার এ সময় ফোন করতে যাবে কেন? নাকি মনে হয় বোনকে বিদায় দেয়ার পরে মন খারাপ লাগছে তাই ফোন করেছে। অথবা শাপলা চত্বরের অবস্থা জানতে ফোন করেছে। শাহেদ কল ব্যাক করল কিন্তু নেটওয়ার্ক বিজি দেখাচ্ছে। অনেক ক্ষন চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। সম্ভবত এই এলাকার নেটওয়ার্কে কোন সমস্যা হয়েছে। হঠাত করে মনে হল হয়তো সরকার এই এলাকার নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দিয়েছে! শাহেদ নটরডেম কলেজের দিকে এগোতে থাকল। এদিকে মনে হয় নেটওয়ার্ক আছে, দুই একজন লোক ফোনে কথা বলছে। মঞ্জুর মোবাইলে কল গেল, রিং টোন শোনা যাচ্ছে। মঞ্জু কল রিসিভ করতেই জানতে চাইল “দোস্ত শাপলা চত্বরের খবর কী?”
শাহেদ উত্তর দিল কিন্তু হৈচৈ শোরগোলে কিছু শোনা যাচ্ছে না। মঞ্জুর কথাও শাহেদ শুনতে পাচ্ছিল না। হঠাত একটা শব্দ শুনল ‘সানজিদা’ আর কিছু বোঝা গেল না। শাহেদ কিছু বলতে গেল এমন সময় ফকিরাপুল মোড় থেকে প্রচন্ড গুলির শব্দ শুরু হল। গুলি এদিকেই করছে, দুই একজন লোকি মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। চারিদিকে আগুনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, বারুদের গন্ধ। ম্যাসাকার শুরু হয়েছে। শাহেদের কাঁধে গুলি লাগল। জ্ঞান হারাল শাহেদ।
শাহেদের জ্ঞান যখন ফিরল তখন খেয়াল করল সে হাসপাতালে। তার পাশে বাবা মা মঞ্জু সবাই অপেক্ষা করছে। ওর জ্ঞান ফেরাটা সকলের জন্যে জরুরী ছিল মনে হচ্ছে কারণ সে চোখ মেলে তাকাতেই সবাই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
মা শাহেদকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন, বাবার চোখেও পানি দেখা গেল। মঞ্জুও চোখ মুছুছে। শাপলা চত্বরে গুলি খেয়ে আহত হবার পরে কে যেন তাকে কমলাপুরে একটা ক্লিনিকের সামনে রেখে যায়। ক্লিনিকের লোকজন শাহেদকে ক্লিনিকে নিয়ে যায়, শাহেদের মোবাইলের মাধ্যমে তারা শাহেদের বাবা মাকে খবর দেয়। সেই ক্লিনিকের পরিচালক শাহেদের বাবার পরিচিত ডাক্তার ছিলেন। তিনি শাহেদের মোবাইল থেকে শাহেদের বাবার নম্বর বের করে কল দিতে গিয়ে দেখেন নম্বরটি তার মোবাইলেই সেইভ করা ছিল। শাহেদের প্রচুর রক্তক্ষরন হয়। কয়েক ব্যাগ রক্ত দিতে হয়েছিল। তিন দিন পরে শাহেদের জ্ঞান ফেরে। জ্ঞান ফিরে পরিচিত লোকদের দেখে।
মায়ের কান্না শেষ হলে মা বলেন “তুই কেন মরতে গিয়েছিলি? তুই যা চেয়েছিস তাই তো পেয়েছিস!”
শাহেদ অবাক হল! সে কী এমন চেয়েছে যা সে পেয়েছে।
মঞ্জু যেদিন সানজিদার সাথে শাহেদের বিষয়ে কথা বলে সেদিনই সানজিদা শাহেদের পরিবর্তনের কথা জানতে পারে। শাহেদ শাহবাগে যাওয়া ছেড়ে দিয়ে নামাজ ধরেছে। নাস্তিকদের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য চাকরিও ছেড়ে দিয়েছে তবুও আপোষ করেনি। সানজিদা জেলে যাওয়ার পরদিন থেকেই শাহেদের এই পরিবর্তন। এ সবের পেছনে সানজিদার অবদান রয়েছে। সানজিদা বিষয়টা নিয়ে ভাবল। একবার সে হাতের আংটির দিকে তাকায় আরেকবার শাহেদের কথা ভাবে।
এর মধ্যে শাহেদের বাবা ডাক্তার সাহেব এক দিন গোপনে শাহেদকে না জানিয়ে সানজিদাদের গ্রামের বাড়ীতে চলে গেল। ডাক্তার সাহেব প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যেভাবেই হোক সানজিদাকে ঘরের বউ বানাবেন। সানজিদার মা শাহেদের বাবার সব কথা শুনলেন কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না। তিনি শাহেদের বাবাকে জানালেন সানজিদা তো এঙ্গেজড! শাহেদের বাবা মঞ্জুকেও অনেক বোঝালেন। মঞ্জুও কোন কথা দিতে পারল না কারণ জীবনটা সানজিদার। সিদ্ধান্ত সেই নিবে। সানজিদা পর্দার আড়াল থেকে সব শুনল। তার মনে ঝড় বইতে লাগল। সানজিদা দিন রাত ভাবে। সে কাকে বেছে নিবে? আতিককে নাকি শাহেদকে? শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয় শাহেদই তার জন্য ভাল হবে। এছাড়া পরিবারের অন্য সদস্যরা শাহেদের পক্ষে। শাহেদের বাবার কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়ে সানজিদার মা আতিকের মায়ের কাছে কিছু দিনের জন্য সময় চায় অর্থাৎ বিয়ের দিন তারিখ পিছিয়ে যায়। ৫ ই মে সানজিদার পরিবারের পক্ষ থেকে শাহেদের পরিবারকে বিয়ের প্রস্তাবের ব্যপারে রেজাল্ট জানায়।
ঠিক এক মাস পরে শাহেদ সানজিদার বিয়ে হয়।
বিষয়: বিবিধ
১৮৭৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন