কর্পোরেট মাওলানা

লিখেছেন লিখেছেন লালসালু ২৩ নভেম্বর, ২০১৪, ০৬:৫৮:৪৯ সন্ধ্যা

১) ভদ্রলোকেরসাথে প্রথম দেখা আমি যখন ফ্যান্টাসী কিংডমের পাশে একটা ফ্যাক্টরিতে চাকরি করতাম।আমরা মার্চেন্ডাইজিং রুমে ছয় জন মার্চেন্ডাইজার বসতাম। সেই রুমে তিনি এলেন। চেহারাদেখে মনে হয় কোন মসজিদের ঈমাম সাহেব। লম্বা দাঁড়ি, মাথায় টুপি, গায়ে জোব্বা, হাতেতসবীহ। ওনাকে এই রুমের চেয়ে বেশি মানাবে কোন মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে খোতবা দিলে। উনিএসে আমাদের সামনের একটা চেয়ারে বসলেন। উনি এসেছেন আমাদের ডিএমডি স্যারের কাছে।স্যার এখনো অফিসে পৌঁছেনি তাই এই রুমে বসে অপেক্ষা করবেন। আমাদেরকে ওনার ভিজিটিংকার্ড দিলেন। কার্ড পেয়ে তো আমাদের চোখ ছানাবড়া! উনি গার্মেন্টস সেক্টরের একজনবিখ্যাত লোক- মোঃ হেমায়েত হোসেন! বাংলাদেশের প্রথম দশটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির নামবললে একটার নাম চলে আসবে ‘পাইওনিয়ার গ্রুপ’ হেমায়েন হোসেন সাহেব এই পাইওনিয়ারগ্রুপের ডিএমডি। আজ থেকে পাঁচ বছর আগেই বেতন পেতেন পাঁচ লাখের উপরে। এখন কত জানিনা। সাথে গাড়ীর সুবিধা তো ছিলই।

যে কোন ব্যবসায়ীতার প্রতিষ্ঠান চালাতে সর্বোচ্চ পদে যোগ্য লোককেই বসান। আর যত বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানতত বড় কর্পোরেট ম্যানেজারের ডিমান্ড। তা যদি দেশ সেরা কোন গ্রুপ হয় তাহলে তো সেইগ্রুপে দেশ সেরা কর্পোরেট ম্যানেজারকে নিয়োগ দেয়া হবে। আমাদের সমাজে দাঁড়িটুপিওয়ালা লোক দেখলেই আমরা নাম সিঁটকাই। ভাবি এই লোক বেশি লেখাপড়া জানে না আরজানলেও তা আরবী লাইনে অথবা ইসলামিক লাইনে অথচ খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে অনেকেরইজেনারেল লাইনে উচ্চশিক্ষা আছে। হেমায়েত হোসেন সাহেবের চেহারা দেখে মসজিদের ঈমামমনে হলেও ওনার শিক্ষাগত যোগ্যতা শুনে আমরা অবাক হলাম। উনি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার,এরপরে তিনটা এমবিএ ডিগ্রী আছে। তাও বাংলাদেশ থেকে নয় আমেরিকা ও কানাডা থেকে!

ভদ্রলোক আমাদেরসাথে এক ঘন্টা ছিলেন। ওনার মত বিখ্যাত একজন লোক পেয়ে আমরা ধন্য। উনি আমাকে একটাকাগজ দিতে বললেন। আমি কাগজ দিলাম। তিনি সেই কাগজে একটা দোয়া লিখলেন ও সবাইকেদোয়াটা মুখস্ত করতে বললেন। দশ মিনিটে সবাই দোয়া মুখস্ত করলাম। এরপর আরেকটা দোয়া,এরপরে আরেকটা। এক ঘন্টায় আমাদেরকে তিনটা ছোট দোয়া শিখালেন, কাজের মধ্যে কীভাবে জিকিরকরতে হয় তা শিখালেন। এরপরে ডিএমডি স্যারের সাথে দেখা করে চলে গেলেন। ওনার অফিসেআমার এক কলিগ জয়েন করল। সেই কলিগ জানাল ওনার অফিসের সবাইকে তিনি সূরা, দোয়া,শেখান। যাদের এমবিএ ডিগ্রী নাই তাদেরকে জোর করে এমবিএ করান। গার্মেন্টস সেক্টরেওনার এতই ডিমান্ড যে উনি চাইলেই যে কোন গ্রুপে পনের লক্ষ টাকা বেতনে চাকরি নিতেপারেন।

২) আমি ভেবেছিলামরুবাবা দৌলা মতিনের দেশে এরকম কর্পোরেট মাওলানা আর নেই। কিন্তু পরে আমি একের পর এককর্পোরেট মাওলানা দেখলাম। মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত এসব লোকের চেহারা দেখে মনে হয়না ওনারা এত বড় পদে ও স্যালারিতে চাকরি করেন। এদের মধ্যে একজনকে দেখলাম বসুন্ধরাসিটির সামনে সুবাস্ত টাওয়ারের এক কর্পোরেট অফিসে। ঐ অফিসে আমি একটা কাজেগিয়েছিলাম। পৌঁছুতে পৌঁছুতে জোহরের নামাজ শুরু হল। ঐ অফিসে ঢুকে দেখি সবাই জামাতেনামাজ পড়ছেন। আমিও অযু করে নামাজে দাঁড়ালাম। নামায শেষে ঈমাম সাহেব হাদীস নিয়েআলোচনা করলেন। আমার সাথে যার কাজ তার সাথে দেখা করলাম। আমি গিয়েছিলাম কাপড় কিনতে।কাপড়ের দাম আরেকটু কমানোর দাবী করলে তিনি বললেন “দাঁড়ান, আমি ইডি স্যারের কাছ থেকেঅনুমতি নিয়ে আসি” ইডি স্যারের রুম থেকে বের হয়ে বললেন “স্যারের সাথে দেখা করেন,অনুরোধ করলে দাম কমাতেও পারে”। ইডি স্যারের রুমে ঢুকলাম, দেখি সেই ঈমাম সাহেব! এইকোম্পানীর মালিক হল্যান্ডের। হল্যান্ডের মালিক পক্ষের একজন ‘ডাচ’ পরিচালক আর উনিএকই রুমে বসেন। ‘ডাচ’ লোকটি হয় নাস্তিক অথবা খৃস্টান কিন্তু ইডি স্যার ১০০% হুজুর।ওনার রুমে কোরআনের বিভিন্ন তাফসীর, হাদীসের বই দেখলাম। রুম থেকে বের হয়ে শুনি উনিসাড়ে তিন লাখ টাকা বেতন পান। কিছুদিন পরে মালিক নাকি ওনাকে কোম্পানীর একটা শেয়ারওদিবেন শুনেছিলাম। এটাও ছয় বছর আগের ঘটনা।

৩)বারিধারাডিওএইচএস হল বায়িং হাউজের এলাকা। এখানকার এক ব্রিটিশ মালিকানাধীন বায়িং হাউজে গিয়েভাবলাম কোন মাদ্রাসায় ভুলে চলে এসেছি। এখানকার সব স্টাফেরই দাঁড়ি টুপি।

৪) আপনারা যারাগাড়ী কিনেন বা প্রাইভেট কারে চড়েন তাদের নিশ্চয়ই ‘সালসাবিলস কারের’ নাম শুনেছেন।বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এই গাড়ীর দোকানে গেলে মনে হবে এটাও একটা মাদ্রাসা।ম্যানেজার, ক্যাশিয়ার, দারোয়ান, পিয়ন সবাই হুজুর। সালবালিস কারের মালিক সালসাবিলএরশাদের আমলে জাতীয় পার্টির এমপি ছিলেন।

৫) আপনারাস্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই। সেই ফ্যাক্টরি যাদের কোনাবাড়ীরবিল্ডিং এ আগুন ধরেছিল। প্রধানমন্ত্রী সেই বিল্ডিং দেখতে যান এবং কান্নারত বৃদ্ধফ্যাক্টরির মালিককে জড়িয়ে ধরে স্বান্তনা দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী যেখানে গিয়েছেনতখন বুঝবেন সেই লোকের কত পাওয়ার! আপনি যদি ওনাদের অফিসে যান তাহলে অবাক হবেন। ওনারঅফিসের তিন চার জন পরিচালক যাদের প্রত্যেকেই উচ্চ শিক্ষিত এবং সাবেক সেনাকর্মকর্তা তাদের চেহারা দেখলে মনে হবে এই মাত্র কোন মসজিদের ঈমামতি করে এসেছেন। অথচযোগ্যতায় তারা কোন অংশে কম নয়।

এরকম আরো হাজারোউদাহরন আছে যা জানাতে অনেক সময় লাগবে।এই পোষ্ট দেয়ার উদ্দেশ্য হল আমরা কর্পোরেট অফিসারবা ম্যানেজার বলতে বুঝি ক্লীন শেইভ করা স্যুটেড বুটেড স্মার্ট ছেলে এবং শরীরদেখানো স্টাইলে শাড়ী পরা মহিলা। মূলত টিভিতে ওনাদেরকেই দেখানো হয়। কিন্তুবাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গেলে দেখতে পাবেন বাস্তবতা কী!

আমার এই পোষ্টেবিভিন্ন ইসলামী ব্যাঙ্ক, ইসলামী বীমা, ইসলামী স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বাদদিয়েছি। সেসব স্থানে তো পুরাই হুজুর আর হুজুর।

বিষয়: সাহিত্য

১৩৮৮ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

287307
২৩ নভেম্বর ২০১৪ রাত ০৯:৩৭
নাবিলা লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ পিলাচ
287325
২৩ নভেম্বর ২০১৪ রাত ১০:২৯
শেখের পোলা লিখেছেন : সুবহানাল্লাহ! আলহামদুু লিল্লাহ!
287345
২৩ নভেম্বর ২০১৪ রাত ১১:১৫
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : সত্যি ঘটনা তবে এনারা এখনও সংখ্যালঘু এই সেক্টরে। বিশেষ করে দেশিয় কিছু গ্রুপ দাড়ি দেখলেই তাবে আনস্মার্ট বিশেষন দিয়ে দেয়। আমি উচ্চ দক্ষ একজন প্রকেীশলিকে জানি যিনি দাড়ি থাকায় দেশিয় একটি কোম্পানিতে চাকরি পাননি। অথচ সিমেন্স এর মত প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। তথাকথিত স্মার্টনেস কে এখনও আমরা হারাতে পারিনি।
287373
২৪ নভেম্বর ২০১৪ রাত ১২:২৯
আফরা লিখেছেন : পড়ে খুবই ভাল লাগল ,শেয়ারের জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে ।
287402
২৪ নভেম্বর ২০১৪ রাত ০৪:৩৬
কাহাফ লিখেছেন :

আপনার সুন্দর উপস্হাপনা হুজুর লেবাসী ব্যক্তি সম্পর্কে সাধারণ নেতিবাচক ধারণা কে কিছুটা হলেও দূর করবে! অনেক ধন্যবাদ ও জাযাকাল্লাহ জানাই!!! Thumbs Up Thumbs Up Big Hug Big Hug
288201
২৬ নভেম্বর ২০১৪ সকাল ১১:১১
311018
২৫ মার্চ ২০১৫ সকাল ১১:৫০
দ্য স্লেভ লিখেছেন : পাইওনিয়ার গ্রুপের হেমায়েত সাহেবের সাথে আমার সুসম্পর্ক ছিল একসময়। আমি তুরষ্কের একটা কোম্পানীর বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে দেড় বছর কাজ করেছিলাম। ওদেরকে আমরা সুয়েটারের অর্ডার দিয়েছিলাম। উনি সাংঘাতিক দারুন মানুষ। সেসময় উত্তরাতে থাকতেন। আর স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের হুজুর টাইপ ডিরেক্টর আমাদের পাশের ফ্লাটে থাকতেন। তাদের সাথে পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। উনি অত্যন্ত বিনয়ী,ধার্মিক মানুষ। আর আমি বহু ফ্যাক্টরীর চেয়ারম্যান,এম.ডির সাথে পরিচিত ছিলাম ,সেসময় দেখেছি অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিক খুবই ধার্মিক।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File