ব্যর্থ মানুষের গল্প ১
লিখেছেন লিখেছেন লালসালু ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৪:৫৪:৫৬ বিকাল
ব্যর্থ মানুষের গল্প ১
“তাই বলে একটা সিএনজি ড্রাইভারের বোনকে বিয়ে করবি? আমার মান সম্মান কোথায় থাকবে একটু ভেবে দেখেছিস?” মা খুব রেগে গেছেন। এই মুহূর্তে কথা না বাড়ানোই ভাল। তবুও মিনমিনে গলায় শাহেদ বলল “এই যুগে এমন মেয়ে পাওয়া যায় না মা। তুমি সারা জীবন ছেলের জন্য অসাধারন রূপবতী ভদ্র মেয়ে বৌ হিসেবে চেয়েছ। এই মেয়ের মধ্যে দু’টো গুণই রয়েছে।” বলেই মনে হল শাহেদের ভুল হয়েছে। রূপ তো কোন মেয়ের গুণ হতে পারে না। এটা আল্লাহর দান। মানুষের এতে কোন হাত নেই। তবে মেয়েটা যে ভদ্র সেটা তার গুণ।
মা “শুধু রূপ দেখলেই হবে না, ফ্যামিলি, শিক্ষা সব দেখতে হবে। বিয়েটা ছেলে খেলা না।”
শাহেদ “ওদের ফ্যামিলি, শিক্ষা দীক্ষা সব তুমি জান। ওরা তো আর তোমার অপরিচিত নয়। ছোট কাল থেকেই চেন।”
“চিনি বলেই তো রাজী না। ওর ভাইয়ের পরিচয় সিএনজি ড্রাইভার, বাবা ভূমি অফিসে চাকরি করতেন। আর তোর বাবা একজন ডাক্তার। আশা ছিল তুইও ডাক্তার হবি। তুই ডাক্তার তো হতেই পারলি না এমনকি কোন সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়েও চান্স পেলি না……………”
শাহেদ এই কথা শুনতে শুনতে অভ্যস্থ হয়ে গেছে।
শাহেদের বাবা একজন ডাক্তার। নামকরা ডাক্তার নন তবে ইনকাম খারাপ না। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে শাহেদ বড় হয়ে ডাক্তার হবে এটাই ছিল বাবা মায়ের লক্ষ্য। কিন্তু ছোটকাল থেকেই শাহেদের লেখাপড়ার প্রতি মনযোগ নেই। এমনকি খেলাধুলার প্রতিও না। ক্লাস নাইনের শুরুতে শাহেদের স্কুল শিক্ষকরা শাহেদকে বিজ্ঞান বিভাগে দিবে না, মানবিক বা কমার্স বিভাগে দিবে তখন শাহেদের বাবা স্কুলে গিয়ে শিক্ষকদের সাথে আলোচনা করেছে “আমি ডাক্তার, ছেলেও ডাক্তার হবে। সরকারী মেডিকেলে চান্স না পেলে প্রাইভেট মেডিকেলে পড়াব। তাও ডাক্তার বানিয়ে ছাড়ব।” শিক্ষকরা ডাক্তার সাহেবকে বোঝালেন “শাহেদ সাইন্সে না পড়ে যদি আর্টস এ পড়ে তাহলে ভাল করবে।” আসলে শিক্ষকরা মনে মনে বলছিল “এই ছেলেকে সাইন্সে দিলে এসএসসিতে ফেইল করবে। আর্টসে দিলে কোন মতে পাশ করতে পারে!” কিন্তু শাহেদের বাবা একজন ডাক্তার, সম্মানিত ব্যক্তি তাই শিক্ষকরা এভাবে বললেন না। জোরাজরি করে ডাক্তার সাহেব তার ছেলেকে সাইন্সেই দিলেন। পরীক্ষাগুলোতে বিজ্ঞানের সাব্জেটগুলোতে ফেইল করতে থাকল। শিক্ষকদের কাছে এটাই স্বাভাবিক। আর ডাক্তার সাহেবের হতাশা বাড়তেই থাকল “ছেলেকে কি ডাক্তার বানানো যাবে না? ফরিদ ভাইয়ের ছেলেটা রংপুর মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। ওনার ক্লাসমেট হেনার ছেলেটাও বরিশাল মেডিকেলে পড়ে। ওনার ছেলে যদি ডাক্তার না হয় তাহলে সমাজে মুখ দেখাবেন কী করে?” ক্লাস টেনে ওঠার পরে ডাক্তার সাহেবের নতুন টেনশন শুরু হল “ছেলে এসএসসি পাশ করবে কি না!” তখন মনে হতে লাগল ‘শিক্ষকরা আসলেই ভাল পরামর্শ দিয়েছিল। ওনাদের কথা মত শাহদেকে আর্টসে দেয়া উচিৎ ছিল। আবার আর্টসের কথা শুনে নাক সিঁটকান। মানুষ আর্টসে পড়ে! কমার্স হলে না হয় একটা কথা ছিল, বিবিএ, এমবিএ পড়া যায়। শাহেদ বাংলা, ইংরেজী, সমাজ বিজ্ঞানে ভালই রেজাল্ট করছে কিন্তু পদার্থ, রসায়ন, বায়োলজীতে ফেইল করছে। তবে ওনার মতে যে ব্যাটা বিজ্ঞান বোঝে না সেই ব্যাটা আস্ত একটা গাধা। অবশ্য ওনার স্ত্রী অর্থাৎ শাহেদের মা আর্টসের ছাত্রী ছিলেন। শাহেদ যখন এসএসসিতে পাশ করল তখন ডাক্তার সাহবে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। স্কুলের সবাই অবাক হল- শাহেদ পাশ করেছে! ইন্টারে শাহেদের বাবা মায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী কমার্সে ভর্তি করা হল। যদিও শাহেদের ইচ্ছা ছিল আর্টসে ভর্তি হওয়া। কিন্তু সমাজে মুখ দেখাতে কষ্ট হবে ভেবে শাহেদের বাবা জোর করে শাহেদকে কমার্সে ভর্তি করালেন। যার ফলে ইন্টারের রেজাল্টও ভাল না। বাংলা ইংরেজীতে ভাল নম্বর ছিল কিন্তু কমার্সের অংকের সাব্জেক্টগুলোতে কোন মতে পাশ করল। এরপর শাহেদের প্রতি তার বাবা মা সকল আশা ছেড়ে দিল। ডাক্তার সাহেব টেনশনে শোকে দুঃখে স্ট্রোক করলেন। মায়ের চুলও পাকতে লাগল। শাহেদ বোঝে না বাবা ডাক্তার হলেই কি ছেলে মেয়েকে ডাক্তার হতে হবে? নিজের ইচ্ছা মত বিষয়ে কি পড়া যাবে না? দুনিয়ার সবাই ডাক্তার হলে রোগী হবে কে? বাকী কাজগুলো কারা করবে? শাহেদ অবশ্য ওসব নিয়ে মাথা ঘামাত না। তার সাহিত্য ভাল লাগল। বিভিন্ন ব্লগে ঢুঁ মারা শুরু করল। ব্লগ জিনিসটাই তার কাছে জীবনের সেরা পাওনা মনে হল। ইচ্ছা মত লেখা যায়, লেখার ফিডব্যাকও পাওয়া যায়। লেখককে প্রশ্ন করা যায়। ঝগড়া করা যায়। কী মজা! এই জিনিস কেন আগে পায় নি? বাবার স্ট্রোকের কারনে অনার্স এ ভর্তি এক বছর পিছিয়ে গেল। এছাড়া শাহেদের ভর্তি নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই। সরকারী কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেল না। ওয়েটিং লিস্টেও নেই। ভর্তি হল একটা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজীতে। সাহিত্য শাহেদের প্রিয় সাব্জেক্ট। এই প্রথম শাহেদ লেখাপড়া করে মজা পেল। পছন্দের সকল বিষয় তার সিলেবাসে আছে। প্রথম সেমিস্টারে সবার চেয়ে বেশি নম্বর পেল। শাহেদ কত নম্বর পেল বা কী রেজাল্ট করল সেটা নিয়ে চিন্তা করে না, সে তার প্রিয় বিষয়গুলো পড়তে পারছে এটাই তার কাছে অনেক পাওনা। বাবার মত বলতে ইচ্ছে করে “মানুষ সাইন্স পড়ে!”
মঞ্জু শাহেদের স্কুল জীবনের বন্ধু। গল্পের শুরুতে যে অসাধারন রূপবতী মেয়েটির কথা বলা হয়েছে তার নাম সানজিদা, মঞ্জুর ছোট বোন। মঞ্জুর বাবা ভূমি অফিসে চাকরি করতেন। জীবনে অবৈধ উপার্জন করেন নি। তারা একই স্কুলে পড়ত। মঞ্জু ক্লাসের প্রথম দিকে ছাত্র ছিল। শাহেদের সাথে মঞ্জুর সম্পর্ক বেশ ভাল। দু’জন দু’জনের বাসায় যেত। মঞ্জুদের আর্থিক অবস্থা তখনও তেমন একটা ভাল ছিল না। যেহেতু শাহেদের বাবা সরকারী হাসপাতালের ডিউটির বাইরে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতেন তাই শাহেদের ফ্যামিলীর অবস্থা তখনও ভাল ছিল। শাহেদ মঞ্জুর বোনকে পিচ্চি অবস্থায় দেখেছিল, কিন্তু এতবার শাহেদের বাসায় যাওয়ার পরেও মঞ্জুর বোনকে বড় অবস্থায় শাহেদ কখনো দেখেনি। ইন্টারে পড়ার সময় শাহেদের বাবা হঠাৎ মারা যায়। তখন থেকে ওদের পরিবার অসহায় হয়ে পড়ে। কোন রকমে ইন্টার পরীক্ষা দিয়ে তিতুমীর কলেজে ভর্তি হয়। পেশা হিসেবে বেছে নিতে হয় সিএনজি অটো রিকশা। শাহেদের একার ইনকাম দিয়ে কোন মতে পরিবার চলে। ছোট বোন অনেক মেধাবী ছাত্রী তার লেখাপড়া বন্ধ করা যাবে না।
এক বছর আগে মঞ্জু একবার শাহেদের কাছে কিছু টাকা ধার করেছিল। বলেছিল –বোনের এইচএসসি পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপের টাকা লাগবে কিন্তু এই মুহূর্তে টাকা নেই। শাহেদ বলেছিল “সানজিদা এত বড় হয়ে গেছে! ক’দিন আগে পিচ্চি ছিল” মঞ্জু অবশ্য কিছুদিন পরেই টাকা ফেরত দিয়েছিল।
সানজিদা বড় হওয়ার পরে শাহেদের সাথে প্রথম দেখা হয় সানজিদার বাসায়। সেদিন মঞ্জু বাসায় ছিল না। শাহেদ মঞ্জুর বাসার ড্রইং রুমে বসে অপেক্ষা করছিল। ড্রইং রুম বলতে পুরনো একটা সোফা, একটা খাট, একটা টিভি গাদাগাদি করে রাখা। এই রুমেই মঞ্জু ঘুমায়। দুই রুমের ছোট্ট একটা বাসা। আরেক রুমে সানজিদা ও তার মা থাকে। সানজিদা গোসল করে চুল মুছতে মুছতে মঞ্জুর রুমে হঠাৎ ঢুকে পড়ল। শাহেদ বসে আছে সেটা খেয়াল করে নি। নন্দীত কথা শিল্পী হুমায়ন আহমেদের মতে মেয়েদের সবচেয়ে বেশি সুন্দর দেখায় গোসল করার পরে ভিজা মাথায় তোয়ালে জড়ানো অবস্থায়। সানজিদার মাথায় তোয়ালে জড়ানো ছিল না। তবে কাছাকাছি পজিশনে ছিল। শাহেদের মনে হল ঘরে একটা পরী ঢুকেছে। গোলাপী তোয়ালের রঙ আর শরীরের রঙ একাকার হয়ে গেছে। শাহেদ হা করে চেয়ে আছে। সানজিদার সে দিকে খেয়াল নেই। তার নজর দরজার দিকে, দরজাটা খোলা। দরজা বন্ধ করার উদ্দেশ্যেই সে মূলত এসেছিল। ভেতরের রুম থেকে এই রুমের দরজা দেখা যায়। সানজিদা গোসল করে বাথরুম থেকে বের হয়েই খেয়াল করল বাহিরের রুমে দরজা খোলা। দরজা বন্ধ করে পেছনে ঘুরেই সে শাহেদকে দেখল। সানজিদার গায়ে ওড়না নেই, তোয়ালেটা মাথায়। ভাইয়ার বন্ধুর সাথে এভাবে দেখা হবে বুঝতে পারেনি। কী করবে, মাথা থেকে তোয়ালে খুলে গায়ে জড়াবে? নাকি দৌড় দিবে? নিজ বাসায় তো দৌড় দেয়া যায় না। এছাড়া তিনি তো অপরিচিত লোক নন। ‘আসসালামুয়ালাইকুম’ বলে সানজিদা দ্রুত ভেতরের রুমে ঢুকে পড়ল। ছোট রুম তাই দৌড় দিতে হল না। দুই কদম হাঁটলেই এক রুম থেকে আরেক রুমে যাওয়া যায়। সানজিদা রুম থেকে চলে যাওয়ার পরেও শাহেদের মাথায় সানজিদার চেহারা ঘোরপাক খাচ্ছিল। সানজিদা চলে যাবার পরে রুমের সৌন্দর্য মনে হয় কমে গেল। শাহেদ ভাবতে লাগল মঞ্জুর বোনটা এত সুন্দর! শাহেদ প্রতি মাসে দুই একবার এই বাসায় আসে অথচ গত দশ বছরে সানজিদাকে একবারও দেখেনি। মঞ্জু সানজিদার লেখাপড়া নিয়ে শাহেদকে সময় সময় আপডেট জানায় যেমন এসএসসিতে সানজিদা যখন ভাল রেজাল্ট করল তখন শাহেদদের বাসায় মিষ্টি পাঠিয়েছিল। এইচএসসিতে শাহেদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে সানজিদার ফর্ম ফিলাপ করা হয়েছিল।
“এই যে লেকচারার সাহেব। কখন এসেছিস?” মঞ্জুর কথায় শাহেদের ঘোর ভাঙ্গে। মঞ্জু বাসায় এসেছে। তার পরনে সিএনজি ড্রাইভারের নীল পোষাক। শাহেদ একদিন মঞ্জুর এই পোষাক পরে সিএনজি চালিয়েছে। অল্পের জন্য পুলিশের কাছে ধরা খায় নি। সে এক মজার ইতিহাস।
আগের পর্বে জেনেছেন শাহেদ অনার্সে ইংরেজীকে মনে প্রাণে ভালবেসেছিল। তাই তার রেজাল্ট ভাল হয়েছিল। অনার্স মাস্টার্স শেষে সে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়েই লেকচারারের চাকরি পায়। গতকাল এপয়েন্টম্যান্ট লেটার হাতে পেয়েছে। আজ তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু মঞ্জুর বাসায় মিষ্টি নিয়ে এসেছে। এসেই মঞ্জুর বাসায় অসাধারন রূপবতী সানজিদাকে দেখল। মঞ্জু যেহেতু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে তাই মঞ্জুর এখনো অনার্সই শেষ হয় নাই। মঞ্জুর রেজাল্টও ভাল। বাবা ঐ সময় মারা না গেলে এই ছেলের ভবিষ্যত আরো ভাল হত। শাহেদ ভাবে মঞ্জুও তার মত ব্যর্থ মানুষ!
শাহেদ “এসেছি আধা ঘন্টা হল। তোর এত দেরি কেন?”
মঞ্জু “ফার্মগেইটের একটা ট্রিপ ছিল। রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম। আজকাল জ্যামের কারনে খ্যাপ মেরে পোষায় না।” প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে মঞ্জু বলল “দোস্ত চাকরি পেয়েছিস, এইবার দ্রুত বিয়ে করে ফেল। অনেক দিন বিয়ের দাওয়াত খাই না।”
বিয়ের প্রসঙ্গ উঠতেই শাহেদের চোখে সানজিদার চেহারা ভেসে আসল। এরকম সুন্দরী বৌ পেলে আর কী লাগে!
“মাত্র তো চাকরি পেলাম। কয়টা দিন যাক।”
মঞ্জু “আন্টিকে তো আমি চিনি দেখবি আগামীকাল থেকেই উনি তোর জন্য পাত্রী খুঁজতে বের হবেন। ইতিমধ্যে হয়তো মেয়ে পছন্দ করে রেখেছেন। পাত্রী পছন্দ হলেই বিয়ে করে ফেলবি, দেরি করবি না।”
--
শাহেদ বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিটা ভালভাবেই করে শুরু করেছে। প্রায় মাস খানেকের মধ্যে সে ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে গেল। এদিকে মা পাত্রী দেখা শুরু করেছে। একদিন এক মেয়ে আরেকদিন আরেক মেয়ের ছবি কালেকশান করছেন। শাহেদ যার ছবিই দেখে তার সাথেই সানজিদার তুলনা করে। তুলনা করে ভাবে কই আগরতলা কই খাটের তলা! অবশ্য মাকে ব্যপারটা জানায় না। কারণ জানানোর পরেই ভেজাল শুরু হবে। প্রথমত, দুই ফ্যামিলীর মধ্যে স্টেটাসগত ব্যবধান প্রচুর। বাবা মা জীবনেও রাজী হবে না। ডাক্তার বাবা চাইবেন ডাক্তার বেয়াই। সানজিদার বাবা নেই। ভাই সিএনজি চালক, এটা বাবা মা কোন মতেই মানতে চাইবে না। দ্বিতীয়ত, সানজিদা মাত্র ইন্টার পাশ করল। ছাত্রী ভাল, মঞ্জু নিশ্চয়ই তার উচ্চ শিক্ষার পথ বন্ধ করবে না। এই মেয়েও নাকি ডাক্তার হতে চায়। মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষা দিবে। দুনিয়ার সবাই শুধু ডাক্তার হতে চায়।
সানজিদা ডাক্তার হতে পারল না। মেডিক্যালে চান্স পেল না। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও না। সেও শাহেদের মত ব্যর্থ মানুষ! ঢাকার বাইরে তার ভাই তাকে পড়াবে না। তার চেয়ে ঢাকার যেকোন কলেজে পড়াবে। এ ব্যপারে মঞ্জু শাহেদের পরামর্শ চাইল। সানজিদার নাম শুনলেই শাহেদের সেই রূপের কথা চোখে ভাসে। শাহেদের ভয় হয় মঞ্জু আবার টের পেয়ে যায় কি না। শাহেদ প্রস্তাব দিল “সানজিদাকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা।” মঞ্জু ম্লান হেসে বলল “গরীবদের জন্য প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি বিলাসিতা। টাকা কোথায় পাব? ইচ্ছা তো আছেই।”
“আমি ব্যবস্থা করব। আমাদের শিক্ষকরা চাইলে প্রতি সেমিস্টারে একজনকে শিক্ষা বৃত্তির ব্যবস্থা করতে পারে। এছাড়া এক সেমিস্টারে প্রথম হলে পরের সেমিস্টারে টিউশন ফী লাগে না।” সে যদি এভাবে আট সেমিস্টার পড়ে তাহলে তাকে মূলত প্রথম সেমিস্টারের টাকা দিতে হবে।” সেই টাকাও বেশি না, যা করার আমি ব্যবস্থা করব। তুই শুধু ওকে ভর্তি করা।”
“ঠিক আছে, আমি সানজিদাকে আগামীকালই তোর কাছে পাঠাচ্ছি। কী করতে হবে না হবে ব্যবস্থা করে দিস।” কথা শোনার পরে শাহেদের মন কেমন যেন করে উঠল। আগামীকাল তাহলে সানজিদার সাথে দেখা হবে!
সেই রাতে শাহেদের উত্তেজনায় ঘুম আসল না!
গার্লস স্কুলের সামনে কোন মেয়ের জন্য অপেক্ষা করা খুব অস্বস্তিকর। মনে হয় আশেপাশের লোকজন আপনার দিকে তাকিয়ে দেখছে। বিভিন্ন কারনে আমার (লালসালুর) গার্লস স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। এর মধ্যে কিছুদিন ছোট বোনের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতাম। সে পড়ত প্রাইমারী সেকশনে, ওর যখন ছুটি হত তখন হাই স্কুলের মেয়েরা ক্লাসে ঢুকত। আমি অসহায়ের মত স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম! আশেপাশের রিকশাওয়ালা, আচারওয়ালা, আইসক্রীমওয়ালা, ঝালমুড়িওয়ালারা আমার দিকে কেমন যেন ট্যারা দৃষ্টিতে তাকাত। মনে হত সব ব্যাটারা ভাবছে “ঐ হালায় গার্লস স্কুলের সামনে খাড়াইয়া খাড়াইয়া টাঙ্কি মারতাছে। হালারে ধইরা পিডা।” নিজেকে চোরের মত মনে হত। আর জানেন তো- চোরের মন পুলিশ পুলিশ! আমাদের গল্পের চরিত্র শাহেদের আজ সেইরকম অনুভূতিই হচ্ছে। যদিও শাহেদ কোন গার্লস স্কুল বা কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে নেই। সে নিজের ইউনিভার্সিটির অফিসে তার চেয়ারে বসে সানজিদার জন্য অপেক্ষা করছে। বেশিরভাগ ইউনিভার্সিটির লেকচারারদের জন্য আলাদা চেয়ার টেবিলের ব্যবস্থা থাকে না। কমন একটা টেবিল থাকে। চারদিকে কিছু চেয়ার থাকে। অন্য দিন এই টেবিলের আশে পাশে কোন স্যার থাকে না অথচ আজ চার চেয়ারে চার জন স্যার বসে বসে গল্প গুজব করছে। সবচেয়ে জুনিয়ার শিক্ষক হচ্ছে শাহেদ। বাকী সবাই সিনিয়ার লেকচারার। সানজিদা আসবে, শাহেদ ওর সাথে কথা বলবে, কিন্তু আশেপাশে এই লোকগুলো থাকলে কীভাবে কথা বলবে? অফিসের পিয়ন এসে জানাল “বাইরে এক ছাত্রী শাহেদ স্যারকে খুঁজছে”।
ইংরেজীতে ছাত্রীর সংখ্যা বেশি তাই প্রতিদিন অনেক ছাত্রী পড়াশোনার ব্যপারে শাহেদের সাথে যোগাযোগ করে। এটা খুব স্বাভাবিক ব্যপার। কিন্তু আজ ‘ছাত্রীর’ কথা শুনে শাহেদের বুকে কেমন যেন একটা অনুভূতি হল। শাহেদ আশা করছে নিশ্চয়ই সানজিদা এসেছে। পিয়ন তো জানে না কে ছাত্রী আর কে বাইরের লোক। এই বয়সী যে কাউকেই ছাত্র ছাত্রী বলে চালিয়ে দেয়।
রিসিপশনে গিয়ে দেখল সেখানে অনেক ছাত্র ছাত্রী! কে শাহেদের খোঁজে এসেছে? চারিদিকে তাকাল, কই এখানে তো সানজিদা নেই! তাহলে কি অন্য কেউ তার খোঁজ করেছে? মনটা একটু খারাপ হতে শুরু করতেই এক মেয়ের কন্ঠ শুনতে পেল “আসসালামুয়ালাইকুম ভাইয়া”। পাশে তাকিয়ে দেখল আপাদমস্তক বোরখা পরিহিত এক মেয়ে শাহেদকে সালাম দিয়েছে। কন্ঠটা কি ভোলার মত! মনে পড়ে গেল সেই রুমের সৃতির! তখনও সানজিদা এভাবে সালাম দিয়েছিল। কিন্তু এই মেয়ে যে নিজেকে এভাবে ঢেকে রাখে তা তার কল্পনাতেও আসে নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক হিজাবী ছাত্রী আছে যাদের মুখ দেখা যায়। অনেক হিজাবীর বডি শেইপ বোঝা যায়, অনেক হিজাবী জিন্সের প্যান্ট টাইটস পরে কিন্তু এই মেয়ে মুখ দেখানো তো দূরের কথা তার পা মোজা দিয়ে ঢেকে রেখেছে! শুধু হাত আর চোখ দুটো দেখা যায়। হাত দেখে পাগলও বুঝবে এই মেয়ে অসাধারন সুন্দরী। আর নেকাবের মাঝে যে চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে তার জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার কেন প্রফেসারও জীবন দিতে রাজী হবে!
শাহেদের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি তার দৃষ্টি নীচু করে ফেলল। শাহেদ তাকে রিসিপশানের এক পাশে নিয়ে ভর্তির ব্যপারে তথ্য দিল। পাঁচ মিনিট কথা বলার পরে বুঝল- এই মেয়ে তার ভাইয়ের মতই পরিশ্রমী। এই বয়সে তিনটা টিউশনি করে। কথা বলে খুব স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড। যেমন,
“ভর্তি ফী ও প্রথম সেমিস্টার ফী যদি তিরিশ হাজার টাকা হয় তাহলে আমি আঠারো হাজার টাকা দিতে পারব। বাকী টাকা ভাইয়া দিতে পারবে কী না জানি না। এই আঠারো হাজার টাকা টিউশনি করে জমিয়েছি।”
শাহেদ “টাকার ব্যপারে চিন্তা ভাবনা করো না। তুমি ভর্তির ব্যপারে সিদ্ধান্ত নাও।”
সানজিদা “সেই ব্যপারে সিদ্ধান্ত এখনো নিতে পারছি না। আসলে আমার ভর্তির কোন ইচ্ছাই নেই। আগামীবার মেডিকেলে আবার ভর্তি পরীক্ষা দিব। আশা করি আগামীতে সুযোগ পাব।”
শাহেদ “তোমাকে নিয়ে সবার খুব আশা ছিল কারণ তুমি বাংলাদেশের সেরা স্কুলের সেরা ছাত্রীদের মধ্যে একজন। তোমার পরের সিরিয়ালের অনেকেই মেডিক্যাল, বুয়েটে চান্স পেয়েছে অথচ তোমার ভাগ্যই খারাপ ছিল। যাক সেটা নিয়ে চিন্তা ভাবনা না করে ভর্তি হয়ে নাও। আগামীতে যদি চান্স না পাও তাহলে আরো একটা বছর নষ্ট হবে। যদি ভর্তি হয়ে থাক তাহলে এক বছর এগিয়ে থাকবা।”
সানজিদা “গত বছর আমার ভাগ্যে ছিল না বলে এই বছর ভাগ্যে থাকবে না এমন কোন কথা নেই। আসলে আমি ভর্তি হতে চাচ্ছি না এ কারনে, আপনি আমার জন্য স্টুডেন্ট ফান্ড থেকে কিছু বৃত্তি দিবেন যাতে আমার পরের সেমিস্টার থেকে টিউশন ফী দিতে না হয়। কিন্তু আমি যদি মেডিকেলে চান্স পাই তখন তো দুই সেমিস্টার শেষ করে চলে যাব। তখন আপনার কলিগরা আপনাকে দোষারোপ করবে। বলবে- কী এমন এক ছাত্রী এনেছেন যাকে বৃত্তি দিয়েছেন অথচ দুই সেমিস্টার পরে চলে গেছে।”
সানজিদার কমন সেন্সের কথা শুনে শাহেদ অবাক হয়ে যাচ্ছে। অথচ অভাবে পড়লে মানুষ অনেক কিছু নিয়ে ভাবতে শুরু করে। শাহেদ জীবনে অভাব কী জিনিস দেখেনি। মঞ্জুর পরিবারকে কাছে থেকে দেখেছে। অনেক দিন দুপুরে মঞ্জুদের বাসায় খেয়েছে। ওদের খাবারের মেন্যু দেখেই শাহেদ বলতে পারে শাহেদদের সকালের নাস্তার খরচ দিয়ে মঞ্জুরা তিন বেলা খায়। আরেকটা জিনিস ভেবে মঞ্জু অবাক হল- এই মেয়ে মেডিকেলে ভর্তির জন্য পাগল। এরকম একটা মেয়ে পেলে শাহেদের বাবার জীবন স্বার্থক হত। শাহেদ আরেকটা জিনিস টের পেল- সানজিদার মাথায় শুধু মেডিকেলে ভর্তি নিয়ে চিন্তা ভাবনা ঘোরপাক খাচ্ছে। অন্য বিষয়ে তার ইন্টারেস্ট নেই। শাহেদ প্রশ্ন করল “এইবার প্রিপারেশন কেমন?”
“এইবার আশা করি মিস হবে না”
শাহেদ “গত বার কি প্রশ্ন কমন পড়ে নি?”
সানজিদা “গত বছর প্রিপারেশন ভাল ছিল না। পরীক্ষা দেয়ার ইচ্ছাও ছিল না!”
শাহেদ “এইবার হঠাত এত আগ্রহ কেন?”
সানজিদা “প্রথমত, বাবার ইচ্ছা ছিল ডাক্তার হব…..” দ্বিতীয়ত কী আর বলল না।
সানজিদার সাথে প্রায় পনের মিনিট কথা বলল কিন্তু শাহেদের মনে হল মাত্র দুই তিন সেকেন্ড কথা হল। ও আরো কিছুক্ষণ পাশে থাকলে ভাল হত। শাহেদ সানজিদাকে অফার করল ওদের ক্যান্টিনে গিয়ে হালকা নাস্তা করার জন্য। উদ্দেশ্য, নাস্তা করার জন্য মেয়েটি যদি তার নেকাব খোলে! কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হল। সানজিদা “টিউশনি আছে” বলে দ্রুত চলে গেল। শাহেদ বুঝল এই মেয়ে ভাইয়ের এবং মায়ের চাপে পড়ে এখানে এসেছে। ওর মাথায় মেডিকেলের ভূত চেপেছে। সেখানে ভর্তি না হওয়া পর্যন্ত সানজিদার মাথা থেকে এই ভূত নামবে না। যদি মেডিকেলে চান্স না পায় তাহলে শাহেদের বাবার মত স্ট্রোক করতেও পারে! বয়স যেহেতু কম তাই স্ট্রোক করবে না কিন্তু দিলে ভালই চোট পাবে।
এর চেয়ে বড় কথা এই মেয়েকে বউ হিসেবে না পেলে শাহেদও মনে ভাল চোট পাবে। সানজিদার যে রূপ তাতে মেকাপ ছাড়া যদি তার ছবি ফেইসবুকে দেয় তাহলে নিশ্চিত কোন রকম স্টেটাস কমেন্ট করা ছাড়াই সেলিব্রেটি বনে যাবে! হাজার হাজার লাইক ছবিতে পড়বে, কমেন্টে তার রূপের প্রশংসা করবে। অথচ এসব না করে সে তার রূপ ঢেকে রেখেছে। এরকম মেয়ে এই যুগে পাওয়া মুশকিল।
শাহেদ ভাবতে লাগল সানজিদাকে বিয়ের ব্যপারে কার সাথে আগে কথা বলবে? মঞ্জু নাকি শাহেদের মা? মঞ্জুকে প্রস্তাব দিলে মঞ্জু অবশ্যই রাজীব হবে। মঞ্জুর মাও রাজী হবেন। কারণ আন্টি তাকে ছোটকাল থেকেই চিনে। এছাড়া শাহেদের মত উচ্চবিত্ত ফ্যামিলী থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসলে মানা করা কঠিন। ডাক্তার বাবার কারনে সমাজে শাহেদদের সম্মানও আছে। যেহেতু শাহেদ মা বাবার ব্যপারটি নিয়ে কনফিউশনে আছে তাই সে সবার আগে মঞ্জুর সাথে কথা বলার প্ল্যান করল।
এ উদ্দেশ্যে সে মঞ্জুকে ফোন দিল “দোস্ত কই আসছ?”
মঞ্জু “মতিঝিলে”
আজ মঞ্জুর একটা চাকরির ইন্টারভিউ দেবার কথা ছিল। সম্ভবত ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছে। শাহেদ দোয়া করছে চাকরিটা যাতে হয়ে যায়।
শাহেদ “সন্ধ্যায় আমার ইউনিভার্সিটির সামনে আসিস। কথা আছে।”
চলবে…………..
বিষয়: সাহিত্য
২২৩২ বার পঠিত, ১৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
অনেক ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা।
"অসাধারন রূপবতী"
বর্তমান সমাজে মেয়েদের রং/রূপ নিয়ে যে বাণিজ্য হচ্ছে তাতে শ্যামলা মেয়েদের বড়ই দুর্দিন বলতে হয়!
আপনার নায়িকার রূপটা এতো হাইলাইট না করে তাকে শ্যামলা রাখলেই ভালো হতো মনে করি!
আমাদের গল্প-উপন্যাস যেন ডাইস(ফর্মা) থেকে বেরুতে পারছেনা- শুরু করলেই "গল্প" হয়ে যায়- "উপন্যাস" আর থাকেনা!!
যতটুকু কাহিনী লেখা হয়েছে এটুকুতেই বিশাল এক উপন্যাস হতে পারতো- তেমন আশা নিয়েই শুরু করেছিলাম!
দেখা যাক কোথায় নিয়ে যান!
পারেন বুঝবো ইসলামপন্থী লেখক। দেখা যাক।
আগামী পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
মন্তব্য করতে লগইন করুন