শীতলক্ষার মাছ
লিখেছেন লিখেছেন লালসালু ০২ মে, ২০১৪, ১০:৪৪:৫০ সকাল
শীতলক্ষ্যার মাছ
সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী জননেতা শামসুল ভাইয়ের আজ ফুরফুরে মেজাজ। ওনার দলেরই এক নেতার বাসায় দাওয়াত খেতে বসেছেন। উনি আবার সাংগঠনিক কাজে ভালই পটু। এ জন্য এক সাথে সাতটি জেলার কাউন্সিল করার দায়িত্ব ওনার উপরেই পড়েছে। এ উদ্দেশ্যে তিনি বৃহত্তর ঢাকার একটি জেলায় এসেছেন। আগামীকাল এই জেলার কাউন্সিল। কমিটি প্রায় ঠিকই আছে তবে সেক্রেটারি পদ নিয়ে এখনো একটু ঘাপলা আছে। দুই সেক্রেটারি পদপ্রার্থীকে এক টেবিলে কেউ বসাতে পারছিলেন না। তবে শামসুল ভাই ঠিকই দু’জনকে এক সাথে বসিয়েছেন। নতুন সভাপতির বাসায় বিশাল সমারোহে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে। এখন তিনি সেই দাওয়াতে মাছ চিবুচ্ছেন। তার ডান ও বাম পাশে দুইজন সেক্রেটারি প্রার্থী। একজন প্রায় ম্যানেজ হয়ে গেছে আরেকজনকে ম্যানেজ করতে এখনো একটু সময় লাগবে।
শামসুল ভাই ভোজন রসিক হিসেবে দলে বিখ্যাত। তিনি যে জেলাই যান না কেন কোন না কোন নেতা কর্মী ওনাকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ান। ওনার প্রিয় খাবারের মধ্যে আস্ত খাসির ফ্রাই, আস্ত চিকেন ফ্রাই, আস্ত বড় মাছের ফ্রাই উল্লেখ যোগ্য। আস্ত জিনিসের প্রতি টানের জন্য ওনার একটা রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। সেটা হল আস্ত খাসি উনি নিজ হাতে কেটে নেতা কর্মীদের হাতে প্লেটে তুলে দেন। এতে নেতা কর্মীদের সাথে আন্তরিকতা বাড়ে। পাকিস্তান আমল থেকে বঙ্গবন্ধুর আহবানে যখন তিনি রাজনীতিতে আসেন তখন থেকেই ওনার এই অভ্যাস। এখন বয়স হয়েছে, বেশি খেতে পারেন না তবুও নেতাদের উৎসাহ দেয়ার জন্য কিছুটা হলেও মুখে দেন।
দল ছাড়াও পুরো দেশে ওনার একটা স্বচ্ছ জনপ্রিয়তা রয়েছে। এই শহরে গতকাল পর্যন্ত ওনার দলে দুই তিনটা গ্রুপ ছিল অথচ তিনি আসাতে সবাই এক ঘাটে পানি খাচ্ছেন অর্থাৎ এক টেবিলে ভাত খাচ্ছেন।
রান্না খুব ভাল হয়েছে। খাসিটা মনে হয় আরেকটু খেলে ভাল হত। কিন্তু সামনে আস্ত মাছ পড়ে রয়েছে। ঘ্রাণ শুকেই বোঝা যাচ্ছে বাবুর্চি ব্যাটা অনেক ঝানু রন্ধন শিল্পী।
খাসির মত তিনি মাছ নিজ হাতে কেটে কেটে টুকরা টুকরা করে নেতাদের বিলিয়ে দিচ্ছেন। এই মাছের ওজন কম হলেও দশ কেজি হবে। ইতিমধ্যে খাসি, মাছ, মাংস, ঝোল প্লেটে মিশে গেছে, আলাদাভাবে চেনা যাচ্ছে না। এক পিছ মাছ খেলেন, অসাধারন স্বাদ। মাছ খাওয়ার উদ্দেশ্যে আরেকটি টুকরো প্লেট থেকে তুলে নিলেন। কামড় দিয়েই বুঝলেন এটা মাছ নয় মাংস, খাসির মাংস। তবে এই খাসির মাংস আগের টুকরোর চেয়ে বেশি মজা। একই রান্নার একই মাংসের স্বাদ কীভাবে দুই রকম হয় এটা তিনি ভেবে পেলেন না। মাংসটার দিকে ভাল করে খেয়াল করলেন। অন্যান্য খাসির মাংসের মত এটাতেও হাড়ের পরিমান বেশি। তবে হাড়টা একটু শক্ত। খেয়াল করলেন এই মাংসের টুকরোটার স্বাদ মাছের মত। তবে কি বাবুর্চি মাছের পেটে কিছু খাসির মাংস ঢুকিয়ে দিয়েছে? মন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি অনেক দেশে গিয়েছেন, অনেক ধরনের খাবার খেয়েছেন। ঐসব দেশে এই সিস্টেমেও রান্না হয়। আস্ত খাসির পেটের ভিতরে মুরগী ঢুকিয়ে সেলাই করে একত্রে রান্না করা হয় অথবা পোড়ানো হয়। ঐসব আইটেম খেতে ভালই লাগে। এই বাবুর্চি নিশ্চয়ই এমন কাজ করেছে! নেত্রীর কাছে এই বাবুর্চির প্রশংসা করতে হবে। নেত্রী নিজেও ভোজন রসিক। নিজে খান অন্যকেও খাওয়াতে পছন্দ করেন। ঐ হাড্ডিওয়ালা টুকরো শেষ করার পরে আরেকটা টুকরো হাতে নিয়ে কামড়ালেন। এ টুকরোটা মানুষের আঙ্গুলের মত দেখতে। অর্ধেক খেয়েছেন এমন সময় মনে হল তিনি লোহা কামড়ালেন। তখনই সাংবাদিকরা ওনার ছবি তুলতে লাগলেন। সাংবাদিকদের দেখে লোহার কথা ভুলে গেলেনে। লোহা বাদ দিয়ে বাকীটা খেলেন। লোহাটা হাত থেকে প্লেটে পড়ে গেল। সাংবাদিকরা চলে গেল। প্লেটের দিকে খেয়াল করলেন। খেয়াল করলেন লোহার টুকরোটা একটা আংটি! বাবুর্চি হারামজাদা করেছে কী? নিজের হাতের আংটি রান্নাতে ফেলে দিয়েছে? কিন্তু এই মুহূর্তে কোন সীন ক্রিয়েট করা যাবে না। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এ ধরনের অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। স্বৈরাচারী জিয়ার সামরিক শাসনামলে যখন জেলে ছিলেন তখন জেলখানার বাবুর্চির ঘড়ি রান্না হয়ে গিয়েছিল। সেই ঘড়ি ওনার প্লেটে আসে। উনি চুপচাপ খেয়ে নিয়েছিলেন, উচ্চবাচ্য করেন নি, পরে বাবুর্চিকে ঘড়ি ফেরত দিয়েছিলেন। ওনার নিজের মেয়ের বিয়েতেও বাবুর্চির গলা থেকে চেইন পড়ে গিয়েছিল। সেটা পরে পাতিলে পাওয়া গেছে। সেবার আল্লাহ মান সম্মান বাঁচিয়েছেন। কোন গেস্টের প্লেটে যদি ঐ চেইন পাওয়া যেত তাহলে পরদিন পত্রিকায় আসত ওমুক মন্ত্রীর মেয়ের বিয়েতে…..
নেতাদের সহজে রাগ করতে নেই। মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। মাথা ঠান্ডা করার কারনেই তিনি এত মানুষের মন জয় করেছিলেন। ঐ যে বাবুর্চি ওনার মেয়ের বিয়েতে রান্না করেছিল, তাকে তিনি নিজ হাতে চেইনটা দিয়ে বলেছেন “বাপু, কাউকে বললাম না। ভবিষ্যতে রান্নার সময় গলা থেকে চেইন খুলে রাখবে।” ঐ বাবুর্চি প্রথমে ভয় পেয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর এত কাছের লোক কী না কী শাস্তি দেয়। শাস্তি তো দিলেনই না বরং ভদ্র ভাষায় বাবুর্চিকে বলেছেন এটা দেখে বাবুর্চি শপথ নিলেন যে দলে এত মহান হৃদয় নেতা থাকেন সেই দলকে তিনি আজীবন ভোট দিবেন।
প্লেট থেকে তিনি আংটিটা হাতে নিলেন। হাত ধোয়ার সময় আংটিটাও ধুলেন, সোনার আংটি ভালই দামী। তিনি বাবুর্চিকে সারপ্রাইজ দিবেন। বাবুর্চি ভাববে এত বড় মন্ত্রী ওনাকে না জানি কত বড় শাস্তি দিবেন। কিন্তু তিনি যখন বাবুর্চিকে খুব ভদ্র ভাষায় ‘বাবা’ ডেকে বলবেন “বাবা, রান্নার সময়া আংটিটা খুলে রেখো” তখন বাবুর্চি অনেক অবাক হবে। দশ জনের কাছে নেতার প্রশংসা করবে। বলবে “শামসুল ভাই অনেক বড়, সিংহপুরুষ……”
তিনি বাবুর্চির খোঁজ নিলেন। বাবুর্চি জানে বড় বড় নেতারা ভাল রান্না পেলে ভাল বখশিস দেয়। এই যে প্যানেল মেয়র নজরুল ভাই মারা গেলেন, উনি গত বছর এক দাওয়াতে বাবুর্চির রান্না খেয়ে খুশি হয়ে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। আহারে বেচারা মারা গেলেন। বাবুর্চি শামসুল ভাইয়ের সামনে এলেন।
শামসুল ভাই বাবুর্চিকে বললেন “তোমার হাত দেখি।” বাবুর্চি বখশিস পাওয়ার আশায় হাত বাড়িয়ে দিলেন। বাবুর্চির হাতে কোন আংটি না দেখে বললেন “বাবা, রান্নার সময় আংটি খুলে রাখবা।”
বাবুর্চি বললেন “স্যার আমি আংটি পরি না”
মন্ত্রী অবাক হলেন “সহকারী বাবুর্চি?”
বাবুর্চি “আমার ছেলেই সহকারী। সেও আংটি পরে না”
মন্ত্রী “রান্নার কাজে আর কে কে সহযোগীতা করে? বাটাবাটির কাজ যারা করে তারাও তো ডেকচিতে নাড়ানাড়ি করে” কথাটা ওনার নিজেরই ভাল লাগে নি কারণ খেয়াল করে দেখলেন আংটিটা সোনার। আর সোনার আংটি বুয়ারা পরেব কীভাবে? বাবুর্চির ভাল ইনকাম আছে একমাত্র সেই আংটির মালিক হতে পারে।
পকেট থেকে আংটি বের করে তিনি বাবুর্চিকে দেখালেন। বাবুর্চি আংটি চিনতে পারলেন না। নেতার মনে হালকা একটা সম্ভাবনা উঁকি দিল। তিনি জেলা সভাপতিকে দেখালেন। সভাপতি বললেন “এই আংটি আপনি কোথায় পেলেন? এটা তো নজরুলের আংটি।” একসাথে আমি আর নজরুল একই দোকান থেকে অর্ডার দিয়ে বানিয়েছিলাম। আপনার হাতে কীভাবে আসল?”
মন্ত্রীর সন্দেহ গাড় হল। সভাপতিকে জিজ্ঞেস করলেন “বড় মাছটা কোথা থেকে কিনেছেন?”
সভাপতি “শীতলক্ষ্যার একটা ঘাট থেকে আমি নিজে কিনেছি। আট হাজার টাকা দাম নিয়েছে। আজ সকালে ধরেছে। কেন ভাই? মাছে কোন গন্ধ পেয়েছেন? মাছ রান্না কী মজা হয় নাই? খাঁটি নদীর মাছ। জেলে আমার চেনা। মৎসজীবি লীগের...”
মন্ত্রী এসব কথায় কোন মনযোগ নেই তিনি ভাবছেন ঐ যে আঙ্গুলের মত হাড় মাংস খেলেন তা কি নজরুলের আঙ্গুল ছিল? বড় মাছ তো মরা মানুষের মাংস খায়। তবে কি .....................
ওয়াক ওয়াক করতে তিনি বমি করতে লাগলেন।
বিষয়: রাজনীতি
১১১৫ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আট হাজার টাকা দামী মাছ !! কি মাছ হতে পারে ? এত দূষনের ফলেও কি এত বড় মাছ শীতলক্ষ্যায় পাওয়া যাবে ? তবে লেগুনের চাষের মাছ হলেও হতে পারে।
এই বড় মাছটা কি মাছ ?
তবে মাটির লাঠির সাথে একমত। এরা কখনই বমি করেনা।
তবে এটাও ঠিকঃ- এরা বমি করেনা। এদের অভ্যাস আছে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন