মা .....
লিখেছেন লিখেছেন লালসালু ২৯ এপ্রিল, ২০১৪, ১০:২৪:৪৪ রাত
আত্মহত্যা করার চিন্তা রাশেদের মাথায় ঘুনাক্ষরেও ছিল না। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস, সে আজ আত্মহত্যা করতে কক্সবাজারে এসেছে। কক্সবাজারে আত্মহত্যার প্লট বেছে নিয়েছে এই কারনে বিয়ের পরে রাশেদ আর শিমুর এখানেই হানিমুনে আসার কথা ছিল, ঠিক আজকের এই দিনটাতেই। শিমুর আজ বিয়ে হচ্ছে। আগামী পরশু তারা হানিমুনে কক্সবাজারে আসবে। রাশেদ যখনই চিন্তা করে আজ রাতে শিমু অন্যের হবে তখনই তার আত্মহত্যার ইচ্ছা প্রচন্ড আকারে রুপ নেয়। মনে হয় এখনই আত্মহত্যা করি, কক্সবাজার পর্যন্ত যাওয়ার দরকার নেই। কিন্তু পরক্ষনেই চিন্তা দূর করে দেয়। কক্সবাজার পর্যন্ত পৌঁছে নেই। আর মাত্র এক দেড় ঘন্টা লাগবে।
রাত আটটায় রাশেদ কক্সবাজার পৌঁছুল। জামা কাপড় বলতে একটা হ্যান্ড ব্যাগ এনেছে। আত্মহত্যা করতে কেউ ব্যাগ নিয়ে আসে নাকি? রাশেদ এনেছে কারণ ব্যাগ ছাড়া কক্সবাজারে বের হচ্ছে শুনলে বাবা মা সন্দেহ করবেন। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মা দোয়া দুরুদ পড়ে গায়ে ফু দিয়ে দিয়েছেন যাতে ছেলের কোন অনিষ্ট না হয়। রাশেদের এসব ঝাড় ফুকের দিকে কোন খেয়াল নেই। তার মাথায় শুধু একটা চিন্তা কখন কক্সবাজার পৌঁছুবে, কখন আত্মহত্যা করবে। ঢাকা থেকে কক্সবাজার পৌঁছুতে বারো ঘন্টা লাগে। এর মধ্যে মা ছয় বার ফোন করে রাশেদের খোঁজ নিয়েছেন। এই মায়ের কথা মনে করেই রাশেদের যেন কেমন লাগে। রাশেদ মারা গেলে মা কত কান্নাকাটি করবে- সেটা ভাবতে গেলেই শিমুর কথা মনে পড়ে যায়, মাথায় রক্ত ওঠে, আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় জেঁকে বসে।
রাত দশটা। বীচ এখন কিছুটা ফাঁকা। মৌসুমের এই সময়ে এই এলাকায় মানুষ কমই আসে। দুইবার শিমুর মোবাইলে চেষ্টা করেছিল। রিং হয়েছে, রিসিভ করেনি। অবশ্য ধরার কথা না। কারণ রাত দশটার মধ্যে কাবিন হয়ে যাওয়ার কথা। এগারোটার মধ্যে বর তাকে নিয়ে যাবে আর বারোটার দিকে বাসর………. এই পর্যন্ত এসে রাশেদের চোখে পানি চলে আসে। যাকে নিয়ে গত তিন বছর সংসার করার স্বপ্ন দেখেছে সে আজ রাতে অন্যের হবে ভাবতেই মনে হয় পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোন অর্থ নেই। আত্মহত্যাই একমাত্র সমাধান। মৃত্যুর পরের জগৎ নিয়ে তার মাথা ব্যথা নেই। যে জগতে শিমু নেই সেই জগতে থেকে তার লাভ নেই। বাবার জন্য মোটেই খারাপ লাগছে না। বাবাই এ বিয়েতে এগোতে রাজী হয় নি। শুধু তার বাবার একার দোষ দিয়ে লাভ নেই। এ বিয়েতে শিমুর পরিবারেরও কেউ রাজী ছিল না। বাবার কথা “ওদের পরিবারের কেউ রাজী না থাকলে আমি কেন যেচে পড়ে ওদের পা ধরব? আগে ওরা রাজী হোক। এছাড়া তোর এখনো লেখাপড়া শেষ হয় নি। ওরাই বা তোর সাথে কেন বিয়ে দিবে?” বাবার কথায় যুক্তি থাকলেও এসব ক্ষেত্রে মন কোন যুক্তি মানে না।
শিমুর শেষ বাক্য গুলো ছিল “সরি, আমাকে ক্ষমা করে দিও। মা বলেছে ওনার অমতে বিয়ে দিলে উনি গলায় দড়ি দিবে। আমি মায়ের মরা মুখ দেখতে চাই না।” এই বলে শিমু কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। সেটাই শিমুর সাথে শেষ দেখা শেষ কথা। এরপর শিমুর বোনের সাথে রাশেদের কথা হয়েছিল। শিমুর বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়ে গেছে, রাশেদকে সে ভুলে যেতে চায়। সে নিজেও নাকি ভুলে গেছে। অদ্ভুতভাবে একটা জিনিস মিলে গেছে। আজ থেকে ছয় মাস আগে যখন ওরা নিজেরা বিয়ের প্ল্যান করেছিল তখন এপ্রিলের ২৮ তারিখকেই ওরা বিয়ের দিন হিসেবে ঠিক করেছিল। বিয়ে করে তারা কক্সবাজারে চলে যাবে। শিমুর শর্ত ছিল কক্সবাজারেই তারা হানিমুন করবে। বাসে কোন ছোঁয়া ছুয়ি দুষ্টুমি করা চলবে না। সেই হিসেবে আজ ২৯শে এপ্রিল রাশেদ ও শিমুর হানিমুনে আসার কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্যে লেখা আছে, আজ শিমুর বিয়ের রাত আর রাশের মৃত্যুর রাত!
রাত সাড়ে দশটা বাজে। এখনই সাগরে ঝাঁপ দিতে হবে। কিন্তু এদিকটায় দুই একজন মানুষ আছে। একটু এগিয়ে নেয়া যাক। রাশেদ বীচের উত্তর দিকে ঝাউবনের দিকে হাঁটা শুরু করল। ধুর এখানেও মানুষ, এত রাতে তারা কী করে। কিছুক্ষন পরে বুঝল এরা নব দম্পতি। নিজদেরকে একান্ত ভাবে পেতে ওরা বীচের অপেক্ষাকৃত এই নির্জন স্থানে এসেছে। রাশেদ আরো উত্তরে হাঁটতে শুরু করল। কতদূর হাটল বুঝতে পারল না। এর মধ্যে মা একবার কল দিয়েছে। জিজ্ঞেস করেছেন “কখন ঘুমাতে যাবি? ভাল হোটেল পেয়েছিস তো?” রাশেদ হু হা করে দ্রুত ফোন রেখে দিল।
এই তো সেই নির্জন স্থান। এখানেই ঘটবে রাশেদের সলিল সমাধী। কয়দিন আগে সেন্টা মারটিনে সাব্বির নামের এক ছেলে ফেইসবুক স্টেটাসে লিখেছিল “চলে যাচ্ছি নেটওয়ার্কের বাইরে” রাশেদও আজ নেটওয়ার্কের বাইরে চলে যাচ্ছে। আর মাত্র কয়েকটা মিনিট পরেই সে মোক্ষম মুহূর্ত।
রাশেদ সাগরের দিকে এগোচ্ছে। হঠাৎ কার গায়ে যেন লেগে রাশেদ মাটিতে পড়ে গেল। এক মহিলা ‘উহ’ বলে শব্দ করলেন। রাগত স্বরে বললেন “দেখেন না?” রাশেদ বলল “সরি, খেয়াল করিনি”। অন্য সময় হলে রাশেদ ভয় পেত, ভূতের ভয়। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। কন্ঠটা একজন বয়স্ক মহিলার। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট মহিলার চেহারা দেখা যাচ্ছে। বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে। রাশেদকে দেখে মহিলা যেন চমকে উঠলেন “কে তুমি? এখানে কী করছ?” এই বয়স্ক মহিলাকে কীভাবে বলে আত্মহত্যা করতে এসেছি। বলল “ঘুরতে এসেছি”। আশে পাশে কোন মানুষ না দেখে রাশেদও জিজ্ঞেস করল “আপনি একা একা এখানে কী করছেন?”
মহিলা ডান দিকে হাত ইশারা করে বললেন “একা একা নই। আমার সাথে লোক আছে।” দূরে দুইজন মানুষের আবছা অবয়ব দেখা গেল। শালার কপালই খারাপ এখানেও মানুষ। এদের সামনে পানি নামা যাবে না। যাই সামনে দিকে এগিয়ে যাই। প্রায় এক মিনিট হাঁটার পরে লোক দু’টোর কাছে রাশেদ চলে এল। সারা দিন বাস জার্নি, পেটে কিছুই যায় নি, রাশেদ অনেক দুর্বল হয়ে পড়ল। আর হাঁটতে পারছে না। একটু বসে জিরিয়ে নেই। কিছুক্ষন পরে তো শেষ বিশ্রাম নিবে। বড় বিশ্রামের আগে ছোট বিশ্রাম! দু’জন লোকের একজন রাশেদের কাছে এসে বললেন “ভাই আমার নম্বরে একটা কল দিন প্লীজ। হাত থেকে পড়ে গেছে, খুঁজে পাচ্ছি না।” রাশেদ ওনার নম্বর জেনে কল দিল, কাছেই মোবাইল পাওয়া গেল। লোকটি থ্যাঙ্কস জানাতে জানাতে রাশেদের কাছে এসে বসল। পাশে বসে নিজে নিজে কথা বলা শুরু করল। রাশেদ বিরক্তি নিয়ে কথা শুনছে।। আরেকজন লোক দূরে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। মনে হয় এই লোকটা সিগারেট পছন্দ করে না। তাই দূরে গিয়ে ফুঁকছে।
লোকটি এক নাগাড়ে কথা বলেই যেতে লাগলেন। দাড়ি কমা নেই। রাশদের শুনতে ইচ্ছা হচ্ছে কি হচ্ছে না তার খবর নেই এক নাগাড়ে বলেই যাচ্ছেন। হঠাৎ লোকটির কথায় রাশেদের আকর্ষণ বেড়ে গেল। প্রতি বছর ঠিক এই দিনে তারা কক্সবাজারে আসেন। আজ থেকে ২৩ বছর আগে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হয়। ঐ মহিলার বিশ বছর বয়সী ছেলে ঐ ঝড়ে জলোচ্ছাসে পানিতে ডুবে মারা যায়। সাগর তাকে যে টেনে নিয়ে গেল আর দেখা নেই। ছেলের লাশও খুঁজে পাওয়া গেল না। কয়েক বছর পর ঐ মহিলার পরিবার ডিভি পেয়ে আমেরিকায় চলে যায়। প্রতি বছর ঐ মহিলা ২৯শে এপ্রিল সুদূর আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে আসেন এবং এই কক্সবাজারের বীচে সারা রাত বসে থাকেন। ২৩ বছর পরেও ছেলের মায়া ভুলতে পারেননি তিনি। যিনি গল্প করছেন তিনি হলে এই মহিলার বোনে ছেলে। মহিলার গল্প শুনতে শুনতে রাশেদের হঠাৎ করে মায়ের কথা মনে পড়ল। তার মাও কি এরকম প্রতি বছর কক্সবাজারে আসবেন?
রাশেদ মায়ের কাছে ফোন দিল “মা, কাল সকালের গাড়ীতে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিব। তোমাকে ছাড়া আর ভাল্লাগছে না।”
বিষয়: বিবিধ
১১৯৪ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এই জাতের হাইব্রিড ছাগলগুলোরে পশ্চাতদেশে লাথি মেরে ফেলে দেয়া উচিত। একটা মেয়েকে পায়নি- তাতেই আত্মহত্যা! শালা মানুষ নামে কলঙ্ক।
মন্তব্য করতে লগইন করুন