আমরা যেভাবে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছি

লিখেছেন লিখেছেন লালসালু ২৪ এপ্রিল, ২০১৪, ০৫:৫৯:৩৪ বিকাল

১)

বাচ্চাটা কাঁদছে। কারণ সে দুধ দিয়ে ভাত খাবে। তাকে ভর্তা দিয়ে ভাত দেয়া হয়েছে। পাশে বসে বাচ্চার মা রোকেয়াও কাঁদছে। কারণ এই বেলা ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে পারছে। রাতের বেলা সম্ভবত উপোষ থাকতে হবে। বস্তির বাড়ী ভাড়া দুই মাসের বাকী। কিছুক্ষন আগে বাড়ীওয়ালা এসেছিল। দুইদিনের মধ্যে ভাড়া না দিলে বের করে দিবে। বাচ্চা তো বোঝে না মায়ের কষ্ট। দুধ কেনা তো দূরের কথা ভাত রান্নার মত চাল কেনার সামর্থ্য রোকেয়ার নেই।

স্বামী হারা রোকেয়া গার্মেন্টসে চাকরি নেয় পাঁচ বছর আগে। কোন মতে সংসার চলত। খাওয়ার লোক মাত্র দুইজন, সে আর তার পিচ্চি ছেলে। গত দুই মাস আগে তাদের ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেছে। ফ্যাক্টরি ঠিকঠাক মত চলছিল। হঠাৎ কোথা থেকে আট দশ জন লোক আসল। কী জানি কী পরীক্ষা করে বলল “ফ্যাক্টরি অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ।” সেই থেকে আজো ঐ ফ্যাক্টরি বন্ধ। ঐ মাসের বেতন এখনো পায় নি। এরপর কাজের সন্ধানে বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে ঘুরেছে কিন্তু কোথাও চাকরি নেই। ছেলেটার কান্নার আওয়াজ বেড়ে গেছে। ইচ্ছা হয় গালে দুইটা কোষে লাগাই। ভাত পাস না আবার দুধ খেতে চাস হারামজাদা!

২)

শিল্পী জীবনে কখনো ভাবে নি তাকে পতিতা বৃত্তি করতে হবে। যে লোকটার সাথে সে শুয়ে আছে তাকে দেখেই গা ঘিন ঘিন করছে। অথচ রাতে তার সাথে অনেক কিছু করতে হয়েছে। লোকটা যে সিগারেট খাচ্ছে তা থেকেও বিশ্রী গন্ধ বের হচ্ছে। তার বমি আসছে। তাকে পাঁচশ টাকা দেয়ার কথা থাকলেও ‘ম্যাডাম’ তাকে তিনশ টাকা দিল।

শিল্পী “কথা ছিল পাঁচশ টাকা দেয়ার।”

ম্যাডাম “তোর মত কত মেয়ে রাস্তায় ঘুরে। দুইশ টাকায় তোর চেয়ে ভাল মেয়ে পাওয়া যায়। নিলে নে নইলে ভাগ।”

শিল্পী জানে এই টাকা না নিলে তার লস। এছাড়া মার্কেট খারাপ যাচ্ছে। গত বছর যেসব মেয়ের সাথে একত্রে গার্মেন্টসে চাকরি করত তাদের অনেকেই এখন তার মত পতিতা বৃত্তি করে। কিছুই করার নেই। কারণ গার্মেন্টসে লোক নিয়োগ দেয়া নিষেধ। কারণ-যথেষ্ঠ পরিমান কাজ নেই। কম বেতনে এক গার্মেন্টসে চাকরি পেয়েছিল কিন্তু হঠাৎ করে একদল লোক এসে ঐ ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দিয়েছে। তারা বলেছে বিল্ডিং এর ফিটনেস নেই। ভাগ্য ভাল বিল্ডিং এর ফিটনেস না থাকলেও তার শরীরের ফিটনেস এখনো আছে। টানা তিন মাস বেকার থেকে খেয়ে না খেয়ে ছিল। তার সাথে কাজ করত এক মেয়ে পরামর্শ দিল এই লাইনে আসার। শিল্পী দেখল কিছু করার নেই। বাড়ীতে বাবা অসুস্থ- হাঁপানী। ওনার ঔষধ বাবদ প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা লাগে। এছাড়া ঢাকা শহরে থাকা খাওয়া মিলে শিল্পীরই লাগে তিন হাজার টাকা। গার্মেন্টসে চাকরি করে আট হাজার টাকা বেতন পেত।

১ নং ঘটনার গার্মেন্টসের মালিক তুহিন সাহেব। উদ্বিগ্ন হয়ে ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের সামনে বসে আছেন। গত মাসে উনি ওনার প্রাইভেট কার বিক্রি করেছেন। আজকাল সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ীর দামও কম। সিএনজি করে ব্যাঙ্কে এসেছেন। ব্যবসার জীবনে কখনো এত উদ্বিগ্ন হন নি। এলায়েন্সের লোকজন এসে ওনার ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দিয়েছে। সাভারে একটা বিল্ডিং ভাড়া করে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি চালু করেছিলেন আজ থেকে দশ বছর আগে। তখনকার বিল্ডিং কোড ও বায়ারের আইন অনুযায়ী সব ঠিক ছিল। কিন্তু এর মধ্যে তিন চারবার বিল্ডিং কোড বদলেছে। সর্বশেষ রানা প্লাজা ও তাজরীন ফ্যাশনে আগুন লাগার পরে আইন অনেক বদলেছে। নতুন আইন অনুযায়ী ওনার বিল্ডিং বেআইনি! এই বিল্ডিং এ ওনার অনেক ইনভেস্টমেন্ট রয়েছে। এই মুহূর্তে বিল্ডিং ছেড়ে দিয়ে অন্য স্থানে স্থানান্তর করা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারনে এই বছর অর্ডার কম। যেগুলো পেয়েছে তার দামও কম। এর মধ্যে দুই মাস ধরে ফ্যাক্টরি বন্ধ। ব্যাঙ্ক লোন শোধ করার জন্য ব্যাঙ্ক থেকে বারবার তাগাদা দিচ্ছে। আজ শেষ বারের মত ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের সাথে মিটিং করতে এসেছে।

মিটিং ব্যর্থ হল। তুহিন সাহেব বাসা থেকে স্ত্রী ছেলে মেয়ের সাথে কথা বলে কী করতে হবে সেই সিদ্ধান্ত নিয়েই এসেছেন। ফ্যাক্টরি যেহেতু বন্ধ হয়ে গেছে তাই ওনার লোন শোধ করতে হলে ব্যাঙ্ক ওনার বন্ধকীকৃত সম্পত্তি নিলামে তুলবে। হিসাব করে দেখলেন যে সম্পদ নিলামে তুলবে তার মূল্য প্রায় দশ কোটি আর ঋণ আছে ষোল কোটি টাকার মত। এরপর কোর্ট আদেশ করলে বন্ধকীকৃত সম্পদ ছাড়াও ওনার অন্য সম্পদে ব্যাঙ্ক হাত দিবে সেটাও নিলামে উঠবে। উনি চালাকি করে নিজের নামে কোন সম্পদ গড়েন নি। ছেলের নামে পূর্বাচলে পাঁচ কাঠা, মেয়ের নামে উত্তরায় একটি ফ্ল্যাট ও স্ত্রীর নামে বাড্ডায় একটি চারতলা বাড়ী আছে। সিদ্ধান্ত নিলে দশ কোটি টাকার সম্পদ ছেড়ে দিবেন, গার্মেন্টস ব্যবসা আর জীবেন করবেন না। চারতলা বাড়ী ভাড়া দিয়ে নিজেরা উত্তরার ফ্ল্যাটে থাকবেন। বাড়ী ভাড়া বাবদ মাসে এক লাখ টাকা পাবেন। তা দিয়ে কোন মতে চলবেন। ছেলে মেয়ের নামে এফডিআর করা আছে তা ভেঙ্গে তাদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা হবে। জীবনে আর গাড়ী চালাবেন না। কারণ গাড়ী চালানোর মত টাকা পয়সা ওনার হাতে নেই।

২ নং ঘটনার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক রাজীব সাহেব ব্যাঙ্ক কতৃক দেউলিয়া হয়ে গেছেন। ওনার সব সম্পদ ব্যাঙ্ক জব্দ করেছে। উনি এর আগে পুরা ফ্যামিলী কানাডা পাঠিয়ে দিয়েছেন। পাঁচ লাখ ডলার খরচ করে ফুল ফ্যামিলী কানাডার নাগরিকত্ব পেয়েছে। এখন বাকী জীবন ওখানেই কাটাতে হবে।

এই হল শ্রমিক আর মালিকের পার্থক্য। শ্রমিক দেউলিয়া হলে ভাত না খেয়ে থাকতে হয়, পতিতা বৃত্তি করতে হয় আর মালিক দেউলিয়া হলে………

এখন বলছি আমি কেন উপরের ঘটনাগুলো আজ বর্ণনা করলাম। গত বছর রানা প্লাজা ও তাজরীনে আগুন লাগার পরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো বাংলাদেশের শ্রমিকদের মানবাধিকারের জন্য সোচ্চার হয়ে উঠেছে। সাথে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশের মানুষও। কিন্তু আমরা অনেকেই নিজের অজান্তেই নিজের পায়ে কুড়াল মারছি। ফেইসবুকে অনেক বন্ধুদের প্রোফাইল পিকচারে দেখলাম ‘মেইড ইন বাংলাদেশে’ এর রক্তাত্ব লোগো। এর মানে হল বাংলাদেশের শ্রমিকদের রক্তে বানানো পোষাক। এই রক্তমাখা লোগো তৈরি করেছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। শ্রমিকদের ভাল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে এটা যেমন সত্যি তেমনি এই ভাল পরিবেশের ব্যবস্থা একদিনেই করা যাবে না এটাও ওদের মাথায় রাখতে হবে। একটি ফ্যাক্টরি বেঁচে থাকলে তাতে কাজ করে কয়েক হাজার মানুষ খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারবে কিন্তু সেই ফ্যাক্টরি বন্ধ হলে এই দুই তিন হাজার মানুষের কী হবে? রিস্ক তো সব কাজে আছে। লাখ টাকার টিকেট কিনে বিমানে চড়তেও রিস্ক। তাই বলে কি বিমানে চড়া বন্ধ হয়ে যাবে? কোন ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেলে মানবাধিকার সংগঠনগুলো আনন্দে বগল বাজাবে “এইতো আমরা একটি খারাপ ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দিয়েছি।” ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেলে ঐ ফ্যাক্টরির মালিকের কাছ থেকে এক টাকাও বেতন দাবী করা যাবে নয়া। মালিক বলবেন “ঠিক আছে আ মার সব নিয়ে যাও। যা খুশী তাই কর।” তাতে কি শ্রমিকের পেট ভরবে?

রানা প্লাজার ঘটনা পরে ফেইসবুকে ইভেন্ট খোলা হয়েছে। স্টেটাসে অনেকেই দিয়েছেন বড় বড় কাস্টমারের কাছে মেইল করতে হবে। মেইলে লেখা আছে “বাংলাদেশের শ্রমিকরা খুব দুঃসহ জীবন যাপন করছে। সুতরাং বাংলাদেশ থেকে তোমরা পোষাক আমদানী বন্ধ করে দাও।”

ঐ সময়ে যদি আমি এর প্রতিবাদ করতাম তাহলে আমাকে গালাগালি করা হত। আমি মেইলে অনেককে জানিয়েছি বিনিময়ে ‘মালিকের দালাল’ উপাধি পেয়েছি।

গত ছয় মাস আমাদের ফ্যাক্টরিতে কোন শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। বরং ছুতা পেলেই শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে। শূণ্য পদে শ্রমিকও নেয়া হচ্ছে না।

অতএব বন্ধুরা আমরা নিজেরা নিজেদের পায়ে যেন কুড়াল না মারি।

বিষয়: বিবিধ

১১২০ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

212744
২৪ এপ্রিল ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৩০
সুশীল লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
212749
২৪ এপ্রিল ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৪১
নীল জোছনা লিখেছেন : একটানে পড়ে ফেললাম। খুবই হতাশাজনক কথা। এই যদি হয় দেশের অবস্থা তাহলে কয়েক বছর পর যে কি হবে বলতে পারি না। আর গার্মেন্টেসের মেয়েদের জন্য সত্যি কষ্ট হয়। Sad
212780
২৪ এপ্রিল ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:১৯
মেঘ ভাঙা রোদ লিখেছেন : এই যদি হয় বাস্তবতা । Sad Sad আল্লাহ তুমি নাকি রিজিকদাতা তাহলে তাদেরকে কি তুমি এই কপালে লিখে রাখছিলা?
212796
২৪ এপ্রিল ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৩৪
ফেরারী মন লিখেছেন : তাদেরকে নষ্ট বানানোর জন্য কি আমরাই দায়ি নই? একদিনে চরম দুর্নীতি, লুটপাট অন্যদিকে হাহাকার।
212825
২৪ এপ্রিল ২০১৪ রাত ০৮:২৩
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : আপনার সাথে একমত। তবে কিছু কিছু ফ্যক্টরিতে সমস্যা যে নেই তাও নয়।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File