মক্কার পথে-১

লিখেছেন লিখেছেন লালসালু ১৪ এপ্রিল, ২০১৪, ১১:০৭:৫০ রাত



রোমান সেনাপতি থিওডাস তাবুর সামনে পায়চারী করছেন। তার সামনে দন্ডায়মান আরব ব্রিগেডের এক ব্যাটালিয়ান কমান্ডার জাহাদ।

সেনাপতি “তুমি বলতে চাচ্ছ তুমি মুহাম্মদের নবুয়াত সম্পর্কে কিছু জান না।”

করজোর হাতে জাহাদ “না হুজুর কিছুই জানি না। যেদিন গোত্র ছেড়েছি সেদিন থেকে ঐ এলাকার প্রতি আমার কোন আগ্রহই নেই। আমি নবুয়তের আগে ওনাকে দেখেছি তবে বুঝিনি উনি নিজেকে নবী দাবী করবেন।”

সেনাপতি জাহাদকে বিদায় হতে বললেন। জাহাদ পেছনের দিকে উল্টা ভাবে দশ কদম পিছিয়ে কুর্ণিশ করে উল্টা দিকে হাঁটা শুরু করল। এটাই ছি তখন রোমানদের নীতি।

ঘোড়া নিয়ে তাবুতে ফিরতে ফিরতে অনেক সময় লেগে গেল। তাবুর কাছে ফেরত আসার পর পরই সাথীরা তাকে ঘিরে ধরে “কী হয়েছে? সেনাপতি ডাকল কেন? কোন সমস্যা?”

কপালের ঘাম মুছতে মুছতে জাহেদ বলল “আমিও ভেবেছিলাম কোন অন্যায় করেছিলাম কি না। পরে আমাকে আমাদের এলাকার নবী দাবী দার মোহাম্মদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হল। আমি তো তার সম্মন্ধে কিছুই জানি না। কী জানাব?”

আবিসিনিয়ার এক আরব কমান্ডার বলল “আমি নবী সম্মন্ধে জানি। তিনি কুরাইশ বংশের লোক। লোকে বলে তিনি সত্যবাদী।”

জাহাদ বলল “সারা মক্কায় তিনিই ছিলেন একমাত্র সত্যবাদী। ওনার শত্রুপক্ষের কাবিলার (গোত্র) লোকজনও ওনার কাছে মালামাল আমানত রাখতেন। সকাল সকাল উঠতে হবে, শুয়ে পড়।”

ঘুমাতে গিয়েও জাহেদের সহজে ঘুম আসল না। তার মনে পড়ে গেল মক্কার সেই দিন গুলোর কথা। হুমায়রার কথা, যাকে সে জীবনের চাইতে বেশি ভালবেসেছিল। আজ হুমায়রা বেঁচে নেই তাই মক্কার প্রতি তার বিন্দু মাত্র আগ্রহ নেই। এই নবীর কথা সে দু’একজন আরবের মুখ থেকে শুনেছিল কিন্তু মক্কার নাম শুনলেই তার হুমায়রার কথা মনে পড়ে। মক্কার প্রতি তার কোন আকর্ষন নেই আর সেই নবীর প্রতিও নেই।

তখন রোমান সম্রাট হেরাক্লিয়াসের শাসনকাল। রোম তখন বিশ্বের পরাশক্তি। রোমানরা যুদ্ধ করছে আরেক পরাশক্তি ইরানীদের সাথে। ইরানে তখন সাসানীদের শাসনামল চলছিল। রোম-ইরান যুদ্ধে তাদের সীমান্তবর্তী আরবরা নিরপেক্ষ ভূমিকায় থাকতে পারেনি। ইরানের সীমানার আরব জমিদাররা যোগ দিয়েছিল ইরানীদের পক্ষে আর সিরিয়া ও আফ্রিকার সীমানার আরবরা যোগ দিয়েছিল রোমানদের পক্ষে। যুদ্ধে অনেক সৈন্য নিহত হয়। রোমান সম্রাট দেখেন তার আরো সৈন্য দরকার তখন তিনি ভাড়াটে সৈন্য নিয়োগ দিলেন। সিরিয়ায় এক সেনা ক্যাম্পে আরব স্বেচ্ছা সেবক নিয়োগ হচ্ছিল। সেখানেই জাহাদ রোমান সেনা বাহিনীর আরব ব্রিগেডে যোগ দেয়। ছোট বেলা থেকে জাহাদ ছিল ঘোড়ার প্রতি ভক্ত। যেকোন তেজী ঘোড়াকে সে খুব অল্প সময়ে বশ মানাতে পারত। মাত্র দশ বছর বয়স থেকেই আরব ঘোড়ার পিঠে চড়ায় অভ্যস্ত জাহাদের গোত্রের লোকজন জাহাদকে নিয়ে গর্ব করত। বিশেষ করে তার বাবা বলতেন জাহাদকে তিনি বীর যোদ্ধা বানাবেন। গোত্রের লোকদের হত্যার বদলা নিবেন।

জাহাদ রোমান সেনাদলের আরব ব্রিগেডে যোগ দেয় আজ থেকে জন্য বারো বহর আগে। এর মধ্যে তার দ্রুত পদোন্নতি হয়। ক্রমে সে ঘোড় সওয়ার ব্যাটালিয়ানের কমান্ডার হয়। তার অধীনে রয়েছে প্রায় পাঁচশ অশ্বারোহী যার প্রত্যেকেই আরব।

যুদ্ধক্ষেত্রে জাহাদের উল্লেখযোগ্য সাফল্যের মধ্যে একটি হল ইরানীরা যখন বায়তুল মোকাদ্দাস দখল করে তখন প্রচন্ড লড়াই করে সেখানকার খ্রিস্টান পাদ্রীদের নিরাপদে উদ্ধার করে আনা। সেই সাফল্যের কারনে তখন রোমান আঞ্চলিক সেনাপতি থিওডাস তাকে অনেক উপঢৌকন দান করেন। যার মধ্যে ছিল কয়েক হাজার স্বর্ণ মুদ্রা ও নজরকাড়া রোমান দশ সুন্দরী। জাহাদ সব ফিরিয়ে দিয়েছিল। এই ঘটনার পর থেকে জাহাদ রোমান সেনাপতির বিশেষ নজরে পড়েন। রোমান সেনাদলের বিভিন্ন ইউনিট কমান্ডারদের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে সুন্দরী নারীর ব্যবস্থা ছিল, ছিল মদের ব্যবস্থা। কিন্তু জাহাদের সেদিকে আগ্রহ নেই। কেন নেই এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে কাউকে কিছু বলে না।

সেনাপতি থিওডাস ছিলেন হেরাক্লিয়াসের সম্পর্কে ভাতিজা। তার বাবা কন্সটেন্টিপোলের গভর্নর থমাস হেরাক্লিয়াসের ডান হাত হিসেবে পরিচিত। থিওডাস ছিলেন হেরাক্লিয়াসের গোয়েন্দা কর্মকর্তা। যুদ্ধ যখন প্রবল আকার ধারন করে তখন সম্রাটের নির্দেশে থিওডাস দক্ষিনাঞ্চলের রেজিমেন্ট গুলোর দায়িত্ব নেয়। এইসব রেজিমেন্টের বেশিরভাগই আরব সৈনিক। আফ্রিকান একটা রেজিমেন্টও আছে। এটা সেই সময়ের কথা যখন ইরানীরা বায়তুল মুকাদ্দাস সিরিয়া আরমেনিয়া সহ ভূ-মধ্য সাগরের পূর্বের বেশিভাগ এলাকা দখল করেছিল। তাদের সৈন্যদল অবস্থান করছিল কন্সটেন্টিপোল দখল করার জন্য। ওদের সৈন্যরা প্রতিদিন সকালে উঠে নদীর ঐ পাড়ে দেখত হেরাক্লিয়াসের রাজ প্রাসাদ। কিন্তু ভূমধ্য সাগরে হেরাকিয়াসের শক্তি অনেক বেশি ছিল। ইয়ারনীদের যথেষ্ঠ যুদ্ধ জাহাজ ছিল না। তারা এপাড় বসে অপেক্ষা করছিল কখন রোমান সম্রাট দুর্বল হবেন।

জাহাদদের বাহিনী ছিল মিশরের নীল নদের সুরক্ষার দায়িত্বে। এখানে প্রায় এক লক্ষ সৈন্য অবস্থান করছিল। নীল নদ ছিল এই এলাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এই অঞ্চল থেকে রোমানরা রসদ সংগ্রহ করে। এই অঞ্চল হাত ছাড়া করা মানে রোমানদের নিশ্চিত পরাজয়।

রোমান সম্রাট প্রতিদিন একজন করে দূত সকল যুদ্ধক্ষেত্রের সেনাপতিদের পাঠাতেন। রোম থেকে থিওডাসের কাছে দূত এসে সম্রাটের চিঠি দেখালেন। সম্রাট যুদ্ধক্ষেত্রের বিভিন্ন অবস্থা জানতে চাইলেন সাথে এটাও জানতে চাইলেন আরবের নবীর দাবিদার এক লোকের কথা। যেহেতু থিওডাসের অধীনে সব আরব সৈনিক তাই ঐ এলাকার বিশেষ করে মক্কার কেউ থাকলে সেই নবীর সম্মন্ধে জানতে। আরব রেজিমেন্টের ছয় জন কমান্ডারকে থিওডাস ডাকলেন তারা কেউ সেই নবী সম্মন্ধে বলতে পারলেন না। তারা প্রত্যেকেই খবর নিতে লাগলেন তাদের কোন অফিসার অথবা সৈন্য মক্কা বা তার কাছাকাছি থেকে এসেছে কি না। খোঁজ পাওয়া গেল জাহাদের যার বাড়ী মক্কায় যদিও সে তার গোত্র ছিন্ন করে সিরিয়ার বনী কোব্বাদ গোত্রে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ জন্যই সেই রাত্রে তড়িঘড়ি করে জাহাদকে রোমান সেনাপতির সামনে আনা হয়।

জাহাদের ঘুম আসছিল না। বার বার শুধু হুমায়রার কথা মনে পড়ছিল। হুমায়রা ছিল ওদের বংশের সেরা সুন্দরী। জাহাদ তখন বাবার সাথে মেষ চড়াত। জাহাদের বাবার কয়েকটি তেজী আরব ঘোড়া ছিল। একটি ঘোড়া নিয়ে জাহাদ একদিন পাহাড়ী পথে বের হল সেখানেই হুমায়রার সাথে প্রথম দেখা।

সিরিজের বাকী লেখাগুলো চলবে আমার পেইজ https://www.facebook.com/lalsalu.page

বিষয়: সাহিত্য

১১৮২ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

207931
১৪ এপ্রিল ২০১৪ রাত ১১:২৯
খেলাঘর বাধঁতে এসেছি লিখেছেন : মধ্যযুগের মুসলিম দস্যু দখলদারদের স্মৃতি মন্থন করা ছাড়া আর কোন উপায় কি?
207937
১৪ এপ্রিল ২০১৪ রাত ১১:৫১
সুশীল লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
208010
১৫ এপ্রিল ২০১৪ সকাল ০৫:১৪
রাইয়ান লিখেছেন : সুন্দর লেখা...অনেক ধন্যবাদ ।
208053
১৫ এপ্রিল ২০১৪ সকাল ১০:৩০
ভিশু লিখেছেন : Rose Rose Rose

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File