সৃতিতে ১লা বৈশাখ ২০০১

লিখেছেন লিখেছেন লালসালু ১৪ এপ্রিল, ২০১৪, ১০:৫০:৩৮ সকাল

প্রতি বছর ১লা বৈশাখে আমি এই লেখাটা পোষ্ট করি।

২০০১ সালে উত্তরা ৭ নং সেক্টরের একটি প্রাইভেট হোস্টেলে থাকতাম। উত্তরা ৭নং সেক্টরে একটি পার্ক আছে, সেই পার্কে প্রতি বছর ১লা বৈশাখ উপলক্ষ্যে মেলা হয়, বিকেলে হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এই মেলা ও অনুষ্ঠানের দায়িত্ব তখন পড়ত এরশাদের ছোট ভাই জিএম কাদেরের উপর। জিএম কাদেরের বাসা ছিল ৭নং সেক্টরের ৩৪ নং রোডে। সেই মেলায় পান্তা ইলিশের আয়োজন করা হত।

আমারা যেই হোস্টেলে থাকতাম তা ছিল পার্কের পশ্চিম দিকে ২৭ নং রোডে অবস্থিত। তখন ডাইনিং এর মিল রেট ছিল ১৪-১৪-৭ অর্থাৎ দুপুর রাতের খাবার ১৪টাকা করে আর সকালের নাস্তা ছিল ৭টাকা করে। ১লা বৈশাখ উপলক্ষ্যে হোস্টেলের বেশিরভাগ ছাত্র ঢাকায় তাদের আত্মীয় স্বজনের বাসায় চলে গেছে,বাড়ী কাছে যেমন গাজীপুর, টাঙ্গাইল তারা বাড়ী চলে গেছে আর আমার মত আট দশ জন তখন হোস্টেলে ছিল। আমি যাইনি কারন আমার টিউশনি ছিল আর আপনারা জানেন টিউশনিতে ১লা বৈশাখের কোন ছুটি নেই। রাতে অনেকের মত আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম পার্কের মেলায় পান্তা ইলিশ খাব। পান্তা ইলিশ খাওয়ার যে কারনটি হল- এক বছর হল মাত্র ঢাকায় এসেছি। মা সহ পরিবারের সবাই থাকেন চট্টগ্রামে। ১লা বৈশাখ উপলক্ষ্যে বাআয় ইলিশের আয়োজন করা হত। পান্তা থাকত বাই ডিফল্ট। ১লা বৈশাখের যেহেতু চট্টগ্রামে যেতে পারছি না তাই মা আগের রাতে ফোন করে কান্না কাটি করতে করতে বললেন-কোথাও থেকে পান্তা ইলিশ খেয়ে নিতে-এ বছর তো এক সাথে খেতে পারলাম না!

পরদিন ঘুম থেকে উঠলাম দশটায়। পান্তা ইলিশ ও অন্যান্য জিনিস কেনার উদ্দেশ্যে মেলায় গেলাম। মেলায় নারী পুরুষের ঠেলা ঠেলি নিয়ে এই পোস্টে কিছু লিখলাম না কারন এই পোষ্টের উদ্দেশ্য সেটা না। পান্তা ইলিশের স্টলে গেলাম। একটা ভর্তা, পান্তা রাইস (!) আর ছোট্ট এক টুকরো ইলিশ মাছের প্যাকেজের দাম চাইল ১৩০টাকা! দাম শুনে আমার মাথা নষ্ট কারন ঐ সময় গরুর মাংস দিয়ে মাঝারি মানের রেস্টুরেন্টে ভাত খেতে লাগত বেশি হলে তিরিশ টাকা আর তখন ইলিশের দাম অনেক কম ছিল। রেস্টুরেন্টে ইলিশের দাম ছিল প্রতি পিস ৩০ থেকে ৪০ টাকা (দামী রেস্টুরেন্টে)।

দাম শুনে তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম এখানে খাওয়া যাবে না। হোস্টেলে তিন বেলা খেতে খরচ লাগে ১৪+১৪+৭৩ টাকা, এই ১৩০ টাকা দিয়ে চার দিন খাওয়া যাবে। ছাত্র মানুষ, বাসা থেকে যে টাকা দেয় ও টিউশনি থেকে যে টাকা পাই তা দিয়ে কোন রকমে চলে। এর মধ্যে ১৩০ টাকা খরচের উটকো ঝামেলা কেনার মানে হয় না। সারা জীবনই তো ইলিশ খেয়েছি, এই একদিন না খেলে কিছু যায় আসে না।

মেলায় কিছুক্ষন ঘোরাঘোরি করে উত্তরা আজমপুর গেলাম। আজমপুর রাস্তার পূর্ব পাশে তখন অনেক ‘ছালা দিয়া ঢাকা’ রেস্টুরেন্ট ছিল। আমি সারা জীবন খেয়ে এসেছি এইসব ‘ছালা দিয়া ঢাকা’ রেস্টুরেন্টে। এর কারন হল এক-দাম সবচেয়ে কম। তখন এক বেলা গরুর মাংস দিয়ে খেতে লাগল তিরিশ টাকা। দুই-রান্না খুব ভাল। তিন-ওদের খাবার ফ্রেশ। ওদের খাবার কখনো বাসী হয় না। দেশের একমাত্র ছালা দিয়া রেস্টুরেন্টগুলোই এক বেলার রান্না আরেক বেলায় বিক্রি করে না। বেলারটা বেলায়ই শেষ হয়ে যায়। তখন ছালা দিয়া রেস্টুরেন্টে ডাল ‘ফ্রী’ দিত। এখন তারা ডাল ফ্রী দেয় কি না জানি না। এইসব রেস্টুরেন্টে সাধারনত মালিক নিয়েই পরিবেশন করেন, অনেক ক্ষেত্রে মালিক নিকেই রান্না করেন। এই মালিক আমাকে চিনতেন কারন মাঝে মাঝে আমি রুচি বদলের জন্য এখানে এসে কাঁচকি মাছ দিয়ে ভাত খেতাম। এখানকার কাঁচকি মাছ রান্না অনেক মজার। দোকানদার আমাকে দেখেই বললেন “আজ কাঁচকি মাছ রান্না হবে না, গরুর মাংস খেতে পারেন। আমি নিজে বাছাই করে কচি গরুর মাংস কিনেছি। রান্নাও মজা হবে।” ‘মজা হবে’ মানে রান্না এখনো চলছে, আমাকে আধা ঘন্টা পরে আসতে বললেন। বাইরে অনেক গরম, এমনিতেই অনেক হেঁটেছি আর হাঁটতে ইচ্ছে করছে না। ভিতরের টেবিল ফ্যানটা আমার সামনে আনা হল। টেবিল ফ্যানের বাতাস খেতে ভালই লাগছে। সিদ্ধান্ত নিলাম বাইরে আর বের হব না, এখানে খেয়ে ছাত্রের বাসায় যাব। নিজেকে খুব অসহায় মনে হতে লাগল। মধ্যবিত্তের জ্বালা অনেক। কেন যে উচ্চবিত্ত হয়ে জন্মালাম না!

কিছুক্ষন পর কোদাল ও ঝুড়ি/টুকরি হাতে নিয়ে মধ্য বয়সী এক লোক আসলেন। ওনাকে দেখলেই বোঝা যায় উনি এই মাত্র মাটি কেটে এসেছেন। উনি আমার টেবিলে আমার সামনে বসলেন। এসব রেস্টুরেন্টে টেবিলে বসার সাথে সাথেই সামনে ভাত চলে আসে। কাঁচামরিচ, লবণ টেবিলেই থাকে। ছালা দিয়ার মালিক ওনার সামনে ভাত আনলেন “কী খাবেন? গরুর গোস্ত দেরি বিশ মিনিট হবে। কাঁচকি মাছ, আলু ভর্তা, রুই মাছ আছে।” মধ্য বয়সী লোকটি উত্তর দিলেন “কিছু লাগবে না। পারলে ডাল দেন।” দোকানদার বুঝে গেলেন এই লোকটি শুধু ভাত আর ডাল খাবে। যেহেতু ডাল ফ্রী তাই এই ফ্রী জিনিস খেতে এসেছেন। তিনি জানালেন “তরকারীর সাথে ডাল ফ্রী দেয়া হয়। তরকারী না কিনলে ডাল দেয়া হবে না। আর খালি ডাল খেতে চাইলে পাঁচ টাকা দিতে হবে।” উল্লেখ্য যে, তখন প্রথম প্লেট ভাতের দাম ছিল তিন টাকা আর পরবর্তী প্লেট ছিল দুই টাকা। মধ্য বয়সী লোকটি কোন কথা না বলে ভাতে পানি ঢেলে লবণ নিয়ে খাওয়া শুরু করলেন। টেবিলে কাঁচামরিচ ছিল, সেখান থেকে কাঁচামরিচ নিলেন আর পকেট থেকে একটা পেঁয়াজ বের করলেন। উনি মজা করে পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে পানি দিয়ে ভাত খাচ্ছেন আর একের পর এক প্লেট ভাত নিচ্ছেন। বুঝলাম উনি পকেট সব সময় পেঁয়াজ রাখেন কারন তিনি প্রতিদিন পানি দিয়ে ভাত খান। মাংস দিয়ে ভাত খেলে পেঁয়াজ দেয়া হয়, যেহেতু তিনি মাংস দিয়ে খাচ্ছেন না তাই পকেট পেঁয়াজ রাখেন। আপনারা ভাল করেই জানেন হোটেল রেস্টুরেন্টে পেটে যে পরিমান ভাত দেয়া হয় সেটা পরিমানে খুব অল্প। এক মুঠ ভাত নিয়ে তা পুরো লেটে ছড়িয়ে দেয়া হয়। তিন চার লোকমা দিলেই ভাত খাওয়া শেষ হয়ে যায়। এই লোকটি মনে সাত প্লেট ভাত নিলেন। বিল আসল প্রথম প্লেট ভাত ৩ টাকা ও পরবর্তী ছয় প্লেট বারো টাকা মোট পনের টাকা। বিল দিয়ে তিনি পকেট থেকে একটি সিগারেট বের করলেন। আমাকে দেখে ইতস্ত করলেন। বললেন “আপনার কি সিগারেটের অভ্যাস আছে?” উত্তর দিলাম “না”।

“তাইলে আমি বাইরে গিয়ে খাই”

“না না আপনি এখানেই খান। আমার সমস্যা হবে না।” আমার রুম মেটরা সবাই সিগারেট খায়, একজন আবার গাঞ্জা খায়। অকেশনালি না, প্রফেশনার গাঞ্জা খোর! তাই সিগারেট গাঞ্জার গন্ধ আমার কাছে ‘স্বাভাবিক’ মনে হয়। উনি আমার সামনেই সিগারেট ধরালেন। ওনার কথাবার্তা শুনে আমার মনে হল “এই লোক মাটি কাটে কেন? ওনাকে মানায় স্কুল মাস্টার হিসেবে। কতা বার্তা তো সেরকমই মনে হল।”

কিছুক্ষন সংকোচ করে জিজ্ঞাসা করলাম “আপনি কোথায় থাকেন?”

লোকটি মনে হয় আমার একটি প্রশ্নের অপেক্ষায় ছিলেন। একের পর এক নিজের কথা বলতে লাগলেন। উনি থাকেন টংগী রেইল স্টেশনের পাশে এক বস্তিতে। ওনার স্ত্রী ওনার সাথে থাকেন। স্ত্রী এক বাসায় কাজ করেন। যে বাসায় কাজ করেন সে বাসায় দুপুরে খাওয়ায়। রাতে শুধু নিজেরা রান্না করেন। এই লোক দিন মজুরের কাজ করেন। কখনো মাটি কাটা, কখনো কন্সট্রাকশনের কাজ, কখনো স্টেশনের কুলির কাজ করেন। এরপর বলতে থাকলেন ওনার জীবনী।

রহমত মাস্টার নামে এলাকায় পরিচিত এই মধ্যবয়সী লোকের বাড়ী ছিল সিরাজগঞ্জের কাজীপুর থানায়। কাজীপুর হল নদী ভাঙ্গা এলাকা। ওনাদের বাড়ী এখন নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এর আগে তিনি ছিলেন ঐ এলাকার একটা স্কুলের মাস্টার। এলাকায় রহমত মাস্টার নামে পরিচিত ছিলেন। ওনার দুই ছেলে ছিল, রোগে শোকে মারা গেছেন। ছেলে হারা পঞ্চাশ বয়সী এই দম্পতী পরে ঢাকায় ভাগ্যান্বষণে আসেন। কুলি মজুর মাটি কাটা ছাড়া আর কোন কাজ পাচ্ছেন না। আর বয়স বেশি বলে এই কাজ কেউ দিতে চায় না। মাঝে মাঝে কাজ পান। যেহেতু প্রতিদিন কাজ করতে পারেন না প্রতিদিন আয় হয় না তাই প্রতিদিন তিন শুধু পানি দিয়ে ভাত খান। বাসায় আধা কেজি পেঁয়াজ কিনে রেখেছেন। প্রতিদিন একটি করে পেঁয়াজ নিয়ে ঘর থেকে বের হন। ভাত খেতে গেলে পেঁয়াজ মরিচ পানি হলে আর কিছু লাগে না। এভাবে টাকা বাঁচিয়ে আরেকদিন খেতে পারেন।

ওনার কথা শুনে আমার দুঃখ ভুলে গেলাম। আমি যদি ১৩০ টাকা দিয়ে পান্তা ইলিশ খেতে না পেরে কষ্ট পাই তাহলে এই লোক তিন বেলা ডাল ভাত খেতে না পেরে ওনার কি অবস্থা! ওনাকে দেখে আমার অনেক সুখী মনে হল। আমি ঐ বেলা ভাত খেলাম না, খিদে চলে গেছে।

গল্পের এখানেই শেষ। এই লেখা আমি প্রতি বছর বিভিন্ন ব্লগে পোষ্ট করি। প্রথম বার যখন সামহোয়ার ইন ব্লগে পোষ্ট করেছিলাম তখন সুইডেনে থাকেন এমন একজন আমাকে রাতে ফোন করেছিলেন। উনি জানালেন, আমার লেখাটা পড়ে উনি অনেক ক্ষন কেঁদেছিলেন কারন উনি সুইডেনে ১লা বৈশাখের দিনে শুধু নুডুলস খেয়ে ছিলেন। এছাড়া আর কোন বিকল্প ছিল না।

বিষয়: সাহিত্য

১০২১ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

207521
১৪ এপ্রিল ২০১৪ সকাল ১১:১১
হতভাগা লিখেছেন : ভাত -গরুর মাংশকে পহেলা বৈশাখের থিম আইটেম বানানো উচিত । বাংলা নববর্ষের প্রচলন মুসলমানরাই করেছিল ।

গরুর মাংশ ইলিশের চেয়ে কম দুষ্প্রাপ্য এবং দামও হাতের নাগালে । সাধারন খেটে খাওয়া মানুষের কাছে ইলিশের চেয়ে গরুর মাংশের Access বেশী এবং acceptance ও বেশী ।
২৪ এপ্রিল ২০১৪ রাত ০৮:২১
161098
লালসালু লিখেছেন : পহেলা বৈশাখ জিনিসটাই তো আকামের দিবস। এটা পালন করার কী দরকার?



207538
১৪ এপ্রিল ২০১৪ সকাল ১১:৪৩
ভিশু লিখেছেন : ভাত+গরু... Rolling Eyes
Love Struck Love Struck Love Struck
Rose Rose Rose
207546
১৪ এপ্রিল ২০১৪ সকাল ১১:৫১
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : হৃদয়স্পর্শি ঘটনাটির জন্য অনেক ধন্যবাদ।
আসলে বৈশাখের নামে পান্তা ইলিশ একটি অপসংস্কৃতি ছাড়া কিছুই নয়। আমি যদিও কখনও গ্রামে যাইনি যতটুক শুনেছি ১লা বৈশাখ সাধারন খাবারের বাইরে বেশি হলে মিষ্টি ও পিঠা খাওয়া হতো।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File