দেশে একটা নীরব বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে, কেউ কি টের পাচ্ছেন?
লিখেছেন লিখেছেন লালসালু ১৭ মার্চ, ২০১৪, ০৭:২১:১৫ সন্ধ্যা
শরীফ ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি এবং ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। ওনার বাবাও এক সময় ছিলেন এই ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি। শরীফ গত তিন মাস ধরে নিজ বাড়ীতে ঘুমাতে পারছেন না। পুলিশ কয়েকবার বাড়ীতে হানা দিয়েছে যশোরের মনিরামপুর এলাকাটা বিএনপির ঘাঁটি। এই এলাকায় আয়ামীলীগের সমর্থক বেশি হলে বিশ শতাংশ। জামাতের সমর্থক তার চাইতে বেশি। গত সপ্তাহে শরীফকে পাশের বাড়ী থেকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। ঐ বাড়ীতে যে শরীফ ঐ রাতে ঘুমিয়ে চিল তা শুধুমাত্র তার স্ত্রী, মা ও দু’জন বিএনপি নেতা জানতেন। স্ত্রী, মা জীবনে পুলিশের কাছে তথ্য দিবেন না এটাই স্বাভাবিক, শরীফের মনে সন্দেহ ঐ দু’জন বিএনপি নেতা আওয়ামীলীগের কারো কাছে টাকা খেয়ে হয়তো পুলিশের কাছে তথ্য দিয়েছে। টাকা খাওয়া ছাড়াও আরেকটা কারন আছে, ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতির পদের দিকে অনেকেরেই নজর। কারন এই ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি হলেই নিশ্চিত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়া যায়। গত নির্বাচনে ষাট শতাংশ ভোট পেয়ে শরীফ নির্বাচিত হন। দুই সপ্তাহ আগে শরীফের দু’তলা মার্কেট পুলিশ বুলডোজার দিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে যায়। এই মার্কেটের পেছনে শরীফের জীবনের সকল ইনভেস্ট ছিল। এখন শরীফ পথের ফকির। ব্যাংক লোন ও ব্যাক্তিগত লোন মিলিয়ে প্রায় তিরিশ লাখ টাকা ধার দেনা কীভাবে শোধ করবে এই চিন্তা করতে করতেই এখন নতুন চিন্তা যোগ হল- কীভাবে জেল থেকে ছাড়া পাবে? কারন জেল থেকে ছাড়া পাবার প্রক্রিয়ায় অনেক টাকা লাগবে প্রায় লাখ পাঁচেক। শরীফের বড় ভাই বিদেশ থাকেন, তার ফ্যামিলী শরীফকে দেখতে হয় আর ছোট ভাই দুই মাস ধরে ঢাকায় পলাতক। মোটামোটি এক ভয়ঙ্কর অবস্থায় আছে। শরীফের স্ত্রী বেশি লেখাপড়া করে নাই। গ্রামের এক লোক ধরে এক উকিলের কাছে কোনমতে পৌঁছাল। এই উকিল আবার যশোরের নাম করা উকিল। যশোর বারের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং একবার বিএনপির সমর্থন নিয়ে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এখন তিনি জেলা বিএনপির গুরত্বপূরণ পজিশনে আছেন।
উকিল- এই কেসে জামিন পাওয়া যাবে না। সরকারের নির্দেশ। তার চেয়ে বরং পরিস্থিতি একটা ঠান্ডা হোক। তখন জামিন নেয়া যাবে।
শরীফের স্ত্রী- পুলিশ নাকি অনেক মার দেয়… বলতে বলতে শরীফের স্ত্রী কেঁদে ফেলল। সাথে স্ত্রীর কোলে থাকা দুই বছরের ছেলেটিও মায়ের কান্না দেখে কেঁদে ফেলল। বড় ছেলেটি ক্লাস থ্রিতে পড়ে। তাকে আনে নি।
উকিল- কিছু টাকা পয়সা খরচ করতে হবে। টাকা পেলে পুলিশ মারবে না।
শরীফের স্ত্রী- টাকা পাব কোথায়? এমনিতেই মামলা চালাতে অনেক ধার দেনা হয়ে গেছে, মার্কেটটাও পুলিশ ভেঙ্গে দিয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
বিএনপি নেতার মিটিং আছে, ঢাকা থেকে তরিকুল ইসলাম আসবেন তাই শরীফের স্ত্রীকে বেশি সময় দিতে পারলেন না। আজ ছয় দিন হল শরীফকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। শরীফের চাচাতো ভাই পরদিনই আদালতে এসেছিল। পুলিশ শরীফের সাথে দেখা করতে দেয় নি।
শরীফের স্ত্রী রুকাইয়া স্কুলের গন্ডি পেরোতে পারেনি। ক্লাস টেনে পড়া অবস্থায় শরীফের সাথে প্রেম হয়, তারপরে বিয়ে। এরপরে আর লেখাপড়া করতে পারেনি। বাড়ীতে পৌঁছে দেখে শরীফের মা গুরুতর অসুস্থ। গ্রেফতারের দিন তিনি দু’বার অজ্ঞান হয়েছিলেন। এরপর থেকে স্যালাইন দিয়ে রাকাহ হয়েছে। আজ কেমন যেন করছে। দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। এখানেও টাকা দরকার। টাকা পাবে কোথা থেকে। চারিদিকে শুধু পাওনাদার আর পাওনাদার। দোকান চালু থাকলে তা থেকে কিছু টাকা আনা যেত। শরীফের এক চাচাতো ভাই ও তার বউ মিলে একটি গাড়ী যোগাড় করে যশোর সদর হাসপাতালে শাশুড়ীকে নিয়ে গেল। শরীফের স্ত্রী গেল ব্যাংকে। ব্যাংকের ম্যানেজাররে কামরা।
ম্যানেজার- আমি দুঃখিত আই আসলেই কিছু করতে পারছি না। পুলিশ এসে লিস্ট দিয়ে গেছে, তাদের মধ্যে আপনার স্বামীও আছেন, এসব একাউন্ট থেকে টাকা পয়সা লেন দেন করা যাবে না। একাউন্টের লাস্ট ট্রানজেকশন তারা রেকর্ড করে নিয়ে গেছে। সুতরাং আমি যদি গোপনে টাকা দেই তাহলে আমার চাকুরি যাবে। ‘জঙ্গী মদদের’ অভিযোগে জেলেও যেতে পারি।
অনেক আহাজারী করেও শরীফের বউ টাকা তুলতে পারে নি। শরীফ জানতেন যেকোন দিন তিনি গ্রেফতার হতে পারেন। তাই এই ব্যাংকের একাউন্টে যৌথ সাক্ষরের ব্যবস্থা রেখেছে। শরীফ অনেকগুলো চেকে সাইন করে রেখেছে। শরীফের বউয়ের প্রয়োজন হলে চেকে নিজের সাইন করে টাকা তুলে নিতে পারবে। এই একাউন্টে বিপদ আপদ ঠেকানোর জন্য তিন লাখ টাকা ছিল।
রুকাইয়ার মাথায় এখন দু’টি চিন্তা। এক-পুলিশকে টাকা দিতে হবে যাতে পুলিশ শরীফকে মার না দেয়। দুই-শাশুড়ীর চিকিৎসার ভার বহন। সাত দিন হয়ে গেল এখন পর্যন্ত কোনভাবেই শরীফের সাথে যোগাযোগ করা গেল না। বেচারা কী খাচ্ছে, না খাচ্ছে আল্লাহই জানেন। খাবার নিয়ে কয়েকবার তার ভাই জেলে এবং থানায় গিয়েছিল কিন্তু এই দু’টি চিন্তার বাইরে মাঝে মদ্যে এরেকটি চিন্তা মাথায় উঁকি দেয়। পত্রিকায় প্রায় দেখি বিভিন্ন স্থানে বিএনপি নেতাদের ক্রসফায়ার করা হচ্ছে। যদি এরকম কিছু হয় তাহলে… নাহ আর ভাবতে পারছে না।
বড় ছেলে স্কুল থেকে বাসায় ফিরেছে, সে আর স্কুলের যাবে না। তার বন্ধুরা তার দিকে চেয়ে হাসে বলে “তোর বাপে কি চুরি করছে? পুলিশ কি ভাল মানুষকে ধরে?”
রুকাইয়ার বড় বোনের হাসবেন্ড রাজশাহীতে পুলিশে চাকুরি করে এসআই পদে। তিনিও কোন সাহায্য করতে পারলেন না। রুকাইয়ার এখন একমাত্র চাওয়া যেভাবেই হোক শরীফের সাথে যোগাযোগ করা, ওর কাছে খাবার দাবার পৌঁছানো। জেলে নাকি টাকা দিয়ে খাবার পাওয়া যায়, দরকার হলে কিছু টাকা ধার করে জেলে পৌঁছে দিবে। কিন্তু কার মাধ্যমে যোগাযোগ করবে?
-
শরীফ গ্রেফতার হয়েছে আজ তিরিশ ঘন্টা হয়েছে। এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র এক বোতল পানি খেয়েছে। খিদায় টেনশনে অবস্থা খারাপ। এর মধ্যে আদালত জেলে চালান করে দেয়। ভাগ্য ভাল রিমান্ডে নেয় নি। হয়তো পরে নিবে কারন রিমান্ডেও বিশাল লাইন। কয় হাজার লোকের রিমান্ড নিবে! বাড়ীর খবর নিতে হবে। পুলিশকে ঘুষের অফার দিয়েছে যাতে একটা ফোন করতে পারে কিন্তু পুলিশ রাজী না। বরং পকেটে টাকা পয়সা যা ছিল তা হাতিয়ে নিয়ে গেছে। জেলে যাওয়ার পর মনে হল প্রচন্ড খিদা পেয়েছে। জেলে সকালে রুটি দেয় এগারোটার দিকে ভাত দেয় আবার ছ’টায় ভাত দেয়। শরীফ জেলে পৌঁছেছে বেলা দু’টায়। অর্থাৎ ভাত দিতে আরো চার ঘন্টা বাকী। এসময় পানি খেয়ে কাটাতে হবে, কিছু করার নেই।
-
কাজের লোক এসে জানাল রুকাইয়ার সাথে এক লোক দেখা করতে চায়। রুকাইয়া লোকটির সাথে দেখা করল। চাপ দাড়িওয়ালা কম বয়সী ছেলেটি একটি সাইকেলে করে এসেছে।
সালাম দিয়ে নিজের পরিচয় দিল। সে এই ইউনিয়ন শিবিরের সভাপতি। জেল থেকে শরীফের খবর নিয়ে এসেছে।
রুকাইয়া এখন এলাকার জামাত শিবির নেতাদের মাধ্যমে শরীফের খবর নেয়, চিঠি পত্র আদান প্রদান করে। জামাতের এক রুকন উকিলের মাধ্যমে কেস চালায়। উকিল বলেছেন, আপাতত হাত খরচের টাকা দিলেই চলবে পরে জামিন হলে টাকা পয়সার ব্যবস্থা হলে টাকা দিলেও চলবে।
শরীফ এখন জেলে ভালই আছে। ক্যান্টিন থেকে খাবার দাবার আনিয়ে নিতে পারে। এই জেলের নব্বই ভাগ আসামী জামাত শিবির। এরা পুরো জেইল নিয়ন্ত্রন করে। জামাত শিবিরের নেতাদের সাথে এখন সে খুব ভাল ভাবে মিশে। তাদের সাথে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। সকালে ফরজরের পরে তা’লিম হয়। এটাকে দারসুর কোরান বলে। বাইরে থেকে জামাত শিবিরের মাধ্যমে বাড়ী থেকে খাবার দাবার আনিয়ে নিতে পারে। মামলাও চালাচ্ছে যশোর জেলা জামাতের নায়েবে আমীর। টাকা পয়সা নাকি এখন দিতে হবে না। মা স্ট্রোক করেছেন। যশোর সদর হাসপাতাল থেকে ঢাকায় ইবনে সিনাতে ট্রান্সফার করা হয়েছিল। জামাতের এক নেতার রেফারেন্সে ইবেন সিনাও বাকীতে চিকিৎসা করেছে। আশি হাজার টাকা মত বিল হয়েছে যার মধ্যে মাত্র বিশ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে বাকী ষাট হাজার টাকা জেল থেকে মুক্তি পেয়ে দিয়ে আসবে। জেলে বিএনপির অনেক নেতা কর্মী থাকলেও দল থেকে তাদের কোন মামলার খরচ যোগানো হয় না যা জামাতের লোকজন করছে। শুধু তাই নয়, যেসব বিএনপি নেতা কর্মী মামলা চালাতে পারছে না তাদের মামলাও জামাতের উকিলরা ফ্রি/বাকীতে করে দিচ্ছে। শরীফ শপথ নিল এবার জেল থেকে ছাড়া পেলে বিএনপি করবে না, তবে জামাতেও যোগ দিবে না।
এক মাস পরে শরীফ জেল থেকে ছাড়া পেল। উপজেলা নির্বাচনে জামাতের একজন ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী দাঁড়িয়েছে। যার নুন খেয়েছে তাদের কছুটা গুণ গাইতেই হবে। যে দলের জন্য শরীফ জেলে গিয়েছিল তাদের কেউ কেস চালায়নি অথচ এই উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর বড় ভাই তার মামলার ভার নিয়েছেন। শরীফ পুরোদমে ঐ জামাত নেতার পক্ষে প্রচারনা চালায়। ফলাফল হিসেবে ঐ ভাইস চেয়ারম্যান বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়। যে গ্রামে জামাতের ভোট ছিল দুহাজার ভোটারের মধ্যে একশ’র কম সেই গ্রামেই জামাতের ভোট পড়েছে হাজারেরও উপরে।
শরীফের মনে হতে লাগল যে দল নেতা কর্মীদের প্রতি এত লক্ষ্য রাখে সেই দলের পরাজয় কখনো ঘটবে না। জামাতের ব্যাপারে তার উৎসাহ বেড়ে যেতে লাগল।
বিঃদ্রঃ শহীদ জিয়াউর রহমানের সৃতি বিজড়িত বগুড়া ও এরশাদের এলাকা রংপুর এখন জামাত শিবিরের অন্যতম ঘাঁটি। দেশে একটা নিরব বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে সেদিকে কি বিএনপি নেতা কর্মীদের খেয়াল আছে?
পুনশ্চঃ উপরের ঘটনাটি একটি সত্যি ঘটনা। শুধু নাম ঠিকানা পরিবর্তন করা হয়েছে। এখন সাবধান না হলে ভবিষ্যতে বিএনপি জামাতের মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে।
বিষয়: বিবিধ
১৫০৮ বার পঠিত, ২০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তবে যতদুর জানি ফাগুনের দিনের শীত চলে যাওয়ার আগে একটা ঝাঁকুনি দেয়। জামাত আবার সেরকম করছে নাতো? বুইজ্জেন ভাইব্বা চিন্তা কৈরা চলেন সামনে ঘোর বিপদ।
ধন্যবাদ আপনাকে। কথাটি খাটি হলেও মানতে খুব কস্ট হয়। জানিনা কেন যে এমন লাগে।
আপনার গল্পটা পড়ে মনে হলো - কোথাও শুনেছিলাম কিংবা পড়েছিলাম - আল্লাহ মানুষকে এমন ভাবে সৃষ্টি করেছেন - যে মানুষকে যে অবস্থায়ই রাখা হোকনা কেন - সে চাইলে জীবনের সব চেয়ে বেস্ট অর্জনটা ঐ অবস্থা হতেই অর্জন করতে পারে।
জামায়াত শিবির যদি সত্যিই এমন টা করে তবে নিঃসন্দেহে এ কাজের জন্য গণমানুষের সন্মান পাবার যোগ্য।
কিছুদিন আগে পত্রিকায় পড়েছিলাম গুয়ানতানামো বে তে জেলখানায় বসে অনেক কয়েদী ই কিনা কোরান এ হাফেজ হয়েছেন, কে জানে আমরা হয়তো আগামীতে প্রচুর সাহিত্য পাব আজকের বাংলার জেলখানা হতে।
ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন