তসবিহ গুনা সুন্নত কিনা এ সম্পর্কে সহি ও জইফ কোন হাদীস আছে কিনা?

লিখেছেন লিখেছেন মদীনার আলো ০৯ এপ্রিল, ২০১৭, ১০:৫১:৫৬ সকাল

উত্তর: যিকির দু’ভাবে আদায় করা যায় : বেশি বেশি পাঠ করে এবং নির্দিষ্ট সংখ্যক পাঠ করে। নির্দিষ্ট সংখ্যক যিকেরের জন্য গণনার প্রয়োজন। কিন্তু আমরা দেখি যে, কোনো কোনো সাহাবী ও পরবর্তী ইমাম যিকির গণনা করতে নিষেধ করেছেন। তারা বলতেন, আল্লাহই তো গণনা করছেন, তুমি কেন গণনা করবে। তুমি কি আল্লাহর কাছে যেয়ে গুণে হিসেব বুঝে নেবে?

ইমাম আবু হানীফা (রহ) ও হানাফী ইমামগণ যিকির ও তাসবীহ-তাহলীল গণনা মাকরুহ বলে জেনেছেন। ইমাম তাহাবী ইমাম মুহাম্মাদ ও ইমাম আবু ইউসূফের সনদে ইমাম আবু হানীফা থেকে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। ইমাম তাহাবী, শাারহু মুশকিলিল আসার ১০/২৯১।

ইবনু মাস’ঊদ (রা) যিক্র গণনা করতে দেখলে বলতেন, তোমাদের গোনাহগুলো গণনা করে হিসেব করে রাখ, সাওয়াব গণনার প্রয়োজন নেই। বিস্তারিত দেখুন : লেখকের “এহ্ইয়াউস সুনান” পৃ: ৬৬-৬৭।

উকবা ইবনু সুবহান নামাক একজন তাবেয়ী বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনু উমারকে প্রশ্ন করলাম, যদি কেউ যিক্রের সময় তার তাসবীহ-তাহলীল হিসাব করে রাখে তাহলে কী হবে? তিনি বললেন :

سُبْحَانَ اللهِ! أَتُحَاسِبُوْنَ اللهَ

“সুব‘হানাল্লাহ! তোমরা কি আল্লাহর হিসাব নেবে ?” হাদীসটির সনদ সহীহ। ইমাম তাহাবী, শারহু মুশকিলিল আসার ১০/২৯১।

এ সকল হাদীসের আলোকে ইমাম আবু হানীফা (রাহ) তাসবীহ তাহলীল গণনা মাকরুহ মনে করেছেন। ইমাম তাহাবী (রহ) বলেন, যে সকল যিকির হাদীস শরীফে নির্দিষ্ট সংখ্যায় আদায়ের নির্দেশনা রয়েছে, সে সকল যিক্রের ক্ষেত্রে মুমিনের উচিত তা গণনা করে পাঠ করা। কারণ গণনা ছাড়া নির্দিষ্ট সংখ্যা পূরণ হয়েছে কিনা এবং আল্লাহর ওয়াদাকৃত সাওয়াবের পরিমাণ যিকির পালিত হয়েছে কিনা তা জানার উপায় নেই। এজন্য এ সকল যিক্র গণনা করে পালন করতে হবে। আর যেসকল যিকির সাধারণভাবে পালন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, বিশেষ সংখ্যার জন্য বিশেষ সাওয়াব বর্ণনা করা হয়নি, সেসকল যিকির গণনা করা বাতুলতা। সেক্ষেত্রেই আল্লাহর হিসাব গ্রহণের প্রশ্ন আসে। নির্ধারিত সংখ্যক যিক্রের অতিরিক্ত সকল সাধারণ যিক্রের ক্ষেত্রে মুমিনের দায়িত্ব কোনো রকম গণনা বা হিসাব ছাড়া যথাসম্ভব বেশি বেশি এবং যথাসম্ভব মনোযোগ সহকারে এসকল যিক্রের বাক্য উচ্চারণ করবেন। হিসাবপত্রের দায়িত্ব রাব্বুল আলামীনের উপর ছেড়ে দেবেন। আবূ জাফর তাহাবী, শারহু মুশকিলিল আসার ১০/২৯১।

সাহাবী ও তাবেয়ীগণের কর্ম থেকে জানা যায় যে, সালাত, সালাম, তাসবীহ, তাকবীর, তাহলীল, তাহমীদ ইত্যাদি যিক্র, যা সাধারণভাবে বেশি বেশি আদায় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা অনেকে নিজের সুবিধামতো নির্দিষ্ট সংখ্যায় ওযীফা হিসাবে নির্ধারণ করে নিয়েছেন। যেমন, কেউ কেউ সারাদিনে ১০০০ বার সালাত বা তাসবীহ বা তাহলীল করবেন বলে নিজের জন্য নির্ধারণ করে নিয়েছেন। এগুলো তাঁরা গুণে আদায় করতেন। এর অতিরিক্ত অগণিত যিক্র তাঁরা আদায় করতেন। আব্দুর রাজ্জাক সান’আনী, আল-মুসান্নাফ ২/২৩৮, ইবনু রাজাব, জামিউল উলূম ১/৪৪৬, মুবারাকপুরী, তুহফাতুল আহওয়াযী ৯/৩২২, শাওকানী, নাইলুল আউতার ২/৩৫৯, মুনাবী, ফাইদুল কাদীর ৪/৩৫৫।

এখন প্রশ্ন: সংখ্যা নির্ধারিত যিকির কিভাবে গণনা করব? ‘তাসবীহ’ ব্যবহার করে? না হাতের কর গণনা করে? তাসবীহ ব্যবহার বিদ‘আত কি না? এ প্রশ্নের উত্তর, যিকির গণনার জন্য দানা বা তাসবীহ ব্যবহার না-জায়েয বা বিদ‘আত নয়। তবে হাতের আঙ্গুল দ্বারা গণনা করা উত্তম; কারণ রাসূলুল্লাহ সা. নিজে যিকির হাতে গণনা করতেন। আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রা) বলেন:

رَأَيْتُ النَّبِيَّ  يَعْقِدُ التَّسْبِيْحَ بِيَدِهِ [بِيَمِيْنِهِ]

“আমি নবীজী (সা.)-কে দেখলাম তিনি নিজের হাতে [ডান হাতে] তাসবীহের গিঠ দিচ্ছেন (গণনা করছেন)।” হাদীসটির সনদ সহীহ। তিরমিযী (৪৯-কিতাবুদ দাআওয়াত, ৭২- বাব.. আকদীদ তাসবীহ) ৫/৪৮৬, নং ৩৪৮৬, (ভা ২/১৮৬); আবূ দাউদ ২/৮২ (ভা ১/২১০); মুসতাদরাক হাকিম ১/৭৩১, ৭৩২।

এছাড়া রাসূলুল্লাহ সা. হাতে গণনা করতে উৎসাহ দিয়েছেন। মহিলা সাহাবী ইউসাইরাহ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে বলেছেন:

عَلَيْكُنَّ بِالتَّسْبِيْحِ وَالتَّهْلِيْلِ وَالتَّقْدِيْسِ وَاعْقِدْنَ بِالأَنَامِلِ فَإِنَّهُنَّ مَسْؤُوْلاَتٌ وَمُسْتَنْطَقَاتٌ

“তোমরা মহিলাগণ অবশ্যই তাসবীহ (সুব‘হানাল্লাহ), তাহলীল (লা- ইলাহা ইল্লল্লাহ), তাকদীস (সুব্বুহুন ক্বুদ্দূসুন) করবে এবং আঙ্গুলের গিটে গণনা করবে ; কারণ এদেরকে কিয়ামতের দিন প্রশ্ন করা হবে এবং কথা বলানো হবে। (এরা যিক্রের সাক্ষ্য প্রদান করবে।)” হাদীসটির সনদ সহীহ। তিরমিযী (৪৯-কিতাবুদ দাআওয়াত, ৭২- বাব.. আকদীদ তাসবীহ) ৫/৪৮৬, নং ৩৪৮৬, (ভা ২/১৮৬); সহীহ ইবনু হিব্বান ৩/১২২, মুসতাদরাক হাকিম ১/৭৩২, মাওয়ারিদুয যামআন ৭/৩৩৯।

পাশাপাশি দানা বা তাসবীহ-মালা দ্বারা যিকির গণনা জায়েয ও সাহাবী-তাবেয়ীগণ কর্তৃক ব্যবহৃত। বিভিন্ন হাদীসে আমরা দেখি যে, রাসূলুল্লাহ সা. কোনো কোনো সাহাবীকে দানা বা বীচির দ্বারা তাসবীহ-তাহলীল বা যিকির গণনা করতে দেখেছেন। তিনি তাঁদেরকে এভাবে গণনা করতে নিষেধ করেননি, তবে সংক্ষিপ্ত ও উত্তম যিক্রের উপদেশ প্রদান করেছেন। এ সকল হাদীস থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, কাঁকর, দানা, বীচি ইত্যাদির মাধ্যমে যিক্র গণনা সুন্নাহ-সম্মত জায়েয।

পরবর্তী যুগে কোনো কোনো সাহাবী ও তাবেয়ী থেকে জমা করা কাঁকর, দানা, গিরা দেওয়া সুতা বা ‘তাসবীহ’ ব্যবহারের কথা জানা যায়। আবু সাফিয়্যা (রা) নামক একজন সাহাবী পাত্র ভর্তি কাঁকর রাখতেন। ফজরের সালাতের পরে দ্বিপ্রহর পর্যন্ত তিনি এগুলো দিয়ে যিকির করতেন। আবার বিকালেও অনুরূপ করতেন। সা’দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস কাঁকর দিয়ে তাসবীহ তাহলীল ও যিক্র করতেন। ইমাম হুসাইনের কন্যা ফাতিমা গিঠ দেওয়া সুতা (তাসবীহের মতো) দ্বারা গণনা করে তাসবীহ তাহলীল করতেন। আবু হুরাইরা (রা)-এর ১০০০ টি গিরা দেওয়া একটি সুতা ছিল। তিনি এ সংখ্যক তাসবিহ-তাহলীল পাঠ না করে ঘুমাতেন না। এছাড়া তিনি কাঁকর জমা করে তা দিয়ে যিক্র করতেন বলে বর্ণিত আছে। আবু দারদা (রা) খেজুরের বীচি একটি থলের মধ্যে রাখতেন। ফজরের সালাতের পরে সেগুলো বাহির করে যিক্রের মাধ্যমে গণনা করে শেষ করতেন।

আল্লামা শাওকানী, সয়ূতী, আব্দুর রাউফ মুনাবী প্রমুখের আলোচনায় মনে হয় ইমাম আবু হানীফা (রা) ও তার সঙ্গীগণ বা মাযহাবের ইমামগণ ছাড়া পূর্বযুগের অধিকাংশ ফকীহ ও ইমাম যিক্র গণনা বা তাসবীহ ব্যবহার করতে নিষেধ করেননি। ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী (৯১১ হি) এ বিষয়ে একটি ছোট্ট বই লিখেছেন বিস্তারিত দেখুন : মুবারাকপুরী, তুহফাতুল আহওয়াযী ৯/৩২২, শাওকানী, নাইলুল আউতার ২/৩৫৯, মুনাবী, ফাইদুল কাদীর ৪/৩৫৫, ইবনু রাজাব, জামিইল উলূম ওয়াল হিকাম, পৃ. ৪৪৬।

সর্বাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর সুন্নাত ও নির্দেশনা সংখ্যা নির্ধারিত যিক্র হাতের আঙ্গুলে গণনা করা। প্রয়োজনে, বিশেষত যারা ওযীফা হিসেবে দৈনিক বেশি সংখ্যক যিকির নিজের জন্য নির্ধারিত করে নিয়েছেন তারা তাসবীহ, কাঁকর, বীচি, ছোলা, ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারেন।

বিষয়: বিবিধ

১৭৩৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File