ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ.

লিখেছেন লিখেছেন মদীনার আলো ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৮:৩৯:২০ সকাল

খুরাসান একটি ইতিহাস সমৃদ্ধ অঞ্চল। এ অঞ্চলটির সাথে জড়িয়ে আছে হাজারো উত্থান-পতনের ঘটনা। হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীর গোড়া থেকেই এটি জ্ঞানের রাজধানী নামে খ্যাত। ইতিহাসে বাগদাদ, বুখারা ও সমরকন্দেরমত তারও রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস। শহরটির বিভিন্ন কেন্দ্রে হাজারো মুহাদ্দিস, শায়খ এবং ফকিহগণের তত্বাবধানে হাদীসে নববী ফিক্হ এবং ইসলামী আইনশাস্ত্রে খোলামেলা আলোচনা চলতো। দূরদূরান্তর থেকে লোকেরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের পিপাসা মিটানোর জন্য ভীড় জমাতো এ সকল মাজলিসে। এক কথায় তখন এটি জ্ঞানের নগরী বলে পরিচিত ছিলো। এই খুরাসানেরই একটি সমৃদ্ধ নগরীর নাম র্সাখস। তখন নগরীর শাসনকার্য পরিচালনার দায়িত্ব যার ওপর ন্যস্ত ছিল তিনি হলেন হাম্বল বিন হিলাল। একেবারে বয়োবৃদ্ধ। তবে আমলে আখলাকে, বিচক্ষণতায় তার তুলনা হয় না। সে সময় বনী উম্মাইয়ার শাসনকাল। হঠাৎ রাজনীতির পালা পরিবর্তন। মহান আল্লাহ তা‘আলার লীলাখেলা বুঝা বড় দায়। তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা দান করেন, আবার যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা কেড়ে নেন। এসবই তার ইচ্ছাধীন। এরই মধ্যে আবু মুসলিম আল-খুরাসানী খুরাসান আক্রমণ করে বসলো। তিনি খেলাফতে বনি উম্মাইয়ার দাবিদার ছিলেন। বনি উম্মাইয়া খলীফা মারওয়ানকে স্বসৈন্যে যুদ্ধে পরাজিত করে খুরাসান দখল করে নিলেন। মুহূর্তে দেশের দৃশ্যপট পাল্টে গেলো। নিরুপায় হয়ে হাম্বল বিন হিলাল বনু আব্বাসিয়ার সৈন্য দলে যোগদান করলেন। শুরু হলো, বনু উম্মাইয়ার পক্ষ্য থেকে জুলুম-নিপীড়ন। কিন্তু, তিনি মুখ বুঝে সব সহ্য করলেন। ফলে, খেলাফতে বনু আব্বাসিয়ার সূচনালগ্নেই বৃদ্ধের ভাগ্যদরজা খুলে গেলো। আপন পুত্র মুহাম্মদের জন্য প্রধান সেনাপতির পদ বরাদ্দ দেয়া হলো। এদিকে বৃদ্ধ দেখলেন নিজের বয়স ঢেড় হয়েছে। তাই যতদ্রুত সম্ভব পুত্রের আক্দ(বিবাহ) সম্পূর্ণ করা দরকার। শুরু হলো যোগ্য পাত্রির সন্ধান। এ শহর ওই শহর, অবশেষে পেয়ে গেলেন। বসরার বিখ্যাত শায়বান গোত্রের অধিপতির একমাত্র কন্যা। মেয়ে নয় যেন সাত রাজার ধন! যেমন সুন্দরী তেমন দ্বীনদার! আবার মেয়ের বাবা আব্দুল মালিকও ছিলেন অত্যাধিক বুযুর্গ। শুধু তার ব্যাপারে এতটুক বলায় যথেষ্ট যে, তার দরজায় কোন মুসাফির কিংবা গরীব-অসহায় এসে খালি হাতে ফিরে যেতে পারতো না। যাহোক, যথাাসময়ে বিবাহ সম্পন্ন হলো। স্বামী-স্ত্রী দুজনই ছিলেন অত্যধিক আল্লাহওয়ালাহ। ফলে, আল্লাহর অশেষ করুণায় ১৬৪হিজরী সনে উভয়ের কোল জুড়ে এলো একটি পুত্র সন্তান। সন্তান নয় যেন চাঁদের টুকরো! যে দেখেন সেই মুগ্ধ হন! বিস্ময়ভরে তাকিয়ে থাকেন! শিশুটির নাম রাখা হলো আহমদ। প্রিয় পাঠক! ইনিই হলেন ইতিহাস বিখ্যাত মুহাদ্দিস, ফকীহ এবং হাম্বলি মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা আহমদ ইবনে হাম্বল রহ.। জগদ্বিখ্যাত চার মাযহাবের মধ্য হতে তাঁর মাযহাবের অনুসারী সংখাও কম নয়। তাই আসুন না আমরা জেনে নেই এই মহাকালজয়ী পুরুষের জীবন ইতিহাস।

(এক)

বাবার আদর-সোহাগ বুঝে উঠার পূর্বেই পিতৃবিয়োগ। শুরু হয় অসহায় জীবন। কিন্তু মা এসবকিছু বুঝে উঠতে দিলেন না। তিনি স্বস্নেহে পুত্রকে ধীরে ধীরে বড় করে তুললেন। ছেলেকে তিনি গ্রামের মাদরাসায় ভর্তি করলেন। বালক আহমদ খুবই অল্প সময়ে পূর্ণ কুরআন শরীফ হিফ্জ সম্পন্ন করলো। তারপর তার মাতা তাকে হস্তলেখা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি করলেন, সেখানেও তিনি কৃতিত্ব দেখালেন। খুবই অল্প সময়ে বিভিন্ন ঢঙ্গের হস্তলিপি আয়ত্ত্ব করে ফেললো। তবে, এত অল্প সময়ে এতসব সাফল্য অর্জনের পিছনে যে বিষয়টি বালক আহমদের মাঝে কাজ করেছিলো তা হলো, পড়া-লেখার প্রতি অত্যধিক মনোযোগ, আকর্ষণ এবং ভালবাসা। এমনকি, এই ছোট্ট বালকের মাঝে এধরণের আগ্রহ উদ্দীপনা দেখে তার এক উস্তাদ মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘প্রতি যুগেই এমন একজন ব্যক্তি জন্মাবেন যার মাধ্যমে উম্মত সঠিক পথের দিশা পাবে। আর এই বালক আহমদ যদি বেঁচে থাকে, তবে সেই হবে উম্মতের ভবিষ্যত দিশারী’। বালক আহমদের চরিত্র মাধুর্য ছিলো জগতজুড়ে। সেজন্যই তার এক সহপঠির বাবা মুখ ফুটে বলেই ফেলেন, ‘আমরা ধন-স¤পদ ব্যয় করে সন্তানকে আদর্শ, জ্ঞানী, গুণী বানাতে চাই। আর এই যে, ছোট্ট ছেলে আহমদ, ইয়াতিম অথচ তার আমল-আখলাক দেখলে অন্তর জুড়ে যায়। কত সুন্দর তার চরিত্র মাধুর্য!

(দুই)

ইমাম আহমাদ রহ.এর বাবা মোহাম্মদ ইবনে হাম্বল রহ. মৃত্যুর পূর্বে শুধুমাত্র একটি বাড়িই সম্পদ হিসেবে রেখে যান। এ ঘরটিরই একাংশে তিনি ও তাঁর মাতা বাস করতেন। এবং ঘরটির অন্যাংশ ভাড়া দেওয়া হতো। আর ভাড়া থেকে যৎসামান্ন সতের দিরহাম আসতো তা দিয়ে পরিবারের খরচ পূর্ণ হতো না। ফলে, ইমাম সাহেবকে জীবিকার তাগিদে, কখনো কাঁধে রশি নিয়ে কাঠ সংগ্রহে আবার কখনো পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাউকে কিছু লিখে দিতে বাইরে বেড় হতে হতো। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, তিনি কোনদিন কারো জমিতে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করতেন না। এমনকি, তিনি তার অন্যান্য কাঠুরীয়া বন্ধুদেরকে বলতেন, দেখো, অনুমতি ছাড়া অন্য কারো জমিতে প্রবেশ করা বৈধ নয়। আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, তিনি কাজ করাকে তুচ্ছ মনে করতেন না। বরং তিনি বলতেন, আরে, হীন তারাই; যারা কাজকে, পরিশ্রমকে তুচ্ছজ্ঞান করে। অনেক দারিদ্রতা থাকা সত্ত্বেও ইমাম সাহেব কারো দান-দক্ষিণা গ্রহণ করতেন না। তাঁর সম্পর্কে একটি ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে আলী ইবনে আল-জাহ্ম রহ.বলেন, আমার এক প্রতিবেশি ছিলো। হঠাৎ তিনি একদিন একটি কিতাব নিয়ে আমার বাড়িতে এসেই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, বলতে পারেন এ লিখাগুলো কার? আমি উত্তরে বললাম, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের। তবে আপনি কীভাবে সংগ্রহ করলেন? আমার প্রতিবেশি তার ঘটনা শুনালেন-আমরা একবার মক্কায় সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা রহ. এর ঘরে অবস্থান করছিলাম। হঠাৎ কিছুদিন যাবৎ আহমদ ইবনে হাম্বলকে না পেয়ে, তার তালাশে তার বাড়ির দরজায় উপস্থিত হয়ে দেখি, ভিতর দিক হতে দরজা বন্ধ করে রাখা। আমি দরজায় করাঘাত করে জিজ্ঞেস করলাম, জনাব! আপনার খবর কি? ভিতর থেকে জবাব এলো, আমার কাপড়গুলো ঘর থেকে চুরি হয়ে গেছে। আমি বললাম, জনাব! আমার সাথে কিছু দিনার আছে। ইচ্ছে করলে আপনি তা গ্রহণ করতে পারেন অথবা ধার নিতে পারেন। কিন্তু তিনি এ প্রস্তাব প্রত্যাখান করলেন। আমি কৌশলে বললাম, আচ্ছা, পারিশ্রমিক নিয়ে কিছু লিখে দেওয়া যাবে? তিনি জবাবে বললেন, হ্যাঁ। অতঃপর তিনি দিনারগুলো গ্রহণ করে আমাকে বললেন, আপনি আমার জন্য সামান্য কাপড় এবং কিছু কাগজ কিনে নিয়ে আসুন। (বর্ণনাকারী বলেন) আমি তাই করলাম। তারপর তিনি কাগজগুলোতে আমাকে লিখে দিলেন। আর এই কিতাবটি হলো সেই দিনের লিখিত কাগজগুলো। তবে, খুব নিরুপায় হলে একমাত্র তাদের কাছ থেকেই ঋণ গ্রহণ করতেন যাদেরকে তাঁর দৃষ্টিতে অধিক নেককার বলে মনে হতো। একবার তিনি কিছু ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে গেলে ঋণদাতা বললো, হে আবু আব্দুল্লাহ! আমি প্রদানের সময়ই নিয়ত করে ছিলাম যে, এগুলো আমাকে আর ফেরৎ দিতে হবে না। কাজেই এগুলো আপনি নিজের কাজে খরচ করুন। একথা শুনে ইমাম সাহেব রহ. বললেন, জনাব! আমাকে ক্ষমা করবেন। আমিও ঋণ গ্রহণের সময় নিয়ত করেছিলাম, আমি অবশ্যয় আপনার পাাওনা আপনাকে বুুঝিয়ে দিবো। কাজেই এই ধরুন আপনার টাকা। আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ। 

(তিন)

খলীফা মামুনুর রশিদ একবার আপন সৈন্য সামন্ত সহ রিক্কা শহরে দীর্ঘ দিন অবস্থান করায় ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. এর ওপর প্রবাসী সৈন্যদের স্ত্রীগণের নামে আগত পত্র পাঠ করে শুনানো এবং তার জবাব লিখে দেয়ার দায়িত্ব অর্পিত হলো। ইমাম সাহেব রহ. একাজ খুবই নিষ্ঠার সাথে আদায় করতেন। প্রয়োজনে কারো গৃহে প্রবেশ করতে হলে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করতেন। কারো স্ত্রীর প্রতি নযর করেছেন কিংবা বাড়ির অন্দর মহলের দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন এমন কথা কোন ঐতিহাসিক গাদ্দারও প্রমাণ করতে পারেনি। এমনকি, খুব ছোট বয়স থেকেই ইমাম সাহেব রাজকীয় পরিবেশ পছন্দ করতেন না। পছন্দ হতো না রাজাদের কর্মকাণ্ড। তাঁর চাচা খলীফার অধীনে চাকরি করায় বগদাদের খবরাখবর খলীফার এক গভর্ণরকে নিয়মিত সরবরাহ করতে হতো। তখন ইমাম সাহেবের বয়স সাত কি আট। চাচা একটি পত্র দিয়ে বললেন যে, গভর্ণরকে দিয়ে আস। কিন্তু ওদিকে খলীফা খবরাখবর না পেয়ে দুশ্চিন্তায় যায় যায় অবস্থা। অবশেষে পত্র পাঠালেন, ‘আচ্ছা, ইদানিং দেখছি তুমি বাগদাদের কোন সংবাদই দরবারে প্রেরণ করোনা। অথচ তোমাকে আমি অনেক দায়িত্বশীল মনে করি’। পত্র পাঠান্তেই তার চাচার অবস্থা শোচনীয়, যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। খলীফা বলে কি! আমি পত্র পাঠালাম আর তিনি কিনা বলছেন পত্র পাইনি। কিন্তু, আবার অবিশ্বাসেরো জো নেই, খোদ খলীফার পত্র। তাই সবশেষে ভাতিজাকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, বাবা আহমদ! তোমাকে আমি পত্র হস্তান্তর করোনি? আহমদ রহ. এর সরল স্বীকারোক্তি, নিশ্চয়। তবে খলীফা যে, বলছে, পত্র পায়নি। এবারো ইমাম সাহেব নিজেকে স্বাভাবিক রেখেই জবাব দিলেন, চাচা! আপনি দিয়েছেন সত্য, তবে আমি তা নদীতে ফেলে দিয়েছি। চাচা ভাতিজাকে সঙ্গে নিয়ে রাজদরবারে ছুটলেন। এরপর খলীফার সামনে তিনি ভাতিজাকে জিজ্ঞেস করলেন, বেটা! কারণ কি? আহমদ রহ. বললেন, আমি চাই না মানুষের ভাল-মন্দের অভিযোগ রাজদরবারে পৌঁছুক। একথা শুনে খলীফা তো হতবাক! তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। এতটুকোন ছেলে বলে কি! ইন্নানিল্লাহ… এই যদি হয় তার তাকওয়া, তাহলে আমরা কোথায়?!!

(চার)

একবার খুরাসানের বিখ্যাত ফকীহ আবু আসেম আদ-দাহ্হাক রহ. উপস্থিত শাগরিদদেরকে ।র্ভৎসনাছলে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, তোমরা ফিক্হ শাস্ত্র অধ্যায়ন করো না কেন? নাকি তোমাদের মধ্যে কোন পণ্ডিত ব্যক্তি আছেন যিনি ফিক্হ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখেন? উপস্থিত সবাই উত্তরে বললো, হযরত! আমাদের মাঝে এক যুবক আছে যে ফিকহ শাস্ত্রে পারদর্শী। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো সে উপস্থিত হবে। এরই মধ্যে ইমাম সাহেব রহ. দরসস্থলে উপস্থিত হলে সবাই একসাথে তার দিকে হাত তুলে ইঙ্গিত করলো, এই তো এসে গেছে। ফকীহ আবু আসেম রহ. যুবকের দিকে তাকাতেই মুগ্ধ হলেন। টগবগে নওজোয়ান! কী সুন্দর তার চেহারা-সূরত! এক কথায়, ফকীহ আবু আসেম রহ. খুবই অভিভূত হলেন। অতঃপর বললেন, সামনে আসো। জবাবে ইমাম সাহেব রহ. সবিনিয়ে বললেন, জনাব! আমি এতগুলো লোককে ডিঙ্গিয়ে আপনার সামনে কী ভাবে আসবো? ফকীহ আবু আসেম রহ. বড় খুশী হলেন। আর বললেন, বাছা! এটা তো পাণ্ডিত্যের প্রথম নির্দশন। অতঃপর উপস্থিত ছাত্রদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, আরে, তোমরা তাকে সামনে আসার জন্য সুযোগ করে দাও। ইমাম সাহেব রহ. আবু আসেম রহ. এর একেবারে সামনে উপবেসন করলেন। অতঃপর শুরু হলো আবু আসেম রহ. এর মেধা যাচাই। প্রথমে একটি প্রশ্ন করলেন। আর ইমাম সাহেবও প্রজ্ঞাভরে জবাব দিলেন। এভাবে দিতীয় ও তৃতীয় প্রশ্নের জবাবেও ইমাম সাহেব একই পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করলেন। ফকীহ আবু আসেম রহ. খুবই আশ্চর্য হয়ে বললেন, আরে, এতো দেখছি জ্ঞানের সাগর!

(পাঁচ)

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের খুব ছোট থেকেই হাদীস সংগ্রহের নেশা ছিলো। তিনি একাধারে ইরাক, শাম এবং হেজায অঞ্চলের প্রায় সকল উলামা থেকেই হাদীস সংগ্রহ করেছেন। তিনি ছিলেন হাদীসে নববীর একজন অসাধরণ ছাত্র। এমনকি, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাদীস সংগ্রহকারীগণের মধ্যে তাঁকেও সুনামের সাথে উল্লেখ করা হয়। ইমাম সাহেব রহ. এর হাদীস সংগ্রহের সূচনা হয়েছিলো ইলমের সুবিখ্যাত নগরী বাগদাদ থেকে। এরপর সেখান থেকে পায়ে হেটে তরতুস শহরে। অতঃপর সেখান থেকে পায়ে হেঁটে ইয়ামানের রাজধানী সানআয়। ইমাম সাহেব রহ. ইয়ামানের বিখ্যাত মুহাদ্দিস আব্দুর রায্যাক বিন হুমাম রহ. এর নিকট প্রবেশ করতেই দেখতে পেলেন, তিনি অসংখ্য সাগরিদ সহ মসজিদে উপবিষ্ট। আহমদ রহ. মজলিসের এককোণে বসে পড়লেন। ওদিকে মজলিসে (ইতিহাস খ্যাত অন্য আরেক মুহাদ্দিস) ইয়াহইয়া বিন মুঈন আগ থেকেই উপস্থিত ছিলেন। তিনিই মুহাদ্দিস আব্দুর রায্যাক রহ. কে জানালেন, হযরত! ইনিই তো ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল। মুহাদ্দিস আব্দুর রায্যাক রহ. বললেন, আমার কাছে তার সম্পর্কে অনেক ভাল আলোচনা পৌঁছেছে। আমি দু‘আ করি মহান আল্লাহ তাকে দীর্ঘজীবী করুন। অতঃপর তিনি আনন্দে ছাত্রদেরকে সত্তরটি হাদীস অতিরিক্ত লিখালেন আর বললেন, আজকের বর্ণিত হাদীসগুলো ইবনে হাম্বলের উপস্থিতি উপলক্ষ্যে হাদিয়া স্বরূপ বর্ণনা করা হলো। যদি তিনি আগমন না করতেন, তবে তা কখনই এ মুহূর্তে আমি শুনাতাম না। র্দস শেষে মুহাদ্দিস আব্দুর রায্যাক রহ. ইবনে হাম্বল রহ. এর কুশলাদি জিজ্ঞেস করার পর বললেন, হে আবু আব্দুল্লাহ! এই দিনারগুলো আপনি নিজের কাছে রাখুন। কারণ আমাদের এ অঞ্চলে জীবিকা তালাশ করা খুবই দুরূহ কাজ। কিন্তু তাকওয়ার পাহাড় এই মহান ব্যাক্তি তা সবিনয়ে ফিরিয়ে দিলেন। ইমাম সাহেব রহ. সানআয় ক্ষুধা ও দারিদ্রতার মধ্য দিয়ে দুটি বছর পার করেন। অধিকাংশ সময়ই ক্ষুধার কারণে চেহারা মলিন হয়ে থাকতো। এতদসত্ত্বেও কোনদিন কারো কাছে কিছু চাইতেন না। বরং জানা যায় যে, সানআ থেকে মক্কায় ফিরার মুহূর্তে, তিনি যে লোকটির নিকট থেকে রুটি সংগ্রহ করতেন, তাকে আপন জুতাটিও ঋণের দায়ে দিয়ে দিয়েছিলেন। দীর্ঘ সফর শেষে তিনি মক্কায় পৌঁছেলে সেখানের লোকেরা বললো, হযরত! শুনিছি আপনি সানআয় থাকাকালে অনেক কষ্ট স্বীকার করেছেন। তিনি জবাবে বললেন,আরে,আমি মুহাদ্দিস আব্দ্রু রায্যাক রহ. থেকে যা অর্জন করেছি তার তুলনায় এ কষ্ট তো নিতান্তই তুচ্ছ। আর আমার মতে, ইলম অন্বেষণের পথে পাহাড় সমান কষ্টও কষ্টের মধ্যেই গণ্য না। 

(ছয়)

বাগদাদে ইমাম শাফেয়ী রহ. এর আগমন ঘটলে, তিনি ইমাম শাফেয়ী রহ. এর র্দসে যাতায়াত আরম্ভ করলেন। একবার ইমাম শাফেয়ী রহ. জানতে পারলেন যে, আহমদ ইবনে হাম্বল সানআর বিখ্যাত মুহাদ্দিস আব্দুর রায্যাক রহ. এর ঘনিষ্ঠ শাগরিদ তার নিকট থেকে হাদীস সংগ্রহে ইবনে আহমদের ভীষণ আগ্রহ রয়েছে। তাই, তিনি খলীফা মামুনুর রশিদকে অনুরোধ জানালেন যেন, ইবনে আহমদকে সানআর বিচারক নিযুক্ত করা হয়। যাতে তার হাদীস সংগ্রহ সহজ হয়। খলীফা ইমাম শাফেয়ী রহ. এর অনুরোধ রক্ষা করলেন। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো অন্যত্র। খলীফা যতবারই তাকে প্রস্তাব পাঠালো, আহমদ রহ. ততবারই প্রত্যাখান করলেন। অবশেষে ইমাম শাফেয়ী রহ. এর নিকট এসে ইবনে হাম্বল রহ. বললেন, জনাব! এমন প্রস্তাব দ্বিতীয়বার আসলে আপনার সাথে আমার আর সাক্ষাত হবে না। একবার আহমদ রহ. এর নিকট সংবাদ এলো যে, তার চাচা এবং তার পুত্র তীব্র ক্ষুধা ও দারিদ্রতায় পরাস্ত হয়ে, সবশেষে খলীফার নিকট থেকে অনুদান সংগ্রহ করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে রাজমিস্ত্রি এনে নিজের ও তাদের উভয়ের ঘরের মাঝখানে প্রাচীর নির্মাণ করে নিলেন। এমনকি চাচার পিছনে নামায আদায় পর্যন্ত বন্ধ করে দিলেন। একবার ঘরে ভীষণ খাদ্য সংকট দেখা দিলে, তিনি একজন থেকে সামান্য আটা ধার নিয়ে তা দিেেয় স্ত্রীকে রুটি তৈরী করতে বলে একটু জরুরী কাজে বাহিরে গেলেন। অল্পক্ষণ পর ফিরে এসেই দেখেন, আশ্চর্য! প্রস্তুতকৃত মোটা মোটা সুন্দর সুন্দর রুটি! তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এত তাড়াতাড়ি? জবাবে স্ত্রী বললো, এগুলো আপনার পুত্র সালেহের বাসা থেকে এসেছে। তিনি একথা শুনামাত্রই খাবার থেকে হাত গুটিয়ে নিলেন। পরিবারের লোকেরা কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, সে এমন পুত্র যে খলীফার অনুদানে চলে।

(সাত)

একব্যক্তি বলেন, আমার মা দীর্ঘদিন যাবত শয্যাশায়ী ছিলো। হঠাৎ একদিন তিনি আমাকে কাছে ডেকে বললেন, বেটা! আহমদ ইবনে হাম্বলের নিকট যাও। আর বলো, সে যেন আল্লাহর দরবারে আমার জন্য দুআ করে। আমি আমার মায়ের কথামতো তার বাড়িতে উপস্থিত হলাম। তখন তিনি বাড়ির ভিতরে অবস্থান করছিলেন। আমি দরজায় নক্ করতেই তিনি ভিতর থেকে জিজ্ঞেস করলেন, কে আপনি? আমি জবাবে বললাম, আমি বাগদাদ থেকে এসেছি। অতঃপর মায়ের ইচ্ছের কথা ব্যক্ত করলাম। কিন্তু তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, আপনার মায়ের নিকট গিয়ে বলুন, ইবনে আহমদই আপনার নিকট দুআর জন্য বেশি মুহতাজ। আমি হতাশ হয়ে ফিরে আসবো, ঠিক এ মুহূর্তে বাড়ির ভিতর থেকে একবৃদ্ধা আমাকে ডাক দিলেন। আমি ফিরে তাকাতেই তিনি বললেন, বাবা! দুঃখ পাবার কিছু নেই। আমি আহমদকে তোমার মায়ের জন্য দুআ করতে বলেছি।

আমি আনন্দে দ্রুত বাড়ি অভিমুখে রওয়ানা হলাম। অতঃপর এসেই দেখি আমার আম্মা পূর্ণ সুস্থ! তিনি নিজে এসে দরজা খুলে দিলেন। এবং বললেন, বেটা! আল্লাহর রহমতে আমি পূর্ণ সুস্থ। আমি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়েই রইলাম। মায়ের মুখে সে যে কী তৃপ্তির হাসি তা আমি বলে বুঝাতে পারবো না! আনন্দে আমার দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। এটা আনন্দাশ্রু; এটাও আল্লাহ তাআলার নিয়ামত। আমি আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হলাম।

(আট)

যখন ইমাম সাহেব রহ. এর বয়স চল্লিশ বছর তখন তিনি হাদীস পাঠদানে মনোনিবেশ করলেন। এর পূর্বে কখনো হাদীসের দরস দিয়েছেন এমন কথা জানা যায়নি। এর পিছনে একটিই কারণ তা হলো, রাসূলে আরাবী সা. এর অনুসরণ। কারণ, রাসূল সা. এ বয়স থেকেই দ্বীন প্রচার আরম্ভ করেন। তাই, প্রিয় নবী সা. এর এই অসামান্ন সুন্নতের সামান্য আনুগত্যই ছিলো ইমাম সাহেব রহ. এর একমাত্র অভিপ্রায়। তিনি মসজিদের এককোণে আসরের নামাযান্তে হাদীসের দরস দিতেন। এতে করে সবাই অংশ গ্রহণের সুযোগ লাভ করতে পারতো। দরসে অশংগ্রহণকারী ছাত্রের সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ হাজারের কাছাকাছি। ইমাম সাহেব রহ. দরসগাহে খুবই শান্ত ও গাম্ভীর্যের সাথে উপস্থিত হতেন। ছাত্রদের সাথে হাসি-তামাশা কিংবা খোশগল্প করা তিনি একদম পছন্দ করতেন না। তাঁর মাঝে আত্মমর্যাদাবোধ সবসময় স্থীর থাকতো। ইমাম সাহেবের এই গুণ ছাত্রদের মাঝে, এমনকি তাঁর শায়খগণের মাঝেও ভীষণভাবে রেখাপাত করেছিলো। একবার ইমাম সাহেব রহ. বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইয়াযিদ ইবনে হারুনের দরসে উপস্থিত হলেন। দরসের এক ফাঁকে ইয়াযিদ রহ. ছাত্রদের সাথে কৌতুক করলে ইমাম সাহেবের মনোপুত হলো না। তিনি সামান্য কাশি দিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করতেই ইয়াযিদ রহ. বিষয়টি বুঝে ফেললেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, ছেলেটি কে? উপস্থিত ছাত্রদের একজন জানালো, শায়েখ! ইনি হলেন আহমদ ইবনে হাম্বল। এবার শায়খ কপালে হাত রেখে বলতে লাগলেন, হায়! তোমরা আমাকে আগে বলবেনা যে, এখানে আহমদ উপস্থিত আছে। তবে তো, আমি তোমাদের সাথে কোনো ধরণের মজার আলাপই করতাম না।

(নয়)

প্রতিদিনের মতো আজও আছরের পর দরস বসেছে। চারিদিকে লোকে লোকারণ্য। বিভিন্নজন হাদীস জিজ্ঞেস করছেন আর তিনি হাদীস বর্ণনা করছেন। হঠাৎ একব্যক্তি ইমাম সাহেবের নিকটবর্তী হয়ে হাদীস সম্পর্কে প্রশ্ন আরম্ভ করলো। আর ইমাম সাহেবও তার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন। কিন্তু, লোকটি হঠাৎ কোন এক বিষয়ে ইমাম সাহেবের সাথে তর্ক শুরো করলে ইমাম সাহেব লোকটিকে বললেন, দেখুন, এটি হাদীসে নববীর মাজলিস। তাই আপনার মনের মতো আলোচনা পেতে হলে, আমার পরামর্শ হলো, আপনি অন্য কারো মজলিসে অংশ গ্রহণ করুন। এদিকে উপস্থিত লোকেরাও লোকটির প্রসঙ্গহীন কথায় অসন্তুষ্ট হলো। ইমাম সাহেব লোকটিকে লক্ষ্য করে আরো বললেন, ভাই! আমাদের উচিৎ অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা পরিহার করা। কারণ, এগুলো কখনই ভালর দিকে পথ দেখায় না। অতঃপর উপস্থিত ছাত্রদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমরাও কখনো কাউকে অনর্থক কথা বলতে দেখলে, তাকে বাঁধা দাও। কেননা, আমদের নেককার পূর্বসুরিগণের আমল তাই ছিলো, যা আমি বর্ণনা করলাম। অন্য একজন ছাত্র জিজ্ঞেস করলো, জনাব! অন্তর নরম হয় কীসে? আহমদ রহ. প্রশ্ন শুনে বেজায় খুশী; মাথা তুলে ছেলিটির দিকে তাকালেন আর বললেন, বেটা! হালাল বক্ষণের মাধ্যমে তুমি এগুণ হাসিল করতে পারো। ছাত্রটি বলে, আমি হুবহু এ বিষয়টি প্রখাত মুহাদ্দিস বিশ্র ইবনুল হারেসের নিকট উপস্থাপন করলে তিনি বললেন, বেশি বেশি আল্লাহর স্মরণ করার মাধ্যমে হাসিল হতে পারে। ছাত্রটি বলে, আমি বিশর রহ. কে বললাম, হযরত! আমি বিষয়টি আহমদ রহ. এর নিকটও উপস্থাপন করেছিালাম। একথা শুনে বিশর রহ. বললেন, আচ্ছা, তিনি কী বলেছেন? আমি বললাম, হালাল ভক্ষণের উপদেশ দিয়েছেন। একথা শ্রবণ মাত্রই বিশর রহ. বললেন, তবে তো তিনি আসল কথাটায় বলে দিয়েছেন। অতঃপর ছাত্রটি বলে, আমি একই বিষয় বিশিষ্ট মুহাদ্দিস আব্দুল ওয়াহাব ইবনে আবুল হাসান রহ. এর নিকট উপস্থাপন করলে তিনি বললেন, আল্লাহর স্মরণে এ দৌলত অর্জন হয়। ছাত্রটি বলে, আমি আগের মতো তাঁর নিকটও আহমদ রহ. এর কথা বললে, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ইবনে আহমদ কী বলেছে? আমিও আগের মতই উত্তর দিলাম। এবার আব্দুল ওয়াহাব রহ. আমার বর্ণনা শুনে বললেন, আরে, তিনি তো তোমাকে সাত রাজার ধন হাতে তুলে দিয়েছেন। এ কথা তিনি দুবার বললেন-তারপর বললেন, জেনে রেখো! তিনি যা বলেছেন তাই ঠিক; তিনি যা বলেছেন তাই ঠিক। আরে, তিনি তো আমাদের উস্তাদ। 

(দশ)

সে সময় আব্বাসী খলীফা মামুনুর রশীদের যামানা। তার দাপটে পুরো খুরাসান জুড়ে ভয় আর আতঙ্ক বিরাজ করতো। কোন এক অসৎ মতলবে একবার বাগদাদের গভর্ণরকে সে লিখে পাঠালো, ‘পত্র পাওয়া মাত্রয় সেখানের বিচারকগণ এবং উলামাগণকে একত্র করে বিতর্কের ব্যবস্থা করবে। এবং এই বিষয়টির (কুরআন আল্লাহর সিফত নয় বরং মাখলুক) ফয়সালা করিয়ে নিবে, ঠিক আমি যেমন চাই।’ কথামত গভর্ণর সবাইকে একত্র করে খলীফার ইচ্ছের কথা জানিয়ে দিলো। কিন্তু আল্লাহর এসব মুখলিস বান্দাগণ পরিস্কারভাবে জানিয়ে দিলেন, তাদের দ্বারা এধরণের অন্যায় কাজ হবে না। গভর্ণরও ছিলো শয়তান প্রকৃতির। সে খলীফাকে লিখে পাঠালো, ‘এসব না-লায়েক আমিরুল মু’মিনীনের নির্দেশ তামিল করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তাই, খলীফার পক্ষ থেকে এদের জন্য কঠিন শান্তির ব্যবস্থা করা হোক।’ অবিবেচক খলীফা মামুন ক্রোধে ফেঁটে পড়লো। সে প্রধান সেনপতিকে সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ দিলো, ‘এসব আহমকদেরকে যেন তার দরবারে হাত-পা বাধাবস্থায় উপস্থিত করা হয়। এমনকি কেউ তাদের রক্ষা করতে এলে তাদেরকেও একইভাবে দরবারে উপস্থিত করা হোক।’ বেউকূফ গভর্ণর প্রধান সেনাপতিকে বাগদাদে স্বাগত জানিয়ে সকল আলেম আর বিচারককে একত্র করলো। তবে খলীফার সৈন্যরা ইমাম আহমদ রহ. এর দরজায় পৌঁছলে কারও সাহস হলো না যে, তাঁর দরজার কড়া নাড়বে। কী করার? তারা কৌশলে তার চাচাকে দিয়ে ডাকিয়ে তাকে জানালো, তিনি যেন গভর্ণরের মুকাবিলা করেন। অতঃপর তাকেসহ সমস্ত উলামাগণকে গভর্ণরের প্রাসাদে উপস্থিত করা হলো। শুরু হলো জুলুম, নির্যাতন আর অসহনীয় শাস্তির ভীতি প্রদর্শন। সবাই তো মানুষ! তাই, কেউ কেউ খলীফার মতের সাথে একমত পোষণ করলেও ইমাম আহমদ রহ.সহ আরো অনেক উলামা নিজেদের কথায় অটল-অবিচল থাকলেন। গভর্ণর তাদেরকে বন্দী করে জেলখানায় রেখে দিতে বললো। এভাবেই কাটলো একদিন। পরদিন বন্দীদেরকে হাত-পা বেঁধে খলীফার কাছে পাঠাতেই পথে খবর এলো, গর্ধভ মামুনের মৃত্যু হয়েছে। বন্দিদেরকে আবার ফিরেয়ে আনা হলো গভর্ণরপ্রাসাদে। নতুন খলীফা নির্বাচিত হলো আরেক পাগল আল-মু‘তাসিম। শুরু হলো তার পাগলামি। সে খলীফা হয়েই ইমাম আহমদ রহ.কে রাজদরবারে তলব করলো। শুরু হলো নির্যাতনের পালা। জল্লাদকে নির্দেশ দেওয়া হলো, বেহুশ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এই না-লায়েককে চাবুক পিটা করো। এমনকি, মাঝে মাঝে তলোয়ারের ধারালো মাথা দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে খুচানো হতো। এভাবেই কেটে গেলো আটশত চল্লিশ দিন। তারপরেও তিনি নিজের মত বদলালেন না, বরং আপন মতের ওপর অনড় থাকলেন। রক্ত পিপাসু মু‘তাসিম মাতাল হয়ে এই পৈশাচিক নির্যাতন স্বচোখে উপভোগ করার জন্য, তার সামনে ইমাম আহমদ রহ.এর ঘাড়ে বেত্রাঘাত করার নির্দেশ দিলো। দুজন জল্লাদ ইমাম সাহেবকে বেত্রাঘাত শুরু করলো। ইমাম সাহেব ধৈর্যের অটলপাহাড় হয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলেন। এরই ভিতর ঘটে গেলো এক অদ্ভূত কাণ্ড! এই নির্যাতনের ভিতরেও ইমাম শাফেয়ী রহ. এর এক শাগরিদ সাবিত আল-যা‘শকে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, তুমি এযাবৎ তাঁর থেকে কতগুলো মাসআলা সংগ্রহ করেছো? উপস্থিত সবাই তো হতবাক! আরে, জ্ঞান পিপাসু ইমাম আহমদ বলে কি! নির্যাতনের মধ্যেও ইলম চর্চায় মগ্ন! অথচ সে নিজেও নিজের শাস্তি স্বচোখে অবলোকন করছে। 

(একাদশ)

খলীফা মু‘তাসিম হতাশ। সে বুঝলো, যাকে জুলুম, নির্যাতন আর জেলখানায় বন্দী রেখে বাগে আনা যাচ্ছে না তাকে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। তাই ইমাম সাহেবকে মুক্ত করে দিলো। আল্লাহর এই নিষ্ঠাবান মুখলিস বান্দা ঘরে ফিরেই পুনরায় মসজিদে হাদীস অধ্যাপনার কাজে নিজেকে অত্মনিয়োগ করলেন। কিন্তু, প্রথম কয়েক দিন কষ্ট হলো। তিনি নির্যাতিত স্থানগুলোর ব্যাথায় ভালো ভাবে হাটা-চলা করতে পারলেন না। নিরুপায় হয়ে অবশেষে সামান্য কদিন র্দস স্থগিত রাখলেন। এরই মধ্যে খবর এলো মূর্খ মু‘তাসিম মারা গিয়েছে। তবে নতুন খেলাফত লাভ করেছে আল-ওয়াসেক বিল্লাহ। খলীফা ওয়াসেক খেলাফত লাভ করেই পূর্বের মূর্খদের মতো অস্বাভাবিক আচরণ আরম্ভ করলো। ইমাম আহমদ রহ. তার মতের সাথে একমত পোষণ না করায় সে ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে নির্দেশ জারি করলো, ইবনে হাম্বল কাউকে র্দস দিতে পারবে না। এমনকি, খলীফা যে শহরে অবস্থান করছে তাকে সে শহর ছেড়ে নির্বাসনে যেতে হবে। ইমাম আহমদ রহ. নিজ দেশে থেকেও প্রবাস। তিনি মসজিদে নামায আদায় এবং দরস প্রদান বন্ধ করে আত্মগোপন করলেন। আল্লাহর কি অপার মহিমা! খলীফা আল-ওয়াসেক বিল্লাহ আপন ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হলো। এবং ইমাম সাহেবের নিকট ক্ষমা চেয়ে নিলো। ভুলে গেলেন ইমাম আহমদ রহ. পিছনের সব নির্যাতনের কথা; বিনাশর্তে ক্ষমা করে অসাধারণ ইতিহাস গড়লেন। 

(দ্বাদশ)

জীবনের বৃহত্তর একটি অংশ জুলুম, অত্যাচার আর নির্যাতনের শিকার হওয়ায়, শেষ জীবনে ইমাম সাহেব রহ. খুবই অসুস্থতা অনুভব করতেন। কী অমানুষিক নির্যাতনই না করেছিলো জালিমরা! আচ্ছা, তাদের হৃদয়ে কি দয়ার উদ্রেক হয়েছিলো না? ইস! কত কষ্টই না পেয়ে ছিলেন তিনি! ২৪১ হিজরী, একেবারে জীবনের শেষ মুহূর্তে। তিনি মারাত্মক অসুস্থ। সে অসুস্থতা আর ভালো হলো না। চলে গেলেন যুগের শ্রেষ্ঠ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. মহান প্রভূর সান্নিধ্যে। কিন্তু এই মহান মানবের কষ্ট, শ্রম আর ত্যাগ বৃথা যায়নি। তিনি আমাদের মাঝে হাদীসের সুবিশাল সংকলন উপহার হিসেবে রেখে গিয়েছেন। যেটি “মুসনাদে আহমদ” নামে পরিচিত। সংকলনটি সুবিশাল কলেবরে ৫২খণ্ডে বাজারে পাওয়া যায়। যাতে প্রায় ৩০,০০০ (ত্রিশ হাজারেরও বেশি) হাদীস সংকলিত হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ। আমরা তাঁর জন্য দু‘আ করি। মহান আল্লাহ তা‘আলা যেন তাকে জান্নাতের সুউচ্চমাকাম দান করেন। মহান আল্লাহ যেন ইমাম সাহেব রহ. এর খেদমতগুলোকে উম্মতের পথ নির্দেশনা হিসেবে বাঁকি রাখেন। আমীন।

উপসংহার : আমরা এতক্ষণ ইমাম আহমাদ রহ. এর জীবনতিহাস জানলাম, আরো জানলাম তিনি হলেন হাম্বলী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা। হাজারও মানুষ যার হাদীস থেকে উদৃত মাসআলার মাধ্যমে দ্বীনের পথে চলার মসৃণ পথ পেয়েছে। যার হাত ধরে আমরা পেয়েছি হাদীসের সু বিশাল ভান্ডার, মুসনাদে আহমাদ, তার প্রতি উম্মতের মুখাপেক্ষিতাই মুসনাদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ বহন করে। এসমস্থ ইমামগণ এতই আদেল যাদের ব্যাপারে কারো কোন মতনৈক্য নেই। আর আমাদেরও নেই তাদের মত কুরআন হাদীস থেকে মাসআলা উদৃত করার ক্ষমতা। তাই আসুন এই সমস্ত ইমামদের ছায়াতলে এসে, নিজেদের দ্বীনের উপর চলার পথকে সুগম করি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হক বুঝার তাওফীক দান করুক, আমীন। সূত্র : সীরাতুল আইম্মাতি ওয়াল ওলামা, মুখতার সবরী : ৪/৩-২৪]

লেখক: প্রাবন্ধিক, তরুণ আলেম, আল-মান্হাল মডেল কাওমী মাদ্রাসা, উত্তরা,ঢাকাhttp://al-jannatbd.com/%E0%A6%87%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%87%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%AE-%E0%A6%86%E0%A6%B9%E0%A6%AE%E0%A6%A6/

বিষয়: বিবিধ

১৯৩৩ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

298044
৩০ ডিসেম্বর ২০১৪ সকাল ১১:০১
সুশীল লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
০৫ জানুয়ারি ২০১৫ সকাল ০৯:০০
242313
মদীনার আলো লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ
298131
৩০ ডিসেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৩৭
জাইদী রেজা লিখেছেন : Excellent । চমৎকার । খুব ভাল লাগলো । আপনি কেমন আছেন।
০৫ জানুয়ারি ২০১৫ সকাল ০৯:০২
242314
মদীনার আলো লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ ভাল আছি
298143
৩০ ডিসেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৩১
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
০৫ জানুয়ারি ২০১৫ সকাল ০৯:০২
242315
মদীনার আলো লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File