দরবেশ শ্রেষ্ঠ, না জাদুকর শ্রেষ্ঠ?

লিখেছেন লিখেছেন মদীনার আলো ২৮ জুলাই, ২০১৩, ১১:১২:০২ রাত

হযরত সুহায়েব (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের পূর্বেকার লোকদের মধ্যে একজন বাদশাহ ছিল। তার দরবারে ছিল একজন জাদুকর। সে যখন বার্ধক্যে উপনীত হলো, তখন বাদশাহকে বললঃ ‘আমি একদম বুড়ো হয়ে গেছি। সুতরাং একটি বালককে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন। আমি তাকে জাদু শিখিয়ে দেব।’ সে মতে বাদশাহ একটি কিশোরকে জাদু শেখানোর জন্যে তার কাছে পাঠালেন। তার চলাচলের পথে ছিল এক খৃস্টান দরবেশ। বালকটি দরবেশের কাছে বসে তার কথাবার্তা শুনে চমৎকৃত হলো। এভাবে জাদুকরের কাছে যাতায়াতের পথে দরবেশের কাছে বসতে লাগল। একদিন জাদুকরের কাছে গেলে সে তাকে খুব মারধর করল। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে সে দরবেশের কাছে এ ব্যাপারে নালিশ করল। দরবেশ তাকে উপদেশ দিল, তোমার মনে যখন জাদুকরের জিজ্ঞাসাবাদের ভয় জাগবে তখন তাকে বলবেঃ আমার পরিবার আমাকে আটকে রেখেছিল। আর যখন তোমার মাঝে স্বীয় পরিবারবর্গের ভয় জাগবে, তখন তাদেরকে বলবে, জাদুকর আমায় আটকে রেখেছিল।

এই পরিস্থিতিতে একদিন এক বিরাট জন্তু এসে লোকদের চলাচলের পথ বন্ধ করে দিল। বালকটি তখন মনে মনে ভাবলঃ আজ আমার জানতে হবে যে, দরবেশ শ্রেষ্ঠ, না জাদুকর শ্রেষ্ঠ? অতপরঃ সে একটি পাথর খণ্ড হাতে নিয়ে প্রার্থনা করলঃ হে আল্লাহ! তোমার কাছে যদি জাদুকরের চেয়ে দরবেশের কাজ বেশি পছন্দনীয় হয়, তাহলে লোকদের পথ চলাচলের সুবিধার্থে এই জন্তুটাকে মেরে ফেল। এরপর সে উক্ত পাথর খণ্ডটি ছুড়ে মারল এবং তাতে জন্তুটি মারা গেল। এতে চলাচলের পথটি উন্মুক্ত হয়ে গেল এবং লোকেরাও নিজ নিজ লক্ষ্যপানে চলে গেল। এরপর সে দরবেশের কাছে এসে এ খবরটি তাকে জানাল। দরবেশ তাকে বললঃ ‘হে প্রিয় বৎস! আজ তুমি আমার ওপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছ। আমার মতে, আজ তুমি একটি বিশেষ পর্যায়ে উপনীত হয়েছ; তুমি খুব শিগগিরই একটি কঠিন পরীক্ষায় নিপতিত হবে। কাজেই তুমি যখন কোন বিপদে ফেঁসে যাবে, তখন আমার সম্পর্কে কাউকে কোন সন্ধান দেবে না।’

বালকটি মানুষের সব জটিল রোগের চিকিৎসা করত; বিশেষত অন্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে সে সুস্থ করে তুলত। তৎকালীন বাদশাহ্‌র দরবারে এক লোক অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে এ খবর শুনে অনেক উপঢৌকন নিয়ে এসে বালকটিকে বললঃ ‘তুমি আমায় সুস্থ করে তুলবে, এ প্রত্যাশায়ই আমি তোমার জন্য এত উপঢৌকন নিয়ে এসেছি।’ জবাবে বালকটি বললোঃ আমি তো কাউকে সুস্থতা দান করি না, আল্লাহই প্রকৃতপক্ষে সুস্থতা দান করেন। তুমি যদি আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখো, তাহলে তোমার সুস্থতার জন্য আমি আল্লাহর কাছে দো’আ করব।’ লোকটি তখন আল্লাহর প্রতি ঈমান আনল। আল্লাহও তাকে সুস্থতা দান করলেন। তারপর সে বাদশাহর দরবারে যথারীতি আসন গ্রহণ করল। বাদশাহ তাকে প্রশ্ন করলঃ কে তোমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিল? সে জবাব দিল আমার প্রভু (রব্ব)।   বাদশাহ আবার তাকে প্রশ্ন করলঃ কে তোমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিল? সে জবাব দিল আমার প্রভু। এবার বাদশাহ প্রশ্ন করলঃ আমি ছাড়াও কি তোমার কোনো প্রভু আছে? সে বলল, ‘আল্লাহই আমার ও তোমার প্রভু।’ এতে ক্রুদ্ধ হয়ে বাদশাহ তাকে শাস্তি দিতে লাগল। শাস্তি সহ্য করতে না পেরে সে বালকটির নাম বলে দিল। সে মতে বালকটিকে ডেকে আনা হলো। বাদশাহ তাকে স্নেহের সুরে বললেন হে প্রিয় বালক! তোমার সম্পর্কে আমার কাছে খবর পৌঁছেছে যে, তুমি নাকি জাদুবিদ্যার সাহায্যে অন্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে নিরাময় দান করো এবং আরও নানা রকমের রোগীকে সুস্থ করে তোল। জবাবে বালকটি বললঃ মহামান্য বাদশাহ্‌! আমি কাউকে সুস্থতা দান করি না। সুস্থতা তো আল্লাহই দান করেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে বাদশাহ তাকে শাস্তি দিতে লাগল। শেষ পর্যন্ত সে খৃস্টান দরবেশের নাম বলে দিল। সে মতে দরবেশকে ডেকে আনা হলো এবং তাকে তার ধর্ম (দ্বীন) থেকে ফিরে আসতে বলা হলো। কিন্তু সে তাতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করল। তখন বাদশাহ জনৈক কর্মচারীকে একটি করাত আনতে বলল। করাত নিয়ে এলে সেটিকে দরবেশের মাথার ঠিক মাঝ বরাবর স্থাপন করে তাকে চিরে ফেলা হলো। এরপর বালকটিকেও নিয়ে আসা হলো এবং তাকেও তার ধর্ম দ্বীন থেকে ফিরে আসতে বলা হলো। কিন্তু সে দৃঢ়ভাবে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করল। তখন বাদশাহ তাকে কতিপয় সঙ্গীর হাতে তুলে দিয়ে বললঃ তোমরা তাকে অমুক পাহাড়ের ওপর নিয়ে যাও। যখন তোমরা পাহাড়ের উঁচু শিখরে গিয়ে উঠবে, তখন সে যদি তার ধর্ম ত্যাগ করে, তবে তো ঠিক। নচেৎ সেখান থেকে তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেবে।

সে মতে লোকেরা ছেলেটিকে নিয়ে পাহাড়ে উঠল। ছেলেটি বললঃ ‘হে আল্লাহ! তুমি যেভাবে পছন্দ করো এদের কবল থেকে আমায় মুক্তি দান করো।’ এ সময় পাহাড়টি হঠাৎ কেঁপে উঠল এবং তারা সবাই নিচে পড়ে গেল। আর ছেলেটি বাদশাহর কাছে ফিরে এল। বাদশাহ্‌ তাকে জিজ্ঞেস করলঃ ‘তোমার সঙ্গীদের কী হয়েছে?’ ছেলেটি বললঃ ‘আল্লাহ তাদের কবল থেকে আমায় রক্ষা করেছেন।’ বাদশাহ তখন তাকে অন্য কতিপয় সঙ্গীর হাতে ন্যস্ত করে বললঃ একে তোমরা একটি ছোট্ট নৌকায় তুলে গভীর সমুদ্রে নিয়ে যাও। অতঃপর সে যদি তার ধর্ম (দ্বীন) ত্যাগ না করে, তবে তাকে তোমরা সেখানে (সমুদ্রে) ফেলে দাও। এই নির্দেশ মোতাবেক লোকেরা তাকে নিয়ে সমুদ্রপথে চললো। ছেলেটি প্রার্থনা করলঃ হে আল্লাহ! তুমি যেভাবে পছন্দ করো, এদের কবল থেকে আমায় মুক্তি দাও। এরপর নৌকাটি তাদের নিয়ে ডুবে গেল এবং তারা সবাই মৃত্যুবরণ করল। ছেলেটি বাদশার কাছে ফিরে এলো। বাদশাহ তাকে জিজ্ঞেস করলঃ তোমার সঙ্গীদের ভাগ্যে কি ঘটেছে? সে জবাব দিলঃ আল্লাহই আমাকে তাদের কবল থেকে রক্ষা করেছেন। অতঃপর সে বাদশাহকে লক্ষ্য করে বললঃ তুমি আমার নির্দেশ মোতাবেক কাজ করো তবেই আমাকে হত্যা করতে পারবে। বাদশাহ জিজ্ঞেস করলঃ সেটা কি ধরনের কাজ? সে বললঃ একটি মাঠে লোকদের জড়ো কর। তারপর আমায় শুলের ওপর বসাও এবং আমার তীরদানি থেকে একটি তীর নিয়ে ধনুকের মাঝ বরাবর রেখে বলোঃ ‘বিসমিল্লাহি রাব্বিল গোলাম’ (অর্থ্যাৎ বালকটির প্রভু আল্লাহর নামে তীর ছুঁড়ছি) --এই বলে তীর ছুঁড়ো। এভাবে তীর ছুঁড়লেই তুমি আমায় হত্যা করতে পারবে।

বাদশাহ তখন একটি মাঠে লোকদের জড়ো করে ছেলেটিকে শুলের ওপর বসিয়ে তার তীরদানি থেকে একটি তীর ধনুকের মাঝখানে স্থাপন করে ‘বিসমিল্লাহি রাব্বিল গোলাম’ বলে তার প্রতি ছুঁড়ে মারল। তীরটি বালকটির কানের পাশ দিয়ে মাথা ভেদ করল এবং তাৎক্ষণাৎ তার মৃত্যু ঘটল। এতে লোকেরা বলতে লাগলঃ ‘আমরা বালকটির প্রভু আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলাম।’ এ সংবাদ বাদশাহর নিকট পৌঁছালে তাকে বলা হলো, ‘যে আশংকা তুমি পোষণ করেছিলে, তা-ই তো হয়ে গেল; অর্থ্যাৎ সব লোকেরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে।’ বাদশাহ তখন রাস্তার পাশে বিরাট আকারের গর্ত করার নির্দেশ দিল। অতঃপর গর্ত খনন করে তাতে আগুন জ্বালানো হলো। বাদশাহ ঘোষণা করলো, কোন ব্যক্তি তার ধর্ম (দ্বীন) থেকে ফিরে আসতে না চাইলে তাকে তোমরা গর্তে নিক্ষেপ করো। এ ঘোষণা অনুসারে যারা স্বীয় দ্বীন থেকে ফিরে আসতে অস্বীকৃতি জানাল, তাদেরকে আগুনে ছুঁড়ে মারা হলো। শেষ পর্যন্ত একজন মহিলা তার সন্তানসহ এলো। সে আগুনে ঝাঁপ দিতে ইতঃস্তত করলে তার সন্তান বললঃ ‘আম্মা! আপনি ধৈর্য ধারণ করুন। (অর্থ্যাৎ আগুনে ঝাঁপ দিতে ইতঃস্তত করবেন না); কারণ আপনি তো সত্যের ওপর রয়েছেন।’ (মুসলিম)

বই ১ :: হাদিস ৩০ রিয়াযুস স্বলিহীন

বিষয়: বিবিধ

১১১০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File