রিকসাওয়ালার পাঁচ আঙ্গুল !
লিখেছেন লিখেছেন ডক্টর সালেহ মতীন ২৫ অক্টোবর, ২০১৭, ০৯:৪২:০৫ সকাল
কয়েকদিন আগে এক বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ন‘টার দিকে খিলগাঁও রেলগেট থেকে কমলাপুর গমনের প্রয়োজন দেখা দিল। গন্তব্য কুমিল্লাগামী রয়েল কোচ বাস কাউন্টার। অফিস টাইমের হিসাবে তখন সুপার পিক আওয়ার, তবু রাস্তায় রিকসার তেমন একটা সঙ্কট পরিলক্ষিত হলো না। ২/১টি রিকসাকে জিজ্ঞাসা করলে তারা ‘না’ সূচক জবাব দিলেন বটে তবে তৃতীয় রিকসাওয়ালা শ্মশ্রুমণ্ডিত ও মধ্য বয়সের সীমান্ত পর্যায় অতিক্রমকারী ব্যক্তি গন্তব্যের নাম শুনেই মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ সূচক উত্তর দিলেন। স্বভাবতই দ্বিতীয় পর্যায়ে আমি জানতে চাইলাম, “কত নিবেন” ? ভদ্রলোক নির্দ্বিধায় তার বাঁ হাতের পাঁচটি আঙ্গুল উচিয়ে দেখালেন। আমি তো এ পদ্ধতিতে ভাড়া নির্দেশে অভ্যস্ত নই- সুতরাং কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলাম, “জী কত ?” তিনি পূর্ববৎ সেই পাঁচটি আঙ্গুলই সগৌরবে উচিয়ে দেখালেন।
‘হাতের পাঁচ আঙ্গুল সমান নয়’ মর্মে বাংলায় একটি জনপ্রিয় প্রবাদ আছে। বাস্তবেও হাতের পাঁচটি আঙ্গুল সমান হয় না। কর্মে, দৈর্ঘে, শক্তিতে, চেহারায় ও বৈশিষ্ট্যে হাতের পাঁচটি আঙ্গুল আসলেই ভিন্ন। কর্ম বিচারে পাঁচ আঙ্গুলকে তো রীতিমতো পাঁচটি পরিচয়ে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। যেমন : পথ দেখানো (শাহাদাত অঙ্গুলি), কান খোচানো (কড়ে অঙ্গুলি), ভেজাল বাঁধানো (বুড়া অঙ্গুলি) ইত্যাদি। কর্ম ভিন্নতার পাশাপাশি প্রত্যেকটি আঙ্গুল অবস্থানগত ভিন্নতা ধারণ করে আসছে মনুষ্য সৃষ্টির সেই আদি লগ্ন থেকেই। কিন্তু রিকসাওয়ালা ভদ্রলোক ঠিক কোন্ আঙ্গুুলের জন্য কত টাকা ভাড়া নির্দেশ করলেন সে রহস্য উম্মোচন করা আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। আমরা জানি, খিলগাঁও রেলগেট থেকে কমলাপুর বর্তমান রেগুলার ভাড়া ত্রিশ টাকা। তিনি ঠিক কত বুঝাতে চাইলেন স্পষ্ট হলো না।
না, ভদ্রলোকের ভাড়া চাওয়ার পদ্ধতি ও রহস্যের সাথে এ্যাডজাস্ট করতে আমাকে প্রস্তুত করা গেল না। হাতে সময় থাকলে হয়ত সবিনয়ে তার কাছে জানতে চাইতে পারতাম- তার কোন্ আঙ্গুলের বাজার মূল্য কত ! অথবা হতে পারে তিনি আমার মতো অধমের সাথে বাক্য ব্যয় করে দর কষাকষির অযথা কোন হেতু খুঁজে পাননি। একবার মনের বারান্দায় উঁকি দিয়েছিল যে, একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখি যে, তিনি সবার সাথেই কি বিজনেস-এর এই পলিসি অবলম্বন করছেন নাকি শুধু আমার সাথেই করলেন ! কিন্তু পরিস্থিতি ও সময় কোনটিই আমাকে তখন এটা করতে পারমিট করেনি।
যাই হোক, সাথে সাথে পাশের এক যুবক বয়সী রিকসাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি রাজী হলেন। জানতে চাইলাম- “কত ?” ভনিতার লেজমাত্রও তিনি মাড়ালেন না, মৃদু হাসি দিয়ে বললেন, “তিরিশ টাকা”। সাথে সাথেই উঠে বসলাম। অদূর গন্তব্যে রওনা দিতে অঙ্গুলি প্রদর্শনের অকুস্থল পেছনে ফেলতে শুরু করলেও সেটি নিয়ে ভাবনা আমার থেকে পেছনে যেতে কোনক্রমেই রাজি হলো না। সমান অসমান যাই হোক ভদ্রলোক পাঁচটি আঙ্গুলকেই সমান মর্যাদা দিয়েছেন অর্থাৎ পাঁচ দশে পঞ্চাশ টাকা দাবী করেছেন তা আর বুঝতে বাকী রইল না।
কিন্তু এ বিষয়ে আমার ভাবনা কেন্দ্রীভূত হয়েছে অন্যত্র। হাতের অগ্রভাগে অবস্থানরত পাঁচটি আঙ্গুল দৈর্ঘে, শক্তিতে, বৈশিষ্ট্যে, সুস্পষ্টভাবে ভিন্ন থাকলেও যখন তারা একত্রিত হয়ে কোন লক্ষ্যে মিলিত হয় তখন অগ্রভাগ পরিপূর্ণ সমতায় অবস্থান নেয় এবং লক্ষ্য অর্জনে তারা সাফল্য স্পর্শ করে। আর হাতের যত কর্মগুণ তা আঙ্গুলসমূহের সযত্নে একত্রিত হওয়ার ফলেই সম্পাদিত হওয়া সম্ভব হয়। ভিন্নমুখী অবস্থানে রেখে কোন আঙ্গুল দ্বারা গুরুত্বপূর্ণ কর্ম সম্পাদন সম্ভব হয় না। বড় জোর কান খোচানো, পথ দেখানো এ ধরনের টুকটাক কাজ করা যেতে পারে। পাঁচটি আঙ্গুলকে স্বতন্ত্রভাবে খাড়া করে দেখুন তো তা দ্বারা কী কী কাজ করা যায় !
দেশের কিংবা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত মানুষের মধ্যে বাস্তবিক অর্থে ভিন্নতা রয়েছে প্রচুর। বিত্তে, প্রভাবে, জ্ঞানে, মর্যাদায়, মননে, শক্তিতে, নৈপুন্যে, বুদ্ধিতে, সৌভাগ্যে, ভাষায়, বর্ণে, সংস্কৃতি ও বৈশিষ্ট্য ইত্যাদিতে মানুষের মধ্যে প্রচুর অসমতা বিদ্যমান। কিন্তু হাতের পাঁচ আঙ্গুলের মতো তারা যদি একই বৃন্তে মিলিত হতে পারত তাহলে দেশ ও পৃথিবী গড়ার অনেক বড় বড় কাজ সম্পাদন তথা শান্তি প্রতিষ্ঠা অনিবার্যভাবে সম্ভব হতো। সৃষ্টি রহস্য তথা সৃষ্টি সৌন্দর্যের প্রয়োজনে মানুষের মধ্যে উঁচু-নিচু থাকতে পারে- কিন্তু তা পেছনে ফেলে পৃথিবীকে সাজানো ও কল্যাণমুখী কর্মসূচিতে একত্রিত হতে পারলে মহা আশ্চর্যজনক ফলাফলের সন্ধান মিলত বলে মনে করি। আঙ্গুলের কাছ থেকে মানব সভ্যতা যদি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এ গুণ ধার করে ব্যবহার করে তাতে দোষ কী ?
লেখক : উন্নয়ন গবেষক ও কলামিস্ট
বিষয়: বিবিধ
১৩০৩ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কারণ এটি গ্রিপ এ সহায়তা করে । গ্রিপ ছাড়া আপনি কোন কিছু শক্তভাবে ধরতে পারবেন না ।
বৃদ্ধাঙ্গুল হল একটি হাতের ক্ষমতার ৫০% । তর্জনী ২০%। বাকীগুলো ১০ করে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন