নৈতিক শিক্ষার মানদণ্ডে মাহে রমজান

লিখেছেন লিখেছেন ডক্টর সালেহ মতীন ২৭ জুন, ২০১৬, ০২:২৬:৫৭ দুপুর

রোজা মুসলমানদের জন্য অবশ্য পালনীয় একটি পবিত্র ধর্মীয় অনুশাসন। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে সাওম বা রোজা অন্যতম। ইসলামী অনুশাসনের প্রত্যেকটির নিজ নিজ হাকীকত বা বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। সাওম বা রোজার হাকীকত বহুমূখী গুরুত্বপূর্ণ ও বাস্তবোচিত প্রশিক্ষণ দ্বারা পরিপূর্ণ। সে দিক থেকে বিচার করলে রোজাকে বলা যায় ইসলামী শরীয়তের সত্যিকার ও বাস্তবোচিত প্রশিক্ষণ একাডেমী। ইসলাম তো বিশ্বাসভিত্তিক একটি ধর্মই শুধু নয়, পূর্ণাঙ্গ ও আধুনিক জীবন বিধানও বটে। তাই এর প্রতিটি আদেশ-নিষেধের গভীরে মানুষের মৌলিক জীবন ঘনিষ্টতা উপলব্ধি করা যায়। ইসলামী শরীয়তের মৌলিকত্ব হলো এক আল্লাহর আদেশ। পবিত্র রমজান মাসের রোজাও মুমিনদের জীবনের নানামূখী প্রয়োজনে ফরয করা হয়েছে। বস্তুত: মুমিন-মুসলমানেরা ঈমানী পথের দুর্গম দৈর্ঘ্য সাফল্যের সাথে পাড়ি দেয়ার বাস্তব ও শক্তিশালী প্রশিক্ষণ রোজা থেকেই অর্জন করে থাকে। মুুমিনের চরিত্রের একটি অন্যতম অপরিহার্য শর্ত হলো নৈতিকতা। নৈতিকতার স্খলনজনিত কারণে ব্যক্তি ও সমাজে গর্হিত কাজকর্মের প্রসার ঘটে। এতে মানবতা বিপন্ন হওয়া ছাড়াও অশান্তিতে সমাজ ভারাক্রান্ত হতে বাধ্য। নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি ও অর্জনে মাহে রমজান কতখানি প্রভাব বিস্তার করে তা আলোচনা করব।

আল্লাহ তায়ালা মানুষকে তাবৎ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। মানুষকে বলা হয় ‘আশরাফুল মাখলুকাত’। মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের পিছনে তার পরিশুদ্ধ নৈতিকতা হলো একটি অপরিহার্য নির্ভরতা। নীতি নির্ভর না হলে মানুষ কখনই সৃষ্টির সেরা বলে দাবী করতে পারে না। পশুর নীতি নৈতিকতার বালাই নেই, সে ভাল মন্দ, সত্য-মিথ্যা বুঝে না। সে জন্যই সে পশু। নিকৃষ্টতার মাপকাঠি। আমরা বলে থাকি ‘নীতিহীন মানুষ পশুর সমান’ বা কোন কোন ক্ষেত্রে বলি ‘নীতি বিবর্জিত ব্যক্তি পশুরও অধম।’ ঠিকই বলি। নীতি যদি একজন মানুষ সামগ্রিক জীবনে সত্যিকার অর্থে অবলম্বন না করে তাহলে তার গর্ব করার কী থাকতে পারে ? শয়তানের অসওয়াসা ও প্রবৃত্তির কুপ্ররোচনায় মানুষের নীতিভ্রষ্ট হওয়ার প্রচুর সম্ভাবনা থাকে। সেই ভ্রষ্টতা শুধরে পরিচ্ছন্ন নৈতিকতা অবলম্বনের জন্য মাহে রমজানের যুগপৎ আবির্ভাব। তবে কেবল চিন্তাশীল ও নিরেট ঈমানদার ব্যক্তিরাই মাহে রমজানের এই নৈতিক তাৎপর্য ও শিক্ষা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। সঠিক ও সত্য পথে অটল থাকার ঈমানী সংকল্প যদি শক্ত না হয় তাহলে রোজা বা এ ধরণের কোন শরয়ী আহকাম মানুষের জীবনে তেমন কোন উপকার সাধন করতে পারে না।

পবিত্র আল-কুরআনের একটি আয়াত দ্বারা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের উপর মাহে রমজানের রোজাকে ফরয করেছেন। সেখানে কেন রোজা ফরয করা হলো তা অতি পরিষ্কার ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলছেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেওয়া হলো যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে দেওয়া হয়েছিল। যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে সক্ষম হও।” মূলত: তাকওয়া অর্জনই মাহে রমজানের আসল উদ্দেশ্য। আর এই তাকওয়ার মধ্যেই নৈতিকতার যাবতীয় গুণাগুণ নিহিত। একজন মুসলমানকে তাকওয়া অর্জনের পবিত্র ও চূড়ান্ত লক্ষ্য নিয়েই মাহে রমজানের রোজাকে বরণ করে নিতে হয়। পুরো একটি মাস প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে সারা বছরই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তা যথাযথ বাস্তবায়ন করাই মুমিনের কর্তব্য। অবহেলা কিংবা অবিবেচনাপ্রসূত খাম-খেয়ালীতে রমজানের নৈতিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হলে তা মুসলমানের জন্য বড়ই পরিতাপের বিষয়।

একটু চিন্তা করলে আমরা সহজেই অনুধাবন করতে সক্ষম হই যে, রোজা এমন কতক জিনিসকে হারাম করে যা অন্য সময়ে সম্পূর্ণ হালাল। প্রশিক্ষণের স্বার্থে সেগুলোকে সাময়িকভাবে হারাম বলে বিবেচনা করতে হয়। যেমন সামরিক জোয়ানরা কল্পিত শত্রু রচনা করে তাকে ঘায়েল করার জন্য সামরিক মহড়ার আয়োজন করে। রোজাও ঠিক তেমনি। ভালোর দিকে ধাবিত হওয়া এবং মন্দ থেকে দূরে থাকা, প্রতিপালকের আদেশ-নিষেধ পূর্ণ মাত্রায় মান্য করা, বিশুদ্ধ চিন্তার অভ্যাস গড়ে তোলা, আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জন, সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভ ও তাকওয়া দ্বারা মানব জীবন পরিপূর্ণ করার সক্রিয় তাগিদ নিয়ে মাহে রমজান মুসলমানদেরকে অভিবাদন জানিয়ে থাকে। রোজা মিথ্যে পরিহার করে সর্বাবস্থায় মুমিনকে সত্য ও সুন্দর বলতে শেখায়। রোজা আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর না হয়ে দু:খী-দরিদ্রজনের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আহবান করে এবং সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক নির্দেশিত হালাল-হারামের বিধান পরিপালনের যথার্থ তাগিদ দেয়। অতিরিক্ত পানাহার ও অসংযম জীবন যাপনের সামনে রোজা মুসলমানদেরকে নিয়ন্ত্রণ শক্তি অর্জনে সাহায্য করে। আল্লাহ পাকের নৈকট্য হাসিলের পুণ্যময় বাসনায় মুমিন ব্যক্তি রোজার মাধ্যমে তাঁর আদেশ-নিষেধ যথার্থ পন্থা ও মাত্রায় মেনে চলতে সচেষ্ট হয়। রোজা একজন মুসলমানের অনাকাক্সিক্ষত ও অনুচিত ঔদ্ধত্য প্রশমনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে এবং অন্যের প্রতি দুর্ব্যবহার, জুলুম, নিপীড়ন কিংবা বে-ইনসাফ করতে বাঁধা দেয়। রোজা মানুষকে পূর্ণ আমানতদার হতে সাহায্য করে যা কিনা একটি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক গুণ। রোজার দ্বারা মানুষের স্বভাবে বিনয়, আনুগত্য ও নম্রতা উৎপন্ন হয়। এ ছাড়াও রোজা মানুষের হৃদয়ে মমত্ববোধ, দয়ার্দ্রতা ও সৌভ্রাতৃত্ব বোধ তৈরিতে সাহায্য করে।

আজ গোটা পৃথিবী জ্বলছে অশান্তির ভয়াবহ দাবানলে। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্ব দু:খজনকভাবে অনৈতিক বৈষম্য, বিদ্বেষ, প্রতিরোধ ও অত্যাচারের করুণ শিকারে পরিণত হয়েছে। এর অন্যতম কারণ বিশ্ব নেতৃবৃন্দের নৈতিকতার অভাব। হিংসা-হানাহানি, ফাঁকিবাজি, লুটতরাজ, খুন-রাহাজানি, পণ্যদ্রব্যে ভেজাল ইত্যাদিতে জনজীবন অতীষ্ট হয়ে উঠেছে। এ সব কিছুর পিছনে নৈতিক অধ:পতন অতি মাত্রায় দায়ী। পৃথিবীতে মানুষ বেড়েছে, বেড়েছে বিজ্ঞান তথা উন্নয়নের উৎকর্ষতা। যুগ অভাবনীয় অগ্রগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে আধুনিক থেকে আরো আধুনিকতার শীর্ষে। কিন্তু বিপন্ন নৈতিকতার কারণে কাঙ্ক্ষিত শান্তি লাভ আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। মানবতা মুখোমুখি হচ্ছে চরম বিপর্যয়ের। এ অবস্থা কি কারো কাম্য হতে পারে ? এ সব সমস্যা দূরীকরণ তথা মানুষের নৈতিক মানোন্নয়নে মাহে রমজানের রোজাকে সঠিক মাপকাঠি বিবেচনা করা এখন যুগের দাবী। ভোগ বিলাসের শয়তানী উম্মত্ততা জিইয়ে রেখে বিশ্ব শান্তির শত প্রচেষ্টা কখনই সাফল্যের মুখ দেখতে পারে না। অনুদার ভোগবাদী চিন্তা সংকুচিত করা না গেলে মানবতার বিপর্যয় ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেতেই থাকবে। রোজা ঐ সব ভোগবাদী চিন্তাধারার বিনাশ ঘটিয়ে ব্যক্তি, সমাজ ও বিশ্বমানবতার কল্যাণে ত্যাগী মানসিকতা প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের মাধ্যমে মানুষকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলে।

উম্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির অবাধ প্রবাহের ফলে অশ্লীলতা ও কুসংস্কৃতির ছোবল বিশ্বব্যাপী যুব সমাজকে নৈতিক অধ:পতনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে যৌন অপরাধের মাত্রাতিরিক্ত প্রবণতা সমাজকে করছে কলুষিত। আধুনিক সংস্কৃতি ও সভ্যতার নামে মূলত: রুচি বিবর্জিত অসভ্য অশ্লীলতারই সেবা করে চলেছে এক শ্রেণীর তথাকথিত সংস্কৃতিসেবীরা। চরিত্র বিধ্বংসী কৃষ্টি কালচার তারা এমনভাবে নিজেদের গায়ে মেখে আপন করে নিয়েছে যে, অনৈতিকতার সীমা পরিসীমা তারা আর এখন নির্ণয় করতে পারে না। রোজা এখানেও নিরব থাকেনি। সকল প্রকার অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকা রোজার মৌলিক বিষয়ের একটি। সুতরাং এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, রোজা অশ্লীলতার বিরুদ্ধেও সোচ্চার ভূমিকা পালনের মাধ্যমে সমাজের নৈতিক অবক্ষয় রোধ করে। একজন রোজাদার কখনই অশ্লীল কাজের সাথে জড়িত থাকতে পারে না এমনকি রোজা অবস্থায় অশ্লীল কথাবার্তা উচ্চারণ করাও নিষিদ্ধ।

পবিত্র মাহে রমজানের নৈতিক শিক্ষাসমূহ আমাদের জীবনে সঠিকভাবে ধারণ করতে পারলে ব্যক্তিজীবন তথা সামাজিক-বৈশ্বিক জীবন হতে পারত অনিবার্য ও অন্তহীন সুন্দর। সেই সুন্দরের পথ দেখাতে মাহে রমজান প্রতি বছর ঘুরে ঘুরে এলেও দুর্ভাগ্যবশতঃ আমরা অনেকেই গাফেল হয়ে রোজার নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সুফল সম্পর্কে অনুধাবন ছাড়াই সময় পার করি। এটি মুসলমানদের জন্য মারাত্মক ঈমানী পরাজয়। শয়তান এ ক্ষেত্রে আমাদের উপর জয়লাভ করে। আমাদের এ অবস্থা থেকে ব্যাপকভাবে উত্তরণ ঘটা প্রয়োজন। রোজার বহুমূখী শিক্ষা ও সুফল সম্পর্কে যেখানে অমুসলিম চিন্তাবিদদের মধ্যেও ব্যাপক ইতিবাচক সাড়া ও স্বীকৃতি রয়েছে, সেখানে মুসলমানেরা এ বিষয়ে নিতান্তই বেখবর হয়ে থাকবে ইহা কোনভাবেই কারো কাম্য হতে পারে না।

বিষয়: বিবিধ

১৫২৮ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

373280
২৭ জুন ২০১৬ দুপুর ০২:৩৪
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : শিক্ষনিয় লিখাটির জন্য অনেক ধন্যবাদ্
373288
২৭ জুন ২০১৬ দুপুর ০২:৫৩
কুয়েত থেকে লিখেছেন : অসাধারণ চমৎকার তাৎপর্য্যপূর্ণ লেখা নৈতিকতার স্খলনজনিত কারণে ব্যক্তি ও সমাজে গর্হিত কাজকর্মের প্রসার ঘটে। এতে মানবতা বিপন্ন হওয়া ছাড়াও অশান্তিতে সমাজ ভারাক্রান্ত হতে বাধ্য। এক মাত্র ত্বাকওয়াই আমাদেরকে রক্ষা করতে পারে আল্লাহ আমাদের উত্তম হেফাজত কারি। অনেক ভালো লাগলো আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ
373294
২৭ জুন ২০১৬ দুপুর ০৩:৩৫
নাবিক লিখেছেন : রোজার শুরুতে তারাবীর সময় মসজিদে জায়গা পাওয়া যেতো না, কিন্তু চার-পাঁচ রোজার যাওয়ার পরেই মসজিদ ফাঁকা! এখন টেনে-টুনে তিন কাতার হয়। কী আর বলবো এই কী রোজার শিক্ষা?

লেখাটা ভালো লাগলো, ধন্যবাদ।
373306
২৭ জুন ২০১৬ সন্ধ্যা ০৬:২৫
চাটিগাঁ থেকে বাহার লিখেছেন : সাইবার ব্যবস্থাপনায় মানুষ এখন অস্থিরমনা।
কোন স্থিরতা আমাদের মাঝে নেই।
চারিত্রিক শক্তিকে মোহগ্রস্থ করে যেন স্লো-পয়জন পুশ করা হচ্ছে।
373320
২৭ জুন ২০১৬ রাত ০৮:১১
শেখের পোলা লিখেছেন : রোজা তার তাকওয়া ও সংযমের ভাণ্ডার ঠিকই খুলে দিয়েছে কিন্তু আমরা তা থেকে সামান্যটি নেওয়ার উপযুক্ত করে নিজেদেরকে তুলতে পারিনি কারণ আমাদের সামাজিক ও চারিত্রিক অবক্ষয়। আমরা আমাদের উন্নত সংষ্কৃতি ভুলে তাদেরটাতেই আকৃষ্ট হচ্ছি। আপনার লেখাটি তাৎপর্যপূর্ণ। আপনাকে ধন্যবাদ।
373335
২৭ জুন ২০১৬ রাত ১০:৪০
জুনাইদ হোসেন সবুজ লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ ধন্যবাদ
373345
২৮ জুন ২০১৬ রাত ১২:২৮
দুষ্টু পোলা লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ পিলাচ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File