টেবিলে ১ গ্লাস দুধ, কে খাবে ?
লিখেছেন লিখেছেন ডক্টর সালেহ মতীন ০৫ এপ্রিল, ২০১৫, ০২:৫৫:২৮ দুপুর
১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাস। আমি তখন মগবাজার নয়াটোলা এলাকায় একটি মেসে থাকি। ম্যাব্স মৌচাক শাখার জনপ্রিয় ও দায়িত্বশীল বাংলা শিক্ষক হিসেবে অতিশয় ব্যস্ত সময় পার করছিলাম। সুপ্রিয় পাঠকবৃন্দের কাছে সবিনয়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি নিজের ঢোল নিজে পেটানোর জন্য নয় বরং বাস্তবতা প্রকাশের নিমিত্ত ‘জনপ্রিয়’ শব্দটি উল্লেখ করেছি। অধমের এ লেখাটির কাহিনী চিত্রের পেছনে ঐ জনপ্রিয়তাই অনুঘটকের কাজ করেছে। আশা করি সম্মানিত পাঠকবৃন্দ আমাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
ম্যাব্স এ আমার শিক্ষকতার প্রাতিষ্ঠানিক জনপ্রিয়তার সূত্র ধরে সুমি নামের এক ছাত্রীর সরকারি চাকুরে বাবা যাদের বাসা ছিল আমার মেসের পাশেই তার ঘনিষ্ট ইঞ্জিনিয়ার বন্ধুর ছেলেকে পড়ানোর অনুরোধ নিয়ে আসেন। ব্যস্ততা ও মৃদু অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভদ্রলোকের আকাক্সক্ষা ও আমার প্রতি তার অগাধ আস্থার কথা বিবেচনা করে তাকে উপেক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। পরের দিন বিকেলেই রামপুরা টিভি ভবনের পেছনে বনশ্রী এলাকায় তার বন্ধুর বাসায় আমাকে নিয়ে গেলেন।
ছাত্রের নাম সাদ তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। ছোট আরেকটি বোন আছে তার নাম সাদিয়া প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। বাবা-মা, দুই ভাই-বোন ও কলেজ পড়ুয়া খালা এই নিয়ে তাদের সংসার। বাবা টিএন্ডটি-র ইঞ্জিনিয়ার। বেশ মিষ্টি চেহারার সাদ সাংঘাতিক মিশুক বলেই প্রমাণ পেলাম। প্রথম দিন দেখা তবু মনে হচ্ছিল সে যেন আমার কত কালের চেনা ! এ স্বভাবের শিশুদের কাছে আপন হতে আমার ঐ একটি বৈঠকই যথেষ্ট।
যাই হোক পরের দিন বিকেলে পড়াতে গেলাম। ঢাকায় এটাই আমার কোন ছাত্রের বাসায় প্রথম পড়াতে যাওয়া। একদম নতুন মনে হচ্ছে না, কারণ তারা আমার সম্পর্কে পূর্বেই অবহিত হয়েছে এবং গতকাল তো পরিচয় পর্ব শেষ করে গেছি। পড়া শুরুর আগে সাদের স্কুল সম্পর্কে জেনে নিচ্ছি। মিনিট পাঁচেকের মাথায় কোন এক মেয়ে সুন্দর ট্রেতে করে ১ গ্লাস দুধ এনে পড়ার টেবিলে রাখল। ছোট টেবিল- ছাত্র শিক্ষক বসেছে মুখোমুখি সুতরাং গ্লাসটিকে কারো দিকে বেশি এগিয়ে দেয়ার সুযোগ ছিল না। তাছাড়া ঢাকার উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের স্কুল পড়–য়া ছাত্রের প্রতি অভিবাবকের সচেতনতা ও যত্নবান হওয়ার নিদর্শন স্বরূপ পড়ার টেবিলে প্রত্যহ ১ গ্লাস ঈষদুষ্ণ দুধ পরিবেশন করার সভ্যতা সম্পর্কে তখনো আমার কোন ধারণা অর্জিত হয়নি।
সাদের সঙ্গে কথা বলছি, তবে মনে মনে নতুন একটি ভাবনাও সে সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ভাবছি দুধটা কি অকারণ দেরি করতে গিয়ে ঠাণ্ডা করে খাওয়া উচিত হবে ? ভেতর থেকে উত্তর এলো মোটেও না। সাথে সাথে দুধের গ্লাস তুলে নিয়ে কয়েক ঢোকে সেটি খেয়ে ফেলি। সাদের এবার লজ্জায় চেহারা বদলে গেল। মুচকি হাসি তার ঠোঁটে লেগেই আছে। বুঝতে বাকী রইল না কিছু একটা অঘটন ঘটেছে। সাদের পাশে বসা সাদিয়া বেশ দ্রুতপদে বাসার ভেতরে চলে গেল। কী বলল কিংবা কিছু বলল কিনা তা শুনতে পেলাম না কিন্তু পৃথিবী এইমাত্র উল্টে গেছে বিশ্বাস করি আর না করি এটা অবিশ্বাস করার কোন সঙ্গত কারণ নেই যে, সাদিয়া তার মা ও খালাকে গিয়ে বলেছে যে, স্যার ভাইয়ার দুধ খেয়ে ফেলেছে।
লজ্জার মুকুট মাথায় নিয়ে সেদিন তো পার করলাম। অল্প ক’দিনের মধ্যেই তাদের পছন্দের শিক্ষকে পরিণত হয়ে গেলাম। সাদিয়াকেও পড়ানোর দায়িত্ব বর্তাল আমার ওপর। সে নাকি তার মায়ের কাছে বায়না ধরেছে যে, আমার কাছেই সে পড়বে। সাদ-সাদিয়া দুজনই আমার অত্যন্ত স্নেহের পাত্রে পরিণত হলো। কিন্তু বছর ঘুরতেই তাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে। আমার চাকুরী হয়েছে- সূর্যের আলো দেখার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। তাদের ভাষ্য ছিল যখনই আমি সময় পাব তখনই তাদের পড়ালেও কোন আপত্তি নেই তবু যেন আমি তাদের ছেড়ে না আসি।
বাস্তবতা অনেক নিষ্ঠুর ! ছাত্রের জন্য পরিবেশিত দুধ খেয়ে নেয়ার ঘটনায় অভিভাবকরা আমার সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করেছিল তা জানতে না পরলেও পেশাগত ব্যস্ততার কারণে তাদের উপর্যূপুরি অনুরোধ রক্ষায় অপারগতার জন্য ক্ষমা চেয়ে বিদায় নিয়েছিলাম। বিদায়ের দিন স্নেহের সাদের চোখে পানি ছাড়াও দূর্বল পর্দা ব্যবস্থার আধো আড়ালে তার মায়ের অস্ফূট কান্নার শব্দ সচেতভাবেই উপলব্ধি করেছি যা আজও আমার কানে বাজে।
খিলগাঁও, ঢাকা
২ এপ্রিল, ২০১৫
বিষয়: বিবিধ
১৫৬৫ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমি হলে আপনার মত এত লজ্জা করতাম না।
একটু একটু কম লজ্জা করতাম।
কারন খাদক মানুষের খাওয়া দাওয়া নিয়ে একটু কম লজ্জা থাকে।
নতুন পরিবেশে এমন লজ্জাকর বিড়ম্বনায় অনেকেই পড়ে!
আর একজন শিক্ষক হিসেবে 'পরিস্হিতি' টা আসলেই ভীষম লজ্জার!
নিজের জনপ্রিয়তায় শেষে কেটে গেলেও এই মজার স্মৃতি মনে পড়বেই বারেবার!
চমৎকার সাবলীল নান্দনিকতায় মুগ্ধ হলাম হে শ্রদ্ধেয়!
অনেক শুভ কামনা ও জাযাকাল্লাহ জানাচ্ছি!!
মন্তব্য করতে লগইন করুন