মা : আমার অনুপম অস্তিত্ব
লিখেছেন লিখেছেন ডক্টর সালেহ মতীন ০৫ মার্চ, ২০১৩, ১২:৫৩:২৮ দুপুর
নাড়ীর বন্ধনে যার সাথে আমার অস্তিত্ব একাকার হয়ে আছে তিনি আমার মা। আমার এ শরীরের রক্ত প্রবাহে যার নির্ঘাত সঞ্চালনা বিদ্যমান তিনি আমার মা। মাকে নিয়ে লেখার কি শেষ নামানো সম্ভব ? মা প্রত্যেকের কাছে দুনিয়ার সবকিছুর চাইতে প্রিয়। মা প্রত্যেকের কাছে পৃথিবীর অবধারিত অস্তিত্ব। কিন্তু কষ্ট পাই এই মাকে যখন বৃদ্ধাশ্রমে দেখতে যাওয়ার খবর শুনি অথচ মাকে নিজের সাথে রাখার অর্থনৈতিক সামর্থ্য সন্তানদের রয়েছে। এটা মায়ের অতুলনীয় ভালোবাসার সাথে নির্মম বিশ্বাসঘাতকতা। এটা নিজের অস্তিত্বের সাথে চরম দুঃখজনক ও আত্মঘাতী আচরণ। পৃথিবীর সব ভালোবাসা, সব স্নেহ-মমতা জড়ো করে কোটি কোটি গুণ বৃদ্ধি করলেও মায়ের সিন্ধুসম ভালোবাসার এক ফোঁটা পানির সমান হওয়া অসম্ভব। সেই মা যখন সন্তান কর্তৃক নিগৃহীত, বঞ্চিত ও অত্যাচারিত হয় তখন সৃষ্টিকর্তার আরশ সঙ্গত কারণেই প্রকম্পিত হয়ে উঠে।
প্রত্যেক মা তার সন্তানের কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মমতাময়ীদের অন্যতম। দুনিয়ার সবকিছু ভেজালে ছেয়ে গেলেও মায়ের ভালোবাসায় কোন রকম মেকি কিংবা ভেজালের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের পক্ষ থেকেই মাতৃত্বের মহান সত্ত্বাকে এভাবেই সৃষ্টি করা হয়েছে। এজন্য মাকে পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ স্বর্গীয় উপহার হিসেবে গণ্য করা হয়। মায়ের সান্নিধ্য দুনিয়ার তাবৎ অশান্তি ও অনিরাপত্তার আবহ দূর করে জান্নাতী প্রশান্তি এনে দেয়। মায়ের স্নেহ পার্থিব সব অমঙ্গল থেকে সন্তানকে আগলে রাখে। সন্তানের জন্য ত্যাগ স্বীকারের ক্ষেত্রে মায়ের যে অবিসম্বাদিত ভূমিকা তা কোন পাল্লায় ওজন করা যায় না। এমন ঘটনাও আছে যে, মায়ের এক চক্ষু কানা থাকার কারণে বাহ্যত তাকে অসুন্দর দেখা যাওয়ায় কোন কোন সন্তান হীনমন্যতায় ভোগেন কিংবা কোন কোন পরিবেশে মায়ের পরিচয় দিতে ইতস্তত বোধ করেন। অথচ শৈশবের বেপরোয়া দুষ্টুমিতে চোখ হারানো ঐ সন্তান মায়ের দেয়া চোখ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমেই বিশ্ব দেখছেন। মায়ের এ আত্মত্যাগের ঋণ কিছুতেই পরিশোধ হবার নয়। তদুপরি মাকে এ ব্যাপারে অমর্যাদার চোখে দেখা, কষ্ট দেয়া কিংবা তাঁকে উপযুক্ত অধিকার বঞ্চিত করা অক্ষমার্হ অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
মায়ের ঋণ কি কখনই পরিশোধ করা সম্ভব ? শিশু অবস্থায় কত শীতার্ত রাতে নিজের অজান্তে মায়ের কাপড় ভিজিয়ে দিয়েছি অথচ মা মোটেও রাগ করেননি বরং ঘুমের ঘোরে যদি আমার বিছানা বদলাতে দেরি হয়েছে, তাহলে মা চোখের পানি ফেলেছেন এই ভেবে যে, না জানি তার কলিজার টুকরা কখন থেকে প্রস্রবের ভেজা কাপড়ে শুয়ে আছে, না জানি ঠাণ্ডা লেগে যায়। দুর্গন্ধময় ঘৃণ্য বস্তু মায়ের পরিচ্ছন্ন শুভ্র কাপড়ে মাখিয়ে দিয়েছি হয়ত কোন অনুষ্ঠানে, অনেকের সম্মুখে অথচ মা মোটেও ঘৃণা বোধ করেননি। শৈশবের বেপরোয়া দুষ্টুমিতে মাকে সীমাহীন যন্ত্রণা দিয়েছি অথচ মা যন্ত্রণা বোধ করেননি। সুলভ-দুর্লভ জিনিসের জন্য কত রকম আবদার মায়ের কাছে করেছি অথচ মা বিরক্ত বোধ করেননি। বরং সাধ্যের সর্বশেষ প্রান্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন সেই জিনিসটি আমার জন্য সংগ্রহ করতে। কত দরিদ্র মা সন্তানের মুখে এক মুঠো আহার তুলে দিতে সীমাহীন পরিশ্রম করেছেন অথচ নিজে অনাহারে থেকেছেন। এ ঋণ কি কোনদিন শোধ করা যায় ? ঐ যে বলা হয়, ‘মায়ের এক ধার দুধের দাম, কাটিয়া গায়ের চাম, পাপোশ বানালেও ঋণের শোধ হবে না’ - একদম যথার্থ অভিব্যক্তি।
যাদের মা বেঁচে আছেন তাদের কাছে মায়ের অনুভূতি যত বাস্তব ও প্রাণবন্ত, যাদের মা বেঁচে নেই তাদের কাছে তা আরো গভীর। অবশ্য এ কথা ঠিক যে, মা সমগ্র বিশ্বের মধ্যে সৌভাগ্যের প্রতীক। যিনি মাকে সঙ্গে নিয়ে বসবাস করছেন তিনি অবশ্যই পরম সৌভাগ্যবান। প্রসঙ্গত মায়ের সাথে জড়িয়ে আমার শৈশবের একটি মজার স্মৃতিময় ঘটনা পাঠকগণের সামনে তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি না। ১৯৭৭-৭৮ সালের দিককার ঘটনা। তখন আমাদের যশোরের গ্রামের বাড়িতে প্রত্যহ ৩-৪ ঠিলে শুকনো গুড় তৈরি হতো। ২/৩ দিন পর পর তা কেশবপুর বা অন্য কোন বাজারে বিক্রি করা হতো। একদিন এ রকম ৬ ঠিলে (ভাঁড়) গুড় আমাদের ঘরে বিক্রির অপেক্ষায় ছিল যার মুখের অংশে চিনি জমে গিয়েছিল। আমার বয়স তখন ছয় কি সাত। আমি একরকম গোপনেই সবগুলোর মুখের চিনি হাত দিয়ে কুরে কুরে খেয়ে নিই। দুপুরের একটু আগে ভ্যান ডেকে নিয়ে এসে আমার বাবা ঘরে গিয়ে দেখেন যে, গুড়ের মুখ শেষ করে ফেলা হয়েছে। এ দশা দেখে তিনি ভীষণ রাগন্বিত হন। কাজটি আমি করেছি তা তিনি নিশ্চিত, কেননা, বাড়ীর সবার ছোট ও অতিরিক্ত দুষ্টু হওয়ার কারণে এটা আমার দ্বারা সম্ভব। বাবা ঘর থেকে বের হয়েই আমার পিছু নিলেন, হাতে লাঠি। কিন্তু দৌঁড়ে তিনি আমার কাছে তিনি পরাজিত হলেন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, তারপর সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, আমি বাড়ি আসতে সাহস পাইনি। অবশেষে সন্ধ্যার পর পরই পাশের বড় চাচার বাসায় এসে আশ্রয় নিই। প্রথমে পিছনের বারান্দায়, পরে ভরসা না পেয়ে চাচাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ছাগলের কোঠায় গিয়ে চুপ করে বসে থাকি।
এদিকে বাড়িতে যা হবার তাই হয়েছে। সন্ধ্যার পরেই মা কাঁদছে আর বাবাকে বলছে, ‘আমি কিছুই জানিনা আমার ছেলেকে এনে দাও।’ বাবাও অনুতপ্ত হলেন, কিন্তু তাতে আমার কী ? আমি তো ঠিকই অভিমান আর ভয়ে ছাগলের সাথে সময় কাটাচ্ছি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর বাবা তার দলবল নিয়ে অবশেষে এলেন চাচাদের বাড়িতে। চাচা-চাচী দু’জনই টেনশন করছেন, ‘এই একটু আগেও এখানে ছিল, ছেলেটা গেল কোথায় ?’ ছাগলগুলো আমাকে মেনে নিতে পারছিল না। বার বার অস্বাভাবিক ডাকাডাকি করছিল যা অনুসন্ধানী দলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তদুপরি ছাগলের কোঠার দরজাটা খোলা দেখে কোন চোর টোর আবার এলো কিনা দেখতে এগিয়ে এলো। কাছে আসতেই আমি কেঁদে উঠি, আর ওরা সবাই আমাকে খুঁজে পাওয়ার আনন্দে হাসতে থাকে। আমি বাড়িতে যেতে চাচ্ছি না, ওরা জোর করে কোলে তুলে আমাকে বাড়িতে নিয়ে গেল। গিয়ে দেখি মা কাঁদছেন। আমাকে কোলে নিলেন, আদর করলেন, সমস্ত গালে মুখে বিশ্বের সেরা স্নেহমাখা চুমুগুলো এঁকে দিলেন, পা দু’টি ধুয়ে দিলেন। খাবার মুখে তুলে দিলেন, কিন্তু আমি খাবই না। অভিমান করেছি, বাবা কেন আমাকে বকা দিলেন ?
নতুন করে ডিম ভেজে খাবার মুখে তুলে দিয় মা বললেন, ‘খা বাজান, তোর জন্য আমিও দুপুর থেকে খাইনি’। আমার অভিমান ধীরে ধীরে ভাঙতে শুরু করলো। মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘মা, তুমি আমাকে অনেক ভালোবাস ?’ মা শুধু আমার দিকে ছল ছল নয়নে তাকিয়ে রইলেন। এত আহ্লাদ দেখানোর সময় এখন না। অনেক কাজ এখনো বাকী। আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে ঘরের কাজ একে একে শেষ করে তবেই তিনি ঘুমাবেন।
সেই পরম মমতাময়ী মা আজ আমার বেঁচে নেই। ১৯৯৪ সালে মাকে হারিয়েছি। বাবাকে হারিয়েছি আরো আগে ১৯৮০ সালে। আমি তৃষ্ণার্ত দাঁড় কাকের মতো এখানে ওখানে খুজে ফিরি কিন্তু মাকে পাই না। কত অভিমান করি, কিন্তু কেউ আমার অভিমান ভাঙাতে আসে না। সারাদিন পরিশ্রমের পর ধুলাবালি নিয়ে শুষ্ক মুখে ঘরে ফিরি কিন্তু কেউ আমার মাথায় ধুলি ঝেড়ে দিতে দিতে বলে না, ‘মুখখানি শুকনো দেখা যাচ্ছে দুপুরে খাসনি ? এখনো গ্রামের বাড়িতে গেলে অশ্রুসজল চোখে মাকে খুঁজি, পাই না। বাড়িটাতে মায়ের অভাব প্রতি পদে পদে অনুভব করি। বাড়ি থেকে কাঁদতে কাঁদতে ঢাকায় ফিরে আসি, এখন কেউ আমার পিছে পিছে আসে না, কেউ জিজ্ঞাসা করে না, ‘বাবা আর কবে আসবি ?’
বড় ইচ্ছে করে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে গল্প শুনি, ইচ্ছে করে মায়ের সোহাগমাখা আঁচলে মুখ ঢেকে লুকোচুরি খেলি। ইচ্ছে করে মায়ের মমতা ও স্নেহপূর্ণ সাগরে একটু অবগাহন করি। কিন্তু সে দিন আর ফিরে আসবে না। আমার মমতাময়ী মা সহ যেসব মায়েরা চলে গেছেন তাদের যেন জান্নাত নসীব হয়। আর যেসব মায়েরা বেঁচে আছেন আল্লাহ যেন তাঁদের সুস্থ ও সুন্দর রাখেন।
বিষয়: Contest_mother
৩৫০৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন