ইসলামী ব্যাংকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ (পর্ব-৮)
লিখেছেন লিখেছেন ডক্টর সালেহ মতীন ০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ১০:৪৩:১৪ সকাল
[পূর্ব প্রকাশিতের পর]
ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে সারা দুনিয়া এখন ভাবছে। এ ব্যাপারে আমার কিছু রচনা সম্মানিত ব্লগার ও পাঠক ভাই-বোনদের উদ্দেশে শেয়ার করতে চাই। প্রকাশিত বিষয়ে সমালোচনা, পরামর্শ, সংশোধন সাদরে গৃহীত হবে। বিষয়টি নিতান্তই বেরসিক বিষয়বস্তুর তালিকায় পড়ে, সুতরাং ইহা যদি কারো বিরক্তি উৎপাদন করে তবে আগে ভাগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
পর্ব-৮
উপমহাদেশে সুদনির্ভর কারবারের মন্দ প্রভাব জনগণকে ক্রমেই বিষিয়ে তুলছিল। সুদের প্রতি এ দেশের মানুষের ক্ষোভ ও ঘৃণার পরিচয় নানা পুরাণ ও উপাখ্যানে প্রকাশ পেয়েছে। এ দেশের নানা লৌকিক বিশ্বাস ও আচরণে জনগণের সুদবিরোধী মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষের মধ্যে মজবুত বিশ্বাস আছে যে, সাত কিংবা নয়জন সুদখোরের নাম লিখে গরুর গলায় ঝুলিয়ে দিলে সে গরুর শরীরে কোন ক্ষত এর পোকা ঝরে যায়। এ বিশ্বাসও আছে যে, ৭(সাত)জন সুদখোরের নাম লিখে চারা খেজুর গাছের রসের হাড়িতে বেঁধে দিলে শিয়াল সে হাড়ির রসে মুখ দিবে না কিংবা নাকের আকস্মিক রক্ত পড়া বন্ধেও কয়েকজন সুদখোরের নাম সংযুক্ত করে মন্ত্র পাঠের প্রচলন এখনো কোন কোন অঞ্চলে দেখা যায়। সন্দেহ নেই যে, সুদ সম্পর্কে জনগণের এরূপ মনোভাব তাদের লালিত বিশ্বাস, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে।
সুদের ক্ষতি থেকে আত্মরক্ষার জন্য মুসলিমগণের ইসলামী ব্যাংকিং এর দিকে ধাবিত হওয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টা। সামাজিক সুবিচার ও অর্থনৈতিক সুস্থিতি বজায় রাখার আকুল আবেদনে মানুষ ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থাকে সর্বাধিক যোগ্য ও নিরাপদ বিবেচনা করছে। এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে ইসলামী ব্যাংকিং এর দুর্দান্ত অগ্রগতি ও বিষ্ময়কর বিস্তার অব্যাহত আছে।
বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক
ব্যাংকিং হলো আধুনিক ব্যবস্থাপনা ও সভ্যতালালিত বহুবিধ উপাদানের মধ্যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ, উপকারী ও মানবজীবনের জন্য অপরিহার্য অনুষঙ্গ। কিন্তু সুদের সংস্পর্শে গোটা ব্যাংকব্যবস্থাই কলূষিত হয়েছে। মুসলিমগণ কখনই সুদভিত্তিক ব্যাংকের কাছে যেতে পারে না। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তা‘আলা সুদকে হারাম ঘোষণা করেছেন। এ পরিস্থিতিতে কোন মু’মিনের পক্ষে সুদের ধারে কাছে যাওয়ারও সুযোগ থাকে না। অথচ ব্যাংকব্যবস্থায় সম্পূর্ণ সুদনির্ভর লেনদেন নীতি মুসলিমগণের ঈমান-আক্বীদার উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে আসছে। সুদের কুফল বিষয়ে পবিত্র কুরআনে আরো অনেক কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশের মানুষ বরাবরই ধর্মপ্রাণ। ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন এ দেশের মানুষের স্বাভাবিক সভ্যতার অংশ। আলিম সমাজের বহুমুখী প্রচেষ্টায় এবং বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের সভা-সেমিনার থেকে এ দেশের মানুষ সুদের ক্ষতি ও গুণাহ্ সম্পর্কে অবহিত হয়ে সুদ বর্জন করতে বদ্ধপরিকর। সুদনির্ভর প্রচলিত ব্যাংকব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের নেতিবাচক ধারণা বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে বিষোদগারে রূপ নেয় এবং ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থার জন্য সুপ্ত আকাক্সক্ষা তাদের মধ্যে ক্রমেই জাগ্রত হতে থাকে। মসজিদের ইমামগণের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে অনস্বীকার্য। ফলে সুদকে সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে ঘৃণা করতে শিখেছে।
ইসলামী শারী‘আহ্ মোতাবেক মসজিদ মাদ্রাসা চলতে পারে, মিলাদ মাহফিল চলতে পারে, কিন্তু অর্থব্যবস্থা তথা ব্যাংকব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে- এ ধারণাকে অনেকেই অবিশ্বাস করেছিল। ইসলামী অর্থনীতি বিষয়ে তাদের বক্তব্য বরাবরই নেতিবাচক, তাচ্ছিল্যপূর্ণ ও উপহাসমূলক। ইসলামী ব্যাংকের সূচনালগ্নে তারা এর অস্তিত্বের প্রশ্নে সন্দেহ পোষণ করেছিল। তাদের সংশয় ছিল, আধুনিক কালের বিচারে নতুন ধরনের এ ব্যাংক টিকে থাকতে পারবে কিনা! তারা সুদনির্ভর ব্যাংকব্যবস্থা থেকে গৃহীত প্রচ্ছন্ন স্বার্থ খর্ব হতে দিতে চায়নি। ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থার ভারসাম্যপূর্ণ কল্যাণমুখিতা তাদের পছন্দ নয়। ফলে তাদের উপহাসমূলক মন্তব্যাদি ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার গতিপথ বিঘ্নিত করছিল। যদিও সে সব উপযুক্ত অপচেষ্টা ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠাকে রুখতে পারেনি।
এদিকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই উপনিবেশ শাসনমুক্ত মুসলিম বিশ্বের ঐক্য, সংহতি ও স্বার্থ সংরক্ষণ বিশ্ব মুসলিম নেতৃবৃন্দ বিশেষভাবে চিন্তা করতে থাকেন। প্রেক্ষিতে তৎকালীন সৌদি শাসক বাদশাহ্ ফয়সলসহ মুসলিম বিশ্বের কল্যাণকামী রাষ্ট্রনায়ক ও চিন্তাবিদগণের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘Organization of Islamic Conference’(OIC) বা ইসলামী সম্মেলন সংস্থা। মুসলিম বিশ্বের সুদৃঢ় ঐক্যের পাশাপাশি অর্থনীতিসহ সার্বিক কল্যাণ কিভাবে সাধন করা যায় এ নিয়ে নবগঠিত সংস্থা বিশেষভাবে চিন্তা করতে থাকে। ১৯৭৫ সালের ২০ অক্টোবর জেদ্দায় আইডিবি প্রতিষ্ঠিত হয়। এ প্রেক্ষাপটে মুসলিম বিশ্বের নেতৃবৃন্দ ও জনগণ উপলব্ধি করেন যে, সুদের ক্ষতি থেকে অর্থনীতিকে বাঁচাতে ইসলামী ব্যাংক জরুরি। এ সময় সৌদি আরব, কুয়েত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্কসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়ে।
বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হবে এ সংবাদে দেশের ধর্মপ্রাণ সহজ-সরল জনগণের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। সুদের চাপে দিশেহারা মানুষ সুপথ পাওয়ার আশাবাদী প্রেক্ষাপটে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মহৎ প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানায় ফলে ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সুবর্ণ প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের তৎকালীন সরকার প্রধান এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৮ সালের এপ্রিল মাসে সেনেগালের রাজধানী ডাকারে অনুষ্ঠিত মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ব্যাংকব্যবস্থাকে সুদের কবল থেকে রক্ষা করতে পর্যায়ক্রমে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ সিদ্ধান্তের আলোকে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের অঙ্গীকার নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীগণ দেশে ফিরেন।
এদিকে বেশ কিছু ইসলাম দরদী সাহসী সৈনিক এবং কোটি কোটি সাধারণ মানুষ এ দেশে ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন। তারা অনুধাবন করেছিলেন যে, আর্থ-সামাজিক সুবিচার এবং সম্পদের সুষম বণ্টনের লক্ষ্যে একটি প্রগতিশীল অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা জরুরি। আশির দশকে সুদনির্ভর প্রচলিত ব্যাংকব্যবস্থার অসমতল পরিবেশে ইসলামী ব্যাংকিং এর চিন্তা-ধারা নিতান্তই বেমানান মনে হতো। তবু উদ্যোক্তারা হাল ছাড়েননি। তাঁরা অনুধাবন করেছিলেন যে, এ দেশে তো ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবেই, তদুপরি এর সাফল্য ও অগ্রগতির সুসংবাদ দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পৌঁছাবে। এমন এক প্রেক্ষাপটে ১৯৭৭ সালে ‘ইসলামিক ইকোনমিক রিসার্চ ব্যুরো’ নামে ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা সংস্থা গঠিত হয়। এ সংস্থার লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভাগ্যবঞ্চিত ও বিড়ম্বিত জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর কল্যাণ সাধন করা। ইসলামে যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও কল্যাণমুখী অর্থব্যবস্থা বিদ্যমান তা যথাযথ প্রমাণে ‘ইসলামিক ইকোনমিক রিসার্চ ব্যুরো’ জন্মলগ্ন থেকেই কাজ করতে শুরু করে। আজ বাংলাদেশের মানুষ ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার যে সুফল ভোগ করছে তার মূলে কৃতিত্বের দাবিদার এই গবেষণা সংস্থাটি। এ জন্য ‘ইসলামিক ইকোনমিক রিসার্চ ব্যুরো'’ কে ইসলামী ব্যাংকিং আন্দোলনের মাদার অরগানাইজেশন বলা হয়। ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে সংস্থাটি বিভিন্ন সভা, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম এবং বিভিন্ন কর্মশালার মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিং এর জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে জনশক্তি তৈরির কাজও শুরু করে।
[চলবে ............]
বিষয়: বিবিধ
১৭৫৬ বার পঠিত, ৩৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আল্লাহ আপনার কলমের জোর বাড়িয়ে দিন, আমীন।যাজ্জাকাল্লাহ খায়ের
সঙ্গত কারনেই ভোগ বিলাসপ্রিয়, অপচয়কারী মধ্যপ্রাচ্যের মুমিন মুসলিমের আরব দেশ এবং বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মত চরম দুর্নীতবাজ-অসত মানুষের দেশে ইসলামি ব্যাংক জেকে বসেছে।
ব্লগের সুধি মহলে বিষয়টি জানান দেয়ার জন্য বরাবরের মত মতীন ভাই কে ধন্যবাদ।
আর দুর্নীতিবাজ? – সে নিয়ে তো ১৬/১৭ শতকে বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেছে যে – আমাদের মহৎ, জিডিপিতে বিশাল অবদানের অধিকারী, বিশাল কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী, মানুষের দু’মুঠো ভাতের দামে ১০ মুঠোর পরিশ্রম নেয়া, সততায় অন্যন্য, অত্যাধিক মুনাফাখোর (মূলত এরাই সুদখোর) ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম সমস্ত দুর্নীতির জন্ম দিয়েছে।
আমরা দুর্নীতিবাজ না তারা সে ১৬/১৭ শতক থেকেই প্রমাণিতভাবে সুধীমহল জেনে এসেছে।
এগুলো গিয়ে শাহবাগের কুকুর-বিড়ালদের বয়ান করো, চেটে-পুটে-গিলে খাবে!
ডুবুরীদের কাছে কেন এসেছো? ডুব দেয়ার জ্ঞানধারী ভাব ধরে?
তোমার কি লজ্জা বলে কিছু নেই?
আল্লাহ আপনার কলমের জোর বাড়িয়ে দিন, আমীন।যাজ্জাকাল্লাহ খায়ের
এটা নিয়ে দীর্ঘ ৪ বছর লিখা পরা করেছি। একটা সময় ভাবতাম, ইসলামিক ফাইনান্স এর উপর একটা গবেষণা মুলক ক্লাব করব।
এখন, আর ভাবি না। সামগ্রিক দিক থেকে... দেশটা অনেক অস্থির...সৃজন শীল দের নিরাপত্তা নাই।
মন্তব্য করতে লগইন করুন