ইসলামী ব্যাংকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ (পর্ব-৭)
লিখেছেন লিখেছেন ডক্টর সালেহ মতীন ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ১১:১৯:৫১ সকাল
[পূর্ব প্রকাশিতের পর]
ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে সারা দুনিয়া এখন ভাবছে। এ ব্যাপারে আমার কিছু রচনা সম্মানিত ব্লগার ও পাঠক ভাই-বোনদের উদ্দেশে শেয়ার করতে চাই। প্রকাশিত বিষয়ে সমালোচনা, পরামর্শ, সংশোধন সাদরে গৃহীত হবে। বিষয়টি নিতান্তই বেরসিক বিষয়বস্তুর তালিকায় পড়ে, সুতরাং ইহা যদি কারো বিরক্তি উৎপাদন করে তবে আগে ভাগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
পর্ব-৭
এ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আরো যেসব ইসলামী ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠান আত্মপ্রকাশ করে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো :
ভারতের বাঙ্গালোরে ‘আমানাহ্ ব্যাংক’, ‘ইত্তেফাক ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড মুম্বাই’ ও ‘ফালাহ ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড’, যুক্তরাষ্ট্রে ‘আল বারাকা ব্যাংকোরপ, টেক্সাস’ ও ‘আল বারাকা ব্যাংকোরপ, ক্যালিফোর্নিয়া’, যুক্তরাজ্যে ‘ইউনাইটেড ব্যাংক অব কুয়েত পিএলসি, লন্ডন’, উম্মাহ্্ ফাইন্যান্স হাউজ’, ‘আরব ব্যাংক লিমিটেড’, ‘আল বারাকা ইনভেস্টমেন্ট কোং’, ও ‘মাসরেফ ফয়সল ইসলামিক ব্যাংক’, থাইল্যান্ডে ‘এরাবিয়ান থাই ইন্টারন্যাশনাল কোং’ ও ‘এরাবিয়ান থাই ইনভেন্টমেন্ট কোম্পানি, ব্যাংকক’, সুইজারল্যান্ডে ‘তাকওয়া ব্যাংক’ ও ইসলামিক ইনভেস্টমেন্ট পুল(ইউনিয়ন ব্যাংক অব সুইজারল্যান্ড)’। আরো প্রতিষ্ঠিত হয়, মরক্কোয় ‘ব্যাংক আল আজিদাহ’, সাইপ্রাসে ‘ফয়সল ইসলামিক ব্যাংক অব সাইপ্রাস’, আর্জেন্টিনায় ‘ইসলামিক প্যান আমেরিকান ব্যাংক’, আলজেরিয়ায় ‘ব্যাংক আল বারাকা ডি আলজেরিয়া’, আলবেনিয়ায় ‘আরব আলবেনিয়ান ইসলামিক ব্যাংক’, মালয়েশিয়ায় ‘মাল্টি পারপোজ ব্যাংক বারহাদ’, ‘ব্যাংক নিগারা’, ‘আরব মালয়েশিয়া মার্চেন্ট ব্যাংক বারহাদ’, ও ‘ব্যাংক ইসলাম মালয়েশিয়া বারহাদ’, ফিলিস্তিনে ‘আরব ইসলামিক ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক’।
সিঙ্গাপুরে ‘আরব ব্যাংকিং কর্পোরেশন’, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ‘দুবাই ইসলামী ব্যংক’, ‘আবুধাবী ইসলামিক ব্যাংক’, ‘ন্যাশনাল ব্যাংক অব সারজাহ্’, ‘নূর ইসলামিক ব্যাংক দুবাই’, ইয়েমেনে ‘সাবা ইসলামিক ব্যাংক’, ও ‘ইসলামিক ব্যাংক অব ইয়েমেন ফর ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টনন্ট’। জাম্বিয়ায় ‘আরব জাম্বিয়ান ইসলামিক ব্যাংক’, সৌদি আরবে ‘ব্যাংক আল জাজিরা’, ‘রিয়াদ ব্যাংক’, ‘ফয়সল ইসলামিক ব্যাংক অব বাহরাইন ইসি’ এবং শ্রীলঙ্কায় ‘আমানা ইসলামিক ব্যাংক লিমিটেড’।
বিশ্বব্যাপী ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটে কিছু আন্তর্জাতিক সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে যা ইসলামী ব্যাংকসমূহকে দিকনির্দেশনা ও এর আন্তর্জাতিক মানদ- নিরূপণে সহায়তা করে থাকে। এদের একটি হলো The Accounting and Auditing Organisation for Islamic Bank and Finacial Institution’, AAOIFI হলো এর সংক্ষিপ্ত রূপ। আলজিয়ার্সে স্বাক্ষরিত চুক্তি মোতাবেক ইসলামী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৯৯১ সালে বাহরাইনে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
এ ধরনের আরেকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হলো International Association of Islamic Banks(IAIB)। এটি বিশ্বের ইসলামী ব্যাংকসমূহের একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন। ইসলামী ব্যাংকসমূহের চলমান স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যা, ইত্যাদি বিষয়ে একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করার জন্য এ সংগঠনটির জন্ম হয়। এ ছাড়াও Council for Islamic Banks and Financial Institution(CIBAFI), মানামা, বাহরাইন, ‘Islamic Financial Services Board(IFSB)’ কুয়ালালামপুর, `International Islamic Financial Market(IIFM)’ মানামা, বাহরাইন এবং `International Islamic Center for Reconciliation and Arbitration(IICRA)’ দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত নামের আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
বিশ্বের প্রায় ৬০টিরও বেশি দেশে বর্তমানে ৩০০ এরও বেশি ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেসব দেশে এ পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো : মিশর, সৌদি আরব, সুদান, জর্দান, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ, ইরান, ইরাক, বাহরাইন, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইয়েমেন, ব্রুনাই, আলজেরিয়া, উগান্ডা, সেনেগাল, মরক্কো, জার্মানি, আর্জেন্টিনা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, বাহামা, রাশিয়া, জিবুতি, সাইপ্রাস, ডেনমার্ক, লুক্সেমবার্গ, ভারত, কাজাকিস্তান, মৌরিতানিয়া, কুয়েত, দক্ষিণ আফ্রিকা, নাইজেরিয়া, থাইল্যান্ড, তিউনিশিয়া, আলবেনিয়া প্রভৃতি। মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক ইসলামী ব্যাংক রয়েছে পাকিস্তানে ৫৮টি। তারপরেই রয়েছে সুদান ৩৭টি ও ইন্দোনেশিয়া ২২টি। অমুসলিম দেশসমূহের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাজ্য। সেখানে ১০টি ইসলামী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকিং আর্থিক সেবা শিল্পে প্রায় ১০০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ওপর সম্পত্তি রয়েছে।
প্রচলিত ব্যাংকসমূহের চটকদারি বিজ্ঞাপন সত্ত্বেও দেখা যায় যে, সাধারণ মানুষ ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার দিকে অতি উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে আসছে। এমনকি মুনাফা বিচারে কোন কোন ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকের চাইতে সুদভিত্তিক ব্যাংকসমূহ বেশি দিচ্ছে তবু তারা ইসলামী ব্যাংকসমূহকে ব্যাংকিং লেনদেনের জন্য পছন্দ করছে। অধিকাংশ ইসলামী ব্যাংক জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করছে। শুধু ক্রমবিকাশের স্বাভাবিক ধারাবাহিকতা রক্ষা এখানে মূল কারণ কিনা বিষয়টি পর্যালোচনার দাবি রাখে।
মধ্যযুগের পুরোটা সময় জুড়ে মুসলিম বিশ্বে ঋণব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে ব্যবসা বাণিজ্যের বিস্তারে ইসলামী অর্থব্যবস্থা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। স্পেনে মুসলিম সভ্যতা বিষয়ে ইতিহাস সোনালী সাক্ষী হয়ে আছে। সেখানে অর্থব্যবস্থা ইসলামীকরণের কল্যাণ সকলেই ভোগ করেছে। স্পেন ছাড়াও তৎকালীন ভূ-মধ্যসাগরীয় ও বাল্টিক অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পাদনে মাধ্যম হিসেবে মুসলিম ব্যবসায়ীগণ ছিলেন অপরিহার্য। পরবর্তীকালে ইউরোপীয় বিনিয়োগকারি ও ব্যবসায়ীগণ নির্বিশেষে ইসলামী আর্থিক ব্যবস্থার বহুবিধ ধারণা, কৌশল ও ইনস্ট্রুমেন্ট ব্যবহার শুরু করে। ইসলামী অর্থনীতির পথ বেয়ে ইসলামী ব্যাংকিং মধ্যযুগে বিশ্বময় কিছুটা নিষ্প্রাণ থাকলেও বিংশ শতাব্দীতে তা পূর্ণমাত্রায় উজ্জ্বীবিত হয়ে উঠে। এর কারণটা কৌশলগতভাবে বহুবিধ।
দ্রুত বিকাশমান ব্যাংকিং ব্যবস্থার তালিকায় ইসলামী ব্যাংকিং এর অন্তর্ভূক্তি ইসলামী শারী‘আহর সর্বজনীন, কল্যাণমুখী, ভারসাম্যপূর্ণ ও সামগ্রিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার দৃঢ়তার ফসল। বিনিয়োগ কার্যক্রমে মহাজনী প্রথা নয় বরং অংশীদারিত্বের প্রথা উদ্যোক্তাগণকে অতি মাত্রায় আশান্বিত করে, একই সাথে তাদের উদ্বেগ দুরীভূত করে। সুদের বিকল্প ব্যবস্থা প্রবর্তনও এর একটা ইতিবাচক দিক। কেননা, বিশ্বের মুসলিমগণ নৈতিক কারণে সুদের বিরোধী। ঈমানি চেতনা বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত কোন মুসলিম সুদের নিকটবর্তীও হতে পারে না। আর বাংলাদেশের মানুষ তো ঐতিহ্যগতভাবেই সুদের ঘোর বিরোধী। সুদ ও শোষণের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ যুগ যুগ ধরে সংগ্রাম করে আসছে। প্রেক্ষিতে সুদনির্ভর কারবারের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের প্রতি সাধারণ মানুষের ঘৃণা প্রবল পর্যায়ে রয়েছে। এমনও আছে যে, দীন সম্পর্কে পরিষ্কার জ্ঞান রাখে না কিন্তু সুদকে অত্যন্ত খারাপ জানে, যারা সুদের সাথে জড়িত তাদিগকে মনে প্রাণে ঘৃণা করে। এমনকি এরা সামাজিক লেনদেনের ক্ষেত্রে তাদেরকে এড়িয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করে।
[চলবে ...........]
বিষয়: বিবিধ
২০১০ বার পঠিত, ২২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
বাংলদেশের মানুষের অন্ততঃ একটি ভাল গুন জানান দিলেন, ধন্যবাদ মতীন ভাই। নিদেন পক্ষে- ঘুষ, দু্র্নীতি, ধাপ্পাবাজি, প্রতারনার দানমারা টাকাটা সুদী ব্যাংকে রাখতে নারাজ। বিষয়টি ইসলামী ব্যাংকের জন্য ইতিবাচক বটেই!!
অনেক কিছু জানলাম।
সাধারনতঃ খাবার টেবিলে কিংবা গল্পে - সাধারন মানুষরা সবসময়ই এ জাতীয় কয়েকটা কথা বলে - যার এ্যাবসুলুট উত্তর সাধারন মানুষ কনভিন্সলী দিতে পারেন না।
ব্যবসায় বিনিয়োগ করলে যেমন লাভ/লোকসান করা যায়, কোন আইটেম কিনে বিক্রি করলে যেমন লাভ/লোকসান করা যায়, টাকা খাটালেও ঠিক তেমনি লাভ/লোকসান করা যায়। তাহলে সুদ কেন হারাম আর ব্যবসা কেন হালাল?
এর উত্তরে আমরা টিপ্যিক্যালী বলে থাকি সুদ নির্দিষ্ট করে দেয়, সুদ আনুষাংগিক বিষয়াদি বিবেচনায় নেয়না, সুদ শোষন করে, সুদ একমুখী, সুদ টাকা পয়সাকে এক জায়গায় মানে ধনীদের কাছে কেন্দ্রীভূত করে ইত্যাদি।
কিন্তু কাউন্টার যুক্তি আসলে - সাধারন মানুষকে কনভিন্সলী উত্তর দেওয়া কঠিন হয়?
আর কনভিন্সিং উত্তর দিতে পুরোপুরি ব্লান্ট হতে পারলে যে রেজাল্ট আসে - তা আমার কাছে মনে হয় মানব সভ্যতা, আন্তর্জাতীক ব্যবসা বানিজ্য ও ইকোনোমিক একটিভিটতে বেশ বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
এনিওয়ে আপনার এ লিখা কনটিনিউ হোক - রাজনীতি সমাজনীতির বাহিরে এ এক অতি প্রয়োজনীয় বিষয় - যেখানে আমরা জানি - শেষ জামানায় টাকা পয়সা তথা সম্পদ সব কেন্দ্রীভূত হবে দজ্জাল এর হাতে - এবং সে এই সম্পদ ও ব্যবহার করে মানুষের ঈমানকে ব্ল্যাকমেইল করবে। ধন্যবাদ।
সালেহ মতীন ভাই, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ‘দুবাই ইসলামী ব্যংক’ বাদ গেছে। এটি সম্ভবতঃ এদেশের প্রথম ইসলামী ব্যংক।
মন্তব্য করতে লগইন করুন