হাসি-কান্নার ফুলের মালায় ফেরদৌসীর বিয়ে
লিখেছেন লিখেছেন ডক্টর সালেহ মতীন ০২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ০৪:০১:২৫ বিকাল
গত ৩০ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার দিকে বাসা থেকে ফোন করে জানানো হলো যে, হঠাৎ করেই ঠিকঠাক হয়েছে আগামীকাল শুক্রবার ফেরদৌসীর বিয়ে, সবাইকে যেতে হবে শনিবার ছুটি নেয়ার ব্যবস্থা করো। সংবাদ শুনে আমি বেশ খুশিই হয়েছি। কারণ, গ্রামের যে কোন অনুষ্ঠানের প্রতি আমার সহজাত আকর্ষণ তো আছেই, তাছাড়া অনেক দিন ঢাকার বাইরে যাওয়া হয়না, একটু বের হওয়ার জন্য মনটা আনচান করছিল। বিয়ের অনুষ্ঠঅনে যোগ দিতে পারিবারিকভাবেও কোনরূপ দ্বিধা না থাকার কারণ হলো ফেরদৌসির বাবা কয়েকমাস আগে দুরারোগ্য অসুখে মারা গেছে। অসহায়ত্ব ছাড়াও দারিদ্যের কষাঘাতে ওদের সংসার চলছে। সুতরাং এই দুঃসময়ে ওদের পাশে আমাদের দাঁড়ানো উচিত। মা, ফেরদৌসী ও ক্লাস নাইন পড়ৃয়া ছোট বোন ইতিকে নিয়ে ওদের সংসার। ফেরদৌসীর মা আমার স্ত্রীর চাচাত বোন। ওদের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার সোনাকান্দি গ্রামে।
৩১ জানুয়ারি শুক্রবার সকাল ৯টায় শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, ভায়রা ও তার দুই ছেলে-মেয়ে সামিন ও সারা, রাতিবের একমাত্র মামাত বোন তিন বছরের শিশুকন্যা রাইসাসহ একুনে আমরা ১১জন গুলিস্তান থেকে রওনা হই। নবনির্মিত গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ি ফ্লাই ওভারের উপর দিয়ে চলার পথে বিআরটিসির দোতলা বাসের ছাদে ছেলে-মেয়েরা বেশ উপভোগ করতে থাকল অনেকটা যেন পর্যটন বাসের উম্মুক্ত ছাদের মতো। বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছি অতএব সবার মধ্যে আনন্দবোধ একটু বেশিই সক্রিয় ছিল। পথের যানজট ও অন্যান্য সমস্যা পা করে আমরা সোনাকান্দি পৌঁছি ২টার দিকে। বর তখনো আসেনি। বরের বাড়ি একই থানার চরসুবুদ্ধি বাজার থেকে একটু দূরে শাহাপুর গ্রামে। খবর নিয়ে জানলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা রওনা দিবেন। ঘনবসতি এলাকা, তাই বিয়ের আনন্দ একটু বেশিই মূল্য পাচ্ছে। কনে ছাড়াও আরো অনেকের হাত মেহেদীর রঙে রঙীন হয়েছে। সবাই সেজেছে সাধ্য মতো। গোটা পাড়াময় বিয়ের আমেজ বিরাজ করছে। উঠানে ছোট্ট করে সামিয়ানা টানানো হয়েছে, ছোট ও হঠাৎ আয়োজন তাই স্বল্প পরিসরে মেহমানরা এসেছে। রান্নার ঘ্রাণ, ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের ছুটাছুটি আর আমার ছেলে রাতিবের বর দেখার আগ্রহ আমাকেও বেশ উচ্ছ্বসিত করে রাখছিল। ওর ধারণা যে, বর মানে ভিন গ্রহ থেকে আসা অদ্ভুত রূপের কোন রোবট কিংবা ডরিমনের মতো যাদুকরী গুণ বিশিষ্ট কোন কার্টুন হয়ত হবে।
সবাই বরের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। এদিক ওদিকে থেকে বিয়ে বাড়িতে যেই আসছে সবারই জিজ্ঞাসা ‘বর এসেছে ?’ অবশেষে বর আসতে আসতে আসরের আযান হলো। দেরি হয়ে গেছে তবু গেটে দখলদারিত্ব টিকিয়ে রাখাতে কন্যার বান্ধবীদের কোন আলস্য নেই। চার গ্লাস শরবত, কিছু মিষ্টি ও ফিতা কাঁচি নিয়ে তারা অপেক্ষা করছিল। যথারীতি গেট চার্জ দাবী, না হলে তারা গেট অতিক্রম করতে দিবে না। বরপক্ষও কম গেল না। গেট চার্জ চাওয়া মাত্রই বরের এক বন্ধু মুখোমুখি অবস্থান করা গেটের মালিক মেয়েগুলির মাথার উপরে স্নো ফল স্প্রে করে দিল। সাথে সাথে দাবী করল যে, মিষ্টি, শরবৎ এগুলো তো নষ্ট হয়ে গেছে, এগুলো খাওয়া যাবে না। ফ্রেশ নিয়ে আসুন। মেয়েদের একটা ভুলও হয়েছিল, তারা শরবৎ, মিষ্টি এগুলো ঢেকে রাখেনি। যাই হোক বেশ ভালোই জমে উঠেছিল। বার বার মনে হচ্ছিল বর অথবা কনে যে কোন এক পক্ষের হয়ে গেটের মজাদার দর কষাকষিতে অংশ নিই। কিন্তু ঢাকা থেকে গেছি তাছাড়া মূল কার্যক্রমে আরো বিলম্ব হয়ে যাবে ভেবে সে ইচ্ছাকে নির্বাসনে পাঠাতে মনস্থ করি। যাই হোক, গেটের আশ-পাশ থেকে ভেসে আসা গেটের মেয়েদের প্রতি উপর্যূপুরি অনুরোধ ও মুরুব্বীদের হুমকি-ধামকিতে এক সময় মীমাংসা হলো। বরযাত্রীদের মাথার উপরে ফুলের পাঁপড়ি ছড়িয়ে ইতির নেতৃত্বে যথাসম্মানে তাদের বরণ করে নির্ধারিত স্থানে নিয়ে অাসা হলো এবং আপ্যায়ন করা হলো। এরই মধ্যে কাজী সাহেব উপস্থিত হয়েছেন, বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা ও দোয়া শেষ হতে হতে মাগরিবের আযান হয়ে গেল। মুরুব্বীজনদের তাগিদে আর দেরি করা যাচ্ছে না, এক্ষুনি কনেকে বিদায় করা হবে। শুরু হলো ফেরদৌসীর কান্না। ছোট বোনটিকে সে আদর-যত্ন করে আগলে রেখেছিল, আজ তাকে ছেড়ে যেতে হবে।
চরম দারিদ্র্যের মধ্যেও ফেরদৌসী তার ছোট্ট ঘরটির এক কোণায় একটি নক্সা করা আয়না, একটি মেক-আপ বক্স এবং আরো কিছু প্রসাধন সামগ্রীর সমন্বয়ে গড়ে তুলেছিল বিউটী পার্লার। সে নিজেই এর পরিচালক (দক্ষ বিউটিশিয়ান) এবং একমাত্র কাস্টমার হলো তার ছোট বোন ইতি। ইতিকে সে অগাধ ভালোবাসে। দুজন একসাথে গলাগলি করে গল্প করতে করতে এক খাটে রাতে ঘুমায়। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার আগে আদর করে সেই-ই ছোট বোনকে রেডি করে দিত। চুল আচড়িয়ে বেণী করে ছোট বোনের কপালে একটা টিপও দিয়ে দিত সে। আজ তাকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে। বুকটা তার ভেঙ্গে যাচ্ছে আপনজন থেকে বিচ্ছেদের বেদনায়। সদ্য বিধবা হওয়া আদরিণী মাকে জড়িয়ে ধরে তার কান্না অন্য এক ক্রন্দসী ভাষা ছড়িয়ে দেয়। শীতার্ত সন্ধ্যার কূয়াশা ভেদ করে সে কান্না যেন সমস্ত গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। বাবা যদি আজ বেঁচে থাকতেন তাহলে তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করতেন। বাবাকে হারানোর পর দুঃখ-সুখের দোলায় সোহাগিনী মা আর স্নেহের বোনকে নিয়ে তাদের যে সংসার সেটা থেকে আজ সে স্থায়ীভাবে বিদায় নিচ্ছে। এ সংসারের সদস্য তালিকা থেকে ক’দিন আগে বাবার নাম কাটা গেছে। আজ কাটা গেল ফেরদৌসীর নাম।
মা ও বোনকে জড়িয়ে ধরে ফেরদৌসীর কান্নার প্রকৃতি আমি একেবারে ভিতর থেকে অনুধাবন করতে পারছিলাম। সবচেয়ে আপনজনদের ছেড়ে নতুন এক মানুষের হাত ধরার রোমান্টিকতার পাশাপাশি নতুন সংসারে নিজকে প্রতিষ্ঠিত করার চ্যালেঞ্জও কম নয়। সারাদিন সবাইকে হাসতে দেখেছিলাম, এখন সবার চোখে কান্না। ফেরদৌসী এমনভাবে বোনকে জড়িয়ে ধরেছে যে, সে তাকে ছাড়তে চায়না। কিন্তু ছেড়ে তাকে দিতেই হবে। এটাই নিয়ম, এটাই আমাদের সামাজিক লোকাচার, এটাই বাস্তবতা। এক সময় তাকে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে নিজের ঘর ছাড়তে হলো। তবে ফেরদৌসীর এ কান্নার মধ্যে আরেকটি বেদনার্ত আবেগ হলো, সে যে পথ ধরে শ্বশুর বাড়িতে পাড়ি জমাচ্ছে সেই পথের অদূরেই তার বাবা চিরনিদ্রায় শায়িত আছে। বাবার কবরের দিকে সে চেয়ে থাকে। ঘোমটার আড়ালে তার চোখের পানি দেখা না গেলেও তার কষ্টের মাত্রা অনুমান করতে কারো কষ্ট হবার কথা নয়। আমিও কান্না থামাতে পারিনি। তবে আগত লোকের ভিড়ে এবং আলো-ছায়ার আড়ালে সে কান্না কেউ দেখেনি।
এটাই বোধ হয় বিবাহ। সারাদিন হাসি, ছেড়ে যাবার সময় কান্না। শুধু তাই নয়, পরবর্তী জীবনেও বুঝি স্থায়ীভাবে হাসি-কান্নার একটা ব্যবস্থা হয়ে যায়। এমন হাজারো দুখী ফেরদৌসীর জন্য দোয়া রইল।
বিষয়: বিয়ের গল্প
২৮৫৬ বার পঠিত, ৩৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এ ধরনের মেয়ে এবং মেয়ের অভিভাবকদের এভাবে বিশৃংখলা সৃষ্টি না করে, শুরুতেই ঘরজামাই হতে আগ্রহী এমন পাত্র অন্বেষনে মনোযোগী হওয়া উচিৎ, এবং ছেলেদেরও বিয়ের আগেই জিজ্ঞাসাবাদ করে নেয়া উচিৎ।
তবে ভাইয়া কিছু মনে করবেন না, আপুটির ছবিটা এভাবে দেয়া ইসলাম সম্মত নয়! এভাবে উন্মুক্ত ছবি আপুটির যেমন গুনাহ হচ্ছে, তেমনি ব্লগের পুরুষরাও সবাই দেখছেন এতেও গুনাহ হচ্ছে!
আশাকরি আপনি ভুল বুঝবেন না! শুভকামনা রইলো!
গল্পে যে এলাকার কথা আমি লিখেছি সে এলাকায় কি আপনার আসা-যাওয়া আছে ?
আপনার সুন্দর দৃষ্টিভংগির জন্য আবারো শুকরিয়া। শুভকামনা রইলো!
মন্তব্য করতে লগইন করুন