ইসলামী ব্যাংকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ (পর্ব-৪)

লিখেছেন লিখেছেন ডক্টর সালেহ মতীন ০২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ১০:৩৩:৫৪ সকাল



[পূর্ব প্রকাশিতের পর]

ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে সারা দুনিয়া এখন ভাবছে। এ ব্যাপারে আমার কিছু রচনা সম্মানিত ব্লগার ও পাঠক ভাই-বোনদের উদ্দেশে শেয়ার করতে চাই। প্রকাশিত বিষয়ে সমালোচনা, পরামর্শ, সংশোধন সাদরে গৃহীত হবে। বিষয়টি নিতান্তই বেরসিক বিষয়বস্তুর তালিকায় পড়ে, সুতরাং ইহা যদি কারো বিরক্তি উৎপাদন করে তবে আগে ভাগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

পর্ব-৪

খিলাফতের আদর্শ ত্যাগ করে মুসলিম শাসকগণ রাজতন্ত্রের পথ ধরার কারণে তাদের পতন ত্বরান্বিত হয়। ইসলামের নৈতিক প্রেরণা থেকে বঞ্চিত হবার ফলে বস্তুগত উন্নতির মূলমন্ত্রও তারা হাতছাড়া করে। এ সময় তাদের চারদিকে এক নতুন সভ্যতার আবির্ভাব ঘটে। সে সভ্যতার সকল উপাদান, উপাচার মুসলিমগণের ইতিহাস, ঐতিহ্য, জীবনবোধ ও আদর্শিক পরিকাঠামোর সাথে শুধু অসঙ্গতিপূর্ণই নয়, পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। বিজ্ঞান ও বস্তুগত শক্তিতে বলীয়ান এ নতুন সভ্যতায় সুদনির্ভর প্রচলিত ব্যাংকব্যবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ চ্যালেঞ্জরূপে আত্মপ্রকাশ করে। বস্তুত ইসলামী নীতি ও আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত ভিত্তির উপর প্রচলিত ব্যাংকব্যবস্থার বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠিত।

কালের বিবর্তনে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ইসলামী সভ্যতার প্রাচুর্য অবনমিত হওয়ার সাথে সাথে সক্রিয় অর্থনৈতিক চিন্তায় ভাটা পড়ে। এমনকি অর্থনীতি তথা ব্যাংকিং এর তেমন প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামো দীর্ঘদিন অনুপস্থিত ছিল। সে সময় মহাজনরা গোত্রবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন সমাজে এ ব্যবসার মাধ্যমে জনগণকে শোষণ করত। জনগণের মধ্যে বিদ্যা-বুদ্ধির অভাবে এ অবস্থার বিপরীতে প্রতিবাদ করার সাহস তেমন গড়ে উঠতে দেখা যায়নি। আবার অভাবের তাড়নায়ও অনেকে বাধ্য হয়ে এ কারবারের নিকটবর্তী হয়।

হযরত মুহাম্মদ(স.) এর আবির্ভাবের পূর্বে পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র এবং তাঁর নবুয়তের পর মুসলিম অধ্যূষিত দেশসমূহ ছাড়া প্রায় সর্বত্র অপ্রাতিষ্ঠানিক সুদনির্ভর মহাজনী ব্যবসা চলতে থাকে। এরই ক্রমধারার একটি অংশ এখনো এ সমাজে প্রচলিত আছে। উল্লেখ্য যে, সুদী কারবারে ইয়াহুদিরাই ছিল সবচেয়ে বেশি উৎসাহী ও অগ্রগামী। লন্ডনের অধিবাসীগণ সুদখোর ইয়াহুদিদের শোষণে ক্ষিপ্ত হয়ে মধ্যযুগে বহু ইয়াহুদিকে হত্যা করেছিল। জনগণের চাপে বাধ্য হয়ে প্রথম এডওয়ার্ড ১২৯০ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটেন থেকে ইয়াহুদিদের বিতাড়িত এবং একই সাথে সুদের ব্যবসাকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছিলেন। সমাজের নৈতিক ও সর্বজনীন কল্যাণবোধের সংকটে বিপর্যস্ত ইয়াহুদিগোষ্ঠী কেবল আপন স্বার্থ রক্ষার বিপজ্জনক চিন্তায় সবসময় মগ্ন থেকেছে। আজও যেখানে তারা সমাজপতির ভূমিকায় অবতীর্ণ, সেখানে সঙ্কট আর অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে।

বিংশ শতাব্দীর বেশ কিছু ইসলামী চিন্তাবিদ ও অর্থনীতিবিদ ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে চিন্তা ও গবেষণা শুরু করেন। তারা মানবসমাজকে সুদের মতো মারাত্মক ক্ষতি থেকে কিভাবে মুক্ত করা যায় সে ব্যাপারে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে কাজ আরম্ভ করেন। সুদমুক্ত ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে মুসলিমগণ তাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও ব্যবসায়িক প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে প্রচলিত সুদভিত্তিক ব্যাংকব্যবস্থার দিকে ধাবিত হওয়াটা ঐ সব মনীষীগণ বেদনার সাথে বিবেচনা করেন। উপমহাদেশের প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক সাইয়্যেদ আবুল আ‘লা মওদূদী ও আল্লামা হিফজুর রহমান চল্লিশের দশকের গোড়ার দিকে তাদের প্রকাশিত গ্রন্থসমূহে ইসলামী ব্যাংকিং এর উপর বিস্তারিত আলোকপাত করেন। তাদের লিখিত প্রবন্ধ ও প্রতিবেদন অন্যান্যদের চিন্তার খোরাক জোগায় এবং নতুন চিন্তার জাগরণ সৃষ্টি করে। মানুষ ধীরে ধীরে অনুধাবন করতে আরম্ভ করে যে, কতটা সংকটাপন্ন ও ধোঁকাবাজির সমাজে তারা বসবাস করছে।

একই দশকের শেষের দিকে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. আনোয়ার ইকবাল কোরাইশী ইসলামী ব্যাংকিং এর একটি চমৎকার কাঠামোগত ধারণা পেশ করেন। এরই মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশে “Savings and Loan Society” নামে একটি সুদমুক্ত সঞ্চয় ও বিনিয়োগ সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সংস্থা উপমহাদেশের মুসলিমগণকে দীর্ঘদিনের বাধ্যতামূলক সুদী কারবার থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে ব্রতী হয়। তারা সুদের রমরমা ব্যবসার মাঝেও এর বিরুদ্ধে সোচ্চার পদক্ষেপের মাধ্যমে ইসলামী রীতি অনুসরণ করে মুসলিম উম্মাহর সামনে আলোর অবতারণা করেন। ১৯৫২ সালে শেখ মাহমুদ আহমাদ তাঁর একটি গ্রন্থে জয়েন্ট স্টক কোম্পানির ভিত্তিতে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিষয় বিস্তারিত উপস্থাপন করেন। শেখ মাহমুদের উত্থাপিত চিন্তা-ভাবনা বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিশেষত ইসলামী অর্থনীতির বিরুদ্ধবাদীরা ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠাকে অমূলক কল্পনা বলে উপহাস করে। তবে ইসলামী চিন্তাবিদগণের চিন্তা ও চেষ্টা থামেনি। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ চিন্তার এ এক অনন্য ধর্ম। এ চিন্তার পথ রোধ করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়।

[চলবে...]

বিষয়: বিবিধ

১৩৫৪ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

171865
০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সকাল ১০:৫২
বুড়া মিয়া লিখেছেন : আর দুই প্যারা করে বাড়িয়ে দেন – পরের পর্বগুলোয়।

আরও কিছু তথ্য উপস্থাপনের জন্য ধন্যবাদ।
০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সকাল ১১:৪০
125619
ডক্টর সালেহ মতীন লিখেছেন : ধন্যবাদ পরামর্শের জন্য। বিষয়টি একটু বেরসিক/খটমটে কিনা তাই পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটার ভয়ে অল্প অল্প করে পরিবেশন করছি। এখন থেকে আপনার পরামর্শ অনুসরণ করার চেষ্টা করব।
171896
০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ১২:৪৩
আহমদ মুসা লিখেছেন : শ্রদ্ধেয় ড. সালেহ মতীনের ধারাবাহিক এই লেখাগুলো মনোযোগ সহকারে পড়ছি।
সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর সাহিত্য সহজেই সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু আল্লামা হিফজুর রহমান লিখিত ইসলামী ব্যংকিংয়ের উপর আর্টিক্যালগুলো কোথায় পাওয়া যেতে পারে? রেফারেন্স দিলে উপকৃত হবো।
০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ১২:৪৭
125640
ডক্টর সালেহ মতীন লিখেছেন : ধন্যবাদ মূসা ভাই। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব আল্লামা হিফজুর রহমান লিখিত আর্টিক্যালগুলো কোথায় পাওয়া যায় সে তথ্য সংগ্রহ ও আপনাকে অবহিত করার জন্য।
171904
০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০১:০৫
প্রিন্সিপাল লিখেছেন : অনেক কিছু জানতে পারলে।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
171905
০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০১:০৬
প্রিন্সিপাল লিখেছেন :
অনেক কিছু জানতে পারলাম।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০১:২৯
125650
ডক্টর সালেহ মতীন লিখেছেন : ধন্যবাদ ভাইজান। দোয়া করবেন।
০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০১:৩৩
125652
প্রিন্সিপাল লিখেছেন : আল্লাহ তায়ালা আপনাকে ও আপনার পরিবারকে সুখে রাখুন, শান্তিতে রাখুন। আমীন
171930
০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০১:৫১
সালাহ লিখেছেন : চমৎকার লিখনীর জন্য ধন্যবাদ । তবে সব ব্যাঙ্কের মত ইসলামী ব্যাঙ্কও সমান লভ্যাংশ প্রদান করে থাকে তাই এই ব্যাপারটা খোলাখুলিভাবে উল্লেখ করলে উপকৃত থাকব
০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০২:১২
125683
ডক্টর সালেহ মতীন লিখেছেন : আমার ব্লগ বাড়িতে বেড়াতে আসার জন্য ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। তবে একটা বিষয়ে কোন ভুল বুঝাবুঝি যাতে না হয় সে জন্য এখানে বলে রাখা ভালো যে, আমি কিন্তু ইসলামী ব্যাংকিং বা ইসলামী ব্যাংকের কোন মুখপাত্র হিসেবে এ লেখাগুলো দিচ্ছি না। আমি কমার্স ব্যাকগ্রাউন্ডের ছাত্রও নই। উপরোক্ত বিষয়ের উপর আমার সামান্য একটু স্টাডি ছিল সেটাই আমি সবাইকে শেয়ার করছি যদি তাতে কারো সামান্য কোন উপকার হয়। আর আপনার আগ্রহের বিষয়টি আমার কাছে পরিষ্কার নয়। আপনাকে আবারো ধন্যবাদ।
172011
০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ বিকাল ০৪:১৭
ইমরান ভাই লিখেছেন : জাজকাল্লাহ....
০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ বিকাল ০৪:২০
125730
ডক্টর সালেহ মতীন লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ
172365
০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০১:৫১
সালাহ লিখেছেন : আপনাকে খোলাখুলিভাবে কুরআন - হাদীস থেকে প্রমান করতে হবে কিভাবে ইসলামী ব্যঙ্কিং আসলেই হালাল । কারন গতাগতুনিক ব্যঙ্কগুলি যে প্রফিট দিয়ে থাকে , ইসলামী ব্যাঙ্কও তাই দেয় - প্রমান করতে হবে দেয়া নেয়ার ক্ষেত্রে কিভাবে ইসলামী ব্যাঙ্ক সঠিক....
০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০২:৩৩
126065
ডক্টর সালেহ মতীন লিখেছেন : ভাইজান আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। অাপনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে থাকবেন যে, আমার আলোচনার বিষয়বস্তু কিন্তু ইসলামী ব্যাংকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ। তবু আপনার আগ্রহের বিষয়টি অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং সে বিষয়ে জবাব তো অবশ্যই আছে।
173918
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ০৮:৫৯
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : ভালো লাগছে এবং ধারাবাহিক ভাবে পড়ার চেষ্টা করছি।
০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সকাল ১০:০২
127753
ডক্টর সালেহ মতীন লিখেছেন : প্রিয় লোকমান ভাই, আপনাকে পাশে পেয়ে ভালো লাগছে। লক্ষ্য করে থাকবেন, নিতান্তই খটমটে বিষয় নিয়ে এগুচ্ছি। তাছাড়া এ সময়ে এক অর্থে এটি অনেকটা স্পর্শকাতর বিষয়। তাই আপনাদের পরামর্শ, সান্নিধ্য ও সহযোগিতা না পেলে গন্তব্যে পৌঁছা কঠিনসাধ্য হতে পারে। আবারো ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File