ইসলামী ব্যাংকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ (পর্ব-২)
লিখেছেন লিখেছেন ডক্টর সালেহ মতীন ২৩ জানুয়ারি, ২০১৪, ১০:৪১:৩৮ সকাল
পূর্ব প্রকাশিতের পর.
[ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে সারা দুনিয়া এখন ভাবছে। এ ব্যাপারে আমার কিছু রচনা সম্মানিত ব্লগার ও পাঠক ভাই-বোনদের উদ্দেশে শেয়ার করতে চাই। প্রকাশিত বিষয়ে সমালোচনা, পরামর্শ, সংশোধন সাদরে গৃহীত হবে। বিষয়টি নিতান্তই বেরসিক বিষয়বস্তুর তালিকায় পড়ে, সুতরাং ইহা যদি কারো বিরক্তি উৎপাদন করে তবে আগে ভাগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।]
পর্ব-২
সুদ মানুষকে পরিশ্রমবিমুখ করে স্থবির যন্ত্রে পরিণত করে। পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট ভাষায় সুদ নিষিদ্ধ হওয়ার পর সাহাবীগণের মধ্যে সুদের প্রতি ঘৃণা জন্ম নেয় এবং ব্যবসাভিত্তিক কাজ-কর্মের প্রতি তারা ঝুঁকে পড়েন। আলস্য পরিহার করে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে রিয্ক অনুসন্ধানের জন্য আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন, যখন তোমাদের নামাজ (আদায়) সম্পন্ন হবে, তোমরা (আল্লাহর) যমীনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (রিয্ক) অন্বেষণ করতে থাক। আর আল্লাহ্কে বেশি বেশি স্মরণ কর, আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে।
পবিত্র কুরআনের এ আয়াতের নির্দেশনার আলোকে সাহাবীগণের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য তথা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থার ধারণা আরো শক্তিশালী হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য অর্থনৈতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে। ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্য পদ্ধতিকে হালাল বলে ঘোষণা করেছে। এর সূত্র ধরে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিক্রয় ও লেনদেনের ক্ষেত্রে মুশারাকা বা অংশীদারিত্বভিত্তিক বাণিজ্যিক পদ্ধতিতে একাধিক ব্যক্তি বা সংস্থা যৌথ উদ্যোগে মূলধন বিনিয়োগ করে। এ ধরনের উদ্যোগ অত্যন্ত পুণ্যময় এবং সৃষ্টিজগতের জীবন-জীবিকা সংস্থানের একটি কাক্সিক্ষত উপায়। আবার ইসলামী ব্যাংকিং-এর আরেকটি প্রচলিত ক্রয়-বিক্রয় পদ্ধতি বায়‘ সালাম বা অগ্রিম কেনা-বেচা সেটারও পত্তন হতে দেখা যায় রাসূলুল্লাহ(স.) এর সময়কালে। হযরত ইব্ন আব্বাস(রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ্(স.) যখন মদীনা শরীফে আগমন করেন, তখন মদীনার লোকেরা এক, দুই অথবা তিন বছর মেয়াদে খেজুর আগাম কেনাবেচা করত (অর্থাৎ ক্রেতা খেজুরের মূল্য বিক্রেতাকে দু তিন বছরের অগ্রিম দিত)। এ দেখে রাসূলুল্লাহ(স.) বললেন, যে ব্যক্তি খেজুরের মূল্য আগাম প্রদান করে, সে যেন নির্দিষ্ট ওজনের উল্লেখ করে (কোন রকম অস্পষ্টতা ছাড়া) আগাম মূল্য প্রদান করে। হাদীসের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, ইসলামী ব্যাংকের স্বরূপ মহানবী(স.) এর সমসাময়িক কালেও উপস্থিত ছিল।
আল্লাহ্ তা‘আলার আদেশে মক্কা নগরী থেকে মদীনায় হিজরতের পর রাসূলুল্লাহ(স.) হন সেখানকার রাষ্ট্রপ্রধান। একজন দুরদর্শী ও সুযোগ্য রাষ্ট্রপতির ন্যায় তিনিও অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এরই অংশ হিসেবে অনেকটা ব্যাংকের আদলেই তাঁর প্রতিষ্ঠিত বায়তুল মাল আর্থিক লেনদেনের দায়িত্ব পালন শুরু করে। বায়তুল মালের তিনটি বিভাগ ছিল। ১. বায়তুল মাল আল খাস-এটা ছিল রাষ্ট্রীয় কোষাগার বা খলীফাগণের একান্ত তহবিল। এ তহবিলে আয়-ব্যয়ের স্বতন্ত্র উৎস বা খাত নির্ধারিত থাকত। খলীফা ও রাজকর্মচারি এবং প্রাসাদরক্ষীগণের আয়, ব্যয়, বেতন ভাতা, উপঢৌকন, পেনশন ইত্যাদি ছিল এ তহবিলের অন্তর্ভূক্ত, ২. বায়তুল মাল আল আম-এটি ছিল মুসলিমগণের রাষ্ট্রীয় ব্যাংক স্বরূপ। অবশ্য আধুনিক ব্যাংকের মতো এত কাজ এর ছিল না। প্রাদেশিক গভর্নরগণের এখতিয়ারে এটি থাকত এবং ৩. বায়তুল মাল আল মুসলিমিন-এটাকে বলা হতো মুসলিমগণের কোষাগার। যদিও সকল ধর্ম-বর্ণের লোক এ তহবিল ব্যবহার করতে পারতো। এ তহবিলের অর্থ দ্ব্রারা রাস্তা-ঘাট, সেতু, নির্মাণ ইত্যাদি জনকল্যাণমূলক কাজ করা হতো। খারাজ, উশর, গানীমাহ্ প্রভৃতি উৎস থেকে এ তহবিল জমা হতো।
বায়তুল মাল আল-আমই ছিল ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ব্যাংকস্বরূপ, যদিও আধুনিক কালের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ন্যায় এর কর্মপরিধি এত ব্যাপক ও সুসংহত ছিল না। বায়তুল মাল আল মুসলিমিন’কে জনগণের দ্বিতীয় কোষাগার বলা হতো। এ তহবিল থেকে ইসলামী রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের কল্যাণার্থে প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় করা হতো।
ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, ইসলামের প্রাথমিক যুগে অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত, প্রাজ্ঞ ও মর্যাদাবান সাহাবী হযরত যুবায়ের ইব্ন আওয়াম ইসলামী ব্যাংকের আদলে একটি অর্থনৈতিক সংস্থা গঠন করেছিলেন যদিও সে ব্যাংকিং পদ্ধতি আধুনিক যুগের ব্যাংকিং এর মতো সুবিন্যস্ত ও সুষ্ঠু কার্যক্রম দ্বারা পরিচালিত ছিল না। তিনি ২২ লক্ষ দিরহাম পুঁজি নিয়ে সংস্থা আরম্ভ করেন। তাঁর ইন্তেকালের সময় এ সংস্থার তারল্য এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৬ লক্ষ দিরহাম। এটা ছিল মুসলিম উম্মাহ্র জন্য অনুসরণীয় একটি ঐতিহাসিক উদ্যোগ।
বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান অবস্থা সাফল্যের কীর্তিগাঁথা উপাখ্যান এর মতো। অথচ কল্যাণমুখী এ ব্যাংকিং ধারার সূচনা খুব বেশি দিনের নয়, ৩০ বছর পূর্বের। কিন্তু কুরআন-হাদীস তথা শারঈ মানদণ্ডে সুদমুক্ত ও কল্যাণমুখী ব্যাংকিং ধারার গোড়া পত্তন খোদ রাসূলুল্লাহ(স.) এর শাসনামলেই হয়েছিল। সময়ের বিবর্তনে মাঝখানের দীর্ঘ সময় এটি নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। দীর্ঘ ধারাবাহিকতায় একটি ক্রম পরিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতির রূপান্তর ঘটেছে।
চলবে
বিষয়: বিবিধ
১৯৪২ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধন্যবাদ অনেক কিছু বুঝলাম জনাব।
সমমনা ইসলামী ব্যাংকগুলো মার্জ হয়ে একটা ব্যাংক হলে সেটা মানুষের কল্যাণে বেশী অগ্রসর হতে পারতো, এখনতো কে কোন সূচকে কার আগে থাকবে – তা নিয়ে কামড়াকামড়ি করে আর গ্রাহকরা কামড়ের যন্ত্রণা ভোগ করে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন