কে দুখু মিয়া ? নজরুল নাকি তার বাবা ?
লিখেছেন লিখেছেন ডক্টর সালেহ মতীন ২৬ মে, ২০১৩, ০১:৫২:১৯ দুপুর
কাজী নজরুল ইসলাম আমার অনেক প্রিয় কবি। জাতীয় কবি বলে নয়, কবিতায় তার শৈশবের বেপরোয়া দুষ্টুমী, নির্ভীক পৌরুষ, অত্যাচারের বিরুদ্ধে অসম সাহসিকতার ছন্দ, অন্যায়ের বিপরীতে সাইক্লোনের বিদ্রোহী ডংকা বাজানো এগুলোই তার প্রতি আমার অগাধ ভালোবাসার জন্ম দিয়েছে। তাঁর মতো আমিও উজ্জ্বল তারুণ্যে উদ্দীপ্ত হতে পছন্দ করি। কাজী নজরুল ইসলাম আমার বেসামাল ও বিপ্লবী পৌরুষের পথিকৃৎ, আমাদের জাতি সত্ত্বার এক মহা বিষ্ময়কর অহংকার।
গত কাল ছিল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের শুভ জন্ম দিন। নজরুল ভক্তদের অনেকেই তাঁর স্মৃতিচারণ করে পত্রিকা, ব্লগে লিখছে, কোন কোন গবেষক বিদ্রোহী কবির অনেক অজানা তথ্য প্রকাশ করে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণও করছে। ভালো লাগছে। কিন্তু কষ্ট পাই যখন প্রিয় কবিকে দুখু মিয়া বলা হয়। জাতীয় কবির এত দুঃখের ভার তো দায়িত্বশীল ভক্ত হিসেবে আমাদের উপরও বর্তায়। কাজী নজরুল ইসলামকে আসলেই কি দুখু মিয়া বলা হতো ? নাকি কেউ আবেগে তার শৈশবের দারিদ্র্যের প্রতি সমব্যাথা প্রকাশ করতে নিতান্তই আদর করে তাকে দুখু মিয়া বলতে শুরু করেছে ! কেনই বা তাঁকে দুখু মিয় বলা হবে ? তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন, অত্যাচারীর বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হতে বিপ্লবী আহ্বান জানিয়েছেন, ক্ষুধার্ত মানুষের আহাজারির জন্য শাসকশ্রেণীর দায়িত্বহীনতার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। কিন্তু তিনি তাঁর অনাহার কিংবা ক্ষুধা যন্ত্রণার কোন বর্ণনা তাঁর কবিতা বা গল্পে উল্লেখ করেছেন বলে জানা যায় না। অবশ্য নজরুল গবেষকরা এ ব্যাপারে ভলো বলতে পারবেন।
যাই হোক দুখু মিয়া আসলে কে ? এ বিষয়ে আমি একটু পরে আসছি। এক্ষণে তাঁকে নিয়ে ১৩ বছর আগে উচ্চারণ করা এক স্মৃতির কথা উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না। আমি তখন ঢাকার একটি অতি প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠানে বাংলা শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। বিদ্রোহী কবির জন্মদিনে কাসে প্রবেশ করে স্বভাবসিদ্ধভাবেই কবিকে নিয়ে দু’টি কথা না বলে লেকচার শুরু করতে মন চাইল না। তাছাড়া বাংলা শিক্ষক হিসেবে জাতীয় কবির জন্মদিনে বাংলা ক্লাসে তাঁকে নিয়ে কিছু বলব না তাকি হয় ? আমি ভাবগাম্বীর্যের সাথে বললাম, আজ আমাদের প্রিয় জাতীয় কবির জন্মদিন, আমরা তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি এবং তাঁর রূহের মাগফিরাত কামনা করছি। কাজী নজরুল ইসলাম অনেক বড় একজন কবি ছিলেন, তাঁর কবিতায় তারুণ্য উদ্দীপনা ও অন্যায়ের প্রতিবাদী যে কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হত তা তুলনাহীন। তাঁর কবিতা শত সহস্র কাল ধরে জাতিকে জাগিয়ে তুলবে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে প্রেরণা যোগাবে। সাহিত্যে তিনি নোবেল পুরস্কার পাননি বটে, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি এ সম্মানজনক পুরস্কার তাঁর পাওয়া উচিত ছিল। এমন বিষ্ময়কর কাব্য প্রতিভা ক’জনের মধ্যেই জন্ম নেয় ? সবাই আমার কথায় সায় দিচ্ছে।
আমি বললাম, কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, কাজী নজরুল ইসলাম প্রাইমারী থেকেই স্কুল ত্যাগ করার কারণে অংকের বই তার খুলে দেখা হয়নি। ফলে অংকে তিনি পারদর্শিতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাছাড়া শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে যে দুরন্ত দুষ্টুমী ও ডানপিঠে চরিত্র লালন করে চলেছিল তাতে তার পক্ষে অংকের মতো বেরসিক কোন সাবজেক্টে ধৈর্য্য ধরে মনোনিবেশ করা সম্ভব ছিল না। তাই যোগ-বিয়োগে তিনি একটু ভুল করে গেছেন। তিনি বলেছেন, “পৃথিবীতে যা কিছু সুন্দর চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার আনিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।” সমস্যাটা এখানে। পৃথিবীতে কল্যাণের কৃতিত্ব তিনি নারী-পুরুষের মধ্যে ফিফটি ফিফটি ভাগাভাগি করে দিয়েছেন। আসলে হবে, “পৃথিবীতে যা কিছু সুন্দর চির কল্যাণকর, একভাগ তার আনিয়াছে নারী নিরানব্বই ভাগ নর।” এ কথা শুনে ক্লাসে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, প্রিয় কয়েকজন ছাত্রী ছাড়া ছাত্রদের প্রায় সবাই ‘ঠিক’ বলে সমর্থন জানিয়েছিল। প্রিয় পাঠকবৃন্দই বলতে পারবেন, কবির সেই ভাগাভাগি কি যথার্থ ছিল ?
এবার আসা যাক দুখু মিয়া প্রসঙ্গে। ঐ একই সালের কথা, পঞ্চম শ্রেণী পড়ুয়া আমার প্রিয় ছাত্র সাদ আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “স্যার, কাজী নজরুল ইসলামকে দুখু মিয়া বলা হয় কেন ?” আমি বলেছিলাম, কেউ কেউ বলে থাকেন, দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত কবির ছেলে বেলা অসামান্য দুঃখ বরণ করে নিতে বাধ্য হয়েছিল, এমনকি অর্ধাহারে-অনাহারেও তাকে দিনের পর দিন কাটাতে হয়েছে। কবির জীবনী থেকে আমরা জানতে পারি, তিনি অভাবের তাড়নায় সামান্য রুটির দোকানে কিছুদিন চাকুরীও করেছিলেন।
আবার কেউ কেউ দাবী করেন, কাজী নজরুল ইসলামের জন্মের পূর্বে তার ৫ ভাই-বোন জন্মের পরপরই মারা যায়। সন্তান হারানোর এ ঘটনা পিতা-মাতার জন্য গভীর দুঃখজনক। সন্তানদের এ বিয়োগ বেদনার প্রেক্ষাপটে কাজী নজরুলের জন্ম হয়, সে কারণে তাঁকে দুখু মিয়া বলা হয়। সাথে সাথে আমার ছাত্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলে উঠে, পরপর ৫ সন্তানের মৃত্যুর পর কাজী নজরুলের জন্ম এবং আল্লাহ তাঁকে বাঁচিয়ে রাখার ঘটনা তো সুখের, সুতরাং কবির নাম সুখু মিয়া হওয়া উচিত। তা ছাড়া, সন্তান হারানোর বেদনা বহন করছিলেন কবির পিতা-মাতা। এ দুঃখের জন্য যদি দুখু মিয়া নাম কারো হতেই হয়, তাহলে তা হওয়া উচিত তার বাবার। কাজী নজরুল ইসলাম তার জন্মের পূর্বের ভাই-বোনদের অকাল মৃত্যুর দায়ভার বহন করতে ‘দুখু মিয়া’ খেতাব পাবেন কেন ? আমি ওর কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম, তার প্রশ্নের কোন উত্তর আমি আজো সংগ্রহ করতে পারিনি।
বিষয়: বিবিধ
৩১২৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন