যত দূর চোখ যায় লাশ লাশ আর লাশ : গণহত্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ আ ব দু ল হা ই শি ক দা র

লিখেছেন লিখেছেন সোনার বাংলার আহমদ ০৩ মার্চ, ২০১৩, ১০:১২:১২ সকাল

অন্তত বোল্ড করা লাইন গুলো পড়ুন।

এক.


টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই দেশটির যেখানে যে দিকে যত দূর চোখ যায় এখন কেবল লাশ লাশ আর লাশ। রক্ত রক্ত আর রক্ত। বাংলাদেশ এখন আর কোনো মানবিক ভূখণ্ড নয়। বাংলাদেশ এখন এক বধ্যভূমি। বাংলাদেশ এখন শেখ হাসিনা সরকারের কসাইখানা। বাংলাদেশ এখন লাশের পাহাড়। বাংলাদেশ মানে এখন রক্তের বীভত্স দরিয়া। আর স্বজন হারানো মানুষের বক্ষফাটা আহাজারি, আর্তনাদ আর হাহাকারকে পদপিষ্ট করে, সেই লাশ আর থৈ থৈ রক্তের বিভীষিকার ওপর চলছে শকুনি গৃধিনীর পৈশাচিক উল্লাস।

চেঙ্গিস খানের চাইতে বর্বরতা নিয়ে, হিটলারের চাইতে নৃশংসতা নিয়ে, ড্রাকুলার চাইতেও ক্রুরতা নিয়ে এই রক্তপিপাসু সরকার বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে ইতিহাসের ভয়াবহতম গণহত্যা।

স্কাইপ কেলেঙ্কারির পদত্যাগী বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম বলেছিলেন, ‘গভর্নমেন্ট গেছে পাগল হইয়া, তারা একটা রায় চায়।’ সেই রায় হতে হবে ফাঁসি, অন্য কিছু নয়। সেই জন্যই যোজিত হয় শাহবাগ নাটক। যে নাটকের মূল কাজ ছিল প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ, ঘৃণা আর বিদ্বেষকে মুক্তিযুদ্ধের আবরণ লাগিয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া। সেই কাজ সম্পন্ন হতেই আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের রায়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির ঘোষণা আসে। সঙ্গত কারণেই গ্রহণযোগ্যতাহীন, সর্বমহল থেকে প্রত্যাখ্যাত, বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে পথে নেমে আসে জামায়াত, শিবিরের নেতাকর্মী ও সাঈদী-ভক্ত সাধারণ মানুষ। এই পথে নেমে আসা যত গণতন্ত্রসম্মতই হোক, ক্ষিপ্ত ও ক্রুদ্ধ হয়ে উঠে আমাদের সরকার। সরকার নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের এই নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদের ওপর লেলিয়ে দেয় তাদের নরঘাতক পুলিশ, খুনি র্যাব ও আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের। তারা মেতে ওঠে গণহত্যায়। নির্বিচারে গুলি চালিয়ে এই সরকারি খুনিরা গত বৃহস্পতিবার একদিনেই খুন করেছে দেশের ৬৬ জন মানুষকে। আহত করেছে কমপক্ষে হাজারজনকে। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছে শত শত বাড়ি-ঘর, ব্যাংক, হাসপাতাল ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল বাদ দিলে বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসে একদিনে এত মানুষ খুনের ঘটনা আর কখনও ঘটেনি। মানুষ খুনে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন হাসিনা, গড়েছেন বিশ্বরেকর্ড।

বাংলাদেশের ৪০ বছরের ইতিহাসে যা কখনও ঘটেনি, পাকিস্তানের ২৫ বছরের ইতিহাসে যা ঘটেনি, ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনে যা কখনও হয়নি, সেই ভয়ঙ্কর হত্যার নেশায় উন্মাদ হয়ে উঠেছে সরকার। ব্রিটিশ আমলে এক জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড ছাড়া এই জিঘাংসার সঙ্গে তুলনা করার মত আর কোনো নজির নেই। এই ভয়াবহ ‘হত্যার উত্সবে’ বাংলাদেশের প্রতিটি জনপদ এখন পরিণত হয়েছে এক একটি গোরস্থানে। ঘটনার ভয়াবহতায় স্তম্ভিত বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বলেছেন, এই হত্যাকারী সরকারকে ক্ষমতা থেকে উত্খাত না করতে পারলে দেশ বাঁচবে না। তিনি বলেছেন আর একটি গুলিও নয়। বন্ধ করুন গণহত্যা। সাধারণ মানুষকে ডাক দিয়েছেন পথে নেমে আসার।


বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যথার্থই বলেছেন, দেশব্যাপী পুলিশ, র্যাব ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের সাধারণ মানুষ হত্যার ঘটনায় গোটা জাতি আতঙ্কিত। সর্বস্তরের মানুষ চরম অস্থিরতায় দিনযাপন করছে। নির্বিচারে সাধারণ মানুষকে হত্যার নজির ’৭১-এর হানাদার বাহিনীকেও ছাড়িয়ে গেছে। গতকালের নারকীয় হত্যাকাণ্ড ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা।

তিনি বলেছেন, গত বৃহস্পতিবার সারা দেশে শাসকগোষ্ঠীর আচরণ দেখে মনে হয়েছে, তারা হত্যাকে আতসবাজির খেলা হিসেবে গণ্য করেছে। মানুষ হত্যার তাদের এই নিষ্ঠুর খেলায় দেশের গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব আজ চরম সঙ্কটের মুখে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। যে দেশের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল তার পিতা শেখ মুজিবের হাত দিয়ে, সেই দেশকে তিনি ঠেলে দিয়েছেন গৃহযুদ্ধের দিকে। মনে হচ্ছে বাংলাদেশের নাম-নিশানা তিনি মুছে দিতে চাচ্ছেন মানচিত্র থেকে। তিনি একবার বলেছিলেন, যে দেশের মানুষ আমার পিতাকে হত্যা করেছে, সেই দেশের মানুষের প্রতি তার কোনো দায় নেই। সে জন্যই কি তিনি প্রতিশোধ নেয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠেছেন?

কবি ফরহাদ মজহার বলেছেন, যদি তা না হয়, তাহলে কি আপনি যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দিলেই ক্ষান্ত হবেন? যদি তাই হয়, তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের ধরে ধরে শাহবাগিদের হাতে তুলে দিন। তারা তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারবে। কিন্তু দোহাই সাধারণ মানুষকে আর হত্যা করবেন না। নিরপরাধ মানুষদের আর খুন করবেন না। বন্ধ করুন এই গণহত্যা। বন্ধ করুন বিচার নামের প্রহসন।

সাধারণ মানুষকে হত্যা করে, নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে ইতিহাসে কেউ রক্ষা পায়নি। ইতিহাস মার্কোসকে ক্ষমা করেনি, পিনোচেটকে বাঁচাতে পারেনি। রদোভান কারাদজিককে দাঁড় করিয়েছে কাঠগড়ায়। হোসনি মোবারক, রেজা শাহ পাহলভি, গাদ্দাফি, সাদ্দাম হোসেন, হিটলার, মুসোলিনি সবাইকে ভোগ করতে হয়েছে করুণ পরিণতি। কারণ মহাবিজ্ঞানী নিউটন বলে গেছেন, প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটা সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে কে বলেছে আপনার সরকারই বাংলাদেশের শেষ সরকার? আপনি বাংলাদেশের শেষ প্রধানমন্ত্রী? সে জন্যই আবেদন, অনুরোধ, বন্ধ করুন এই হৃদয়বিদারক হত্যাযজ্ঞ। নইলে একদিন বাংলাদেশে গণহত্যা চালানোর অপরাধে আপনারও বিচার হবে। আপনাকেও নতমুখে দাঁড়াতে হবে ইতিহাসের কাঠগড়ায়। অতএব বাসার আল আসাদের পথ পরিহার করে ফিরে আসুন সুস্থতার পথে, মঙ্গলের পথে। ক্ষমতার মোহ আপনাকে অন্ধ করে দিয়েছে। বধির হয়ে গেছে আপনার হৃদয়। ইতিহাসে আপনি কি হিরো হয়ে থাকতে চান, নাকি ভিলেন হিসেবে?

যদি হিরো হয়ে থাকতে চান, তাহলে পরিহার করুন হালাকু খান ও নাদির শাহর পথ। ফিরে আসুন বাংলাদেশের পথে। হজরত শাহ জালালের ন্যায়ের পথে, সাম্যের পথে। শ্রী চৈতন্যের প্রেমের পথে। লালন শাহর মরমীয়া পথে। সবুজ-শ্যামল কোমল জোছনা মাখা আব্বাসউদ্দীনের পথে।

বন্ধ করুন অপবিত্র রক্তপাত। কারণ রক্ত শুধু রক্তকেই ডেকে আনে। আর দেশপ্রেম মানুষকে করে মহত্।

দুই.

যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে নিয়ে শাহবাগে তরুণদের একত্রিত হতে বলা হয়েছিল, তা থেকে গণজাগরণ মঞ্চের দূরত্ব এখন কয়েক হাজার মাইল। অথবা বলা যায় তরুণদের বিভ্রান্ত করে, তাদের আবেগকে ব্যবহার করে আমাদের ব্যর্থ, অযোগ্য, অদক্ষ, দুর্নীতিগ্রস্ত, দায়িত্বজ্ঞানহীন অপদার্থ সরকার দেশজুড়ে নৈরাজ্য ও সন্ত্রাস ছড়িয়ে, জাতীয় ঐক্য ও সংহতি ভেঙে গুঁড়িয়ে বিরোধিতার কণ্ঠকে রুদ্ধ করে যে উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে চেয়েছিল তাতে তারা দারুণভাবে সফল হয়েছে। ফলে নব বাকশাল এখন দরোজায়। আর দেশে জন্ম নিয়েছে দুটি সরকার। একটি হাসিনা সরকার অন্যটি ইমরান সরকার। দুই সরকারই এখন বিচারক ও শাসক।

থলের বিড়াল এখন বেরিয়ে গেছে। সে জন্য অনেক কথাই বলা যায়। শাহবাগ জমায়েতের প্রযোজক, পরিচালক এখন সরকার। সরকারের ছাত্র সংগঠন। তাদের লেজুড় রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠন। পেছনের সব শক্তি ও সাহায্যের উত্স আমাদের মহান প্রতিবেশী (!) ভারত। ভারতীয় পত্রিকা টাইমস অব ইন্ডিয়া পরিষ্কার ভাষায় বলেছে, ভারতের মদতে শাহবাগ আন্দোলন হচ্ছে। আর এই পুরো প্রক্রিয়াকে জনপ্রিয় করে জনউন্মাদনায় পরিণত করার দায়িত্ব নিয়েছে আমাদের দেশের গণমাধ্যম। বলে রাখি, এভাবে গণউন্মাদনা সৃষ্টি করেই সিকিমের মানুষের মাথা বিগড়ে দিয়েছিল সে দেশের গণমাধ্যম। এই শাহবাগের কায়দায় স্বামী রামানন্দ তীর্থকে লেলিয়ে দিয়ে হায়দারাবাদের জনগণকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছিল ভারত। হায়দারাবাদের মধ্যে সৃষ্টি করেছিল নৈরাজ্য, সে নৈরাজ্য সৃষ্টির জন্য কখনও ব্যবহার করেছে দেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীকে, কখনও তেলেঙ্গানা বিদ্রোহের নামে নিজেদের মদতপুষ্ট কম্যুনিস্টদের।

সরকারের দরকার ছিল গাঙ পার হওয়ার নৌকা। পাপের ভারে নুয়ে পড়া শরীর নিয়ে নদী পেরুবার উপায় ছিল না তার। শাহবাগ সরকারকে সেই সুযোগ এনে দিয়েছে। জাতিকে স্থায়ীভাবে বিভক্ত করার কাজটি সরকার শাহবাগের মাধ্যমে সম্পাদন করতে পেরেছে। লগি-বৈঠার খুনি বাপ্পাদিত্য বসুরা ডেকে এনেছিল ১/১১। এবারও শাহবাগের ঘাড়ে চেপে সেই একই লোকেরা পথ খুলে দিয়েছে অসাংবিধানিক শক্তিকে ক্ষমতা নেয়ার। ১৯৭২-৭৫-এ দেশে আইনের শাসন বলে কিছু ছিল না। শেখ মুজিব ও তার নেতা-কর্মীদের কথাই ছিল আইন। শাহবাগ আবার আমাদের সেই জগতে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। বিচার ব্যবস্থা আগেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল, এখন তার গলিত লাশের ওপর সরকার নিশান উড়ালো ফ্যাসিবাদের। দেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও বর্তমান সরকারের জুতা বহন করার জন্য, তাদের ফরমাশ মোতাবেক খাবার পরিবেশনের জন্য মিডিয়ার অভাব ছিল না। হাতেগোনা কয়েকটি মাত্র সংবাদপত্র ছিল, যারা শত ঝড়-ঝঞ্ঝাটের মধ্যেও সত্য কথা জানিয়ে যাচ্ছিল জাতিকে। এর মধ্যে আমার দেশ, নয়াদিগন্ত, দিনকাল, সংগ্রাম, দিগন্ত টিভি, ইসলামি টিভি পেশাগত সততার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছিল। সরকার অত্যন্ত ধূর্ততার সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মাঠে নামাতে পেরেছে শাহবাগকে।

বিশ্ব ইতিহাসের নজিরবিহীন ঘটনা ঘটিয়েছে শাহবাগ। যে পত্রিকা ও পত্রিকার সম্পাদক বর্তমান স্বৈরাচারী সরকার কর্তৃক চরমভাবে নির্যাতিত হয়েছে, যে পত্রিকা ও তার সম্পাদক পরিণত হয়েছে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রামের প্রতীকে, পরিণত হয়েছে গণমানুষের কণ্ঠস্বরে, সেই পত্রিকার পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে শাহবাগ থেকে দাবি উঠেছে, স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে পত্রিকা বন্ধ করার, পত্রিকার সম্পাদককে গ্রেফতার করার জন্য। চমত্কার! চমত্কার!!

সরকারের অপকর্মের বাধা হয়ে গিয়েছিল ধর্ম। ধর্মীয় আলেম-ওলামারা। সরকার শাহবাগের কয়েকজন ব্লগার দিয়ে কুিসত আক্রমণ চালিয়েছে ধর্মের ওপর। আলেম-ওলামারা এর প্রতিবাদ করলে তাদের উপরও বর্বরোচিত দমন অভিযান চালিয়েছে সরকার। পাখির মতো গুলি করে ডজন ডজন ধর্মপ্রাণ মানুষ হত্যা করে রক্তের নদী বানিয়ে ফেলেছে দেশটাকে। আর ‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা বেটাই চোর’ বলে সব আক্রোশ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে জামায়াত-শিবিরের উপর। আর মিডিয়া বলছে সরকার বা শাহবাগের কোনোই দোষ নেই। শিবিরই হলো যত নষ্টের মূল!

সরকার ধর্মদ্রোহী ব্লগারদের পক্ষ নিয়ে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। তাদের পক্ষে বেহায়ার মতো সাফাই গাইছে। তাদের শোকসভায় গিয়ে কেঁদে জারজার হচ্ছে। নির্লজ্জের মতো বলছে, ব্লগের লেখা ক’জন পড়ে, কিন্তু পত্রিকা সেগুলো যেভাবে প্রকাশ করেছে, তা মানুষের কাজ হতে পারে না। পত্রিকাগুলোর বিরুদ্ধে শোনা যাচ্ছে তাদের তর্জন-গর্জন। কিন্তু ব্লগারদের বিরুদ্ধে তারা উচ্চারণ করছে না একটি শব্দও। নেয়নি কোনো ব্যবস্থাও।

শাহবাগ সরকারকে খুনি হতে সাহায্য করেছে। শাহবাগ সরকারকে আরও নৃশংস হতে সাহায্য করছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটাতে উত্সাহ দিচ্ছে।

বাংলাদেশে এখন যা কিছু ঘটছে সবই নজিরবিহীন। কোনো গণআন্দোলন ক্ষমতাসীন সরকারের ঢালাও সমর্থন ও সাহায্য পায়—তাও নজিরবিহীন। দেশের তরুণরা গণজাগরণের নামে সরকারের ‘দালাল’-এ পরিণত হয়—এটাও নজিরবিহীন। শাহবাগের তরুণরা যদি বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ হয় তাহলে বলতে দ্বিধা নেই, এদেশের কপালে দুঃখ আছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে চাই, শাহবাগে যা ঘটছে তার সঙ্গে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক তরুণদের আর কোনো সম্পর্ক নেই। তরুণদের নাম করে, জনগণকে বোকা বানিয়ে যারা ওখানে জমায়েত হয়েছে তারা ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র মৈত্রী, ছাত্র ফ্রন্ট বা যুবলীগের নেতাকর্মী। সে জন্যই শাহবাগ হারিয়ে ফেলেছে নৈতিক শক্তি।

তিন.

১৯৯২ সালে ভেঙে গিয়েছিল সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ ইউনিয়ন। বিদায়ী বছরের ১ মার্চে পত্রিকায় দেয়া এক যুক্ত বিবৃতিতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আবার একযোগে কাজ করার অঙ্গীকার করেছিল সাংবাদিকদের ইউনিয়নগুলো। সাগর-রুনির রক্তের ওপরে দাঁড়িয়ে ঐক্য ধরে রাখার শপথও নিয়েছিলেন তারা। সেই ঐক্য প্রক্রিয়ার মর্মমূলে নিদারুণভাবে কুঠারাঘাত করেছে শাহবাগ। শাহবাগের কারণে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে, বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন কোনো কোনো সাংবাদিক নেতা। কেউ কেউ রীতিমত প্রলাপ বকছেন। আচরণ করছেন উন্মাদের মতো।

এই অসুস্থদের একজন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (একাংশ) সভাপতি ইকবাল সোবহান চৌধুরী। ইকবাল সোবহান চৌধুরী লম্বা লম্বা কথা বলায় বড়ই ওস্তাদ। তিনি সব সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। ১৯৭১ সালের পুরো সময়ই চাকরি করেছেন পাকিস্তানের কড়া সমর্থক (আজকের ভাষায় রাজাকার) হামিদুল হক চৌধুরীর ‘দি পাকিস্তান অবজারভারে।’ সে সময় সাংবাদিকতার সুবাদে পাকিস্তানের কর্তাদের সঙ্গে তার কিছু মাখামাখি ছিল বলেও নিন্দুকেরা বলে। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, তিনি অবজারভারে যে পদটি দখল করেছিলেন, সেই পদটি যার ছিল তিনি চাকরি ছেড়ে অংশ নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে তিনি তার আওয়ামী কানেকশনকে কাজে লাগিয়ে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বনে যান পত্রিকাটির। একপর্যায়ে মূল মালিকদের ভিটেছাড়া করে ছিনতাই করেন সম্পাদক পদটিও। তারপর তার অন্যায় ও অপকর্মের ফলে অবজারভারের মতো পত্রিকা হারিয়ে ফেলে পাঠকপ্রিয়তা। তিনি ধ্বংস করে দিয়েছেন ওই পত্রিকাটিকে।

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের ভোটে জেতার লোভে এই নীতি ও নৈতিকতাহীন লোকটি অধ্যাপক গোলাম আজমকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের দাবি করে পত্র-পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছিলেন। আবার আমাদের সাংবাদিকতার ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ট্রেড ইউনিয়নিস্ট, যিনি হাজার হাজার সাংবাদিককে বেকার করে দিয়েছিলেন। তারই পরামর্শে শেখ হাসিনার সরকার বন্ধ করে দিয়েছিল দৈনিক বাংলা, বাংলাদেশ টাইমস, বিচিত্রা ও আনন্দ বিচিত্রার মতো পত্রিকাগুলো।

সাংবাদিকতা করার পাশাপাশি তার আবার রাজনীতি করারও খায়েশ আছে। আওয়ামী লীগের টিকিট নিয়ে ২০০৮-এর নির্বাচনে তিনি ফেনী থেকে প্রার্থীও হয়েছিলেন। কিন্তু পোড়া কপাল। যে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কলাগাছগুলো পর্যন্ত জিতে এসেছে, সেই নির্বাচনে তিনি গোহারা হেরেছেন।
তিনি এতই জনপ্রিয় যে, তার জামানত পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হয়েছে!

সেই ইকবাল সোবহান চৌধুরী বাংলাদেশের গণমানুষের কণ্ঠ দৈনিক আমার দেশ-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে বলেছেন ‘কুলাঙ্গার’, বলেছেন হাইজাক করা সম্পাদক। কারণ মাহমুদুর রহমান তার মতো ‘অসভ্য’ ‘কুরুচিপূর্ণ’ লোকের প্রেসক্রিপসন মেনে শাহবাগকে ধন্য ধন্য বলেননি। তাতেই এত গোস্বা। সেজন্যই গ্রেফতার দাবি।

মাহমুদুর রহমান ছিলেন বুয়েটের মেধাবী ছাত্র। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন সেখান থেকে। এমবিএ করেছেন আইবিএ’র মতো সারাবিশ্বে সমাদৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। ইঞ্জিনিয়ারদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান আইইবি থেকে পেশাদারিত্বে উত্কর্ষের জন্য গোল্ড মেডেল পেয়েছেন। বাংলাদেশের সিরামিক শিল্পে আধুনিকতা আনয়নের স্থপতি তিনি। বেসরকারি থেকে সরকারি, বিনিয়োগ বোর্ড থেকে সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা, সবখানে রেখে এসেছেন সাফল্যের স্বাক্ষর। ১/১১-এর সময় ইকবাল সোবহান চৌধুরীর মতো আওয়ামী ও জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীদের বিরাট অংশ যখন মইন উ মোসাহেবীতে ব্যস্ত, সেই সময় হাতেগোনা যে দু’একজন লোক এর বিরুদ্ধে সাহস করে হাতে কলম তুলে নিয়েছিলেন, দেশের মানুষকে জুগিয়েছিলেন পথ নির্দেশনা, নিঃসন্দেহে মাহমুদুর রহমান তাদের অগ্রগণ্য নাম।

এক নিদারুণ সঙ্কটকালে তিনি আমার দেশ-এর হাল ধরেন। তাও এখানকার কর্মরত সাংবাদিকবৃন্দ ও মরহুম আতাউস সামাদের অনুরোধে। তার পরের ইতিহাস সবারই জানা।

শুধু যে সুচারুরূপে সম্পাদনা করছেন তিনি তাই নয়, তার কারণে আমার দেশ আজ দেশের মানুষের প্রাণের প্রদীপে পরিণত হয়েছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তার লেখনী এখন বাংলাদেশের মানুষের প্রেরণার উত্স। তার সততা ও সাহস নিয়ে গর্ব করে জনগণ। সত্য প্রকাশের জন্য তাকে পুরস্কার দেয়ার বদলে ইকবাল সোবহান চৌধুরীর ‘প্রিয় সরকার’ তার উপর চালিয়েছে চরম নির্যাতন। ১০ মাসেরও বেশি সময় তাকে পচাতে হয়েছে জেলে। গত দুই মাসেরও অধিক সময় ধরে তিনি অবরুদ্ধ হয়ে আছেন নিজ কার্যালয়ে। তারপরও তিনি শাসকের রক্তচক্ষুকে পরোয়া করেননি। অন্যায়ের কাছে মাথানত না করে সমস্ত শক্তি দিয়ে সমুন্নত রেখেছেন ন্যায়ের পতাকা। আসলে অপরাজেয় বাংলাদেশের অনবদমিত জাতিসত্তার প্রতিনিধি তিনি। এখনও নির্বিরাম লিখে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে তার ৯টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। কোনো কোনো গ্রন্থের এই মেলাতেই তিন-চারটি করে সংস্করণ হয়েছে। বিপুল তার জনপ্রিয়তা। বিশাল তার পাঠকগোষ্ঠী।

সেই মানুষটি সম্পর্কে ইকবাল সোবহান চৌধুরী যে জঘন্য ভাষা ব্যবহার করেছে তার নিন্দা করার জন্য যে ভাষা ব্যবহার করা উচিত, সে ভাষা ব্যবহারের রুচি আমার নেই। আমি শুধু বলব, তার নোংরা কথায় গোটা সাংবাদিক সমাজ শুধু নয়, দেশের প্রতিজন বিবেকবান মানুষ লজ্জিত, ব্যথিত, ক্ষুব্ধ। খুব ভালো হয় যদি প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে তিনি তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেন।

নইলে বলতেই হবে, পুরো সাংবাদিক জীবনকে তিনি শুধু খ্যাতি আর প্রতিপত্তি অর্জনের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। না হতে পেরেছেন সাংবাদিক, না হতে পেরেছেন মানুষ। তার পুরো সাংবাদিক জীবনে কয় পৃষ্ঠা তিনি লিখেছেন? কী তার অবদান? তার অবদান তো হলো অবজারভারের পত্রিকার সম্পাদক পদ হাইজ্যাক করা। একজন যথার্থ হাইজ্যাকার বলেই তিনি একজন সম্মানিত সম্পাদককে হাইজ্যাকার বলার দুঃসাহস দেখাতে পেরেছেন। নিজে মানসিক বিকারগ্রস্ত, ভারসাম্যহীন কিংবা হিতাহিতবোধশূন্য উন্মাদ অথবা কুলাঙ্গার বলেই তিনি মাহমুদুর রহমানের মতো সত্যনিষ্ঠ মানুষ সম্পর্কে ওইসব দাঁতাল আক্রমণ চালিয়েছেন।

আমার ধারণা, তার মাথার মধ্যে জলাতঙ্ক রোগের বীজাণু ঢুকে গেছে। যে কারণে জলাতঙ্ক রোগীদের মতোই আচরণ করছেন তিনি। পানি দেখলেই ভয় পাচ্ছেন। একদিক থেকে ঠিকই আছে, মাহমুদুর রহমান যদি জাতির আয়না হন তাহলে বলতেই হবে ইকবাল সেই আয়নায় নিজেকেই দেখেছেন।


মানুষের ব্যক্তিজীবন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি আমার পছন্দ নয় বলে ওদিকে গেলাম না। নইলে বলা যেত তার জীবনের ওই দিকটাতেও বেশ অন্ধকার। তবে পাকিস্তান ও যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ অবলম্বনের জন্য তার গ্রেফতার দাবি তো করাই যায়।

ইকবাল সোবহান চৌধুরী আমার চাইতে বয়সে বড়। পেশাতেও সিনিয়র। উপদেশ দেয়া মানায় না। তবে সর্বশক্তিমানের কাছে প্রার্থনা করব তার সুস্থতা। তিনি যেন মানসিক ও দৈহিক অসুখ থেকে উদ্ধার পান। আর অনুরোধ করব, আলতু-ফালতু কথা বলা বাদ দিয়ে পেশাগত উত্কর্ষতার দিকে মন দেন। মরার আগে অন্তত দুই-চারটি বই লিখে যান। নইলে মৃত্যুর পর তার নাম নেয়ার লোকও তো দেশে পাওয়া যাবে না।

চার.

পাকিস্তান আমলের কথা। মুহম্মদ ইকবাল তখন পাকিস্তানের জাতীয় কবি। সে সময় বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর এ দেশের কয়েকজন কবি তত্পর হয়ে উঠেন পূর্ব পাকিস্তানের একজন জাতীয় কবি ঘোষণার জন্য। অনেকেই করাচি, রাওয়ালপিণ্ডিতে বিস্তর দৌড়ঝাঁপও করেন। বিষয়টাতে পাকিস্তানি শাসকরাও বেশ মজা পেয়ে যায়। তারাও একে বানাব, ওকে বানাব বলে খেলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি শাসকদের অনীহার কারণে সে সময়কার বড় বড় কবিদের উত্সাহে ভাটা পড়ে।

এরকম সময়ে কবি ফররুখ আহমদের কাছে এলেন একজন মশহুর কবি। বললেন, দেখুন ফররুখ ওরা কত নিষ্ঠুর। পূর্ব পাকিস্তানের ‘জাতীয় কবি’ হওয়ার মতো সমস্ত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ওরা আমাকে তা হতে দিচ্ছে না। আমার নখের সমান যার যোগ্যতা নেই, শুনছি তাকেই নাকি জাতীয় কবি করবে। আপনিই বলুন ফররুখ কাজটা কত বড় অন্যায় হবে। আরে ও তো একজন সামান্য কবি। আর আমি কত বড়। আসলে আমি তো পূর্ব পাকিস্তানের ইকবাল। বাংলা ভাষার ইকবাল। সেই আমাকে কিনা বঞ্চিত করা হবে। শুনে বড় কষ্ট লাগছে।

সব শুনে ফররুখ আহমদ বললেন, ভাই আপনার কষ্ট দেখে বড় মায়া হচ্ছে। সত্যিই তো আপনি পূর্ব পাকিস্তানের ইকবাল, কিন্তু একটা কথা না বলে পারছি না, আপনি ‘ইকবাল’ই বটে। তবে আপনার ‘ইক’টা নেই। বাকিটুকু আছে। সে জন্যই হয়তো এই অবিচার।

গল্পের পরের অংশ জানি না। তবে এখন মনে হয় আমাদের ইকবাল সোবহান চৌধুরীরও ‘ইক’টা খুলে পড়ে গেছে। সে জন্যই হয়তো দেখা দিয়েছে যত গণ্ডগোল।


পাঁচ.

শাহবাগ আমাদের জাতীয় সংসদ সদস্যদেরও মাথা বিগড়ে দিয়েছে। আর এই বিগড়ানোর প্রথম শিকারে পরিণত হয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র বিচারপতি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ভূঞা। তার অপরাধ তিনি নাকি অসদাচরণ করেছেন। কী অসদাচরণ করেছেন? ব্লগার রাজিব ইসলাম ও মহানবীকে অপমান করে তার ব্লগে যেসব জঘন্য অশ্লীল কথা লিখেছে সেগুলো ছাপিয়ে দেয় দৈনিক ইনকিলাব। সেইসব মিথ্যা, মনগড়া ও কুরুচিপূর্ণ লেখা ইসলাম ধর্ম অনুসারীরা তো দূরের কথা, কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে কয়েক লাইনও পাঠ করা সম্ভব নয়।

ইসলাম ধর্মের একজন অনুসারী হিসেবে, সমাজের একজন অভিভাবক হিসেবে, সত্য ও ন্যায়ের একজন সেবক হিসেবে—সেইসব মুদ্রিত লেখা ফটোকপি করে বিচারক ভূঞা তার জমাদারের মাধ্যমে তারই কয়েকজন সহকর্মী বিচারপতির কাছে পাঠিয়েছিলেন। আর যায় কোথায়, হা রে রে করে উঠলেন আওয়ামী লীগের আইনের মাস্তানরা। যারা এর আগে লাথি মেরে ভেঙে দিয়েছিলেন প্রধান বিচারপতির দরোজা। আদালতকে দেখিয়েছেন ঝাড়ু ও জুতা। তারা সংসদে এবং সংসদের বাইরে চিত্কার-চেঁচামেচির হাট বসালেন। তাদের সম্মিলিত হাউকাউয়ে যে কারও মনে হতেই পারে নিশ্চয়ই বিচারপতি ভূঞা অসদাচরণ করেছেন, কারও বউ ভাগিয়ে নিয়ে গেছেন অথবা আইন প্রতিমন্ত্রীকে কষে চড় লাগিয়েছেন।

অতএব তাদের দাবির মুখে অতি দ্রুততার সঙ্গে গঠিত হলো সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। আইন মন্ত্রণালয়ের পাঠানো প্রস্তাবও অতি দ্রুততার সঙ্গে অনুমোদন দিয়েছেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। যিনি এর আগে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত অনেক খুনিকে খালাস দিয়ে রেকর্ড স্থাপন করেছেন। প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের দু’জন বিচারপতি নিয়ে গঠিত কাউন্সিল এখন বিচার করবে বিচারপতি মিজানুর রহমান ভূঞার। এর আগে জাতীয় সংসদ সদস্য ও স্পিকারকে অজ্ঞ, মূর্খ ও দেশদ্রোহী বলে বিচারপতি শামসুদ্দিন আহমদ চৌধুরী বীরদর্পে হুঙ্কার ছাড়লে সংসদ মাথায় নিয়েছিলেন সংসদ সদস্যরা। সেবার অবশ্য কিল খেয়ে কিল হজম করার অনন্যসাধারণ নজির স্থাপন করে রহস্যজনক কারণে নিঃশব্দ হয়ে যান তারা। হাজার চিল্লাচিল্লি সত্ত্বেও গঠিত হয়নি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল।

দেশের সিনিয়র আইনজীবী যাদের মাথা এখনও বিগড়ে যায়নি তারা বলছেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের মতো কিছুই ঘটেনি তার কাজে। বিচারপতি পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন বিলি করেছেন মাত্র। এতে আচরণবিধি কোনোক্রমেই লঙ্ঘিত হয়নি। ইসলাম ধর্ম ও রাসুলকে অপমান করা হলে একজন মুসলমানের অন্তরে আঘাত লাগা স্বাভাবিক। কোনো ধর্মকেই কটাক্ষ করার অধিকার কারও নেই। তিনি যা করেছেন তা একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমানের মতোই করেছেন, তাও করেছেন নিজের সহকর্মীর সঙ্গে। এতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের মতো কিছুই ঘটেনি।

কিন্তু এখন তো চলছে উন্মাদনার যুগ। আমরা বাস করছি উন্মাদনার যুগে। অস্থিরতার যুগে। রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদের সময়ে। এখানে ন্যায়ের কথা, বিবেকের কথা কে শোনে। সরকারের কেউ একবারও ভাবল না একজন বিচারপতিও তো মানুষ। তিনিও তো ধর্মপ্রাণ সামাজিক মানুষ। তারও বিশ্বাসের জগত্ আছে। তিনি তো সেই জায়গা থেকেই জীবনযাপন করেন। কিন্তু তিনি তো রাজনীতিবিদদের মতো গলাবাজি করেননি। পাবলিক নুইসেন্স সৃষ্টি করেননি। হাঙ্গামা বাধাননি। সম্মান ও মর্যাদার অবস্থান থেকে সরে যাননি। তারপরও তাকেই বানানো হচ্ছে বলির পাঁঠা। আর ধর্মদ্রোহী, অশান্তি সৃষ্টিকারী, রক্তপাত ডেকে আনা ব্লগার হয়ে উঠেছেন ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ।’ চমত্কার! অতি চমত্কার!!

ছয়.

সরকার শাহবাগ-কাণ্ডের মধ্য দিয়ে মাথা খারাপ করে দিয়েছে দেশের শিশু-কিশোরদের। তারই মর্মান্তিক নজির নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জের বসুরহাট পৌরসভার লবণ বেপারি বাড়ির ১৩ বছরের আবদুর রহমান সাকিল। শাহবাগ এবং আমাদের কাণ্ডজ্ঞানহীন মিডিয়ার হিংস্র প্রচারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ফাঁসির অভিনয় করতে গিয়ে গলায় ফাঁস আটকে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দুর্ভাগ্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করে সাকিল। এই অনাকঙ্ক্ষিত মৃত্যুর জবাব কে দেবে? শাহবাগ নাকি সরকার, নাকি আমাদের গণমাধ্যম? কার পাপে এসব হিংস্রতায় জর্জরিত হচ্ছে আমাদের সন্তানরা?

আমাদের সরকার ও শাহবাগের মিলিত তত্পরতার আরেক রক্ত হিম করা দৃষ্টান্ত মানিকগঞ্জের সিংগাইরের গোবিন্দল ও জৈল্যা গ্রাম। শুধু জামায়াত-শিবির নয়, আলেম-ওলামা নয়, বিএনপির লোকদেরও এখন পাখির মতো গুলি করে মারছে এই সরকারের রক্তপিপাসু বাহিনী।

এই দুটি গ্রামের আকাশ-বাতাসে এখন ভেসে বেড়াচ্ছে বারুদ ও রক্তের দুর্বিষহ গন্ধ। দৈনিক মানবজমিন লিখেছে, পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন দুই গ্রামের চারজন। গুলিবিদ্ধ হেলেনার প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে নিহত হয়েছেন কুড়া-ভূষির দোকানদার নাসির উদ্দিন (২৬)। জমি থেকে সরিষা আনতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন কৃষক আলমগীর (৩০)। ইউপি চেয়ারম্যানের দিকে ছোড়া গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় ঘটনাস্থলেই মারা যান মসজিদের ইমাম শাহ আলম (২৪)। মিছিল থেকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে দুবাই প্রবাসী নাজিমউদ্দিনকে (২৫)। গতকাল সরেজমিন এলাকায় গেলে গ্রামবাসীরা জানান এসব তথ্য। তাদের তথ্য মতে, নিখোঁজ রয়েছেন এসএসসি পরীক্ষার্থীসহ আরও ক’জন। সেই সঙ্গে গ্রেফতার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন গ্রামের প্রায় ৭ হাজার পুরুষ।

প্রত্যক্ষদর্শী ও এলাকাবাসী জানান, নবীজীর অবমাননা তারা সইতে পারেননি। এ কারণে মিছিল করেছেন। সকাল থেকেই রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তখন থেকেই শত শত মিছিলকারীর নিরাপত্তা দিয়েছে সিংগাইরের থানা পুলিশ। তাদের হেফাজতেই তারা রাস্তায় শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করছিলেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সিংগাইর সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেওয়ান মাহবুবুর রহমান ও কয়েকজন কমিশনারের হস্তক্ষেপে কর্মসূচি শেষ করে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তারা। ঠিক সেই মুহূর্তে সিংগাইর থানা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি আবদুল মাজেদ খানের নির্দেশে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালায় মিছিলকারীদের ওপর। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় পুলিশ। তারপর শুরু হয় বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ। না সরকার এই হত্যাযজ্ঞের জন্য কোনো তদন্ত কমিটি তো করেইনি, উল্টো গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে লাগিয়ে দিয়েছে মামলার পর মামলা। ঘাতকরা নয়, নিহতরাই অপরাধী। চমত্কার! অতি চমত্কার!!

সাত.

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি আপনার শপথ ভঙ্গ করে, দেশ ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিনাশ করে, শান্তি, সম্প্রীতি, ন্যায়, নৈতিকতা ও আইনকে ধূলিসাত্ করে ডেকে এনেছেন নৈরাজ্য, সন্ত্রাস, আতঙ্ক ও রক্তপাত। আপনার দুই হাতে এখন শত শত মানুষের রক্ত, নিরস্ত্র-নিরপরাধ মানুষের রক্ত। এই রক্ত ধুয়ে-মুঝে সাফ করার মতো কোনো পানি বাংলাদেশের নদ-নদীতে নেই। বিশ্বের কোথাও নেই। এই রক্ত সারা জীবন আপনাকে তাড়া করে ফিরবে। এই রক্ত আপনার জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলবে। আপনাকে ঘুমাতে দেবে না কোনো দিন। সেই রকমভাবে, যেভাবে রাজা ডানকানের রক্ত উন্মাদ করে দিয়েছিল লেডি ম্যাকবেথকে।

পুলিশকে বলি জনগণ কুকুর-বিড়াল নয়, পাখিও নয়। তারাও মানুষ। তাদেরই ট্যাক্সের টাকায় চলে আপনাদের সংসার। একটি বিকারগ্রস্ত সরকারকে খুশি করতে গিয়ে সেই অন্নদাতা জনগণের ওপর গুলি চালাবেন না। তাদের হত্যা করবেন না। জনগণকে রক্ষা করুন। আপনাদেরও মনে রাখতে হবে এ সরকারই শেষ সরকার নয়। জবাবদিহি আপনাদেরও করতে হবে একদিন।

জনগণের উদ্দেশে আমার আবেদন, সরকারের হাতে আর একটি অস্ত্র আছে, তার নাম সাম্প্রদায়িকতা। পুরো বিষয় থেকে বিশ্ববিবেককে বিভ্রান্ত করে আন্দোলনকারীদের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে পার পাওয়ার জন্য সরকার রামু স্টাইলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাতে পারে। সেজন্য সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকতে হবে সবাইকে। সরকারের শয়তানিকে সফল হতে দেয়া যাবে না।

আরও একটা কথা—প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কারা কারা হত্যাকাণ্ডে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে, কারা জনগণের ওপর জুলুম করছে, তাদের তালিকা প্রণয়ন করে রাখেন।

যখন সময় আসবে তখন যাতে এদের আইনের হাতে সোপর্দ করা যায় সেজন্যই এ ব্যবস্থা।



সূত্র

বিষয়: বিবিধ

১২৯১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File