তাহরির স্কয়ার থেকে শাহবাগ অনেক দূর- সি রা জু র র হ মা ন
লিখেছেন লিখেছেন সোনার বাংলার আহমদ ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ১০:১৯:৪৫ সকাল
তাহরির স্কয়ারের সঙ্গে শাহবাগ মোড়ের দূরত্ব অনেক। শুধু কয়েক হাজার মাইলেরই নয়। এই দুই সমাবেশের প্রকৃতি এবং উদ্দেশ্যও সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। মিসরের সাবেক স্বৈরশাসক হোসনি মোবারক যদি নিজের গদি বাঁচানোর জন্য চেলা-চামুণ্ডাদের দিয়ে হুজুগ সৃষ্টি করে তাহরির স্কয়ারে হাজার হাজার লোকের সমাবেশ ঘটাতেন তাহলে শাহবাগ মোড়ের সঙ্গে তার যথার্থ তুলনা সম্ভব হতো। বাস্তবে কিন্তু পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত। মোবারকের ৩০ বছর স্থায়ী স্বৈরশাসনের উত্খাতের জন্যই তাহরির স্কয়ারে মিসরীয় জনতা ভিড় করেছিল। কোনো অত্যাচারী স্বৈরশাসকের পতন ঘটানোর জন্য শাহবাগে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ জড়ো হচ্ছে না। বরং এমন একটি সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উস্কানিতে এ সমাবেশটি ঘটেছে যে সরকার সম্পূর্ণ জনসমর্থনবিহীন হলেও অগণতান্ত্রিক পন্থায় এবং একটি বিদেশি শক্তির সহায়তায় বাকশালী স্বৈরতন্ত্র কায়েম করতে চায়।
কী ছিল শাহবাগ সমাবেশের উদ্দেশ্য? একটি বিতর্কিত এবং প্রশ্নবিদ্ধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপতিরা কাদের মোল্লা নামক এক ব্যক্তির বিচার করছিলেন ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে। শেষে তারা রায় দিয়েছেন। সে রায়ে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। সরকার তাতে খুশি নয়। আরও বহু লোক অসন্তুষ্ট সে রায়ে। প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী প্রমুখ সরকারি নেতারা কৃত্রিম রোষে ফেটে পড়েছেন বিচারকদের বিরুদ্ধে। বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে তারা বিচারকদের এবং ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে আবেগপরায়ণ তরুণ সমাজকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। সরকারের পোষ্য মিডিয়া দিনরাত্রি অবিরাম তাতে ইন্ধন জোগাচ্ছে। এ কাজে সরকারকে মদত দিচ্ছে কয়েকটি গোষ্ঠী, যাদের কোনো কোনোটি বিদেশি শক্তির স্বার্থে কাজ করে বলে সাধারণের বিশ্বাস। আরও কোনো কোনো গোষ্ঠী যে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নয় সদাসর্বদা প্রমাণ পাওয়া যায়।
তাহরির স্কয়ারের জনতা হোসনি মোবারকের স্বৈরশাসনকে টেনে নামাতে চেয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত নামিয়েছে। তাদের দাবিতে মোবারককে বিচারে চড়ানো হয়েছে, হাসপাতালের বেডে করে এনে আদালতে লোহার খাঁচার ভেতর তাকে রাখা হয় শুনানির সময়। শাহবাগের জনতা সরকারের কৃত্রিম রোষকেই ফেনিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলেছে। ‘মব সাইকোলজি’ (জনতার মনঃস্তত্ত্ব) বলে একটা কথা অনেকেরই জানা আছে। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এখন ঘটছে শাহবাগে। দুটি-একটি ছেলে পথে বেরুলে তারা শান্ত-শিষ্ট থাকে, কিন্তু দশ-বারোটি জড়ো হলে তারা পরস্পরকে বাহাদুরি দেখানোর জন্যও বালিকা ও মহিলাদের উত্ত্যক্ত করে, পথের নিরীহ কোনো ছেলেকে মারধর করে, নিদেন কারও বাড়ির জানালায় ঢিল ছোড়ে। দু’চারজন লোক হয়তো চোরকে চোর বলে ধাওয়া করে। কিন্তু একটা জনতা জড়ো হলে উপস্থিত কাউকে পিটিয়ে চোর বলে হত্যা করে—সে লোকটির বিরুদ্ধে চুরির কোনো প্রমাণ থাক কিংবা নাই থাক। শাহবাগে ঠিক তা-ই ঘটছে। কেউ একজন ধ্বনি তুললেই হলো যে কাকে কান নিয়ে গেছে। হাজারো জনতা তখন ধ্বনি তুলল, কাকে কান নিয়ে গেছে, ধরো কাক, মারো তাকে।
জনতার মাথার রক্তচাপ যখন বেড়ে যায় তারা কিছু ভেবে দেখে না—এই হচ্ছে ‘ম্যাস হিস্টিরিয়া’র বৈশিষ্ট্য। যে আইনে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল, সরকার এখন সে আইন সংশোধনের জন্য আইন পাস করেছে। কিন্তু সেজন্য জনতাকে ক্ষেপিয়ে তোলার, শাহবাগে হাজার হাজার মানুষ জড়ো করার কী প্রয়োজন ছিল? আরও একটা কথা ভেবে দেখার সময় নেই আবেগোন্মাদ জনতার; এই যে এতদিন ধরে শাহবাগের মোড়ে হাজার হাজার লোককে খাবার দেয়া হচ্ছে, মিনারেল ওয়াটারের বোতল দেয়া হচ্ছে, কে তার ব্যয় জোগাচ্ছে? কীভাবে এবং কী উদ্দেশ্যে? এ বিষয়গুলো ভেবে দেখলেই মাথার রক্তচাপ নেমে যাবে, শাহবাগের মোড় থেকে ঘরের পথে পা বাড়াবে জনতা।
ওদের মাথায় নুন আর বরই খাচ্ছে সরকার
জনতাকে দিয়ে স্লোগান দেয়ানো হচ্ছে। আসলে তাদের দোহাই দিয়ে এবং তাদের মাথায় নুন রেখে বরই (কুল) খাচ্ছে সরকার। বিএনপির কানে কোন মন্ত্র দিয়ে সরকার তাদের বেগবান আন্দোলনের স্রোতে চড়া পড়তে দিয়েছে কে জানে! কিন্তু জনতা ঘুমিয়ে থাকতে রাজি ছিল না। তাদের অনেকে জামায়াতে ইসলামের আন্দোলনে গিয়ে ভিড়তে শুরু করেছে। তাদের জোয়ার খরস্রোতা হয়ে উঠছে। সরকার সর্বনাশ গুনছে তাতে। সুতরাং জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতির ময়দান থেকে সরিয়ে দেয়া দরকার। ইংরেজি প্রবাদে বলে ‘গিভ দ্য ডগ এ ব্যাড নেম অ্যান্ড হ্যাঙ্গ ইট’—কুকুরকে দুর্নাম দাও তাহলে তাকে ফাঁসি দেয়া যাবে। জামায়াতে ইসলামকে সত্য-মিথ্যা দুর্নাম দেয়ার কত যে চেষ্টা শাহবাগে এবং অন্যত্র চলছে এখন ভাবলে স্তম্ভিত হতে হয়। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা গেলে বিচ্ছিন্ন, হতাশাক্লান্ত বিএনপিকে খতম করা কঠিন হবে না। অনেক আগেই আমি বিএনপিকে হুশিয়ার করে দিয়েছিলাম : ২০১২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি মেনে নিতে বাধ্য করুন, নইলে তাদের ঠেলে গদি থেকে ফেলে দিন। গড়িমসি করার পরিণতি মারাত্মক হবে। সে মারাত্মক পরিণতিই এখন দেখছে বাংলাদেশের মানুষ।
শাহবাগের টেকনিকটা এ রকম। জনতার পেছন থেকে সরকারের কিংবা র’এর কেউ একজন চর স্লোগান তুলল, জামায়াতকে নিষিদ্ধ কর। সেই যে ধ্বনি উঠল সরকারের পোষ্য মিডিয়া ঢাক পিটিয়ে সেটাকে কান-ফাটানো করে তুলল। এটাই শুধু দরকার ছিল সরকারের। বাংলাদেশে অন্যায় যা ঘটছে তার সবগুলোর দোষই এখন চাপানো হচ্ছে জামায়াতের ঘাড়ে। এমনকি আওয়ামী লীগ ক্যাডারদের কৃত দুষ্কর্মগুলোও। মন্ত্রীরাও এখন বার বার করে এ দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিচ্ছেন। আর প্রধানমন্ত্রী বলছেন বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকার জামায়াতের নেই। বাংলাদেশে কার কী অধিকার আছে স্থির করেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। হায়, কোথায় গেছে সেসব দিন! নিজামীর পাশে বসে শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার সরকারকে টেনে নামানোর ষড়যন্ত্র করছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে হরতাল করেছিলেন, বহু মানুষ খুন হয়েছিল সে হরতালে।
জামায়াত আর শিবিরের তত্পরতায় ১৯৯৬ সালের সে আন্দোলন সফল হয়েছিল। সে বছরের জুন মাসের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় হয়েছিল; কিন্তু সংসদে তারা নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পায়নি। জামায়াত অল্প কয়টি সংসদীয় আসন পেয়েছিল। কিন্তু তাদের সমর্থন হাসিনাকে সরকার গঠনের জন্য যথেষ্ট গরিষ্ঠতা দিয়েছিল। মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনগুলো পাওয়ার পর জামায়াতের সমর্থনের প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছিল শেখ হাসিনার জন্য। কিন্তু তিনি তখনই জামায়াত আর শিবিরের সুশৃঙ্খল আন্দোলনের শক্তিমত্তার পরিচয় পেয়েছিলেন। জামায়াতকে নিয়ে বিএনপির আন্দোলন করাকে সে জন্যই তিনি এত ভয় পান। যে কোনো উপায়ে বিএনপি আর জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হাসিনা ও আওয়ামী লীগের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
শাহবাগের সমাবেশ স্বতস্ফুর্ত নয়। স্বতস্ফুর্ত ছিল তাহরির স্কয়ার। বরং কার্যত শাহবাগকে ব্যবহার করা হচ্ছে একটা রুদ্ধদ্বার আইন পরিষদের মতো। সরকারের ইচ্ছামত বিল ও প্রস্তাবগুলো সদস্যদের সমর্থন করতেই হবে, নইলে তারা ছাড়া পাবেন না। শাহবাগের হিস্টিরিয়াগ্রস্ত জনতা বলছে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করতে হবে। সরকার ও প্রধানমন্ত্রী তাতে উল্লসিত। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এখন বলছেন, বাংলাদেশে জামায়াত আর শিবিরের রাজনীতি করার অধিকার নেই। বাংলাদেশে কে রাজনীতি করবে আর কে করবে না শেখ হাসিনা এরই মধ্যে সে সিদ্ধান্ত স্বহস্তে তুলে নিয়েছেন।
মিডিয়া এখন তোপের মুখে
প্রস্তুতিপর্বও চলছে জোরেশোরে। রাজীব হায়দার নামে একজন ব্লগারকে রাতের আঁধারে কুপিয়ে কুপিয়ে অমানুষিকভাবে হত্যা করা হয়েছে। কে বা কারা এ জঘন্য কাজ করেছে এখনও প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু এ হত্যাকে ব্যবহার করে যতটুকু রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করা যায় তার শেষবিন্দু পর্যন্ত শুষে নিচ্ছে সরকার। হত্যার পরের দিন সকালেই প্রথমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কোলাবোরেটর আলমগীর খান মহীউদ্দীন আর তারপর খোদ প্রধানমন্ত্রী গেলেন নিহতের বাড়ি। বহু ভিডিও আর আলোকচিত্র তোলা ও ব্যবহার করা হয়েছে তাদের সে ভিজিটের।
‘শহীদ রাজীবের’ গৌরব কীর্তন করে গান গাইতে কলকাতা থেকে শিল্পী এসেছেন, কলকাতার ব্লগগুলো মুখর হয়ে উঠেছে, শাহবাগে স্মৃতিসৌধ তৈরি হচ্ছে। শাহবাগে যারা জড়ো হয়েছে তাদের একজনও কি জিজ্ঞেস করেছে, হাসিনার সরকারের চার বছরে কত লোকই তো খুন হলো, কতজনকে জবাই করা হলো, প্রধানমন্ত্রী তাদের কতজনকে দেখতে গিয়েছিলেন? রাজীবকে জবাই করা হয়েছে। মন্ত্রীরা, জনতা আর মিডিয়া ফলাও করে সেটা প্রচার করছে। মানুষ জবাই করা অবশ্যই জঘন্যতম হত্যা। কিন্তু বিগত দু’সপ্তাহে শাহবাগে অজস্র সহস্রবার কি স্লোগান দেয়া হয়নি—ফাঁসি চাই, শিবির ধরো, জবাই করো? এই ধ্বনিগুলো যারা দিয়েছে রাজীব হায়দারের মর্মান্তিক হত্যায় আতঙ্ক প্রচার করার অধিকার কে দিয়েছে তাদের? এই স্লোগানগুলো যারা লিখে দিচ্ছে শিশুদের গালে তাদের মানুষ বলতে আমার বিবেকে বাধে।
আগেই বলেছি, সরকার যা করতে চায় আগে সেটা শাহবাগের জনতাকে দিয়ে বলিয়ে নিচ্ছে। কিছু সমালেচনা উঠেছিল (খুব সম্ভবত সরকারি উদ্যোগ) সোনার বাংলাদেশ ব্লগের। কালবিলম্ব না করে সে ব্লগটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সরকারের বিন্দুমাত্র সমালোচনা করছে মিডিয়ার যে অংশ সেগুলোও বন্ধ করতে চায় সরকার। কেননা, দেশের মানুষ বিশ্বাস করছে তাদের কথা, সরকারের প্রচারযন্ত্রগুলোকে নয়। দিগন্ত টেলিভিশন, নয়া দিগন্ত, আমার দেশ, দিনকাল আর সংগ্রাম পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ করার জন্য দাবি ওঠানো হচ্ছে একই কায়দায়। কোনো না কোনো সুযোগে এই পত্রিকাগুলোকেও নিষিদ্ধ করা সরকারের পরিকল্পনা। কিন্তু নিজেরা দায়িত্ব না নিয়ে তারা ‘জন দাবি, জন দাবি’, করে দোষ চাপানোর চেষ্টা করছে শাহবাগে সমবেত আবেগোন্মাদ জনতার ঘাড়ে।
গোড়া থেকে এই সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে চেয়েছে। সেটা তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির অন্তর্ভুক্ত ছিল। অন্য কোনো প্রতিশ্রুতি (পদ্মা সেতুসহ) তারা পালন করতে পারেনি, সুতরাং এ প্রতিশ্রুতি তাদের মান বাঁচানোর শেষ সম্বল। কথা হচ্ছে, তারা কি বিচার চায়, না ফাঁসি? বিচার এবং ফাঁসি এক ব্যাপার নয়। যে মুহূর্তে মামলা আদালতে সোপর্দ করে দেয়া হলো সে মুহূর্ত থেকে সে মামলার রায় সম্পূর্ণরূপে বিচারকদের ওপর নির্ভর করবে। বিচারে অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ করা, বিচারের গতিকে প্রভাবিত করা (পারভার্টিং দ্য কোর্স অব জাস্টিস) সব দেশের আইনেই জঘন্য অপরাধ। ড্রাইভিংয়ের স্পিড লিমিট সংক্রান্ত সামান্য একটি ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলে বর্তমান ব্রিটিশ সরকারের সাবেক মন্ত্রী ক্রিস হিউন বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি সরকার থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, আদালতে তার বিচার হয়েছে, তিনি এখন জেল খাটছেন। তার সাবেক স্ত্রী তার কথায় তখন সায় দিয়েছিলেন। আদালতে এখন তার বিরুদ্ধেও বিচার হচ্ছে।
রাজনৈতিক ফাঁসি বিচারকে অস্বীকার করার শামিল
বিচারের উদ্দেশ্য হচ্ছে অপরাধ প্রমাণ করা, দোষীকে শাস্তি দেয়া। কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। শুনেছি তিনি এখন মালির কাজ করছেন। যদি তিনি সত্যি অপরাধ করে থাকেন বাকি জীবন সেজন্য পস্তাতে থাকবেন। আমার মনে হয় ফাঁসি দিলে কাদের মোল্লা বরং খুশিই হবেন, বহু বহু বছরের ভোগান্তি আর অনুশোচনা থেকে বেঁচে যাবেন তিনি। কিন্তু তার রায় নিয়ে সরকার এখন যা করছে এবং করতে চাচ্ছে সেটা রীতিমত বিচারের প্রক্রিয়া বিকৃত এবং রায়কে প্রভাবিত করার অপচেষ্টা। এবং সেটা ফৌজদারি আইনে অপরাধ। অপরাধের বিচার সবাই চায়। কিন্তু প্রতিহিংসা বিচার নয়। বিচারের নামে প্রতিহিংসা সেজন্যই নিন্দনীয় এবং সব বিবেকবান মানুষের উচিত তার বিরোধিতা করা।
বিশ্বজুড়ে ফাঁসি ও প্রাণদণ্ড এখন বিলুপ্তির পথে। ইউরোপ-উত্তর আমেরিকা তো বটেই, আফ্রিকারও অনেক দেশ এখন প্রাণদণ্ড রহিত করেছে। এমতাবস্থায় যে প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশে রক্ত-পিপাসার হিস্টিরিয়া তৈরি করা হচ্ছে এবং যে প্রক্রিয়ায় আইন পরিবর্তন করা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। সর্বপ্রধান দুটি মানবাধিকার সংস্থা—লন্ডনের অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং নিউইয়র্কভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সরকারের ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং বিচারের প্রক্রিয়ার ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা আগেই বলেছে। এখন তারা বলেছে, সরকার অভিযুক্তদের ফাঁসি দেয়ার মতলবে যেভাবে আইন সংশোধন করতে যাচ্ছে সেটাও বৈধ হচ্ছে না। তারা বলেছে ১৯৯৩ সাল থেকে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত এবং অন্যান্য যেখানে মানবাধিকারের অবমাননা, যুদ্ধাপরাধ, এমনকি গণহত্যারও বিচার হচ্ছে সেগুলোতে কোথাও প্রাণদণ্ডের বিধান থাকছে না।
কিন্তু কার কথা কে শোনে? প্রতিহিংসার বাসনা নিয়ে এ সরকার ক্ষমতায় এসেছিল, চার বছর ধরে প্রতিহিংসার বিষ দিয়ে তারা বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস বিষাক্ত করে দিয়েছে। এখন তারা সে প্রতিহিংসার বাসনা থেকেই ‘ক্যাঙ্গারু কোর্টের’ বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে এখন দুঃস্বপ্নের কালো রাত চলছে। শান্তিকামী সমাজব্যবস্থা, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার এবং গণতন্ত্রের ইনস্টিটিউশনগুলোকে হত্যা করা হয়েছে। এমনকি স্বাধীন রাষ্ট্রের অস্তিত্বও এখন বিপন্ন। একটা উন্মাদ সরকার কখন কাকে রাখে আর কাকে মারে সম্পূর্ণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। হতাশায় কালো হয়ে গেছে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। কিন্তু দেশের মানুষকে এখন হতাশ হলে চলবে না। আমরা যারা অনেক দেখেছি তারা জানি যে সূর্য ওঠার আগে রাতের শেষ প্রহরটিই সবচাইতে আঁধার হয়। (লন্ডন, ১৮.০২.১৩)
সূত্র
বিষয়: বিবিধ
১১৯৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন