পিতামাতার প্রতি দায়িত্ব
লিখেছেন লিখেছেন জোনাকি ০৬ জুলাই, ২০১৪, ০৪:৪৯:০৯ রাত
“মুসা ট্র্যাশটা নিয়ে যাওতো।” মুসা খেলতে যাওয়ার সময় বলি আমি। “পরে নিব আম্মু।” এই বলে জুতা গলিয়ে চলে যেতে লাগলে মুসার বন্ধু এরিক দৌড়ে আসে, “Let me throw away trash please।” “মুসা গোসল করে নাও।” পরে করছি বলে খেলা চালিয়ে যেতে থাকলে এরিক বলে, “Listen to your mom first; go take a shower!” এরিকের সামনে মুসা “না” বলে পার পায়না। সে মুসাকে করিয়ে ছাড়ে, অথবা নিজে করে। এরিক প্রসঙ্গক্রমে প্রায়ই এমন উক্তি করতো, “You have to listen to your mom.” “Never say no to her.” Ahmed, you are lucky; you should be thankful for her.” একদিন সে আমাদের বাসায় রাতে থাকলো, সকালে আমি রাইস ক্রিস্পি বার বানিয়েছি। সে কি খুশী! তার আব্বু খোঁজ নিতে ফোন করলে প্রথমেই যে কথাটা বল্লো তা হলো, Dad, guess what! Ahmeds mom made a rice crispy treat; it’s so delicious! মার হাতের home maid treat তার কাছে খুব স্পেশাল ব্যাপার। আমি রান্না করতে লাগলে সে এসে পাশে দাঁড়িয়ে দেখে যেন কোন বিশেষ ঘটনা ঘটছে এমন আনন্দ পায়। মজা করে খায় যে কোন সাধারণ খাবার, আর অন্যান্য বন্ধুদের বলে, Ahmeds mom is the world’s best chef! এরিকের মাতৃ প্রিতীর কথা বলে শেষ করা যাবেনা। মায়ের সাথে রিলেটেড তুচ্ছ ব্যাপার তার কাছে মহান। মা বিষয়টা ওর কাছে amazing! কারন ওর মা নাই। সে এক সিংগল ভদ্রলোকের এডপ্টেড সান। তাই মা তার কাছে এত কদরের, স্বপনের। মার সার্ভিসকে এরিকের মত আমরা এপ্রিশিয়েট করতে পারিনা, আমরা মনে করি এ আমাদের প্রাপ্য, অথবা মনে করি এতো ব্যাপার...কোরান হাদিসে সুস্পষ্টভাবে মা বাবার প্রতি দায়িত্ব কর্তব্যসমূহ - সদাচরণের আদেশ এবং অসদাচরণ থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে যা সিন্সিয়ারলি মেনে চললে আমাদের দুনিয়া ও আখিরাত সুন্দর হবে।
কোরানে মাবাবার সাথে সদাচরণকে তাওহীদের পরেই স্থান দেয়া হয়েছে। আল্লাহ্র আনুগত্য ও কৃতজ্ঞতার সাথে জোড়া করে মা বাবার আনুগত্য ও কৃতজ্ঞতাকে উল্লেখ করে এর গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। যেমন, “আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না এবং মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো।” (বনি ইসরাইল, ২৩)“আমার প্রতি এবং তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও।” (লুকমান, ১৪) সুরা লুকমান ও আহকাফে মার গর্ভ ও দুধদান কালীন কষ্টকর সময়ের বর্ণনা দিয়ে বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্শন করা হয়েছে যেন মার প্রতি মানুষ আরো সদয় হয়। যেমন, "তার মা তাকে কষ্টসহকারে গর্ভে ধারণ করেছে এবং কষ্টসহকারে প্রসব করেছে। তাকে গর্ভে ধারণ করতে ও তার দুধ ছাড়তে লেগেছে ত্রিশ মাস।"(আহকাফ, ১৫) একটি বিখ্যাত হাদিসের সারসংখেপ হলো, একব্যাক্তি নবীজিকে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমার কাছে সবচেয়ে উত্তম ব্যবহার পাওয়ার অধীকারি কে? তখন নবীজি তিনবার মার কথা এবং চথুর্তবার বাবার কথা বলেছেন।(আবু হুরাইরা, বুখারি) এখানে সুস্পষ্ট ভাবে মাকে সম্মান দেয়া হয়েছে।তবে মায়ের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশে কিন্তু বাবার মাহাত্ব ক্ষুন্য হয়না। বাবার স্থানও কোরান, হাদিসের দৃষ্টিতে মহীয়ান: “পিতার সন্তষ্টি-ই আল্লাহ্র সন্তুষ্টি এবং পিতার অসন্তষ্টিতে আল্লাহ্র আসন্তষ্টি।” (আব্দুল্লাহ ইবন আমর, তিরমিজি) বাবার মর্যাদা ও তাকে খুশী রাখার আবশ্যকীয়তা বোঝার জন্য এই হাদিসই যথেষ্ট। তবু আর একটি হাদিস বলছি, ‘পিতা জান্নাতের একটি দরজা, এখন তোমাদের ইচ্ছা এর হেফাজত করো অথবা একে বিনষ্ট করে দাও।’( আবু দারদা, মুসনাদ আহমাদ, তিরমিজি, ইবনে মাজাহ)
কোরানে মাবাবার সাথে ইহসান করা বলতে সুন্দর ও সম্মানজনক আচরণ ও সেবাযত্ন করা বোঝানো হয়েছে। জ্ঞ্যনি ব্যাক্তিরা কোরান হাদিসের শিক্ষা গভীরভাবে অণুধাবন করে বলে তারা মাবাবার প্রতি খুব বিনয়ী ও ত্যাগি হয়। নবীজি এক গল্প বলেছিলেন সাহাবিদেরকে, যা আমারা অনেকেই জানি। একদিন তিন ব্যাক্তি পাহাড়ের গুহায় আটকা পড়ে নিজেদের ভালো কাজের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ্র কাছে মুক্তির জন্য দোয়া করতে লাগলো। প্রথম ব্যক্তিটি বললো, আমি প্রতিদিন কাজ থেকে এসে দুধ দুয়ে সন্তানদের আগে বৃদ্ধ মা বাবাকে খাওয়াই, একদিন ফিরতে দেরি হওয়ায় ক্ষুধার্ত অবস্থায় মা বাবা ঘুমিয়ে গেলে দুধের বাটি নিয়ে সারারাত তাদের শিয়রে দাঁড়িয়ে থাকলাম যেন তাদের ঘুম ভাঙলেই খাওয়াতে পারি। ইয়া আল্লাহ্, এই কাজ যদি তোমার সন্তষ্টির জন্য করে থাকি তাহলে এই পাথর সরিয়ে আমাদের বের হবার পথ করে দাও। তখন পাথরটা এতটা সরে গেল যে তারা স্পষ্টভাবে আকাশ দেখতে পেলো। এটি ইহসানের একটি নিখুঁত উদাহারণ।
এইসব উদাহারণ সামনে থাকলে আমরা বুঝবো যে মা বাবার সাথে আরো ভালো ব্যাবহার এবং আরো সেবাযত্ন করতে হবে। তখন তাদেরকে দোষ দিবোনা যে এত করি, অত করি, সবি তো করছি তাও মা/বাবা আমার উপর সন্তষ্ট নয়। বরং আমরা ভালো পারছিনা, কখনই পারবোনা মাবাবার ঋণ শোধ করতে এই ভেবে দোয়া করতে হবেঃ “হে আল্লাহ! আমার মা-বাবার প্রতি আপনি দয়া করুন, যেমনি তাঁরা শিশুকালে আমার প্রতি দয়া করেছেন।"(বনি-ইসরাইল ৩৪)
বৃদ্ধ অবস্থায় মাবাবার সেবাযত্নের জোর তাকিত করা হয়েছে হাদিসে যেমন, "সে ব্যাক্তি অপমানিত হোক, যে তার মাতা-পিতাকে বৃদ্ধাবস্হায় পেয়েও তাদের সাবাযত্ন করে জান্নাতে যেতে পারলোনা।" (আবু হুরাইরা, মুসলিম) বাধ্যগত সন্তানের দৃষ্টিরও দাম কত দেখুন, "যে সেবাযত্নকারী সন্তান পিতামাতার দিকে দয়া ও ভালোবাসা সহকারে দৃষ্টিপাত করে, তার প্রত্যেক দৃষ্টির বিনিময়ে সে একটি মকবুল হজের সওয়াব পায়। লোকেরা আরজ করল ইয়া রাসূলাল্লাহ সাঃ সে যদি দৈনিক এক শ’বার এভাবে দৃষ্টিপাত করে? তিনি বললেন, হ্যা, এক শ’বার দৃষ্টিপাত করলেও প্রত্যেক দৃষ্টির বিনিময়ে এই সওয়াব পেতে থাকবে। (আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস)
অন্যদিকে মাবাবার অবাধ্যতা কবিরা গুনাহ; যা দুনিয়া আখিরাতে দুর্দশা ও ব্যার্থতা ডেকে আনে। মাবাবার প্রতি দুরাচারী হওয়া মানে নিজের অস্তিত্বের উপর জুলুম করা। কারণ তারা আমাদের অস্তিত্বের অংশ। মাবাবার সাথে দ্বিমত বা সংঘাত হতে পারে, এ ক্ষেত্রেও ভদ্রভাবে মিটমাটের চেষ্টা করা উচিত। যেমন, আবু হুরাইরা তার মাকে ইসলামের দাওয়াত দিলে তার মা রেগে যেত, ইসলাম সম্পর্কে কটুক্তি করতো। একদিন তার মা ক্ষেপে গিয়ে নবীজিকে গালমন্দ করেন; এতে আবু হুরাইরার হৃদয় ভেঙে গেলেও মার সাথে উচ্চবাচ্য না করে কাঁদতে কাঁদতে নবীজির কাছে যান এবং মার জন্য দোয়া করতে বলেন। এহেন দুর্ব্যাবহারের পরও আবু হুরাইরার ধৈর্য ও বিনয় নিশচয়ই তার মাকে প্রভাবিত করেছিল, আর আল্লাহ্ও খুশী হয়েছিলেন তার দ্বন্দ্ব মোকাবেলার আদব ও পদ্ধতিতে, তাই নবীজির দোয়া আল্লাহ্ কবুল করে আবু হুরাইরাকে মুসলিম মা উপহার দেন।
মাবাবার অবাধ্যতার ফলাফল দুনিয়াতেই পাওয়া যায়ঃ “আল্লাহ যে গুনাহর শাস্তি চান কিয়ামাতের দিন পর্যন্ত বিলম্বিত করেন। কিন্তু মাতাপিতার নাফরমানির শাস্তি মৃত্যর পুর্বে জীবিত অবস্থায় প্রদান করা হয় (আবি বাকরা, রাওয়াহুল হাকিম)।” মাবাবার অবাধ্যতায় ভালোকাজও ফলহীন হতে পারেঃ “তিনটি গুনাহ এমন যে, তার সাথে কোন নেকী কাজ দেয় না, শিরক, মাতাপিতার অবাধ্যতা, ও জিহাদ থেকে পলায়ন।” (সাওবান)
শিরকের পর সবচেয়ে বড় গুনাহ হলো মাতাপিতার অবাধ্যতা যা তওবা করে নিজেকে শুধরে নিয়ে মা বাবাকে সন্তষ্ট করলে হয়তো মাফ হয়। আর মা বাবা মারা গেলে কি হবে সে সম্পর্কে হাদিস বলে, “যদি কোন ব্যাক্তি আজীবন মাতাপিতার অবাধ্যতা করে এবং তাদের একজন বা দুজনই ইন্তেকাল করেন তাহলে তাদের উচিত অব্যহতভাবে মাতা-পিতার জন্য দোয়া করা ও ক্ষমা চাওয়া। ফলে আল্লাহ্ নিজ অনুগ্রহে তাকে নেক লোকদের মধ্যে লিখে দেন।“(আনাস) তাছাড়া তাদের জন্য সাদকায়ে জারিয়ার ব্যাবস্থা করা, ঋণ থাকলে তা পরিশোধ করা, তাদের বন্ধু-সজনদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ইত্যাদি দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে হয়তো গুনাহ মাফ হবে।
মাবাবার সাথে সুসম্পর্ক পরিবারকে মজবুত ও সুন্দর করে যা সুস্থ্য সমাজের ভিত্তি। এই দায়িত্বকর্ত্যব্য মোটেই আবেগের বিষয় না তা প্রজ্ঞার মাধ্যমে চেষ্টা সাধনা করার বিষয়। আল্লাহ্ আমাদের তৌফিক দিন যেন কোরান হাদিসের দাবী অনুযায়ি মা বাবার প্রতি সদাচার করে এবং দুরাচার থেকে দূরে থেকে দুনিয়া আখিরাতে লাভবান হতে পারি।
কৃতজ্ঞতায়ঃ ভিশু
বিষয়: বিবিধ
১৬৬১ বার পঠিত, ১৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ব্যস্ত থাকবো বলে একদিন আগে পোস্ট দিয়ে সেই যে অফ হয়েছি নেট থেকে আর এই এলাম...
মা বাবার প্রতি সুন্দর ব্যবহার করা প্রতটি মানুষের দায়ীত্ব কর্তব্য । কিন্তু বর্তমান সমাজে মানুষ দায়ীত্ব ও কর্তব্য পালনে নির্ধিদায় পিছু হেটে যাচ্ছে। আখেরাতের কথা স্বরণ করা উচিৎ।
....রসূল (সাঃ) ৩ বার আমিন বলছেন.....উত্তরে বললেন....যে রমজান পেল কিন্তু পাপ মাফ করিয়ে নিতে পারল না,সে ধ্বংম হোক...আমি বললাম আমিন...যে তার পিতা-মাতা অথবা যে কোনো একজনকে পেল কিন্তু জান্নাতে যেত পারল না,সে ধ্বংস হোক..জিবরাঈলের এই কথার পর আমি বললাম আমিন ....
জাজাকাল্লাহ খায়রান
পিতা-মাতা নেই যার
জীবনে কি আছে তার! ধন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন