মহাভারত উপাখ্যান – “প্রসঙ্গ বাংলাদেশ” (২)
লিখেছেন লিখেছেন আইমান হামিদ ২৪ নভেম্বর, ২০১৩, ০১:৪৭:৪১ দুপুর
অনেকেই বলে থাকেন ভারত একটি উদীয়মান অর্থনৈতিক পরাশক্তি। ব্যাপারটি নিয়ে অনেকে সংশয় প্রকাশ করলেও আমি ব্যাক্তিগত ভাবে ভারতকে উদীয়মান অর্থনৈতিক পরাশক্তিই মনে করি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা “খাজনার চেয়ে বাজনা বেশী”, অর্থাৎ আবেগ এবং কল্পনা প্রসূত অতিরঞ্জন। আর যাই হোক অর্থনীতি-রাজনীতি-সংস্কৃতির মান ও গতি আবেগ এবং কল্পনা দ্বারা নির্ধারিত হয় না।
একটি উদাহরণ দেওয়া যাক, আমেরিকা আয়তনের দিক থেকে পৃথিবীর তৃতীয়/চতুর্থ বৃহত্তম রাষ্ট্র (ভারতের চেয়ে প্রায় তিন গুন বড়) অন্যদিকে জনসংখ্যা ভারতের এক চতুর্থাংশ! মাত্র তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ মিলিয়ন জন্যসংখ্যার দেশ হওয়া সত্বেও- পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশী গাড়ি আমেরিকাতে চলে, আমেরিকার ডোমেস্টিক ফ্লাইটের সংখ্যা বাকী বিশ্বের মোট ফ্লাইটের সংখ্যার চাইতেও বেশী এবং পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশী গবেষণা আমেরিকাতেই হয়! তবে আমেরিকার নয় ভাগ মানুষ দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে এবং সাত ভাগ মানুষ বেকার!!! – এখানে আমেরিকার প্রসঙ্গ আনার কারন হচ্ছে কিছু কিছু ভারতীয়দের অতি উচ্ছ্বাস। শুধুমাত্র জিডিপি আর মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানির লোকাল অফিস দিয়ে সামগ্রিক অর্থনৈতিক মুক্তি আসে না। ভারতের অধিকাংশ মানুষের দৈনিক আয় দুই ডলারের নিচে। ভারতের অধিকাংশ মানুশ পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধা থেকে বঞ্চিত! অন্যদিকে ভারত সরকার বিপুল সংখ্যক জনসাধারণ কে সুবিধা বঞ্চিত রেখে সুপার-পাওয়ার স্বপ্নে একে একে হাতে নিচ্ছে উচ্চবিলাসী প্ল্যান।
আলোচনা শুনে মনে হতে পারে আমি ভারতের পেছনে কেনো লাগলাম! এসব তো তাদের নিজস্ব ব্যাপার। হ্যাঁ কথা সত্য তবে আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্রের অনেক কিছুই আমাদের দেশে মানুষ জানেন না কিংবা জানলেও মানতে চান না। তাছাড়া প্রবাসে, মিডিয়ার কল্যানে ভারতীয়রা নিজেদেকে যেভাবে উপস্থাপন করেন তাতে উক্ত ব্যপারগুলো টেনে আনতে বাধ্য হলাম। সম্প্রতি যুক্তরাজ্য ভিক্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে (LEGATUM PROSPERITY INDEX) জীবন মানের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের উপরে!
উপমহাদেশীয় ট্রেন্ডঃ
প্রবাসে উপমহাদেশীয়দের পেশাগত দৌড় ঝাঁপ, মিথস্ক্রিয়া ইত্যাদির দিকে ভালোভাবে লক্ষ্য করলে একটি জিনিস খুব সহজেই ধরা পড়ে। অধিকাংশ বাংলাদেশী, ভারতীয় মুসলিম এবং পাকিস্থানীদের মধ্যে মোটামুটি সুসম্পর্ক বিদ্যমান। দক্ষিণ ভারতীয়দের সাথে বাংলাদেশীদের সম্পর্ক বেশ ভালো। তবে ঝামেলা পাকায় কলিকাতার দাদাবাবুরা! যদিও ব্যাপারগুলো খানিকটা অনুমান প্রসূত তবে কাকতালীয় ঘটমান। আপনি ভারতীয় এবং পাকিস্থানী পাঞ্জাবীর মধ্যকার দহরম দেখলেও , ভারতীয় বাঙ্গালী এবং বাংলাদেশী বাঙ্গালীর মধ্যে সেই ভাব পুরোপুরি অনুপস্থিত!
ছোট একটি উদাহরণ দেয়া যাক, আপনারা যদি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যাল্যের দিকে নজর দেন তাহলে দেখতে পাবেন এর স্থাপন কাল বৃটিশ কর্তৃক উপমহাদেশ দখলের ঠিক একশত বছর পরে, অর্থাৎ ১৮৫৭ সালে। অন্যদিকে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১৯২১ সালে ব্রিটিশদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের “রিমেডি” হিসেবে! যদিও এ নিয়ে আমাদের জমিদার বাবুদের গোস্বার অন্ত নেই! মোসেলমানের পোলাপাইন ইশকুলে যাবে! কলি কাল বোধহয় অতি সন্নিকটে! আর পূর্বের বাঙালদের ভাষার যা বিতিকিচ্ছিরি!
বাংলা সাহিত্য নিয়ে আমার পড়াশুনা খুবই সীমিত। তবে সাহিত্যপ্রেমী বাংলাদেশীদের অনেকেই কলিকাতার লেখকদের গল্প উপন্যাস পড়ে বড় হয়েছেন। আমার মনে হয় না বাংলা সাহিত্য পড়ার সময় পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের পাঠকবৃন্দের মনে নূন্যতম সাম্প্রদায়িকতাবোধ জন্মেছে। বস্তুত তারা সাহিত্যকে সাহিত্য হিসেবেই গ্রহণ করেছেন। আর আমার মাঝে মাঝে মনে হয় “সাম্প্রদায়িক-অসাম্প্রদায়িক” শব্দগুলো যতটা না সামাজিক তার চেয়েও বেশী রাজনৈতিক। তবে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতার পেছনে আমাদের জমিদার বাবুদের অবদান অনস্বীকার্য। এটা অনেকটা ব্রিটিশ ইংলিশ এবং আমেরিকান ইংলিশ ট্রেন্ট কিংবা ফরাসীদের লম্বা বিরতি নিয়ে কাজ ফাঁকি দিয়ে অতীত স্মৃতি রোমন্থন করা নাক উঁচু গল্পের মতো! আর ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে নির্বিচারে মানুষ হত্যা, আন্তর্জাতিক নদীর পানি নিয়ে টালবাহানা, মাদক পাচার, পুশইন, ছিটমহল সমস্যা ইত্যাদিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করছেন দাদারাই! অবাক হবার কিছুই নেই, ব্রিটিশদের সৌজন্যে পাওয়া অনেকদিনের বদঅভ্যাস!
সেদিন দক্ষিণ ভারতের একজন (সাবেক সিভিল সার্ভেন্ট) বললো, পূর্ব বঙ্গের মানুষ জনকে নাকি মুসলিম শাসকরা জোর করে ধর্মান্তরিত করেছে? আমি প্রতিবাদ করে বললাম বর্ণ প্রথার হাত থেকে বাঁচার জন্য নিন্মবর্ণের মানুষজন সেদিন একেশ্বরবাদী হয়েছিলো, তাদেরকে জোর পূর্বক ধর্মান্তরিত করা হয়নি। উদাহরন স্বরূপ তাদের “দলিত” সাম্প্রদায়ের লোকজনের কথা বললাম।
সামগ্রিক ভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, জীবন যাত্রার মান পশ্চিমবঙ্গ থেকে অনেক এগিয়ে। যারা টুকটাক খবরাখবর রাখেন তারা চাইলেই বিভিন্ন ওয়েব পোর্টাল ঢুঁ মেরে দেখতে পারেন।
বার্ড’স অ্যাই ভিউঃ
*** সেদিন এক ভারতীয় লাঞ্চ রুমে উপস্থিত সকলের নিকট একটি মানবিক সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছেন। পাঁচ বছরের এক শিশু অমানুষিক নির্যাতনের স্বীকার। এমনিতে বলিউডের অতিবাণিজ্যিক কৌশল এবং জাতে উঠার জন্য পশ্চিমা সংস্কৃতির উপমহাদেশীয় সংস্করণের ফলে ভারতে ধর্ষণের মাত্রা জ্যামাতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সেখানে অবুঝ শিশু, বৃদ্ধা থেকে শুরু করে নিজ পরিবারের সদস্য কারো রেহাই নেই। আবেদনটি যেহেতু মানবিক তাই সাড়া প্রদান অত্যাবশক। এখানে প্রসঙ্গটি টেনে আনার কারণ অনেকে ভারতীয় সীমান্ত বাহিনী কর্তৃক ফেলানী হত্যাকাণ্ড কিংবা অন্যসব নির্মম হত্যাকাণ্ডের উদাহরণ দেখাবেন। তবে আমার মতে ভারতের মজলুম জনসাধারণের অধিকাংশই শোষিত। ভারত সরকারের অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান করা আর ভারতের নির্যাতিত সাধারণ জনগণের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া পুরোপুরি আলাদা জিনিস। দুটোর মধ্যে তালগোল পাকানোর কোনো কারণ নেই।
*** অনেকেই হয়তো একটি ব্যাপার লক্ষ্য করেছেন। মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে বাংলাদেশের একটি ভৌগলিক মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে – বাংলাদেশের সমান্তবর্তী কোনো মুসলিম রাষ্ট্র নেই। চিন্তার বিষয় বটে! তবে ভারত যেই পথ্য নেপাল এবং ভুটানের উপর প্রয়োগ করেছে তা বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয়।
আর বাংলাদেশের সাথে ভারতের যেই দেনা- পাওনার ভারসাম্যহীনতা তা যে কোন সরকারের পক্ষেই সমাধান করা এক প্রকার চ্যালেঞ্জিং বটে! অন্যদিকে ভারত যেখানে সাংবিধানিক ভাবে স্যাকুলার রাষ্ট্র হয়েও বিজেপির মতো একটি দলকে হজম করে আসছে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশে তার স্যাকুলার ভূত চাপানোর উচ্চাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করতে হবে। এমনিতে আদিবাসী, সংখ্যালগু, সংখ্যাগুরু শব্দগুলো আমি অপছন্দ করি তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতীয় কূটনীতিবিদরা যখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সাম্প্রদায়িকদাঙ্গা নিয়ে কথা বলে তখন মনে হয় তারা গোল্ড ফিসের স্মৃতিশক্তি ধারণ করেন! অন্যথায়, আহমেদাবাদ, মুজাফফরনগর কিংবা আসামের অবর্ণনীয় দাঙ্গার কথা তাদের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ব্যাক্তিগতভাবে আমি সকল প্রকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার প্রতিবাদ জানাই। আর আগেই বলেছি “সাম্প্রদায়িক” শব্দটি যতটা না সাম্প্রদায়িক তার চেয়েও বেশী রাজনৈতিক!
*** বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের জন্য বিশেষ কোটার ব্যাবস্থা আছে। দৃশ্যত অনেকেই সরকারী-বেসরকারী গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল। বিষয়টি বেশ ইতিবাচক। অন্যদিকে ভারতেও সুবিধাবঞ্চিত ও সংখ্যালঘুদের জন্য আলাদা কোটার ব্যাবস্থা আছে। তবে তা কেবল নিন্ম বর্ণের লোকজনের জন্য প্রযোজ্য!!
*** একটি সংস্কৃতিতে অন্য একটি সংস্কৃতির প্রবেশ রোধ করা অনেকটা অসাধ্য হয়ে পরে বিশেষত যখন আক্রান্ত সংস্কৃতির ধারক ও বাহকেরা বিজড়িত হয়ে পড়েন। তবে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের চূড়ান্ত ফলাফল যেহেতু সামাজিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক পতন তা মাথায় রেখে নির্ধারণ করতে হবে আপনি কতটুকু উদারতা প্রদর্শন করবেন। অন্যদিকে একতরফাভাবে চাপিয়ে দেওয়া সংস্কৃতি সুস্থ মস্তিষ্কে অযৌক্তিক এবং অগ্রহনযোগ্য। সেটা আমাদের সাংস্কৃতির কর্ণধার এবং জাতীর হর্তাকর্তা আশা করি ভেবে দেখবেন।
*** ভারতের এখনো পর্যন্ত অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি দক্ষ শ্রমবাজার অর্থাৎ জনশক্তি। একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বাংলাদেশও সেই সম্ভবনা বিদ্যমান। তবে এক্ষেত্রে পেশাগত দক্ষতার পাশাপাশি কূটনৈতিক পন্থা এবং সার্বিক ভাবে মানুষের চিন্তার প্যাটার্নের পরিবর্তন অত্যাবশক। দুই একদিন আগে ইউ এস কংগ্রেসে বাংলাদেশ নিয়ে শুনানিতে বাংলাদেশী রাষ্ট্র বিজ্ঞানী ডঃ আলী বিয়াজের বক্তব্য শুনছিলাম। তার কথার সার সংক্ষেপে যা বুঝলাম তিনি বাংলাদেশের চাইতে ভারতের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন!!! আমার মনে হয় তার কথাশুনে উপস্থিত কংগ্রেসম্যান এবং সাংবাদিকগন বেশ বিব্রত হয়েছেন।
আমাদের দেশের সেরা মেধাবীদের চূড়ান্ত স্বপ্ন পরিবার নিয়ে প্যাসিফিকসোর, ভেগাস বা নায়াগ্রাফল’স এ লং ড্রাইভ। অন্যভাবে বললে আমাদের সমাজে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার চাইতে বড় কামলাগিরিকে সম্মানিত এবং উৎসাহিত করা হয়!!! অবশ্য এক্ষেত্রে কিছু কিছু ভারতীয় খানিকটা এগিয়ে।
যতদিন পর্যন্ত আমাদের দেশের সোনার সন্তানেরা অন্যের দ্বারা মগজ ধোলাই হবে, যতদিন পর্যন্ত নিজ দক্ষতায় এবং সৃষ্টিশীলতায় নিজেদের সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবে, যতদিন পর্যন্ত আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং নীতি নির্ধারকরা তাদের গতানুগতিক “ব্যানানা রিপাবলিক” নীতি থেকে বেড়িয়ে আসতে অক্ষম হবে ততদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকবে।
বিষয়: বিবিধ
১৭৭৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন