মহাভারত উপাখ্যান - "প্রসঙ্গ বাংলাদেশ"
লিখেছেন লিখেছেন আইমান হামিদ ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০৩:৩৬:২১ দুপুর
এমনিতে সাপ্তাহের শেষ দিন হিসেবে শুক্র বারে কাজের চাপ একটু কমই থাকে। অনেকেই লাঞ্চের পর অফিস ত্যাগ করে। তাই লাঞ্চ শেষে বর্ষণ মুখর দিনে কফি ব্রেক মন্দ না। নিয়ম অনুযায়ী কফি দুই-তিন ঘণ্টার পুরনো হলে তা নিজ দ্বায়িত্বে ফেলে দিয়ে নতুন করে তৈরি করতে হবে। যাহোক পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ছোট খাট একটা জটলা বেঁধে গেলো। সবাই ফুরফুরে মেজাজে পরস্পরের মাঝে কুশল বিনিময় করছিলো। এমন সময় একজন আমার সম্পর্কে জানতে চাইলেন। আমি জবাব দেওয়ার পর বললেন আমার নাম বেশ অপরিচিত। আমি বললাম জী বাংলাদেশে তেমন একটা প্রচলিত নয়, ঈজিপটে বেশ কমন ওরা শুধু “আই” এর পরিবর্তে “ওয়াই” ব্যাবহার করে।
ভদ্রলোকে ভদ্রতাবশত পাল্টা প্রশ্ন করতেই বললেন আমি তোমাদের প্রতিবেশী “ওয়েস্ট বেঙ্গল” ওমুক গাঙ্গুলি। আমি বললাম বুঝেছি ওমুক গঙ্গোপাধ্যায়। উনি বললেন বাহিরের লোকতো আর বুঝবে না যে গাঙ্গুলি এবং গঙ্গোপাধ্যায় একই জিনিস। আমি মাথা নেড়ে সম্মতির সুরে বললাম ঠিক বলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললে তো আর কেউ বুঝবে না মমতা ব্যানার্জী বলতে হবে! পাশে হঠাৎ করে দক্ষিন ভারতীয় সহকর্মী বলে উঠলেন “বাঙ্গালী বাবু”, আমি বললাম উনি বাবু কিন্তু আমি সাহেব!
বাংলাদেশ – ভারত ফ্যাক্টবুকঃ ভৌগলিক আয়তনে ভারত বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় একুশ গুণ বড়। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ভারতের মোট জনসংখ্যার আট ভাগের একভাগ। অধিক জনসংখ্যার কারণে ক্রয় ক্ষমতার দিক থেকে ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থান তৃতীয় অন্যদিকে বাংলাদেশের অবস্থান চুয়াল্লিশ তম। ( অন্য মানদণ্ডে ভারত ৯ম এবং বাংলাদেশ ৫৭ তম) । ভারতের জিডিপি বাংলাদেশের জিডিপ তুলনায় ছয় গুন বেশী। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ ভাগ ভারতীয় তবে একক ভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের বৃহত্তম জাতি বাঙ্গালী। এমনকি বর্তমান ভারতের রাজনৈতিক সীমান্তের মধ্যেও বাংলা ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা।
বাংলাদেশে বার্ষিক আমদানিকৃত পন্যের শতকরা ১৪ শতাংশ আমদানী করা হয় ভারত থেকে। অন্যভাবে বললে এককভাবে বাংলাদেশ ভারতের বৃহত্তম বাজার।
ভৌগলিক ভাবে বেকায়দায় পরে বাংলাদেশকে ভারতের সাথে ছোট বড় প্রায় সাতশতাধিক আন্তর্জাতিক নদীর অংশীদার হতে হয়েছে যেগুলো উৎপত্তি স্থল, ভারতে, চীনে অথবা হিমালয়ের কোনো চূড়া থেকে। ভারতের অভ্যন্তরে অনেক গরুর খামারে গরু পালা হয় শুধু মাত্র বাংলাদেশে রপ্তানি করার জন্য। আর বাংলাদেশের সীমান্তের চারিদিকে ভিমরুলের বাসার মতো রয়েছে অসংখ্য ডাইলের (ফেনসিডিল) কারখানা। যার একমাত্র উদ্দেশ্য উৎপাদনকৃত ডাউল গরম গরম পূর্ব বঙ্গের তরুন সমাজের মাঝে বিতরন।
ভারতবাসীদের মধ্যে কলিকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া বাকি জাতি গোষ্ঠী যেমন তামিল, তেলেগু, মালায়ালাম ইত্যাদি যেগুলোর অবস্থান বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে দূরে তারা বাংলাদেশী সম্পর্কে তেমন বিদ্বেষমূলক ধারন পোষণ করেন না কিংবা তেমন মাথা ঘামান না। মূলত পশ্চিম বঙ্গের প্যারমানেন্ট স্যাটেলমেন্টের সুবিধাভোগী জমিদারদের বর্তমান প্রজন্ম বাংলাদেশ নিয়ে বেশ অ্যালার্জিতে ভোগেন। সেই অ্যালার্জি জনিত হাঁচিতে মাঝে মাঝে আমাদেরকেও ভোগান।
ভারতীয় পণ্য, চলচিত্র, মিডিয়া ইত্যাদি বাংলার ভূখণ্ডে চির বহমান হলেও পদ্মার জলে ভাটা পরেছে সেই বহুকাল আগ থেকে। ত্রিস্রোতা তিস্তা আজ স্রোত হীন। বরাকে গলায় গেঁথেছে মানব সৃষ্ট কাঁটা। বাংলাদেশের গভীরতম নদী সুরমার অস্তিত্ব আজ সংকটময়। অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাসের উপর নেমে এসেছে ফেরাউনের উপর নিক্ষিপ্ত গজব। তিতাসের বুক চিরে চলছে সর্দারজীদের আর্থোপেডিক দানব। ভারতের কট্টরপন্থী সুব্রিমিনিয়াম স্বামীরা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশী শরণার্থী আশ্রয়ের বিনিময়ে বাংলাদেশের সুন্দরবন থেকে তামাবিল পর্যন্ত দখল করার স্বপ্ন দেখেন!
আরেকটু গভীরেঃ দ্রাবিঢ়, আর্য এবং মঙ্গোলদের সংকরে ভারতীয় উপমহাদেশ পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলোর একটি। বহু বর্ণ, ধর্ম, গোত্র, শ্রেণী, পেশায় বিভক্ত উপমহাদেশীয়রা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় চার ভাগের এক ভাগ। মহাত্না গান্ধী তাই বলেছিলেন উপমহাদেশ ঘুরে দেখলে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেকটা দেখা হয়ে যায়।
অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ক্রান্তিলগ্নে ফ্যাসিবাদ ও ঔপনিবেশবাদের পতনের পরপরই পৃথিবীজুড়ে সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদ বিস্তৃতি লাভ করে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেই আধিপত্যবাদী আচরণের ক্রমাগত সাক্ষর রেখে চলেছে আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র ভারত। একটি ব্যাপার লক্ষনীয় দক্ষিন এশিয়ার মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশ এবং পাকিস্থান ছাড়া ভারত বাকি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে তার করদ রাজ্য বানিয়ে রেখেছে অনেক আগ থেকেই। যেমন শ্রীলঙ্কায় তামিল বিদ্রোহীদের সহযোগিতার মাধ্যমে শ্রীলঙ্কায় সমস্যা বাধিয়ে রেখেছে। নেপাল – ভুটান অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে ভারতের রাজ্যই বলা চলে। আর তিস্তার উৎপত্তি স্থল সিকিমেতো অনেক আগেই লেন্দুপ দর্জির বিশ্বাসঘতকতায় ভারতে অংশ হয়েছে। বাকি থাকলো বাংলাদেশ এবং পাকিস্থান। এক্ষেত্রে পাকিস্থান যেহেতু পারমাননিক শক্তিধর দেশ এবং ভারতের চির প্রতিদ্বন্দ্বী তাই পাকিস্তানের হিসেব আলাদা। তাছাড়া আন্তর্জাতিক পরাশক্তি উদীয়মান অর্থনৈতিক পরাশক্তি ভারতকে এই অঞ্চলে একক ক্ষমতাধর রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে অনিচ্ছুক। সব শেষে বাংলাদেশ!
বাংলাদেশ কোনো পরাশক্তি বা উদীয়মান অর্থনীতি না হলেও বাংলাদেশে রয়েছে বিশাল ভোক্তা শ্রেণী। আর এই ভোক্তাদের চাহিদা যদি দেশীয় উৎপাদিত পন্য থেকেই মেটানো সম্ভব হয় তাহলে ভারত তার বহুদিনের বাজার হারাবে। তাই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন শুধু মাত্র একটি দেশের জনসাধানরের মানসিক বিকৃতিই ঘটায় না। দীর্ঘ মেয়াদে তা নতুন ভোক্তা সৃষ্টি করে। পাশাপাশি সামাজিক অবক্ষয় ও অস্থিতরাতো আছেই।
এখানে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন দক্ষিন ভারতের অনেক রাজ্য রাজনৈতিকভারে ভারতের অন্তভুক্ত হওয়ার পরে হিন্দিকে তারা ভাষা হিসেবে গ্রহন করে নি। সেখানে বলিউডের মুভি কিংবা হিন্দি সিরিয়াল অপ্রচলিতই বলা চলে। অন্যদিকে বাংলাদেশ একটি ভিন্ন স্বাধীন দেশ হওয়া সত্বেও গনহারে ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের স্বীকার। এক্ষেত্রে আমাদের সাংস্কৃতির হর্তা কর্তাদের মৌন ভূমিকা আমাদেরকে আরও বেশি আশাহত করে।
যেখানে ভারতীয় বাজারে নানা প্রকার অযৌক্তিক শর্তারোপ করে বাংলাদেশি মিডিয়াকে বন্ধ করা হয়েছে সেখানে বেশ অবাদে বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে চলছে ভারতীয় চ্যানেল! একদিকে চলছে সীমান্ত হত্যা অন্য দিকে চলছে ক্যাটরিনা কাইফের উদ্যোম নৃত্য! আর একটি কথা বিশাল ভারতে পাশে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে সফল বাংলাদেশ ভারতে সুবিধা বঞ্চিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অঙ্গরাজ্য গুলোকে অনুপ্রাণিত করবে যা ভারতের মোটেও কাম্য নয়।
আমাদের করনীয়ঃ আসলে এই পরিস্থিতিতে ব্যাক্তিগত পর্যায়ে আমাদের করণীয় খুবই সামান্য। মূল কাজ দেশের হর্তাকর্তাদেরকেই করতে হবে। কৌশলী ও বহুমাত্রিক কূটনৈতিক পন্থা অবলম্বন করতে হবে। অভিন্ন নদীর সুষম ও ন্যায্য পানি বণ্টন, সীমান্ত হত্যা বন্ধ, এক তরফা ট্রানজিট সুবিধা, বাংলাদেশের পরিবেশ বিনষ্ট করে ভারতীয় বিনিয়োগে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, বিনা মাশুলে এয়ার টেলের মতো ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে অন্যায্য সুবিধা প্রদান ইত্যাদি আমাদের হর্তাকর্তাদের আরেকে বার ভেবে দেখা উচিত। অন্যথায় দেশের মানুষ হর্তাকর্তাদের সম্পর্কে ভাবতে বাধ্য হবেন। দেশে এবং দেশের বাহিরে বাংলাদেশের বিরাট সংখ্যক সিভিল সোসাইটি রয়েছে। তাদের উচিত এই সমস্ত জাতীয় ন্যায় সঙ্গত স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় গুলোকে গুরুত্বের সাথে নেয়া।
*** ব্যাক্তিগত এবং সামাজিকভাবে আমরা যতটুকু সম্ভব ভারতীয় পন্য বর্জন করতে পারি। অন্যভাবে বললে নিজেদের উৎপাদিত পন্য ব্যাবহারকে ট্রেন্ট হিসেবে নিতে পারি। প্রাথমিক ভাবে হয়তো সবক্ষেত্রে এই পন্থা খাটবে না তবে আন্ততিকতাটাই বড় জিনিস।
*** ভারতীয় টিভি চ্যানেল সাধ্যমত পরিহার করতে হবে। কারন এই একবিংশ শতাব্দিতে কেউ আর গতানুগতিক ঢাল-তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ করবে না এখন যুদ্ধ বাজার দখল। সেই যুদ্ধের প্রধান হাতিয়ার মিডিয়া তথা প্রচার মাধ্যম। তাই দেশীয় মিডিয়া এবং চলচিত্রকে প্রাধান্য দিতে হবে। পাশাপাশি ঢালাও ভাবে অনন্ত জলিল, সাকিব খানদের সমালোচনা না করে তাদের সীমাবদ্ধাতা ও ভুলত্রুটি গঠনমূলকভাবে উপস্থাপন করা উচিত। আর বাণিজ্যিক ধারার চলচিত্রের পাশাপাশি সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ নিয়ে তৈরি সচেতন মূলক চলচিত্রকে প্রমোট করা উচিৎ।
*** বাংলাদেশে বা ভারতে কোনো নারী, শিশু কিংবা বৃদ্ধা ধর্ষিত, নির্যাতিত বা অত্যাচারিত হলে প্রথমে তা ভিকটিমের ধর্ম পরিচয়ের উপর ভিক্তি করে ল্যাবেলিং করা বন্ধ করতে হবে। অপরাধকে অপরাধ হিসেবে দেখতে হবে।
*** ডঃ ইউনুসের পেছনে লাগা বন্ধ করতে হবে। ব্যাক্তি ইউনুস কখনোই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। তবে তাকে তার যোগ্য সম্মান দিতে হবে। পাশের দেশের অমর্ত্য সেনের চাইতে তিনি আমাদের কাছে অধিক শ্রদ্ধার দাবীদার। তাকে দালাল বলা হোক আর যাই বলা হোক। পশ্চিমারা আমাদের দেশের ওই সব তথাকথিত হোমরা চোমড়াদের তেমন গোনায় ধরে না কেবল ইউনুস ছাড়া! আর ইহাই ভারতীয়দের এক প্রকার মাথা ব্যাথা বলা চলে।
*** মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশে অধিকাংশ মাদক ভারত থেকেই আসে।
*** আমাদের শিক্ষিত নারী সমাজকে ভারতীয় সিরিয়ালের ইটোপিয়ান জগত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাদেরকে বুঝতে হবে মাথাপিছু দুই থেকে তিন হাজার ডলার আয় করা দেশে কেউ সারাদিন দামি দামি শাড়ি গহনা পড়ে, মেকাপ দিয়ে, দামি গাড়ীতে চড়ে, খাবার না খেয়ে, বাথরুম না করে শুধু লিভিং রুমে বসে কুটনামি করে না। আর অমুক মুভির মতো করে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান না হলে লাইফ তেজপাতা হয়ে যাবে না। এসব কিছু থেকে প্রগতি আসে না, প্রগতি আসে আত্নসম্মানবোধ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থেকে।
*** সব সময় মনে রাখতে হবে বাংলাদেশই কেবল মাত্র বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতির ধারক ও বাহক।
আর মনে রাখতে হবে পূর্ব বঙ্গে শিক্ষার প্রসারে প্রধান বিরোধিতাকারী ছিলেন আমাদের দাদাবাবুরাই।
*** সর্বোপরি বিশাল ভারতের পাশে বাংলাদেশের টিকে থাকার প্রধান হাতিয়ার অর্থনৈতিক মুক্তি। তবেই হয়তো আর কোনো ফেলানীকে কাঁটা তারে ঝুলতে হবে না। অন্যথায় এ গ্লানি তাড়িত করবে ১৬ কোটি বনি আদম কে!
বিষয়: বিবিধ
৪৫৯৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন