অরেগনের পথে – ৯ (ক্রেটার লেক)

লিখেছেন লিখেছেন আইমান হামিদ ০৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০৮:২৬:২৭ সকাল



পাহাড়ি নদের বাঁকে বাঁকে বয়ে চলা জনমানবহীন রাস্তা দিয়ে চলছে গাড়ী। কিছুক্ষণ পরপর রাস্তার ধারে গাড়ী পার্ক করে নামতে বাধ্য করছে প্রকৃতি! কিছু কিছু স্থান মনে হয় বহুকাল যাবত সূর্যের আলো বঞ্চিত। পাহাড়ি পাথুরে নদের স্বচ্ছ জলে মাছের আনাগোনা পরিস্কার ভাবে দৃশ্যমান। জায়গাটির নাম “উম্পক্যুয়া ন্যাশানাল ফরেস্ট” আমাদেকে জনমানবহীন এই জঙ্গলের মধ্যদিয়ে ২ ঘণ্টা ড্রাইভ করতে হবে। চারপাশে পাইন ট্রি’র আধিক্যই বেশী চোখে পড়ছে। মাঝে মাঝে সবুজ পাহাড়ের ভিন্ন রূপ চোখে পরে, অর্থাৎ শুধুমাত্র কিছু বৃক্ষ দণ্ড দাঁড়িয়ে ডালপালা কিছুই নেই! দাবানলে পুড়ে গেছে সব! এমনিতেই অরেগনের আবহাওয়া বেশ আদ্র, বছরের ৮ থেকে ৯ মাস জুড়ে বৃষ্টি তারপরেও দাবানলের থাবা! এসব চিন্তা মাথায় ঘুরপাক করতে করতেই দূর থেকে দেখা মিললো মাউন্ট স্কটের। এই মাউন্ট স্কটের ঠিক পাশেই ক্রেটার লেকের অবস্থান। জিপিস বলছে আরও ২৫ মাইল বা আধ ঘণ্টা সময় লাগবে। যদিও আমাদের পরিকল্পনা ছিলও ক্রেটার লেকের আশেপাশের কোন হোটেল। কিন্তু হায় ক্রেটার লেকের আশে পাশে ৩০ মাইলের ভেতর কোনো হোটেল নাই! যাহোক সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম আগে সন্ধ্যা কালীন ক্রেটার লেক দর্শন অতঃপর হোটেল অনুসন্ধান।





ক্রেটার লেক ন্যাশনাল পার্কের গেইট অতিক্রম করার পর দেখলাম আসল লেকের দূরত্ব আরও ৯ মাইল। এই নয় মাইল যাত্রাপথে আবারও থামতে বাধ্য হলাম পাহাড় ও বনানীর মধ্যে সৃষ্ট ক্ষুদ্র মরুভূমির সৌন্দর্যে। হঠাৎ চারপাশের শুন্যতায় মনে হলো ভিন্ন কোনো গ্রহে আছড়ে পড়েছি! তবে আমারদের জন্য আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিলো। কিছুক্ষণ পর হিমশীতল আবহাওয়ায় গাড়ী থামাতেই চোখ পড়লো পর্বত বেষ্টিত মোহনীয় ক্রেটার লেক।





ভলক্যানো থেকে সৃষ্ট ক্রেটার লেক আমেরিকার গভীরতম লেক। অনেকটা আমাদের বগা লেকের মতো। ভূ- পৃষ্ট থেকে অধিক উচ্চতায় অবস্থিত বিধায় সারাবছরই কম বেশি বরফ থাকে। ঠাণ্ডায় হাত পা নিস্তেজ হয়ে আসছে। আপাতত রাত কাটানোর ব্যাবস্থা করা দরকার। ক্রেটার লেক থেকে সবচাইতে নিকট শহর চিমুল্ট। যাত্রাপথে অন্ধকারের মধ্যে অনেকবার থামতে হলো হরিণের জন্য। বন্য হরিণ আলো দেখে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।

চিমুল্টে যখন পৌঁছলাম রাত তখন প্রায় ৯.৩০ এটাকে কি শহর বলা যায়! দু তিনটি গ্যাস স্টেশন, কিছু মোটেল আর সরাইখানা। আমরা যেই মোটেলে উঠেছি তার মালিক ভারতীয় (পাঞ্জাবী) দীর্ঘ দুই যুগ নিউইয়র্কে নির্মাণ শিল্পের শ্রমিক এবং ঠিকাদার হিসেবে কাজ করেছেন। কিন্তু শেষ বয়সে বিশ্রাম না করে এই রিমোট জঙ্গলে কেনো ? স্বামী স্ত্রী দুই জনেই বললো ব্যাবসা ভালো হওয়া সত্বেও তারা আর বেশিদিন এই দুর্গম স্থানে অবস্থান করবে না। তাদের একমাত্র ছেলের সাথে আবার নিউইয়র্কে বসবাস শুরু করবে।

চারজনের জন্য আমরা আলাদা একটি কটেজ বেছে নিলাম। ভিতরে প্রবেশ করতে করতে ভারতীয় সহকর্মী বললো “দুনিয়ার যেখানেই যাও এমনকি চাঁদে গেলেও দেশী পাওয়া যাবে” এখন মেক্সিকান সহকর্মীয় প্রশ্ন “দেশী” মানে কি? ভাবছিলাম কি বলা যায়। অবশেষে বললাম “উপমহাদেশীয় লোকজন, খাবার ও সংস্কৃতি কে দেশী বলা হয়”।

যাহোক এবার ফোনের কম্পাসে দিক নির্ধারণ করে নামাজ পড়ার পালা। নামাজ শেষে মেক্সিকান সহকর্মীকে জিজ্ঞাসা করলাম যে সে কি কখনো নামাজ পড়তে দেখেছে কিনা? সে বললো না, টিভিতে দেখেছি। যাহোক দেশী মানুষের মোটেল আসলেই দেশী! হিটার নাই, কফি ম্যাট আছে মাগার কফি নাই! সবকিছু মিলিয়ে আমাদের আরটিফিশিল্যাল ক্যাম্পিং এর অভিজ্ঞতা বলা যায়।

সকালে নাস্তা শেষে দেখি ওই দেশীর খুব একটা দোষ নাই আশেপাশের অলমোস্ট সব মোটেলই “হোটেল আল ছালা দিয়া ঢাকা” বা “চিৎ-কাইত বোডিং”, এমনকি স্বয়ং বিল গেটস সাহেব আসলেও তাকে এহালে রাত্রি অতিক্রম করতে হবে!







ব্রেকফাস্ট শেষে এবার দিনে বেলা ক্রেটার লেক দেখার পালা, যাত্রাপথ রৌদ্রজ্জল হওয়া সত্বেও ক্রেটার লেকে গিয়ে দেখি মেঘাচ্ছন্ন ও চারিদিকে ভারী তুষারপাত। লেকের ধারে বরফাচ্ছন্ন রাস্তায় আমরা এগিয়ে যাচ্ছি আর প্রার্থনা করছি তুষারপাত বন্ধের। পাহাড়ি বিপদ সংকুল রাস্তা মাড়িয়ে থামলাম “রীম ভিলেজে” কাঠ দিয়ে নির্মিত বিশাল কুটির বলা যায়। ভিতরে গিয়ে দেখালাম বাঙ্গালী সহ উপমহাদেশীদের আধিক্য, সবাই কেনাকাটায় ব্যাস্ত, আন্দাজ করে নিলাম আই টি পেশার প্রভাব। মেক্সিকান সহকর্মী হঠাৎ বলে উঠলো আইমান, লুক “দেশীস” আমি মুখ ফিরিয়ে বললাম “ইসসসসসস,। “ডোন্ট সে লাইক দ্যাট দ্যে মাইট গেট অফেনডেড”! সে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো, পাশে ভারতীয় ও পাকিস্থানী সহকর্মী মিটমিট করে হাসছে।

ঘণ্টা খানেক পর তুষারপাত বন্ধ, সূর্যও মাঝে মাঝে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। বের হলাম, দিনের আলোয় ক্রেটার লেক দর্শনে। আরও একবার মোহিত হলাম, স্ব-প্রণোদিত হয়ে বা অনুরোধে ক্যামেরাবন্ধী করলাম অসংখ্য যুগল কে। নিজেরাও হলাম মাঝে মাঝে। ভাবলাম সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এতো উচ্চতায় একটি বৃহৎ জলাশয় যেটি হাজার বছর পূর্বে ছিলো আগ্নেয়গিরির জলন্ত মুখ, লাভা নিঃসরণের উত্তপ্ত স্থান!! কালের পরিক্রমায় আর হিমশীতল লীলাভূমি।

চলবে .....................





বিষয়: বিবিধ

১৭৮২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File