অরেগনের পথে – ১২ "কেমন আছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মরা ?"
লিখেছেন লিখেছেন আইমান হামিদ ০৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ১২:৪১:১৯ রাত
উত্তর অ্যামেরিকাতে উপমহাদেশীয়দের মধ্যে একটি শব্দ বেশ জনপ্রিয় “ ABCD” American Born Confused Deishis!
বিষয়টির প্রকটতা ও গভীরতা বুঝতে সময় লেগেছে বেশ কিছু দিন! বিষয়ের তাত্ত্বিক ও পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণের যাওয়ার আগে আপনাকে কিছু ফ্যাক্টর যেমন – জনসংখ্যা, ধর্ম, জলবায়ু, স্থানীয় ঐতিহ্য ইত্যাদি জিনিস মাথায় রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে নিউ ইয়র্কে বা লস এঞ্জেল’স এর সাথে মিউ ওয়েস্টের ছোট কোনো শহরের কোনো তুলনাই চলে না।
তাই স্থান কালের উপর ভিক্তি করে চলতে থাকে জটিলতার মাত্রা।
প্রসঙ্গক্রমে অ্যামেরিকার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল তথা ওয়াশিংটন এবং অরেগনে বাচ্চারা যেই সকল জটিলতার মুখোমুখি হয় ফ্লোরিডা কিংবা টেক্সাসে সমস্যা গুলো ভিন্ন রূপে দেখা দিতে পারে।
সাধারনত কসমোলিটনের বাহিরে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা অধিকাংশই মূল ধারার পেশাজীবী। একে একে জীবনের অনেক বন্ধুর পথ অতিক্রম করে মেধা ও কঠোর পরিশ্রমের সমন্বয়ে নিজেদের নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়। কিন্তু কয়েক দশকের সকল অর্জনই বৃথা মনে হয় যখন তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়।
এক
ভৌগলিক ও জলবায়ু গত কারণে অরেগন ও ওয়াশিংটনের অনেক বাচ্চা অটিজম এবং ভিটামিন ডি এর অভাবে ভুগে। প্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রে যেটা অনেকটা বিষণ্ণতায় রূপ নেয়। তাছাড়া ছোট শহর বিধায় স্কুলে বাচ্চারা একই ধর্মের বা স্বদেশীয় সহপাঠী পায় না বললেই চলে। অন্যদিকে পরিবার থেকে আরোপিত অনুশাসন তাদেরকে বেশ বিভ্রান্ত করে। কারন তারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং পারিবারিক শিক্ষার মধ্যে কোনো সমন্বয় সাধন করতে পারে না। অনেকটা একই সাথে দু-তিনটি ভাষা গেলানোর মতো। অধিকাংশ সামাজিক অনুষ্ঠানে বাচ্চাদের একত্রিত হবার সুযোগ মিললেও তার অভ্যাস বসত ভিভিও গেমসে ডুবে নিজেদের জগতেই ব্যাস্ত। দেখা গেলো দীর্ঘ ৪-৫ ঘণ্টা একসাথে কাটালেও তারা কেউ কারো নাম জানে না!! তার উপর আবহাওয়াগত কারণে বছরের অধিকাংশ সময় আউট ডোর অ্যাক্টিভিটিসের সুযোগ কম। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে যায় শিশুদের সাথে পিতামাতার দূরত্ব, প্রত্যাশার চাপ এবং অপরিকল্পিত ভাবে মূল্যবোধের প্রয়োগ।
একটি বিষয় উল্লেখ্য যে এখানে উক্ত অভিভাবদের অনেকেই ধর্মীয় মূল্যবোধ সম্পন্ন এবং প্রায় সবাই উচ্চ শিক্ষিত। তারা তাদের বিশ্বাস ও কৃষ্টি সম্পর্কে বেশ সচেতন কিন্তু আসল গলদ প্রায়োগিক দিকে। একটি শিশু বা কিশোরকে যখন কোনো মৌলিক বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে অবহিত করা হয় তখন তাকে সেই বিষয় সম্পর্কে যৌক্তিক ব্যাখ্যা প্রদান অত্যাবশক হয়ে পরে। অনেকেই আছেন বাচ্চাদের অতিরিক্ত প্রশ্ন করাকে নিরুসাহিত করেন! ফলাফল – জেনারেশন গ্যাপ। তাছাড়া আমাদের দেশের টিপিক্যাল বাবা মা কিংবা মুরুব্বিদের সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলা এক প্রকার অসম্মান হিসেবে দেখা হয় কিংবা হতো! কিন্তু এখানে বাচ্চাদের শেখানো হয় “আই কন্টাক্ট” ঠিক রেখে কথা বলার জন্য বরং বিপরীতটাই অসম্মানজনক !
দুই
এতো গেলো মুল ধারার পেশাজীবীদের করুন সমাচার। তবে সাধারণ অভিবাসীদের ক্ষেত্রে এর ভিন্ন চিত্র ও লক্ষ্য করা যায়। এইসব পরিবারের বাবা মাদের অজ্ঞতা ও অসচেতনতা বসত অনেক বাচ্চাই বিপথে যায়। শৈশব অতিক্রম করে কৈশরে পা রাখতেই তারা বাবা মায়ের অজ্ঞতা ও সীমাবদ্ধতাকে কাজে লাগায়। তাছাড়া কসমোপলিটনের ডাইভারস কালচার তো আছেই। বেশ কিছুদিন আগে নিউ ইয়র্কের সাবওয়েতে (পাতাল রেল) দেখা মিলে মধ্যবয়সী উষ্কখুষ্ক পোশাক পরিহিত এক বাংলাদেশীর; বেচারা এক পায়ের মোজা পরতেও ভুলে গেছেন, চেহারায় দীর্ঘ তন্দ্রাহীনতার ছাপ! দূর থেকে আমাদের বাংলা কথোপকথন শুনে কাঁচুমাচু করে জিজ্ঞাসা করলো বাংলাদেশী কিনা? হ্যাঁ সূচক উত্তর মেলার পর বেশ উচ্চস্বরে গড়গড় করে নিজের দুরাবস্থার বর্ণনা দিতে লাগলেন। বললেন দীর্ঘ দুই দশক ঢাকা সুপ্রিম কোর্টে কাজ করার পর অনেক আশা নিয়ে বউ বাচ্চা সহ অ্যামেরিকায় পাড়ি জমিয়েছেন। কিন্তু জীবন এখন তার কাছে জলন্ত নরক! তার ক্লাস এইটে পড়ুয়া মেয়ে তার কথা শুনে না, ইন্টারনেট ব্যাবহার করতে দেয় না, ছেলে বিপথে ইত্যাদি। উনি নিজেও সামান্য টাকায় ফাস্ট ফুড সপে অমানুষিক খাটুনি খাটেন। তার বিধস্ত অবস্থা দেখে আর অসংলগ্ন কথাবার্তা শুনে আমি বলি তাহলে দেশে ফিরে যাচ্ছেন না কেনো? উনি বলেন ওনার স্ত্রী যেতে নারাজ!!! যাইহোক আশেপাশের যাত্রীদের কৌতুহলী চাহনি দেখে তাড়াতাড়ি ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম তবে বিষয়টি মাথার ভেতরে ঘুরপাক খেয়েছে বেশ কিছুদিন।
তারও কিছুদিন পর শুনতে পাই এক ব্যাক্তি তার হাইস্কুল পড়ুয়া মেয়েকে প্রতিদিন দেখভাল করতে সাবওয়ে স্টেশনের সামনে অপেক্ষা করতো। গতানুগতিক ভাবে একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে বাবা লক্ষ্য করলো মেয়ে সাথে একটি কৃষ্ণাঙ্গ ছেলে। পিতা দেশীয় কায়দায় ক্ষেপে গিয়ে পড়েন বেকায়দায়। মেয়ে তাৎক্ষনিক ভাবে পুলিশকে খবর দেয় এবং পুলিশ পরিচয় পত্র যাচাই করা পূর্বক পিতাকে প্রস্থানে বাধ্য করেন। কিছু দিন পর পিতা হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু বরণ করেন।
এখানে একটি ব্যাপার লক্ষ্যনীয় এইসব পিতামাতাই এক সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যত নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তবে তাদের ভিক্তিহীন প্রত্যাশা, ভুল মানদণ্ড ও কৌশল, মূল্যবোধ ও প্রায়োগিক ত্রুটির কারণে সব আজ হতাশায় রুপান্তরিত হয়েছে।
আশার কথাঃ পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যাবস্থায় পশ্চিমা দেশগুলোতে মুসলিম তথা বাংলাদেশী কমিউনিটি আগের চাইতে এখন অনেক বেশি সক্রিয়। ভিনদেশে নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশীদের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষা অর্জনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে বিভিন্ন অলাভজনক সংগঠন। তাদের গৃহীত কর্মসূচীর মধ্যে ইয়থ ক্যাম্প, মূল ধারার পেশাজীবীদের সাথে পরিচিত ও মতবিনিময় সভা, সোশ্যাল ওয়ার্ক, দেশীয় কৃষ্টি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। পাশাপাশি এসব আয়োজনের মাধ্যমে অভিভাবক মহলও আজ বেশ সচেতন। তারা ধীরে ধীরে বুঝতে সক্ষম হয়েছেন যে কনভেনশনাল সম্পর্ক দিয়ে এই ভিন্ন পরিবেশে সন্তান মানুষ করা প্রায় অসম্ভব।
বিষয়: আন্তর্জাতিক
১৩৫২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন