সাহসের বাতিঘর মাহমুদুর রহমান

লিখেছেন লিখেছেন শরীফ মিরাজ ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৪:৩০:০৭ বিকাল

রেডিও তেহরান : জনাব মাহমুদুর রহমান, আপনি কোন যুক্তিতে রাজধানীর শাহবাগের সমাবেশ ও অবস্থান কর্মসূচিকে ফ্যাসিবাদ বলছেন? ফ্যাসিবাদের যে সংজ্ঞা আছে তার আলোকে কি এ আন্দোলনকে ফ্যাসিবাদ বলে আখ্যায়িত করা যায়?

মাহমুদুর রহমান : দেখুন! আন্দোলনের কিছু ধারা আছে। প্রথম কথা হচ্ছে, আন্দোলন বলতে আমরা যেটা বুঝি সেটা হয় সরকার কিংবা establishment-এর বিরুদ্ধে। আর বর্তমান আন্দোলনটি পরিচালিত হচ্ছে সরকার দ্বারা এবং সরকারের সহায়তায়। সরকার খাওয়া দিচ্ছে, টাকা-পয়সা দিচ্ছে, সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে এবং মিডিয়াতে প্রচারের ব্যবস্থা করেছে। কাজেই এটা পরিপূর্ণভাবে সরকার দ্বারা পরিচালিত একটি সমাবেশ। এটাকে আন্দোলন বলা যায় কিনা সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই।

আর আরো গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি নিয়ে আপনি প্রশ্ন করেছেন- সেটি হচ্ছে ফ্যাসিবাদ সংক্রান্ত। ফ্যাসিবাদ মানে কী? ফ্যাসিবাদের মানে খুব সহজে যদি আমি বলি- তা হচ্ছে আমি যাকে পছন্দ করি না বা যার মতামত আমি পছন্দ করি না তাকে আমি একটা খারাপ নাম দেব, তার বিরুদ্ধে আমি অপপ্রচার চালাব এবং তাকে ধ্বংস করার জন্য কিংবা হত্যা করার জন্য instigate করব।

আমরা যদি ১৯৩০ সালের জার্মানীতে ফিরে যাই তাহলে দেখব- হিটলার তখন বলত- জার্মানীর সব অসুবিধার জন্য দায়ী ইহুদি এবং কম্যুনিস্টরা। কাজেই ইহুদি এবং কম্যুনিস্টদের ধর এবং হত্যা কর। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, তখন হিটলারের নাতসি বাহিনীর নেতৃত্বে reichstag পোড়ানো হয়েছিল এবং তখনও কিন্তু জার্মানীর তরুণ সমাজ এই কাজটি করেছিল।

আজকের শাহবাগে কী হচ্ছে? শাহবাগে বিচারের কথা কিন্তু বলা হচ্ছে না। সেখানে বলা হচ্ছে, ‘ফাঁসি চাই, জবাই কর’। তো একবিংশ শতাব্দীতে কোন সভ্য রাষ্ট্রে, ‘ফাঁসি চাই, জবাই কর’ -এসব কোনো আন্দোলনের ভাষা হতে পারে বলে আমি মনে করি না। তাছাড়া যখন পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে মৃত্যুদণ্ড উঠিয়ে দেয়ার আন্দোলন চলছে তখন শাহবাগ থেকে এই স্লোগান দেয়া হচ্ছে।

ফ্যাসিবাদের আরেকটি বড় কথা হচ্ছে যে, ভিন্নমতকে আটকে দেয়া বা ভিন্নমতকে থাকতে না দেয়া। শাহবাগ থেকে বলা হচ্ছে, instigate করা হচ্ছে পত্রিকা অফিস আক্রমণ করতে। পত্রিকা পোড়ানোর কথা বলা হচ্ছে এবং শারীরিকভাবে নিগৃহীত করার কথা বলা হচ্ছে। আপনারা জানেন যে, ইতোমধ্যে গত দু’দিনে নয়া দিগন্ত পত্রিকায় ও অফিসে এবং তাদের ছাপাখানায় আগুন দেয়া হয়েছে। খুব বড় একটা দুর্ঘটনা থেকে তারা বেঁচে গেছে। আগুন যদি spread করত তাহলে ১০০/২০০ সাংবাদিক সেই আগুনে পুড়ে নিহত হতেন। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা বিক্রিতে বাধা দেয়া হচ্ছে এবং সর্বত্র আমার দেশ পত্রিকায় আগুন দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া প্রাইভেট কোম্পানিগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যাতে আমার দেশ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন না দেয়া হয়। তার মানে দেশে যে ভিন্নমত আছে সেই ভিন্নমতকে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। গতকাল (১৩ ফেব্রুয়ারি) ১৪ দল অর্থাত যারা বর্তমানে সরকারে আছে-তাদের একটি মিটিং-এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তাদের কোনো অনুষ্ঠান কাভার করার জন্য ভিন্নমতের কোনো মিডিয়া প্রবেশ করতে পারবে না। আপনারাও মিডিয়াতে আছেন; সেক্ষেত্রে এগুলো সব যদি আমি মিলিয়ে দেখি- তাহলে এর চেয়ে বড় ফ্যাসিবাদ তো আর কিছু হতে পারে না, অন্তত আমি যতটুকু লেখাপড়া জানি তাতে সেটাই মনে হয়। কাজেই শাহবাগের আন্দোলন কোন সাধারণ-স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন নয়, এটা সরকার দ্বারা পরিচালিত, সরকারের সহায়তায় দেশের ভিন্নমত দমনের জন্য এক ধরনের সহিংসতা বা হিংসা ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সমাজে। আর এতে করে বাংলাদেশ long term-এ একটা বড় বিপদের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে বলে আমি মনে করি। আর আমি যেটা মনে করি তা প্রকাশ করার অধিকার যে কোন গণতান্ত্রিক সমাজে যেমন আছে আমারও সে অধিকার আছে।

রেডিও তেহরান : দেশের চলমান এ আন্দোলনে সাংবাদিকতার জগতে সম্ভবত আপনিই একা এর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান নিয়েছেন? আপনার অবস্থান তো তাহলে গণবিরোধী হয়ে গেল? তাছাড়া, এ আন্দোলন যদি ভুল পথে এবং ভুল উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয় তাহলে দেশের সর্বস্তরের মানুষ কেন এর সঙ্গে রয়েছে?

মাহমুদুর রহমান : দেখুন, দেশের সর্বস্তরের মানুষ যে এর সঙ্গে আছে এর প্রমাণ কোথায় পাওয়া গেল তা আমি জানি না! এ নিয়ে কোন রকম survey করা হয়েছে কিনা সে সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নেই। তবে আমি যেটা দেখতে পাচ্ছি তা হচ্ছে, প্রতিটি স্কুলের বাচ্চাদের বলে দেয়া হচ্ছে যে, কোন্‌ দিন কোন্‌ স্কুলের বাচ্চাদের এখানে আসতে হবে এবং ক্লাস থ্রি/ফোরের বাচ্চাদের মাথায় ‘ফাঁসি চাই’ স্লোগানের ব্যান্ড পরিয়ে দেয়া হচ্ছে। আর এসব ব্যান্ড পরিয়ে দিচ্ছেন স্কুলের শিক্ষকরা। আর বিভিন্ন জায়গা থেকে শুনেছি, সরকার স্কুল কর্তৃপক্ষকে টাকা-পয়সা দিচ্ছে। এভাবে যদি সরকার একটা concord আন্দোলন চালায় তাহলে তাকে গণমুখী আন্দোলন বলা যায় কিনা সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই।

আর আমার অবস্থান নিয়ে আপনি যে প্রশ্ন করলেন- সে ব্যাপারে আমি বলব- ভিন্নমতকে তো অনেক রকম নাম দেয়া যায়। তবে আমার বিবেচনায় আমি সঠিক অবস্থানে আছি; আপনার বিবেচনায় সেটা নাও হতে পারে। তার মানে তো এই নয় যে, আপনি ভিন্নমতকে ধ্বংস করে দিতে চাইবেন, ভিন্নমতকে আপনি পুড়িয়ে মেরে ফেলে দিতে চাইবেন। একটা কথা মনে রাখতে হবে, পৃথিবীতে জনগণের আবেগ বা উন্মাদনাকে পুঁজি করে ফ্যাসিবাদ বিকশিত হয়েছে। বাংলাদেশে তারই এক ধরনের পুনরাবৃত্তি দেখতে পাচ্ছি।

রেডিও তেহরান : আপনি শাহবাগের এ আন্দোলনকে ফ্যাসিবাদ বলছেন। কিসের ভিত্তিতে বা কিসের দাবিতে আন্দোলন হলে আপনি তাকে সঠিক বলে আখ্যায়িত করতেন?

মাহমুদুর রহমান : শাহবাগের এ আন্দোলনকে আমি সঠিক বলে আখ্যায়িত করতাম যদি এখানে সঠিক বিচারের দাবি করা হত। আমাদের মনে রাখতে হবে, যে ট্রাইবুনালে বিচার করা হয়েছে সেই ট্রাইব্যুনালটি সরকার গঠন করেছে। যে বিচারপতিরা ট্রাইব্যুনালে বিচার করছেন তাদেরকে সরকার বিচারক বানিয়েছে। আর বাংলাদেশে বর্তমানে আদালতের যে অবস্থা সে সম্পর্কে আমি বলব- এ দেশের ইতিহাসে এর আগে এখনকার মতো সরকারের নিয়ন্ত্রণে আদালত কখনও হয়নি। কাজেই এখানে যে রায়গুলো হচ্ছে তাতে সরকারের যে হাত নেই সে কথা না বলারও কোন সুযোগ নেই। তাহলে কি সরকারই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে? কাজেই এটাকে আমি তখনই জনগণের প্রকৃত আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করতাম- যদি ‘ফাঁসি চাই ও জবাই কর’ মার্কা ফ্যাসিস্ট স্লোগান এখান থেকে উচ্চারিত না হত। দ্বিতীয়ত যদি আন্দোলনটা সরকারের বিরুদ্ধে হত তাহলে বলতে পারতাম এটি জনগণের আন্দোলন- কারণ কাজটি তো সরকার করছে। পক্ষান্তরে এখানে দেখতে পাচ্ছি সরকার উল্টো সহায়তা দিচ্ছে। আর সরকারের সঙ্গে ১৪ দল মিলে এ আন্দোলনটি পরিচালনা করছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এটাকে নিরপেক্ষ বলা বা জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া বলার কোনো সুযোগ নেই। কাজেই আন্দোলনের যে নিরপেক্ষ চরিত্র সেটা প্রথম থেকেই ধ্বংস হয়েছে।

আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে-সেটি হচ্ছে- এখানে যারা উদ্যোক্তা তারা যেভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলেছেন…আপনি জানেন যে, গত পরশু দিন ঢাকা শহরে বিক্ষোভের সময় যেভাবে বয়োবৃদ্ধ মুসল্লিদের দাড়ি ধরে টানাটানি করা হয়েছে- এ রকম দৃশ্য একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে দেখতে হবে বলে আমি কখনও মনে করিনি।

রেডিও তেহরান : বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে, আপনি জামায়াত ও বিএনপি’র হয়ে কাজ করছেন এবং একজন সাংবাদিক হিসেবে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করছেন না। এ ছাড়া, শাহবাগ আন্দোলন তো হচ্ছে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের শাস্তির দাবিতে। তার মানে হচ্ছে, আপনি এ আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে প্রকৃতপক্ষে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন…?

মাহমুদুর রহমান : প্রথম কথা হচ্ছে, আপনি একটি শব্দে ভুল বললেন, সেটি হচ্ছে তারা বিচারের জন্য আন্দোলন করছে না- তারা ফাঁসির জন্য আন্দোলন করছে। বিচার এবং ফাঁসি এক জিনিস নয়। এখানে Mob lynching এর কথা বলা হচ্ছে। তো Mob lynching কবে থেকে বিচার হল সেটা আমার জানা নেই। সেই মধ্যযুগে যখন ফ্রান্সের Joan of Arc’কে ডাইনি বলে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল তখনও কিন্তু এই ধরনের কথা বলা হয়েছিল যে, সে ডাইনি। সেগুলোকে আপনারা বিচার বলবেন কিনা আমি জানি না; হয়তো আপনারা তাকে বিচার বলতে পারেন তবে আমি অন্তত বিচার বলতে পারছি না।

আর দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, সব পত্রিকার একটি editorial policy থাকে। বিএনপি ও জামায়াতের পক্ষে আমি যাচ্ছি- এ কথাটা বলা সম্পূর্ণ ভুল। গত দুই সপ্তাহে আমি শুধু পত্রিকা সম্পাদনাই করিনি যথেষ্ট লেখালেখিও করেছি এবং হয়ত আপনারা কেউ আমার লেখা পড়তেও পারেন। গত দুই সপ্তাহে দুটি লেখাতে আমি বিএনপির বেশ কিছু policy’র তীব্র সমালোচনা করেছি। শুধু তাই নয়, বিএনপির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমাদের পত্রিকায় সমালোচনা করা হয়। জামায়াতের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। জামায়াতের ভুল-ত্রুটি দেখিয়ে আমার অনেক লেখালেখি আছে। কাজেই আমি জামায়াত ও বিএনপির হয়ে কাজ করছি- এ অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আপনার অভিযোগ যদি আমি সত্যি ধরেও নেই- সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে তো সরকারের পক্ষের মিডিয়ার কোনো অভাব নেই। বাংলাদেশের অনেক পত্রিকা আছে যেগুলোকে আওয়ামীকণ্ঠ নামে অভিহিত করা হয়, এ বিষয়টি সকলেই জানেন। তাহলে কি আপনি বলতে চান, সে সমস্ত পত্রিকাও ফ্যাসিবাদী কায়দায় বন্ধ করে দিতে হবে? নাকি বাংলাদেশে শুধুমাত্র সরকারের তল্পিবাহক হয়ে পত্রিকা চালালেই কেবল পত্রিকা চালানো যাবে, সরকারের সমালোচনা করলে পত্রিকা চালানো যাবে না!

আরেকটি বড় কথা হল- আমার দেশ কি করেছে! আমার দেশ গত চার বছর ধরে বর্তমান সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লিখেছে। এই সরকারের মানবাধিকার হরণের বিরুদ্ধে লিখেছে। বর্তমান সরকারের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে লিখেছে, গণতন্ত্র বিরোধী কার্যকলাপের ব্যাপারে লিখেছে এবং আদালত দলীয়করণের বিরুদ্ধে লিখেছে। এর মধ্যে কোনটা আপনার কাছে মনে হচ্ছে যে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটা যুক্তিসংগত নয় এবং (আপনার দৃষ্টিতে) কোনটা বিএনপি এবং জামাতের পক্ষে যাচ্ছে? কাজেই আমরা একটা আদর্শের ভিত্তিতে পত্রিকা চালাচ্ছি। আর যত বড় বিপদই আসুক না কেনো এবং ফ্যাসিবাদী শক্তি যত শক্তিশালী হোক না কেন ইনশাআল্লাহ আমরা যে independence নিয়ে কাজ করছি সেটা শেষ পর্যন্ত অব্যাহত রাখব। আর তার জন্য যদি এই সরকার আমাদের ওপরে অত্যাচারের স্টিম রোলারও চালিয়ে দেয় যেভাবে অন্যান্য রাষ্ট্রে ফ্যাসিবাদী সরকারগুলো চালিয়েছে সেক্ষেত্রে আমরা আমাদের দায়িত্ব থেকে নিবৃত হব না। আপনারা মনে করে দেখবেন যে, সেই হিটলারের সময়ও কিন্তু যারা তার নীতির সমালোচনা করেছে আপনাদের মতো করেই সেদিন তাদের সমালোচনা করে বলা হয়েছে, এরা গণবিরোধী অবস্থান নিয়েছে কারণ সব জনগণ হিটলারের সাথে আছে। এসব বিষয়কে আমরা যেন ভুলে না যাই।

রেডিও তেহরান : আচ্ছা, একজন সম্পাদক হিসেবে আপনার দৃষ্টিতে সরকার ও বিরোধীদলের সফলতা ও ব্যর্থতা কি?

মাহমুদুর রহমান : সরকারের সফলতার কথা আমি আগে বলি, কারণ আপনারা বলেন যে আমি সব সময় সরকারের সমালোচনা করি। সরকারের সফলতার মধ্যে একটি কথা আগে বলতে হবে যে, বর্তমান সরকারের সময়ে পর পর চার বছর খুব ভাল ফসল উতপাদিত হয়েছে। আর সেই দিক থেকে আমরা খাদ্যে- অন্তত ধান উতপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি; যদিও দ্রব্যমূল্য এখনও অনেক উচুঁতে। কাজেই কৃষিক্ষেত্রে এই সরকার ভাল কাজ করেছে।

আর ব্যর্থতার দলিল বলতে গেলে সেটা অনেক লম্বা হয়ে যাবে। ফলে অনেকগুলো না বলে দু’তিনটি ব্যর্থতার কথা আমি বলতে চাই। সর্বগ্রাসী দুর্নীতি বাংলাদেশকে গ্রাস করেছে। আর এই দুর্নীতি শীর্ষমহল থেকে চালানো হচ্ছে। পদ্মা সেতু সম্পর্কে আপনারা জানেন যে, বলা হয়েছে একজন মন্ত্রী ঘুষ নিয়েছেন বা ঘুষের ষড়যন্ত্র করেছেন; যে কারণে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকা সবাই ঋণ প্রত্যাহার করে চলে গেছে। এ বিষয়টি নিয়ে জাতি হিসেবে আমাদের মাথা কাটা গেছে। তাছাড়া টিআইবি প্রতিবেদনেও দেখা গেছে যে, এক বছরে আমরা প্রায় আট ধাপ নিচে নেমে গেছি দুর্নীতির সূচকে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও ক’দিন আগে Reporters without borders-এর একটি সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে- সেখানে শতকরা ১৫ ভাগ নেমে গেছে বাংলাদেশ। মানবাধিকার বিরোধী অপরাধের দায়ে দেশে এখন বিচার হচ্ছে- যে কথা আপনি বললেন, (কিন্তু আসলে মানবাধিকারের অপরাধের বিচারের দাবি নাকি ফাঁসীর দাবি; কিন্তু সে যাই হোক) এখনও প্রতিদিন দেশে মানবাধিকার হরণ হচ্ছে। আর সেগুলোর রেকর্ডও এ সরকারের আমলে খুব খারাপ।

আর বিরোধীদলের ব্যর্থতার দিকে যদি আসেন-তাহলে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি তাদের দল গোছাতে ব্যর্থ হয়েছে। দেশের জনমত তাদের পক্ষে গেলেও জনমতের ইস্যু নিয়ে মাঠে নামতে এখন পর্যন্ত তারা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আর সফলতার কথা যদি বলেন- তাহলে পূর্বের তুলনায় ধ্বংসাত্মক কাজ অনেক কম করেছে, হরতাল অনেক কম দিয়েছে। সেই বিবেচনায় জনগণের জন্য তারা খুব একটা অসুবিধার কারণ হয়নি। অন্য একটি বিরোধীদল জামায়াতে ইসলামীর কথা যদি বলেন- সেক্ষেত্রে তাদের ১৯৭১ সালের যে ভূমিকা ছিল এবং তাদের নেতারা যখন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর জন্য কাজ করেছেন, এবং কোনো কোনো নেতা-কর্মী মানবতা বিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়েছেন- সেই অপরাধের বোঝা তারা নামাতে পারেনি এবং তারা জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। আমার কাছে মনে হয়, এটাই জামায়াতে ইসলামীর সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।

তার সঙ্গে এ কথাও বলতে হবে যে, বাংলাদেশে কিন্তু এখন যুদ্ধাপরাধের বিচার হচ্ছে না। কারণ প্রকৃত যুদ্ধাপরাধী ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৯৫ জন কর্মকর্তা যাদেরকে কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান ছেড়ে দিয়েছিলেন। এ ইতিহাস যেন আমরা বিস্মৃত না হই। তবে মানবতাবিরোধী যাদের কথা বলা হচ্ছে-তারা কিন্তু অন্যান্য দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিতেও আছে। কিন্তু বেছে বেছে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির লোকজনের বিচার করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে থাকা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এখনও করা হয়নি। এ সম্পর্কে একটি উদাহরণ আপনাদেরকে দেই যেটি আমাদের আজকের (১৪ ফেব্রুয়ারি) পত্রিকায় আছে। বাংলাদেশের জামালপুর জেলাতে সরিষাবাড়ি নামে একটি জায়গা আছে। সেখানে গতকাল একটি গণতন্ত্র মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। আর সেই গণতন্ত্র মঞ্চের যিনি প্রধান নেতা তার নাম নুরু মাওলানা। তিনি ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধী। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে যে তিনি নিজে মানুষ হত্যা করেছেন। সেই ব্যক্তি আজ গণতন্ত্র মঞ্চের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার মানে সরকারী দল আওয়ামী লীগ করলে যুদ্ধাপরাধী কিংবা মানবতাবিরোধীও মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যায়। তো এ বিষয়টি এই সরকারের একটা বড় সমস্যা। কাজেই সব মিলিয়ে আমি যে কথা বলব সেটা হচ্ছে- আমাদের গণতন্ত্র হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে, দেশ সহিংসতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কাজেই যারা সরকারে আছেন তারা যদি একটু দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ না করেন তাহলে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদী সহিংসতার মধ্যে পড়তে পারে। আর সেটা কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিকের কাম্য হতে পারে না। আমি একজন পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে জনগণকে শান্তি, ন্যায়বিচার এবং আইনের শাসনের দিকে আহবান জানাচ্ছি। কোনো mob rule একটি রাষ্ট্রের আইন হতে পারে না। আর mob rule যদি চলে তাহলে ট্রাইব্যুনাল বিচার করবে কীভাবে! আর সেক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালের বিচারের গ্রহণযোগ্যতা থাকবে কী করে! ইতোমধ্যে আপনারা জানেন যে জাতিসংঘ বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনালের নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। এই চাপের মধ্যে ট্রাইব্যুনালের বিচারপতিদের পক্ষে কোনো রায় দেয়া কীভাবে সম্ভব হতে পারে সেটা আমি বুঝতে পারি না। কিছুদিন আগে আমাদের একজন বরেণ্য আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল হকও বলেছেন, এরপর এই ট্রাইব্যুনাল থেকে যে রায়ই দেয়া হোক না কেনো তা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আর এই পরিস্থিতি তৈরির জন্য সরকারই সর্বোতভাবে দায়ী- এ কথাটাও যেন আমরা ভুলে না যাই। আমি রেডিও তেহরানের শ্রোতাদের প্রতি আহ্বান জানাব, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার যে লড়াই আমার দেশ করছে তার সঙ্গে যেন তারা থাকেন।#

বিষয়: বিবিধ

১১৬১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File