পরিণতি - পর্ব ৪

লিখেছেন লিখেছেন রেহনুমা বিনত আনিস ১০ জানুয়ারি, ২০১৫, ০৫:৫৫:৪২ সকাল

পরদিন একটা অপরিচিত খাটে নিজেকে আবিষ্কার করে শান্তা। মুক্তাবুবুর বড় মেয়েটা নিজের বাচ্চা আর মায়াকে মাদুর পেতে একসাথে রোদে বসিয়ে খাওয়াচ্ছে। এই অনিন্দ্য সুন্দর ভালোবাসার দৃশ্যটা দেখে শান্তার মনে হয় যেন গতরাতে যা ঘটেছে তা ছিলো এক দুঃস্বপ্ন। কিন্তু প্রত্যক্ষ সবকিছু সাক্ষ্য দেয়, ওর দুঃসহ স্মৃতিটা আসলেই বাস্তবতা।

সে মাথা তুলে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার নাম কি?’

‘নাবিলা’।

‘তুমি কি একটু মায়াকে দেখবে? আমি একটু বাইরে যাই। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে’।

‘ও মা, আমি তো রাত থেকেই ওকে দেখছি! আপনি যান’।

মাথা ঝিমঝিম করে শান্তার। পুকুরপাড়ে একটা গাছের গুঁড়ির ওপর বসে ঝির ঝির বাতাসে মাথার ভেতরের সব জঞ্জাল উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে সে। একটু পর একটা শিশুর খিল খিল হাসির শব্দ, সাথে কোন নারী, সম্ভবত শিশুটির মায়ের, প্রশ্রয়দায়িনী নির্মল হসির আওয়াজ শুনে চোখ তুলে তাকায় শান্তা। পুকুরের ঐ পাড়ে একটা অসম্ভব সুন্দর শিশু এক অসম্ভব রূপবতী মায়ের কোলে বসে স্বর্গীয় হাসি ছড়িয়ে দিচ্ছে পুরোটা পুকুরপাড় জুড়ে। মেয়েটার সাথে চোখাচোখি হয়ে যায় শান্তার। সেই টানা টানা চোখ কি যেন বলতে চায়। দু’জনই দু’জনের দিকে এগিয়ে যায় অমোঘ আকর্ষনে।

মেয়েটা অপ্সরীর মত রিনরিনে কন্ঠে বলে, ‘শান্তা, তাই না?’

গলাটা কেমন পরিচিত মনে হয়। কিন্তু একটা অপরিচিত মেয়ে ওকে নাম ধরে ডাকছে, ব্যাপারটাতে প্রচন্ড অবাক হয় শান্তা। মেয়েটা আবারও বলে, ‘তুমিই তবে শান্তা, মোক্তারের ... শোভনের বৌ’।

‘তুমি?’

‘আমি ঝর্ণা। মোক্তারের ... শোভনের বৌ ছিলাম’।

শান্তার বুকের ভেতরটা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে আসে, সে ঝর্ণার দু’হাত মুঠো করে ধরে বলে, ‘বিশ্বাস কর, আমি জানতাম না’।

ঝর্ণা বলে, ‘না, তুমি জানতে চাওনি’।

কোন অভিযোগ না, অভিমান না, নিখাদ সত্যের উপস্থাপনা। আসলেই তো, সত্য বার বার শান্তার সামনে এসে কড়া নেড়েছে কিন্তু সে নিজের সুখের পেছনে ছুটতে গিয়ে কিছুতেই তার আহ্বানে সাড়া দিতে পারেনি।

‘তুমি আমাকে মাফ করে দিয়ো’।

‘সে তো কবেই দিয়েছি! মোক্তারের বৌ হওয়াটাই তো একটা শাস্তি! আমি আর তোমার ওপর রাগ রেখে কি করব? আমি পাপ করেছিলাম। ওকে বিশ্বাস করে ঘর ছেড়ে পালিয়েছিলাম। তার শাস্তি তো আমি, আমার বাবামা, আমার পুরো পরিবার মিলে পেলাম। ও আমাকে বের করে দিয়ে আসলে আমাকে মুক্তি দিয়েছে, আমার গুনাহ শেষপর্যন্ত মাফ হয়েছে’।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্তা প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে চায়, ‘পুকুরের ঐ পাড়ে আলিশান বাগানবাড়ীটা নিশ্চয়ই তোমার বাপের বাড়ী!’

‘কে বলল? ওটা আমার বাড়ী। আমার স্বামীর বাড়ী। তিন বছর আগে ওর বৌ মরল বাচ্চা হতে গিয়ে। সে সিদ্ধান্ত নিলো আর বিয়ে করবেনা। কিন্তু যখন মোক্তার আমাকে বের করে দিলো তখন মুক্তা বুবু ওর সাথে কথা বলে, অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজী করল। কেমন হালে আছি তা তো দেখছই। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা মানুষটা খুব ভাল। আমাকে, আমার বাচ্চাকে নিজের মত করে যত্ন করে’।

‘বিশ্বাস কর, তুমি ভাল আছ দেখে ভাল লাগছে। আমাকে মাফ করে দিয়ো ঝর্ণা’।

ঝর্ণা কিছু বললনা। মুক্তাকে এগিয়ে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কি বুবু, লোকজন কবর দিয়ে ফিরেছে?’

‘আমার ছেলে ছোটটা এসে বলল মোনাজাত শেষ, যেকোন সময় ফিরবে। রায়হানকে বলেছি আমাদের এখানে এসে নাস্তা খেতে, তুমিও চলে আস’।

তারপর হাত বাড়িয়ে দিয়ে শিশুটিকে কোলে আহ্বান করে, শিশুটিও খিল খিল করে হাসতে হাসতে মুক্তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শান্তার দিকে তাকিয়ে মুক্তা বলে, ‘ওর নাম মুসলিম’। তারপর আর কিছু না বলে বাড়ীর দিকে এগোতে থাকে। শান্তা আর ঝর্ণা নিঃশব্দে অনুসরন করে।

নাস্তার পর্ব শেষে শোভন আর শান্তা ফিরে আসে ঢাকায়। ঝর্ণার স্বামী রায়হানকে এক নজর দেখে ওর মনে হয় এই বাড়ীর সবাই যেমন দেখতে সুন্দর, তেমনই মনের দিক থেকেও পবিত্র। ওদের সাথে নিজের ভাগ্যের তুলনা করে কেমন একটা হাহাকার জন্মায় ওর মনের ভেতর।

(চলবে ইনশা আল্লাহ)

বিষয়: বিবিধ

২২২১ বার পঠিত, ২১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

300007
১০ জানুয়ারি ২০১৫ সকাল ০৭:৫৩
ইবনে হাসেম লিখেছেন : ঢাকা শহরের ডিজিটাল (একবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের) যুগের এক জলজ্যান্ত এবং বাস্তব প্রতিনিধি এই মেয়ে শান্তা। আপনার কলমের খোঁচায় সমসাময়িক মহিলা -মেসের নারী চরিত্রের এক অভিনব উপাখ্যান। এই একটি মেয়ে যেন বর্তমান রাজধানী ঢাকার কলেজ ভার্সিটিতে পড়ুয়া অভিভাবকহীন নারী সমাজের - যারা গ্রাম হতে তথাকথিত উচ্চ শিক্ষার্থে ঢাকায় আসে - আভ্যন্তরীণ করুণ অবস্থার এক দুর্দান্ত প্রতিনিধি, তথা চলমান কাহিনী। নারী হয়ে নারীর এ করুণ অবস্থার কথা আপনার কলমে অতি স্ফটিক স্বচ্ছতার সাথেই উঠে এসেছে। আল্লাহ আপনাকে বাংলার আধুনিকা নারীদের মুক্তির দূতরূপে ক্ববুল করুন, আমিন।
১০ জানুয়ারি ২০১৫ দুপুর ১২:১১
242848
রেহনুমা বিনত আনিস লিখেছেন : আমীন Praying Praying
300008
১০ জানুয়ারি ২০১৫ সকাল ০৯:০৬
জাহিদ হাসান লিখেছেন : রেহনুমা বিনত আনিস যার নাম
তার লেখার এমনই দাম।
দারুন আপু ধন্যবাদ।
১০ জানুয়ারি ২০১৫ দুপুর ১২:১২
242849
রেহনুমা বিনত আনিস লিখেছেন : হা হা, সুন্দর কবিতার জন্য ধন্যবাদ ভাই যদিও কথাগুলো সত্য নয় Good Luck
300009
১০ জানুয়ারি ২০১৫ সকাল ০৯:১৪
ইবনে হাসেম লিখেছেন : শান্তা কি এখনো মোক্তার নামক বজ্জাতের সাথে চালিয়ে যাবে, নাকি ঢাকায় পৌঁছেই তার সাথে চূড়ান্ত বুঝাপড়া করে নেবে এখন সেটাই দেখার বিষয়। তবে, চূড়ান্ত বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে এখন কোলের সন্তানটি হবে বড় বাঁধা। হয়তঃ বা ঝর্ণার যেমন অলৌকিক একটা গতি হয়ে গেল, শান্তার বেলায়ও তো হতে পারে। লেখিকার প্ল্যান কি সেটা তো আর বলা যাচ্ছে না.... Thinking Thinking
১০ জানুয়ারি ২০১৫ দুপুর ১২:১৩
242850
রেহনুমা বিনত আনিস লিখেছেন : আর একটা পর্ব বাকী, ক্ষুদ্র পর্ব, দেখুন কি হয় Happy
আমি আসলে সিরিজ লিখিনা। গল্প বেশী বড় হয়ে গেলে ভাগ ভাগ করে দেই। সুতরাং, প্ল্যান করার কোন সুযোগ থাকেনা Happy
300021
১০ জানুয়ারি ২০১৫ সকাল ১০:১৩
পুস্পগন্ধা লিখেছেন :
এরপর কি হবে?
১০ জানুয়ারি ২০১৫ দুপুর ১২:১৩
242851
রেহনুমা বিনত আনিস লিখেছেন : আগামী পর্বে সমাপ্য ইনশা আল্লাহ Happy
300051
১০ জানুয়ারি ২০১৫ দুপুর ০৩:৫৮
নিরব পড়ুয়া লিখেছেন : শান্তার সংসারে কি শান্তি নামক বস্তুুটা আসবে না।আমাদের শান্তা আপুরা কবে সচেতন হবে।
১১ জানুয়ারি ২০১৫ রাত ০৩:০৯
242884
রেহনুমা বিনত আনিস লিখেছেন : প্রথম থেকে শান্তির পথ বেছে নেয়ার ব্যাপারে সচেতন না থাকলে পরে শান্তি পাওয়া কঠিন ব্যাপার :Thinking
300058
১০ জানুয়ারি ২০১৫ বিকাল ০৫:৩৫
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : ঝর্ণার ভাগ্যটা পরিবর্তন হওয়াতে ভালো লাগলো।
১১ জানুয়ারি ২০১৫ রাত ০৩:১০
242885
রেহনুমা বিনত আনিস লিখেছেন : মানুষ যখন নিজের পাপের জন্য লজ্জিত হয় তখন আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করে দেন Happy
300076
১১ জানুয়ারি ২০১৫ রাত ১২:২০
প্রগতিশীল লিখেছেন : বুদ্ধিমতি বনাম বোকা...ইনাদের ‘অতিবুদ্ধি’ থাকার কারণেই সেকেন্ড হ্যান্ড হতে হয়...কি দুষ করছি আমি (হতভাগারা) ;Winking ;Winking
১১ জানুয়ারি ২০১৫ রাত ০৩:১১
242886
রেহনুমা বিনত আনিস লিখেছেন : হা হা, মানুষ কেন যে সতযটাকে চোখের সামনে দেখেও মূল্যায়ন করেনা অথচ দুষ্টের মিষ্ট কথায় ভুলে যায়, কে জানে!
300131
১১ জানুয়ারি ২০১৫ সকাল ১১:২০
নোমান২৯ লিখেছেন : Applause Happy Good Luck Rose
১২ জানুয়ারি ২০১৫ রাত ১২:৫৬
242965
রেহনুমা বিনত আনিস লিখেছেন : Happy Good Luck
300181
১১ জানুয়ারি ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:৫০
প্রবাসী আশরাফ লিখেছেন : অমানুষের হাত থেকে মুক্তি পাওয়াটাও একটা নেয়ামত মনে হয় যা ঝর্নার কন্ঠে ভেসে এসেছে...দেখি সামনে কি আছে...
১২ জানুয়ারি ২০১৫ রাত ১২:৫৭
242966
রেহনুমা বিনত আনিস লিখেছেন : যে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে সে মুক্তি পায়, অন্যদের অবস্থা হয় আরো করুণ Worried
১০
300234
১২ জানুয়ারি ২০১৫ রাত ০৩:২৯
সাদিয়া মুকিম লিখেছেন : পড়তে পড়তে খুব ইচ্ছে হলো শান্তার বড় হয়ে ওঠা বিষয়ে জানার জন্য! ১ম পর্বে পড়েছিলাম ঢাকায় পড়তে আসা, ছোট বেলায় মা হারা! এটাইকি মূল কারন? হয়ত কিছুটা দায়ী! কেননা শুধু সৎমা আছে বলেই কেউ এত অনৈতিক কাজে জড়ায় না!

বাবা মা উভয়ের দা্যিত্ব সন্তান পৃথিবীতে আসার আগেই তাকে ইসলামী জীবন ব্যবস্হার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া, ভালো মুসলিম হিসেবে তৈরিতে সহায়তা করবে! প্রথম থেকেই যখন সে ইসলামের দেখা পায়নি বা পেলেও তা অন্তঃসার শূন্য ছিল তাই সে বাকি সময়েও জীবনটাকে ভুলের সীমানায় নিয়ে গেছে! বিয়েও করেছে সেটাও কি বাবার সন্মতিতে হয়েছিলো কিনা সেটাও দেখার ব্যাপার! হ্য়ত সব শান্তারা এই রকম না কিন্তু সব শান্তারা একই রকম ভুল করে!

ভুল করা থেকে বিরত রাখার জন্য আপনার এই গল্পের ভয়াবহ পরিনতি আশাকরি আমাদের সমাজের সবাইর জন্য শিক্ষনীয় হয়ে থাকবে!জাযাকিল্লাহু খাইর! Love Struck
১২ জানুয়ারি ২০১৫ সকাল ০৮:৫৩
242987
রেহনুমা বিনত আনিস লিখেছেন : ভুল করা থেকে বিরত রাখার জন্য আপনার এই গল্পের ভয়াবহ পরিনতি আশাকরি আমাদের সমাজের সবাইর জন্য শিক্ষনীয় হয়ে থাকবে - সেটাই উদ্দেশ্য আপু Happy
ওয়া ইয়্যাকি Love Struck Love Struck Love Struck
১১
308052
০৯ মার্চ ২০১৫ বিকাল ০৪:২৫
সত্য নির্বাক কেন লিখেছেন : তবে কি সব মা হারা মেয়েদেরকে মানুষ সন্দেহের চোখে দেখবে??
মা বাবা সহ টাকা পয়সা ওয়ালাদের ললনাদের ই বেশী পতিত দেখি ঢাকা শহরে......

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File