পরিণতি - পর্ব ৩
লিখেছেন লিখেছেন রেহনুমা বিনত আনিস ০৯ জানুয়ারি, ২০১৫, ০৯:৫৭:০২ সকাল
শোভন বাথরুম থেকে বেরোলে শান্তা ওকে খবরটা দেয়। শোভন কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। ওর প্রশ্নেরও কোন জবাব দেয়না। কিন্তু শান্তা মনে শান্তি পায়না। ফোন যেই করে থাকুক, মা অসুস্থ এটাই এখন প্রায়োরিটি। পরদিন সে অফিস থেকে ফেরার পথে দু’টো টিকেট করে এনে শোভনকে বলে, ‘অফিস থেকে ছুটি নিয়ে এসেছি। কাল আমরা মাকে নিয়ে আসতে যাচ্ছি’।
প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে যায় শোভন। ওর এত রেগে যাবার কারণ বুঝতে পারেনা শান্তা। আজকাল প্রায়ই সে কারণে অকারণে রাগারাগি করে। নিশ্চয়ই মায়ের জন্য মন খারাপ, এই ভেবে পাত্তা দেয়না শান্তা। কোন জবাব না দিয়ে ধীরেসুস্থে স্যুটকেস গুছাতে থাকে। পরদিন ভোরে শোভনের খিটিমিটির মধ্যে ট্যাক্সি ডাকিয়ে বাস স্টেশনে রওয়ানা দেয় ওরা। বাসে উঠেও শোভনের মুডের কোন উন্নতি হয়না। সাত ঘন্টা পর বাস থেকে নেমে রিক্সা নিয়ে কিছুদূর গিয়ে একটা বাড়ীর উঠোনে থামে ওরা। সাধারন গ্রামীন চাষীদের বাড়ী যেমন। দেখে মনে হয় যেন কতদিন এখানে কেউ থাকেনা। অনেকক্ষণ দরজায় কড়া নাড়ার পর পাশের বাড়ীর এক মহিলা বেরিয়ে এসে বলে, ‘তুই এসেছিস, ...র বাচ্চা! বুড়া মা’টাকে উঠানের মধ্যে ফেলে দিয়ে যে চলে গেলি, দুই বছরে একবারও কি মনে হোলনা দেখে আসি বুড়ি মরল না বেঁচে আছে?’
শোভন কোন জবাব দেয়না। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বলে, ‘বড়বুবু ফোন করে বলল মা অসুস্থ, সেজন্যই তো এলাম। তো মা কই?’
‘সে তো তখনই মুক্তা এসে তোর মাকে নিয়ে গেল। এমন কঠিন রোগী এখানে একা একা বাঁচত কি করে?’
আবার রিক্সায় চেপে বসে ওরা। শোভনের মুখের অবস্থা দেখে শান্তা কোন প্রশ্ন করেনা। শোভনের মা এত অসুস্থ, অথচ মহিলার কোন কমন সেন্স নেই, কিভাবে এত কড়া কড়া কতগুলি কথা বলল বেচারাকে! অথচ সে নিজের স্ত্রী সন্তানের পেছনে ব্যায় না করে প্রতিটি পয়সা মাকে পাঠিয়ে দেয়!
কিছুদূর গিয়ে একটি মোটামুটি অবস্থাপন্ন গৃহস্থবাড়ী দেখা গেল। গৃহস্থ বাড়ীর আঙ্গিনায় আরামকেদারায় বসে পড়ন্ত বিকেলের রোদ পোহাচ্ছিল। ওদের দেখে মুখ ফিরিয়ে চলে গেল। বাড়ীর ভেতর হাঁক শোনা গেল, ‘বৌ, তোমার কুলাঙ্গার ভাই এসেছে’। একজন বিশালকায় মহিলা ব্যাস্তসমস্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন। কোন অভিবাদন নয়, অভ্যর্থনা নয়, নীরবে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন বাড়ীর ভেতর। একটা বড় কামরার ঠিক মধ্যখানে বিশাল একটা খাটের ওপর শুয়ে আছেন শীর্ণকায়া মা, হাড়ের সাথে চামড়া যেন লেগে গিয়েছে। সেই হাড্ডিচর্মসার দেহের সেবায় ব্যাস্ত তিন চারজন মেয়ে। একজনকে দেখে বুঝা গেল নিশ্চয়ই সেই বিশালকায়া মহিলার মেয়ে, বিবাহিতা, কোলে বাচ্চা, সযত্নে মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। যে পায়ে হাত বুলাচ্ছে সে সম্ভবত ওনার ছোটমেয়ে, হয়ত ক্লাস নাইন টেনে পড়ে। আরেকটা মেয়ে ঔষধপত্র গুছিয়ে, বাসী খাবার পানি নিয়ে যাচ্ছে, এর খুব কমই খাওয়া হয়েছে। শোভনকে দেখে কেউ কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না সামান্য নাক কুঁচকানো ছাড়া। শোভন পাত্তা দিলোনা। মায়ের পাশে গিয়ে ‘মা’ বলে ডাক দিতেই তিনি ধীরে ধীরে চোখ খুললেন। ওকে চিনতে পারার সাথে সাথে এক অপার্থিব চিৎকার বেরিয়ে এলো ওনার গলার ভেতর থেকে। চোখ দিয়ে ফোয়ারার মত পানি বইতে লাগল, ‘কি এক হতভাগা জন্ম দিলাম আমি! তুই আমার দুনিয়া আখিরাত সব খেলি। এখন আমি আল্লাহর সামনে গিয়ে কি জবাব দেব?’ তাঁর শ্বাসকষ্ট শুরু হোল, বুকের ভেতর ঘড় ঘড় শব্দ হতে লাগল। সেই বিশালকায়া মহিলা শোভনকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে মাকে জাপ্টে ধরল। কিন্তু মাকে রাখতে পারল না। আর দশ পনেরো মিনিট প্রচন্ড কষ্ট ভোগ করে তিনি পার্থিব শরীরটাকে ফেলে রেখে চলে গেলেন।
যে মূহূর্তে স্পষ্ট হয়ে গেল মা নেই, সেই বিশালকায়া মহিলা তার পাহাড়ের মত শরীর নিয়ে অসম্ভব ক্ষিপ্রতার সাথে শোভনের দিকে ফিরে হিংস্র বাঘিনীর মত গর্জন করে উঠল, ‘তুই খুনী, তুই খুনী। তুই আমার মাকে খুন করেছিস। বেরিয়ে যা আমার চোখের সামনে থেকে। নইলে আমি তোকে খুন করব’। তাঁর দুই মেয়ে সর্বশক্তি দিয়ে তাঁকে আটকে রাখতে হিমশিম খাচ্ছিল। শোভন কোন কথা না বলে বের হয়ে গেল। এই গলা শান্তার পরিচিত। ইনিই তবে মুক্তাবুবু। সে এগিয়ে গিয়ে মায়ের চোখ দু’টো আলতো করে বন্ধ করে দিলো, ঐ দৃষ্টিতে যে ভয় ছিলো তা সে সহ্য করতে পারছিলোনা। জীবনের সমাপ্তি চোখে দেখতে পেলে নিজের কৃতকর্মের কথা ভেবে বুঝি এমনই ভয় ছেয়ে যায় মৃত্যুপথযাত্রীর দুই চোখে। মুক্তা এবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। শান্তা তার কাঁধে হাত দিয়ে বলে, ‘বুবু, শান্ত হোন। তিনি তো শোভনেরও মা ছিলেন!’
মুক্তা উদ্ভ্রান্তের মত ফিরে তাকায় শান্তার দিকে। সেই পাহাড়ের মত শরীর আর লাল লাল চোখ দেখে ভয় পেয়ে যায় শান্তা। সে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, ‘শোভন? ওর নাম তো মোক্তার! ওকে শোভন নামে শুধু তুমিই চেন’।
শান্তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। না! ওর নামটা! নামটাও সে ওকে মিথ্যা বলেছে?
‘মোক্তার বিয়ে করেছিল ঝর্ণাকে। বড়লোকের মেয়েকে সুন্দর সুন্দর কথায় ভুলিয়ে বিয়ে করল ঠিক, কিন্তু কাজ নেই কর্ম নেই, নিজেই চলতে পারেনা, বৌ চালাবে কি করে? ঝর্ণার বাবা মাসে পাঁচ হাজার টাকা ধরে দিলো ওদের কাপড়ের দোকান থেকে। ঐ টাকা আনতে সে মাসে একবার ঢাকায় যেত। ঐ দোকানে গিয়ে দেখা পেলো তোমার। ঝর্ণার তখন বাচ্চা হবে। তখন আর ওকে ভাল লাগেনা মোক্তারের। সে তখন তোমার প্রেমে মজেছে। আমরা অনেক বুঝালাম, পরে ভাবলাম একবার বাচ্চা হয়ে গেলে সন্তানের মায়ায় সে ফিরে আসবে। মা, আমি ঝর্ণার টুকটাক বদনাম করতাম। এটা না করলে ঘরের বৌয়ের উপর পাওয়ার দেখানো যায়না। কিন্তু আমরা কখনোই চাইনি ওর ঘর ভাঙ্গুক। একবার সে তোমাকে ফোন করে কথা বলার চেষ্টা করে। কি মারটা মেরেছিল ওকে পাষন্ডটা, দুই সপ্তাহ চোখ খুলতে পারেনি মেয়েটা। অথচ পরের দিন সে আবার ওদের দোকান থেকে টাকা আনতে গেল! মেয়েটার যে এত সহ্যশক্তি ছিলো! এগুলো কিছুই সে তার বাবামা ভাইদের বলতনা। পালিয়ে বিয়ে করে একবার ওদের সমাজের কাছে অপদস্থ করেছে, আবার যাতে কিছু না হয় সেজন্য কি সহ্য করেনি সে! কিন্তু পারলনা তো সংসারটা টিকাতে। তোমার মোটা মাথায় কিছুই ঢুকলোনা। তোমার কাছে শেষ একবার আর্জি জানানোর জন্য আমিই ওকে ফোনটা করে দেই। কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারলাম না। মোক্তার টের পেয়ে ওকে মারতে মারতে ঘর থেকে বের করে দিলো। মানুষ কোন পশুকেও ঐভাবে মারেনা। অবুঝ বাচ্চাটা গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মায়ের বুকে। মেয়েটা সেই সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত বাচ্চাটাকে বুকে নিয়ে বন্ধ দুয়ারের বাইরে বসে কাঁদল। কিন্তু মোক্তার আমাদের দরজার কাছেও যেতে দিলোনা। ঝর্ণাকে মারতে দেখে মা ‘অ্যাই, ওকে ছেড়ে দে’ বলে চিৎকার করতে করতে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। তখন বুঝিনি মায়ের স্ট্রোক হয়ে যায়। আমি মাকে নিয়ে বসে আছি, ডাক্তার আনার জন্য চিৎকার করে কাঁদছি, এর মধ্যে সেই পশুটা দরজা পাহাড়া দিতে দিতে তোমাকে বিয়ের খোশখবর শোনায়, বাইরে তখনও বৌটা বসে কাঁদছে। আমার অসুস্থ মা’টাকে চিকিৎসার কথা বলে ঢাকায় তোমার বিয়ে খেতে নিয়ে যায়। আবার দুইদিন পর বাড়ীর উঠানে ফেলে রেখে চলে যায়। এই দুই বছরে না একটা টেলিফোন, না একটা টাকা, না কিছু ...’
‘কিন্তু ও তো ওর বেতনের সম্পূর্ন টাকা মায়ের জন্য পাঠাত!’
‘ও কিছু করলে তো বেতন! ঝর্ণাদের দোকানের টাকা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তো একটা টাকাও আয় করে নাই, তাহলে টাকা পাঠাবে কোত্থেকে?’
পৃথিবীটা দুলে ওঠে শান্তার চোখের সামনে। তারপর ওর আর কিছু মনে নেই।
(চলবে ইনশা আল্লাহ)
বিষয়: বিবিধ
২৩৯৭ বার পঠিত, ৩২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আর বেশী বাকী নেই, সাথেই থাকুন।
আর বেশী বাকী নেই, আশা করি পড়বেন
আশা করি একটু শাস্তি দিয়ে, সরল পথে নিয়ে
আসবে। মাঝে , আমরা পড়ে কষ্ট পাবো।
সাথেই থাকুন
এরকম গাধা মেয়েদের গালে সজোড়ে থাপ্পর লাগানো দরকার যেন কিছু করার আগে একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে যে কি করছে..
আমি বৃষ্টি চাই অবিরত, তবু সমুদ্র ছোব না...
মরুর আকাশে রোদ হব শুধু, চায়া হব না....
মা বাবা সহ টাকা পয়সা ওয়ালাদের ললনাদের ই বেশী পতিত দেখি ঢাকা শহরে......
সত্যি অসাধারণ;অনেক ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন