পরিণতি - পর্ব ১, ২, ৩--
লিখেছেন লিখেছেন রেহনুমা বিনত আনিস ০৭ জানুয়ারি, ২০১৫, ১১:২৮:০৬ সকাল
শোভনের রিংটোন শুনে কান খাড়া হয়ে যায় শান্তার। মোবাইলের স্ক্রিনে শোভনের হাসিমাখা চেহারাটা দেখে মূহূর্তেই উবে যায় সমস্ত রাগ, অভিমান। মোবাইলটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে একটু ঝাঁঝ আর অনেক ভালোবাসা মিশিয়ে বলে, ‘কি? তুমি না বলেছিলে আজ ফোন করতে পারবেনা? তোমার এমন কাজ, তেমন ব্যাস্ততা! কই? পারলে আমাকে ছাড়া থাকতে?’
ওপাশে কেবল নীরবতা।
বিরক্ত হয় শান্তা, ‘কি ব্যাপার শোভন? সারাদিন পরে একবার মাত্র ফোন করলে, তাও কোন কথা বলছনা। ব্যাপার কি?’
ওপাশে ফোঁপানোর শব্দ।
সচকিত হয়ে ওঠে শান্তা, ‘কে? কে ওখানে?’
জবাবে দ্বিধা আর অশ্রুমেশানো নারীকন্ঠের আওয়াজ ভেসে আসে, ‘আমি শোভনের স্ত্রী। আমার একটা ছোট্ট সন্তান আছে ...’
হঠাৎ হুটোপুটির শব্দ, ধুপধাপ আঘাতের আওয়াজ, আর্তনাদ ... ফোনের লাইনটা কেটে গেল।
মাথা ঝিম ঝিম করে ওঠে শান্তার। এইমাত্র কি ঘটে গেল সে কিছুই বুঝতে পারেনা। হৃৎপিন্ড এত দ্রতলয়ে স্পন্দিত হচ্ছে , মনে হচ্ছে যেন এখনই ফেটে যাবে। সে দ্রুত কল দেয় শোভনের নাম্বারে – একবার, দুইবার, তিনবার, চারবার, পাঁচবার ... কেউ ফোন ধরেনা। এবার ওর মনে পড়ে শোভন বলেছিলো ওর পরিবার খুব রক্ষণশীল। ওর মা যদি জানতে পারেন ছেলে প্রেম করছে তাহলে তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে ফেলবেন। তাই শোভনই সবসময় ওকে ফোন করে, এই প্রথম ওর শোভনের নাম্বারে ফোন করা। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত, রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে যায়, কিন্তু সেই নারীকন্ঠের আওয়াজ ওকে তাড়া করে ফেরে, ‘আমি শোভনের স্ত্রী। আমার একটা ছোট্ট সন্তান আছে ...’। মেয়েটা কে? কেনই বা ওকে ফোন করল? কেন ওকে এসব বানোয়াট কথা বলল? শোভন ওকে ভালবাসে, সে ওকে বিয়ে করবে। কিন্তু শোভনের মোবাইল মেয়েটা পেলো কোথায়? অনেক প্রশ্নই মাথায় ঘুরপাক খায় ওর, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি ছাড়া, ‘মেয়েটি যদি সত্য বলে থাকে?’ যতবারই এই প্রশ্ন মনের ভেতর মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চায় ততবারই শান্তা শোভনের সাথে প্রথম পরিচয়ের স্মৃতি, ওর সাথে ঘুরতে গিয়ে আনন্দময় মূহূর্তগুলো, ওর কথার মায়াজালে আবিষ্ট হবার অনুভূতির কথা মনে করে সেটিকে মাটিচাপা দেয়।
ঘুম ভাঙ্গে শোভনের রিংটোনে। সাথে সাথে ঝাঁ করে গত সন্ধ্যার দুঃস্বপ্নময় স্মৃতি ভেসে ওঠে মনের পর্দায়। ফোন ধরব, ধরব না করেও না ধরে থাকতে পারেনা শান্তা। ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে শোভনের চনমনে গলার আওয়াজ, ‘কি গো রাজকন্যা? ঘুম ভাঙ্গলো?’ মনের ভেতর মুখিয়ে থাকা একরাশ প্রশ্নের সাথে এই স্বতঃস্ফুর্ত কন্ঠের কোন সঙ্গতি খুঁজে পায়না শান্তা। শোভন আবার বলে, ‘ওঠ গো রাজকন্যা! দেখ তোমার দুয়ারে কে এসেছে!’ এক মূহূর্তের জন্য হকচকিয়ে গেলেও তড়াক করে বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে দরজার দিকে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড় লাগায় সে। দরজার বাইরে শোভনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সব ভুলে চিৎকার করে ওঠে, ‘তুমি! এখানে?’
সাথে সাথে ওদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রতিবেশীদের কয়েক জোড়া চোখ। ঢাকায় পড়াশোনা কিংবা চাকরী করতে আসা অনেক মেয়ের মতই শান্তা একা থাকে। মা নেই। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা ফিরে গিয়েছেন তাঁর প্রথমা স্ত্রীর সংসারে। কালক্রমে বাবা মেয়ের সম্পর্ক শিথিল হয়ে এসেছে, যদিও তিনি প্রতি মাসের শুরুতে মনে করে বিশ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন। শান্তা নিজেই ভাল আয় করে, এই টাকা ওর প্রয়োজন নেই, সব ব্যাঙ্কেই জমছে। এর চেয়ে সে অনেক খুশি হত যদি বাবা মাসে একবার এসে ওকে দেখে যেতেন। সৎ মায়ের সাথে শান্তার সম্পর্ক ভালো না। সৎ ভাইবোনরা ওর অনেক বড়, সবাই নিজের নিজের ব্যাবসা বাণিজ্য সংসার নিয়ে ব্যাস্ত, কারো সময় নেই ওর খবর রাখার। প্রতিবেশীরা জানে এই ছেলেটি এই মেয়েটির একাকীত্বের সুযোগ নিচ্ছে। কিন্তু ঢাকার জীবন ব্যাস্ত জীবন। ওদের কারো সময় নেই শুভাকাঙ্খী হয়ে ওকে দু’টো উপদেশ দেয়ার। তবে ব্যাস্ততার মাঝেও এমন রসময় ঘটনা প্রত্যক্ষ করার জন্য অবশ্য কারো সময়ের অভাব হয়না।
শান্তা চায়না প্রতিবেশীদের রসাত্মক আলোচনার খোরাক হতে। এদের সবাইকে সে ঘৃণা করে। এরা অন্যের মন্দ নিয়ে আলোচনা করে আনন্দ পায়, কিন্তু অন্যের ভাল দেখলে এরা সহ্য করতে পারেনা। গ্রামের মেয়ে শহরে এসে যতই আধুনিকা হোক, ছোটবেলা থেকে নিজের মাঝে গড়ে ওঠা মূল্যবোধের শেকড়টাকে নিমেষে উপড়ে ফেলতে পারেনা সে। গ্রামের ফজিলত দাদী বলতেন, ছেলেরা মেয়েদের কাছে যা চায় তা বিয়ের আগে পেয়ে গেলে আর বিয়ে করতে চায়না, বিয়ে অনেক বড় দায়িত্ব, কে চায় সেধে এই দায়িত্ব কাঁধে নিতে? তাই সে শোভনকে নিয়ে পাবলিক প্লেসে বেড়াতে গেলেও কোনদিন ঘরে প্রবেশ করতে দেয়নি। কিন্তু প্রতিবেশীদের উৎসুক দৃষ্টি থেকে আত্মরক্ষার্থে সে শোভনকে ঘরে ঢুকতে বলে। অনেক প্রশ্ন ওর মনে। এই সম্পর্ক টিকতে হলে ওর প্রশ্নের জবাব চাই।
নাস্তার টেবিলে বসে শান্তা কোন ভনিতা না করে সরাসরি জিজ্ঞেস করে, ‘মেয়েটা কে?’
শোভন আকাশ থেকে পড়ে, ‘কোন মেয়েটা?’
গত সন্ধ্যার ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করে শান্তা। সব শুনে শোভন খুব অবাক হয়, ‘তোমাকে তো বলেই ছিলাম গতকাল আমি খুব ব্যাস্ত থাকব। অফিসে এত কাজ ছিলো যে ফোন কোথায় ছিলো খবর ছিলোনা। সেই ফাঁকে হয়ত অফিসের কোন মেয়ের মাথায় দুষ্টবুদ্ধি চাপে। টেবিলের ওপর ফ্রি মোবাইল পেয়ে কল করে দেয়’।
‘সে আমার নাম্বার পেলো কোথায়?’
‘তুমি তো জানোই আমার মোবাইলে সবসময় লাস্ট কল তুমি। লাস্ট কল টিপে দিয়েছে আর কি!’
শান্তাকে চিন্তিত দেখে উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করে শোভন, ‘কি নিয়ে এত ভাবছ বল তো! তুমি কি তাহলে আমাকে বিশ্বাস করনা?’
এবার শান্তা বিব্রত হয়ে পড়ে। নাহ, কে না কে ফোন করেছে সেটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে মন কষাকষি করার কোন অর্থ হয়না। তাছাড়া দু’জনেরই অফিসের সময় হয়ে এসেছে। শোভন বার বার তাড়া দিচ্ছে ওর অফিসে যেতে হবে। জরুরী কাজে নাইটকোচেই চলে আসতে হয়েছে ওকে। এত কষ্ট করার পর যদি কাজটা উদ্ধার না হয় তাহলে অফিসে কি বলবে? শান্তা দ্রুত প্লেটগুলো গুছিয়ে গিয়ে অফিসের জন্য রেডী হয়ে আসে। এবার শোভন বাথরুমে ঢোকে। ডাইনিং রুমে টেবিলের ওপর শোভনের মোবাইলটা পড়ে থাকতে দেখে নিজেকে সামলাতে পারেনা শান্তা। একবার বাথরুমের দরজার দিকে চকিতে নজর দিয়ে মোবাইলটা তুলে নেয়, কল হিস্ট্রি চেক করে। একটু আগে শান্তাকে করা কল ছাড়া পুরো কল হিস্ট্রি ফাঁকা। কি মনে করে কন্ট্যাক্ট লিস্টও চেক করে সে, নাহ, কোথাও ওর নাম বা নাম্বার নেই। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে শান্তা। কাজ থেকে ফিরে শোভনের সাথে কথা বলতে হবে।
সন্ধ্যায় রেস্টুরেন্টে বসে শান্তাকে খাবার খুটতে দেখে শোভন খাওয়া থামিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কি ব্যাপার? খাচ্ছ না যে!’
শান্তা আবদারের সুরে বলে, ‘শোন, এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করতে আমার আর ভাল লাগছেনা। আমি আমাদের প্রেমের স্বীকৃতি চাই। চল, আমরা বিয়ে করি। এবার তুমি বাড়ী ফিরে যাবার সময় আমি তোমার সাথে যাব’।
শোভন খেতে খেতে বলে, ‘পাগল হয়েছ? মা তোমাকে আর আমাকে দু’জনকেই কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেবেন’।
‘দেবেন না। আমি ওনার পা ধরে ওনার কাছে ওনার ছেলেকে ভিক্ষা চাইব। উনি রাজী না হয়ে পারবেনই না!’
হেসে ফেলে শোভন, ‘মাকে রাজী করতে তোমার যতদিন সময় লাগবে তত লম্বা ছুটি তোমাকে অফিস থেকে দেবেনা’।
‘দেবে, আমি অফিসে কথা বলে এসেছি’।
এবার শোভন খাওয়া বন্ধ করে ভ্রু কুঁচকে তাকায়, ‘তুমি তো দেখছি সিরিয়াস!’
শান্তা এবার উদগ্রীব হয়ে বলে, ‘তুমি কি ভেবেছ মিথামিথ্যি বলছি? দেখ শোভন, আমরা দু’বছর যাবত বিয়ে করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে আছি। আর কত অপেক্ষা করব বল? মাকে তো কোন না কোন একদিন কথাটা বলতেই হবে, তবে আজ কেন নয়?’
শোভন কি যেন ভাবে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, ‘হুট করে তোমাকে নিয়ে গেলে অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়তে হবে। এবার আমি একা যাই। গিয়ে মাকে তোমার কথা বলব। আগামীবার আমি তোমাকে আমার সাথে নিয়ে যাব’।
আনন্দে ক্ষিদে পেয়ে যায় শান্তার। সে সাগ্রহে ঝাঁপিয়ে পড়ে খাবারের ওপর।
(চলবে ইনশা আল্লাহ)
পর্ব -২
click here
পর্ব-৩
click here
বিষয়: বিবিধ
৩৩৫৩ বার পঠিত, ৩৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
পরবর্তি পর্ব কখন আসবে আপু? খুব কিউরিসিটি হচ্ছে....
ওমর তিলমি-সানি'র লেখা "শহীদে মেহরাব ওমর ইবনুল খাত্তাব" বইয়ে পড়েছি, এক যুবক এবং যুবতী জেনার দায়ে অভিযুক্ত হয় । হযরত ওমর উভয়কে শরীয়ত নির্ধারিত শাস্তি দেন । তারপর তিনি বারবার ছেলেটিকে বলেন মেয়েটিকে বিয়ে করতে । ছেলেটি সেই মেয়েকে বিয়ে করতে রাজী হয়নি, যদিও তারা উভয়ে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছিল ।
ইদানিং আমরা হ্যাপি-রুবেলের ঘটনা পত্র-পত্রিকায় দেখেছি । হাজার বছর ধরে লাখোবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে ।
জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা তো আর ব্লুটুথ দিয়ে অন্যকে ট্রান্সমিট করা যায় না !
সাথে থাকবেন আশা করি
পড়তে থাকুন ... :
মেয়েরা আধুনিকতার নামে জাহিলি জীবনেই ফিরে যাচ্ছে, বিনিময়ে ধোকা, লান্ছনা আর কঠিন গুনাহের সন্মুখীন হচ্ছে! সমাজে দুষনের হাওয়া বইছে আপু! এই দুষন সুস্হদের ও রোগাক্রান্ত করে ফেলছে
জাযাকিল্লাহু খাইর!
দূষনের হাওয়া বন্ধ করার লক্ষ্যেই দূষনের পরিণতি নিয়ে লেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। নইলে এই ধরনের লেখা আমার জন্য অত্যন্ত কঠিন
তবু যদি কেউ লেখাটা পড়ে খানিকটা চিন্তা করে, তাহলেই লেখার কষ্ট সার্থক হবে
সাথে থাকুন ...
চমৎকার গল্প শুরু করেছেন, আপা।
যখন সময় পান তখন পড়বেন ইনশা আল্লাহ, না পড়তে পারলেও কোন লস নেই পৃথিবীতে আরো অনেক অনেক ভাল ভাল লেখা আছে যেগুলো পড়া আরো অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ
আপনার উৎসাহব্যাঞ্জক মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন