অ্যানালগ বনাম ডিজিটাল
লিখেছেন লিখেছেন রেহনুমা বিনত আনিস ২৪ নভেম্বর, ২০১৪, ০৯:০৬:১৬ সকাল
১/
দরজার বাইরে ছোট ছোট পায়ের ধুপধাপ শব্দ শুনে দরজাটা খুলতেই আমার দেড় বছর বয়সী ছোটভাই মোহাম্মাদ তীরবেগে কোলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চার হাত পা দিয়ে এমনভাবে জাপ্টে ধরল যে আমার আর ধরার প্রয়োজন নেই, ক্রেন দিয়ে টেনেও ওকে আমার কাছ থেকে আলাদা করা যাবেনা। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘আপানা, আপানা, বাঁচাআআও! আমি নাআআ বা’নার কুম্পতানানে এত্তা তুউউউত দিসি’ (আপু! বাঁচাও! আমি না বাবার কম্পিউটারে একটা ‘টুট’ দিয়েছি)। ড্রয়িং রুম থেকে বাবার হুংকার শুনে বুঝলাম কম্পিউটারের ‘কি’ চেপে ‘টুট’ শব্দ শোনার আগ্রহে সে বাবার এতক্ষণ ধরে কষ্ট করে তৈরী করা প্রোগ্রামের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। তখন কম্পিউটারের আদিযুগ। যেকোন কাজ করতে হলে নানান কসরত করে প্রোগ্রাম সেট করতে হত, তারপর কাজ করার পর ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে হত। পুরো কাজ শেষ করে প্রিন্ট করতে দিয়ে ড্রয়িং রুমের দরজা লাগিয়ে বাবা গিয়েছে পিঠের ব্যাথার উপশম খুঁজতে, আর এই সুযোগে মোহাম্মদ গিয়ে ‘টুট’ দিয়ে এসেছে। এই হোল ডিজিটাল যুগের বাচ্চাকাচ্চা।
বিজ্ঞানের আগ্রহী ছাত্রী হলেও টেকনোলজির ব্যাবহারের ক্ষেত্রে আমি হলাম ডাইনোসর প্রজাতির। এখনও টিভির রিমোট টিপতে ভয় পাই। ফোন আর কম্পিউটারের মত সার্বক্ষণিক প্রয়োজনীয় দু’টো জিনিসের ব্যাবহারের ক্ষেত্রেও আমি হলাম যাকে বলে মিনিমালিস্ট, যা না হলেই নয় তার বাইরে কিচ্ছু পারিনা। সেই আমাকে ডিজিটালাইজ করার চেষ্টায় বাবা বলল, ‘মোহাম্মাদ তোমার বারো বছরের ছোট। সে কি’না ‘টুট’ দেয়। তুমি আর কিছু না হোক কম্পিউটারে বসে টাইপিংটা শেখ’। গড়িমসি করতে করতে প্রথম বসলাম স্কুলে ছুটির দরখাস্ত টাইপ করতে। ভয়ে ভয়ে পুরোটা টাইপ করে প্রিন্ট নিয়ে দেখলাম লেখাটা অন্তত আমার হাতের লেখার চেয়ে অনেক বেশি সহজপাঠ্য (তখন কম্পিউটারে লেখার প্রিন্ট হত পুরাই ডিজিটাল প্রকৃতির)। প্রসঙ্গক্রমে, এর আগে সব জায়গায় আমি হাতে লিখে লেখা পাঠাতাম। একবার ইয়াং টাইমস ম্যাগাজিনে হাতের লেখা নিয়ে একটি সংখ্যা বের হয়েছিল। যদিও সেই সংখ্যার কভার স্টোরি ছিল আমার লেখা গল্প, সেই প্রবন্ধে ব্যাতিক্রমধর্মী হাতের লেখা হিসেবে আমার হস্তলিপি পরিবেশিত হয়, তখন বুঝলাম আমার হাতের লেখার পাঠোদ্ধার করতে কতখানি কষ্ট হওয়াতে একই সংখ্যায় আমাকে সম্মানিত এবং অপমানিত করা হোল!
দুর্বোধ্য হাতের লেখার আরেক নজির ছিলো আমার প্রথম পত্রমিতা সারা উইকহ্যাম। যদিও আমার প্রথম পত্রমিতালীর আমন্ত্রণ আসে ঢাকার একটি ছেলের কাছ থেকে, যার বাবা সম্ভবত মিডল ইস্টে চাকরী করতেন এবং নিয়মিত ইয়াং টাইমস ম্যাগাজিন পাঠাতেন, যেখানে আমার লেখা পড়ে সে বন্ধুত্ব করতে আগ্রহী হয়; এবং যদিও আমার বন্ধুদের মধ্যে ছেলেরাও অন্তর্ভুক্ত ছিলো; পরিবারের দিক থেকেও বাঁধা ছিলোনা; কিন্তু আমি দুই লিঙ্গের বন্ধুত্বের মধ্যে সবসময় কঠিন সীমারেখা বজায় রাখায় বিশ্বাসী ছিলাম যেটা পত্রালাপে সবসময় বজায় রাখা সম্ভব নয়; ফলে ঐ আহ্বানে সাড়া দেয়া হয়নি। সারার সাথে বন্ধুত্বটা ছিলো খুব আচানক। ওর মা এবং ও প্রায়ই ইয়াং টাইমসে লিখত, দু’জনই লেখাই ছিল চমৎকার। একবার সে লিখল সে ইথিয়োপিয়ায় দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সাহায্য করার উদ্দেশ্যে স্ট্যাম্প কালেকশন করছে। এগুলো অক্সফামের নিলামে বিক্রি করে ওদের টাকা পাঠানো হবে। দিলাম আমার সমস্ত কালেকশন পাঠিয়ে। কিছুদিন পর সে লিখল এত স্ট্যাম্প এসেছে যে এগুলো প্রসেসিং করতে গিয়ে দীর্ঘ সময় হাত ভেজা থাকার কারণে হাতে ফোস্কা পড়ে গিয়েছে। যেহেতু সারা বাহরাইন এবং ইংল্যান্ডের মধ্যে ভ্রাম্যমান থাকত, ওর মাকে লিখে জানালাম আমি প্রসেসিংয়ে সাহায্য করতে চাই। জবাব দিলো মেয়ে। এভাবেই স্ট্যাম্প আর মেসেজ চালাচালি করতে গিয়ে পত্রমিতালী। পরে আমরা এমন আরো অনেক কাজ করেছি। এখন ওর বিয়ে হয়েছে, দুই সন্তান। আমরা বড়ই হয়ে গেলাম, কিন্তু হাতের লেখা তেমনই রয়ে গেল। আর এই লেখা নিয়ে কিভাবে আমরা এতদূর পথ পাড়ি দিলাম সেটাই বিস্ময়কর!
যাক, তার কয়েক বছর পর বার্তা পাঠায় আমার দ্বিতীয় পত্রমিতা সাবাহ দারউইশ। তখন আমার ডিজিটাল যুগের শুরু। বাবা পরামর্শ দিলো সে যেহেতু আরবী, ওকে আমার দুর্বোধ্য হাতের লেখা দিয়ে কষ্ট দেয়া ঠিক হবেনা, এই সুযোগে টাইপিং প্র্যাক্টিসও হয়ে যাবে। তখনও আমার টাইপিং স্পিড দাদু বা বাবার মত হয়নি। বহু কষ্টে যথাসম্ভব সহজ ভাষায় মনের ভাব গুছিয়ে ফুলেল স্টিকার লাগিয়ে ওকে জবাব দিলাম। রিপ্লাই পেয়ে তো আমি হতভম্ব! সে লিখেছে, ‘তোমার মত অহংকারী মেয়ে আমি আমার জীবনে দেখিনি!’ আমার তো কাঁদো কাঁদো অবস্থা! আমার পাঠানো চিঠির কপি আঁতিপাতি করে খুঁজেও অহংকার প্রকাশক কিছু বাবা বা আমি বের করতে পারলাম না। তাই নিরুপায় হয়ে ওকেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিসে তোমার মনে হোল আমি অহংকার করলাম?’ সে জবাব দিলো, ‘তুমি চিঠি টাইপ করে পাঠালে কেন?’ আকাশ থেকে পড়ে আমার হাড়গোড় ভেঙ্গে গেল! এত অল্পের ওপর এত চরম মন্তব্য ফেস করার ক্ষেত্রে এই ছিলো আমার প্রথম অভিজ্ঞতা, তাই হয়ত এত চমকে গিয়েছিলাম, এখন আর গায়ে লাগেনা। নাহ, কথাটা ঠিক বললাম না, লাগে, কিন্তু চেষ্টা থাকে যেন পিছলে যায়। তবে আনন্দের বিষয়, তার ছয়মাস পর সাবাহ নিজের ভুল স্বীকার করে ঠিক উলটো বিশেষণে আমাকে ভূষিত করেছিল।
২/
আমার অনলাইন জগতে বিচরণের ক্ষেত্রে আমি তিনজন মানুষের কাছে অতিশয় কৃতজ্ঞ – হাফিজ সাহেব, তারিক রিদওয়ান এবং মাইমুনা। আমি যখন দেশ ছেড়ে চলে আসছি তখন আমার ছাত্রী এবং সহকর্মীরা কেউ অশ্রু দিয়ে, কেউ নিষ্ফল রাগ দিয়ে নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ করল। ওরা বলল, ‘এখন ওসব ভালো ভালো কথা আমাদের কে বলবে? আমাদের কোন সমস্যা হলে আমরা কার কাছে যাব?’ আল্লাহ মাফ করুন, ঐসব ভালো ভালো কথার জন্য আমাকে কত যে ভালো ভালো কথা শুনতে হয়েছে! ‘উনি পড়াতে এসেছেন, পড়াবেন। সিলেবাসের বাইরে ওনার এত কথা বলার দরকার কি?’, ‘আমাদের ব্যাক্তিগত জীবনে ওনার নাক গলানোর কোন অধিকার নেই’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার আরেকদিকে স্টুডেন্টদের ব্যাক্তিগত সমস্যা সমাধান করতে কত ঘন্টা যে ক্লাসের বাইরে সময় ব্যায় হয়েছে! ভেবেছিলাম, স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায়? এবার ওরা আমার লৌহকঠিন শাসন থেকে মুক্তি পেয়ে আনন্দে কিচির মিচির গেয়ে উঠবে। কিন্তু নাহ, স্বাধীনতা পেয়ে ওরা আর স্বাধীনতা চাইলোনা, বলল, ‘স্বাধীনতা ভালো লাগেনা’। কি আর করা? সবাইকে ইমেল অ্যাড্রেস দিয়ে এলাম যোগাযোগ করার জন্য।
ক্যানাডা এসে দেখলাম অনেকে ইমেলের পরিবর্তে ইয়াহুতে চ্যাট করতে চায়। কিন্তু চ্যাটিং আমার পছন্দ না। যাদের হাতে প্রচুর সময় তাদের কথা জানিনা; আমার মত যারা ফুলটাইম কাজ করে, সংসার করে, স্বামীসন্তান, প্রতিবেশী বন্ধুবান্ধবের প্রতি দায়িত্ব পালন করে সামান্য সময় পেলে একটু পড়তে ভালবাসে তাদের জন্য এত সময় দেয়া কঠিন বিষয়। বিকল্প হিসেবে আমার প্রাক্তন ছাত্রী মাইমুনা ইনস্ট্রাকশন দিয়ে আমাকে দিয়ে ব্যাক্তিগত ব্লগ খোলালো যেন বিভিন্ন বিষয়ে লিখে ছাত্রীদের জন্য পোস্টিং দিতে পারি। তাহলে একই জিনিস বার বার এককভাবে বলার পরিবর্তে একসাথে সবাইকে জানিয়ে দেয়া যাবে। সেই প্রথম আমার ব্লগিংয়ের সাথে পরিচয়। কোথা থেকে যেন জুটে গেল আরো কিছু পাঠক যারা আমার ছাত্র ছিলোনা। এরা কিভাবে এই ব্লগের খবর পেলো আজও জানিনা।
তার কিছুদিন পর একদিন হাফিজ সাহেব ফেসবুকে আমার অ্যাকাউন্ট করে পাসওয়ার্ডসহকারে উপহার দিলেন। কিভাবে কি করতে হয় কিছুই জানিনা। এমন অবস্থায় দলে দলে ছাত্রীদের পাশাপাশি ছাত্ররাও ভিড় জমাতে শুরু করল – ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা যাদের কোনদিন পড়াইনি; এবং স্কুলের, যাদের কোলে বসিয়ে পড়িয়েছি। ফাঁকে ফাঁকে কোথা থেকে যেন আরো এক ঝাঁক তরুণ মেধাবী মুখ যোগ হোল যাদের চিনতাম না, কিন্তু না চিনলে আমার ফেসবুক যাত্রা অসম্পূর্ন রয়ে যেত। খুঁজে পেলাম অনেক পুরোনো বন্ধুদের, জীবনের যাত্রাপথে যাদের হাত ছুটে গিয়েছিল। এই নিয়ে গড়ে উঠল আমার ফেসবুক পরিবার। এদের কারো সাথে ভ্রাতৃত্ব, কারো সাথে বন্ধুত্ব, কারো ঘটকালী, কাউকে পরামর্শ, কারো কাছ থেকে উপদেশ সব মিলে তৈরী হোল আরেক পৃথিবী। কিন্তু সর্বাবস্থায় আমার লক্ষ্য ছিলো আমার ফেসবুক পরিবারটিকে ক্ষুদ্র এবং সুরক্ষিত রাখা। ক্ষুদ্র রাখার উদ্দেশ্য, অনেক মানুষ হয়ে গেলে সবার হক্ক আদায় করা সম্ভব হয়না। বিশুদ্ধ রাখতে চাইতাম এজন্য যে মূলত এই পেজ ছিলো আমার ছাত্রছাত্রীদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম, সুতরাং এই ক্ষুদ্র অঙ্গনটির পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা ছিলো আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ফেসবুকে নানা ধরনের নোট শেয়ার করতাম। অনেকেই বলত এগুলো পাবলিক ব্লগে দিতে। কিন্তু আমার মনে হত আমার লেখা কে পড়বে? ছাত্রছাত্রীদের না হয় একটা ব্যাক্তিগত সম্পর্কের কারণে পড়তে ইচ্ছা হয়, অন্যদের কি খেয়েদেয়ে কাজ নেই যে আমার লেখা পড়ে সময় নষ্ট করবে? তাছাড়া আমার সামাজিক দক্ষতা কম। পাশাপাশি ব্যাক্তিজীবনের ব্যাস্ততা এত বেশী যে এরপর ব্লগে সময় দেয়া আমার পক্ষে আসলেই সম্ভব ছিলোনা। কিন্তু কে শোনে কার কথা? আমার ফেসবুকের এক ক্ষুদে বন্ধু এবং ব্যাক্তিগত ব্লগের নিয়মিত পাঠক, তারিক রিদওয়ান একদিন আমাকে একটা পাসওয়ার্ড দিয়ে জানালো, ‘এটা আপনার সোনার বাংলা ব্লগের অ্যাকাউন্ট এর পাসওয়ার্ড। ওখানে আপনার লেখা ছাপিয়ে দিয়েছি। গিয়ে জবাব দিয়ে আসেন’। ব্যাপারটা এতটাই অপ্রত্যাশিত ছিল যে এরপর সাতদিনেও আমার ওখানে যাবার সাহস হয়নি। মিতুল আপা বাংলাদেশ থেকে ফোন করার পর গিয়ে দেখি আসলেই ওখানে আমার নামে একখানা লেখা এবং অ্যাকাউন্ট রয়েছে! ধীরে ধীরে গড়ে উঠল আরেকটি বন্ধুমহল।
ভার্চুয়াল জগতে এসে পেয়েছি অনেক, আশাতীতভাবে বেশী। কিন্তু এখানে এমন কিছু রিঅ্যাকশনও পেয়েছি যা কারোরই কাম্য নয়। এ’ এমন এক জগত যেখানে চাইলেও বন্ধুসংখ্যা নিয়ন্ত্রনে রাখা যায়না। ব্লগের কারণে তা আরো অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। একসময় ফেসবুকে প্রতিদিন ডজন ডজন ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট আসতে শুরু করল। এক পর্যায় ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট চেক করাও অসম্ভব হয়ে পড়ল। অনেকে বুঝতে চাইলেন না ভার্চুয়াল জগতের বাইরেও আমার একটা জগত আছে যেখানে আমার কিছু দায়িত্ব আছে, যেখানে কিছু মানুষকে আমার সময় দিতে হয়। তারপর আমার প্রায়োরিটি থাকে জ্ঞান অর্জন। এর পর যদি সময় চুরি করে কুলাতে পারি তখন আসি জ্ঞান বর্জন, সরি বিতরণ করতে, কারণ ঘট খালি হলে পানি দেব কোত্থেকে? কিন্তু এর ফলে অনেক সময় ব্লগে জবাব দেয়া বা ফেসবুকে আদৌ বসা সম্ভব হয়না। যখন পাঁচ দশ মিনিট সময় পাই তখন চেষ্টা করি অল্প অল্প লিখতে। ফেসবুকে বসতে পারলে প্রায়োরিটি থাকে যার প্রয়োজন যত গুরুতর তাকে আগে জবাব দেয়া। ব্লগে প্রায়োরিটি থাকে যারা কষ্ট করে আমার লেখায় মন্তব্য করেছেন তাঁদের জবাব দেয়া।
একসময় অনেকে ফোনে, ফেসবুকে বা অন্যান্য মাধ্যমে যোগাযোগ করতে লাগলেন। কেউ শুভকামনা জানাতে, কেউ উৎসাহ দিতে, কেউ কৌতুহল থেকে। অনেকেই আশা করলেন এই যোগাযোগ থাকবে নিয়মিত। লেখা পড়ে অনেকেই মনে মনে লেখকের একটা ছবি আঁকে। কিন্তু অনেকেই বুঝতে চাননা কেউ লেখায় মনের ভাব প্রকাশ করতে পারলেই মুখেও মনের ভাব প্রকাশ করায় দক্ষ হবেন তেমন কোন গ্যারান্টি নেই। যারা সত্যিকারের লেখক তাদের অধিকাংশই ব্যাক্তিজীবনে লাজুক প্রকৃতির ছিলেন এবং কেবল বন্ধুমহলেই তাঁরা মন খুলে কথা বলতে পারতেন। আর সময়ের সীমাবদ্ধতা তো আছেই। আমার সীমাবদ্ধতাকে অনেকে ভুল বুঝেছেন। যেমন ক’দিন আগে এক ভাই ফ্রেন্ড রিকুয়েস্টের জবাব দেইনি বলে আমাকে কারুনের মত জঘন্য একটা লোকের সাথে তুলনা করলেন। আরেকজন ধমক দিয়ে মেসেজ দিলেন, ‘কি ব্যাপার? ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট অ্যাক্সেপ্ট করছেন না কেন?’ কিছু বলার নেই। নদীর এপাড় কখনোই বোঝেনা ওপাড়ের অবস্থা। কষ্ট পাবোনা বলে বদ্ধপরিকর হলেও মাঝে মাঝে কষ্ট লেগেই যায়।
আমার মনের অবস্থা মেঘাচ্ছন্ন দেখে হাফিজ সাহেব বললেন ফলো অপশন চালু করতে। কিন্তু সেটাও লজ্জা লাগে। আমি কোথাকার কে যে কেউ আমাকে ফলো করবে?! তাই ভাবি সব কাটছাঁট করে শুধু ছাত্রছাত্রীদের রাখব, সংখ্যাটা ম্যানেজেবল থাকবে, সবার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করা সম্ভব হবে। তারপর মনে হয় মাঝরাতে যদি কারো বাতির দরকার হয়, দিনদুপুরে প্রয়োজন হয় একটু ছায়া, তৃষিত হৃদয় চায় একফোঁটা জল বা চাতক চায় একফোঁটা বৃষ্টি, তার জন্য আমি কি করে দরজা বন্ধ করে দেই? সেজন্য যেভাবেই হোক, অন্তত দু’তিনদিন পর পর হলেও মেসেজটা চেক করার চেষ্টা করি। তারই মাঝে মিস হয় যায় কত! আমরা যদি একটু ধৈর্য্যশীল হতাম, হতাম সহনশীল, অন্যের সুবিধা অসুবিধার ব্যাপারে সামান্য কন্সিডারেট হতাম, কথাবার্তায় হতাম আরেকটু সংযত – হয়ত পৃথিবীটা বেহেস্ত হয়ে যেতনা কিন্তু আমাদের আশেপাশের মানুষগুলোর জীবন হতে পারত আরেকটু সুন্দর।
আমার প্রবল সম্ভাবনাময়ী ছাত্রী ফারজানা মাহবুবা একসময় প্রচুর লিখত। এখন লেখেনা মোটেই। জিজ্ঞেস করলাম, ‘লেখনা কেন?’ বলল, ‘কি করব ম্যাডাম? ব্লগে লেখা দিলে সবাই আশা করে জবাব দেব। অথচ সময়ে কুলাতে পারিনা। তখন মানুষ অহংকারী মনে করে। তাই লেখাই বন্ধ করে দিলাম’। একই কাহিনী আরো অনেকের। হয়ত ভার্চুয়াল জগতে অনেকেই নিক ব্যাবহার করতে গিয়ে ভুলে যান তাঁদের পরিচয় কেউ জানেনা এর অর্থ এই নয় যে তাঁদের কাঁধে বসা দুই ফেরেস্তা তাঁদের প্রতিটি অক্ষর থেকে প্রতিটি ইমোর হিসেব রাখছেন না বা তাঁরা কি করছেন তা আল্লাহ দেখছেন না। তাই হয়ত তাঁরা এত সহজে কাউকে এত আক্রমনাত্মক কথা বলতে পারেন যা হয়ত প্রকৃত জীবনে পারতেন না। প্রতিদিন সময় চুরি করে কখনো এক লাইন দুই লাইন অথবা একটা প্যারা করে এইটুকু লেখাটা লিখতে আমার সময় লাগল দুই সপ্তাহ। কাল থেকে আবার কাজ শুরু হয়ে যাবে। এরপর আবার কবে অনলাইনে আসার সময় পাব জানিনা। এলেও প্রায়োরিটি ভাগ করে সবার আকাঙ্খা পূরণ করা সম্ভব হবেনা। শুরু হয়ে যাবে আলোচনা পর্যালোচনা অভিযোগের বন্যা। কেউ বুঝতে চাইবেন না এই লেখাটার পেছনে তাদের জন্য কতখানি স্নেহ ভালোবাসা লুকিয়ে আছে। তাই ভাবছি একদিন হয়ত সে পথই ধরতে হবে যা আমার আগে আরো অনেকে অতিক্রম করে গিয়েছেন। ফিরে যাব আবার আমার অ্যানালগ অঙ্গনে যেখানে কেউ আমার দিকে আঙ্গুল তুলবেনা, আমাকে গ্রহন করে নেবে আমি যেমন সেভাবেই।
বিষয়: বিবিধ
২৪৭৬ বার পঠিত, ৫৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আর এখন আমার শতক ছাড়িয়ে হাজার ফ্রেন্ড, সে সংখ্যা বেড়ে লক্ষের দিকে ছুটে চলছে। মনের অনূভূতির কথা মহুর্তে ছড়িয়ে যাচ্ছে। তারপর ও যেন একাকীত্ব টা আজকাল অনেক বেশী মাথা ছা্ড়া দিয়ে উঠছে। মনের গহীনে শূন্যতা যেন অনেক বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে.......
বলতে ইচ্ছে করছে " আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম"।
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
আপনি যে কারণগুলো বললেন, সে কারণেই আমি ফেসবুক বন্ধ করে দিয়েছি। আশেপাশের মানুষগুলো নিয়ে সুন্দর পৃথিবী গড়ার চেষ্টা করি আগে, বাকি দুনিয়া পরে দেখা যাবে।
সত্যি বলতে, ভাল মানুষের পিটা খাওয়া আমার স্বপ্ন। ভাল মানুষের পিটা খাওয়ার উছিলায় আল্লাহ যদি আমাকে ভালো মানুষ বানায় আর কি! *- পিটা খাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করিতেছি >-
শুভকামনা অনন্ত।
আমি মোন খারাপ দেখতে পছন্দ করি না আপু
ও কন্যা ভুল করিস না দেখি কি হয়
জাযাকাল্লাহু খাইরান।
আল্লাহর কাছে দোয়া যেন আপনাকে হায়াতে তৈয়বা দান করেন যাতে অধিক সংখ্যক পথভ্রষ্টরা আলোর দেখা পায় আপনার লেখার আলোক রেখা অনুকরনে।
ফারজানা মাহবুবার সাথে একমত নই। যারা সব কমেন্ট এর উত্তর দেয়ার সময় পায়না তারাও সবার কমেন্ট এর প্রসঙ্গ একটা কমেন্ট এ দিয়ে দিতে পারেন। পৃথিবিতে যে লিখক তার পাঠক এর প্রতিক্রিয়াকে অবজ্ঞা করেন তিনি কখনই সফল হন না। পৃথিবি এগিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। পুরানর জন্য দির্ঘশ্বাস ফেলা যায় কিন্তু কিন্তু নতুন কে বরন করে নিতেই হয়।
২/ আমি অনেক সময় এমন করে থাকি। কিন্তু ফিরে এসে চেক না করলে তো পাঠক জানতে পারেন না কমেন্টের উত্তর দেয়া হয়েছে, যেহেতু প্রতিমন্তব্য ছাড়া উত্তর দিলে নোটিফিকেশন যায়না :
৩/ দীর্ঘশ্বাস বা বরণের ব্যাপার নয়, আমাদের ব্যাবহার মার্জিতকরণের ব্যাপারে বলছিলাম।
কিন্তু আপু, আমরা যে তোমার লেখা চাই! নিন্দুকের কাজ নিন্দুক করবে, তাই বলে তুমি তোমারটা বন্ধ করে বসে থাকলে কি চলবে? (তুমি বলতাম না আপনি ভুলে গেছি, এত দীর্ঘ সময় কেউ পালিয়ে থাকে?)
আমার মতে আফরোজা একজন অত্যন্ত মেধাবী লেখিকা। আমার অভাব পূরণ করা কোন বযাপার না, কিন্তু ওর অভাব পূরণ করা অসাধ্য। ১৪ নং মন্তবযে দেখুন বেচারীর কি অবস্থা! অথচ আমরা একটু ধৈর্য্যশীল, সহনশীল এবং সংযত হলে একটা সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করা কঠিন কিছু নয়।
কিন্তু আপু, নিন্দুকের কাজ নিন্দুক করবে, তাই বলে আমরা নিজেদের কাজ থেকে হাত গুটিয়ে নিলে কি চলবে?
পোষ্ট পড়ে বুঝতে পারলাম আপনি পেশায় একজন শিক্ষক ছিলেন, এবং সেটা সম্ভবত চট্রগ্রাম অথবা ঢাকায়।হাফিজ ভাই আপনার উনি। এবং বয়সে আপনি আমার অনেক অনেক সিনিয়র। তাই নিঃসন্দেহে আপনাকে বড় আপু ডাকতে পারি।
এবং আপনি নিয়মিত ব্লগ বা ফেসবুক এ বসার সময় পান না, তাই সবার কমেন্টস বা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন না। আচ্ছা আপু আপনি কোন বিষয়ের শিক্ষক বা আপনার প্রিয় সাবজেক্ট কি?
আমার পছন্দ সাইকোলজি এবং বিজ্ঞান, কিন্তু আমি বিগ+জ্ঞানী নই, সামান্য ইংরেজীর মাস্টার মাত্র।
তবে আমারও পছন্দ বিজ্ঞান এবং ম্যাথ ।
যে কোন লেখা লিখতেই কষ্ট হয়, বিশেষ করে সেটা যদি হয় সমাজের সৌন্দর্য খুঁজে বের করে, একে নির্ভুল বানানে অত্যন্ত উপাদেয় ভাষায় মানুষের কাছে উপস্থাপন করা, তাহলে বেদনাটা ত্রিমুখী । এক তো লেখা লিখতে যে সময়-শ্রম-ঘাম বের হয়, তার বেদনা, দ্বিতীয়টি হল, এত কষ্টের লেখা পাঠক সমাজ যদি ঠিকমত গ্রহণ না-করে, তাহলে এর কষ্ট । নারী রাণী হলেও তাকে ঘরের কাজ করতে হয়, সন্তানকে মমতা দিতে হয়, এর সাথে স্বামী যদি হয় ( বে-নজীর ভুট্টোর স্বামী ) আসিফ আলী জারদারীর মত, তাহলে তো আরও মুশকিল ।
জনপ্রিয় হওয়ার যে সমস্যা সেটা একেবারে কম নয় । রবিঠাকুরের খ্যাতির বিড়ম্বনা নাটিকায় পড়েছিলাম, খ্যাতিমান হতে দুকড়ি উকিল কতই না বিপাকে পড়েছিল ।
তৃতীয় কষ্টটি হল, একটি ভাল লেখায় আসে অনেক মন্তব্য, আর মন্তব্যকারীরা স্বভাবতই প্রতিমন্তব্য আশা করেন, তার সাথে আছে মেসেজ বা ইনবক্সের বার্তা-সম্ভার । যারা মেসেজ করেন তারাও এর জবাব আশা করেন । কবি নজরুল লিখেছেন, "তুমি বুঝিবে না, বুঝিবে না, আলো দিতে গিয়ে পুড়ে কত প্রদীপের প্রাণ" ! খুব সহজ ভাষায় যদি বলি, ভাল লেখা লিখে এবং মন্তব্য প্রতি মন্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে একেবারে ঘাম বের হয়ে যায় । মস্তিস্কের উপর চাপ পড়ে, মাথা ব্যাথা করতে থাকে ।
বোন, আপনারা এত কষ্ট করেন বলেই তো আমরা কিছু জানতে ও শিখতে পারি । সুন্দরভাবে ভাব প্রকাশের যে তওফিক আল্লাহ্ আপনাদের দিয়েছেন, সে জন্য তাঁর শোকর গোজার করছি ।
আপনাকে নিরন্তর সহযোগিতার জন্য হাফিজ সাহেবকেও ধন্যবাদ দিতে হয় ।
বেনজীর তো সব্দিক থেকেই বেনজির, বেচারীর জন্ম থেকে মৃতযু পর্যন্ত সব বেনজীর। ভাগয ভালো আমার বাবা তেমন আহামরি নাম রাখেনি। রেহনুমার কাজ পথ দেখানো, সেটাই একটু আধটু করার চেষ্টায় শর্টকাট নিলাম লেখালেখি। আপনারা মূল্যায়ন করেন সেটা আপনাদের উদারতা।
কাউকে সাহায্য করতে পারলে ভাল লাগে, তবে জনপ্রিয় হতে চাইনি। প্রিয় হতে চেয়েছি শুধু একজনের কাছে, সেটা কিছুতেই হতে পারছিনা।
জনদরদী গণহিতৈষী হলেন হাফিজ সাহেব, খ্যাতি এবং এর বিড়ম্বন্না দু'টোই ওনাকে ট্রান্সফার করে মুক্তি পেতে চাই।
লেখা চালিয়ে যান আপু। ২/১ জন মিসবিহেভ/সমালোচনা করলে ও হাজার মানুষ অনুপ্রাণিত হয় আপনার লেখা থেকে। তাই কিছু মনে করবেন না।
ধন্যবাদ আপনাকে
আপনার উপদেশের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন