ছোট ছোট বালুকণা - ৪
লিখেছেন লিখেছেন রেহনুমা বিনত আনিস ২৫ অক্টোবর, ২০১৪, ০৮:০৭:৪৩ সকাল
মারযান চলে গেলে তিনি সামিয়াকে বললেন, ‘শোন মা, তুমি আমার কাছে আমার তিনটা সন্তানের চেয়ে আলাদা নও। তুমি আসার আগেও ত্রিশ বছর আমার সংসারের সব কাজকর্ম চলেছে, আরো কিছুদিন এভাবে চললে কোন ক্ষতি নেই। এখন তোমার প্রয়োজন ঘরের সবার সাথে বন্ধুত্ব করার, সবার পছন্দ অপছন্দ বুঝে নেয়ার, আমাদের তোমার পছন্দ অপছন্দ বুঝার সুযোগ দেয়ার, বিশেষ করে মাসরুরের সাথে অ্যাডজাস্ট করার’।
নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায় তাঁর, ‘আট বছর আগে মাসরুরের বাবা ব্যাবসায় বিরাট লস করেন। কিন্তু নিজের ক্ষতির চাইতেও তাকে পীড়া দিতে থাকে শেয়ার হোল্ডারদের লস, কর্মচারীদের কি হবে এইসব ভাবনা। একদিন সারারাত চিন্তা করার পর সকালে উঠে দেখেন আর হাতপা নাড়তে পারছেন না। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ওরা বলল রাতে কোন একসময় স্ট্রোক হয়েছে, বেঁচে আছেন এটাই বেশি, হয়ত সুস্থ হবেন, কিন্তু আর কোনদিনই বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে পারবেন না। ভাবলাম ব্যাবসা বাণিজ্য সব বিক্রি করে দেই, যা পাওয়া যাবে তা দিয়ে হয়ত মাসরুরের লেখাপড়া শেষ হওয়া পর্যন্ত সংসার চালিয়ে নিতে পারব। কিন্তু ছেলে আমার বেঁকে বসল। বলল, ‘না মা, মানুষের টাকা কর্জ থাকা পর্যন্ত বাবা সুস্থ হবেন না। তাছাড়া এতগুলো পরিবার আমাদের ওপর নির্ভরশীল, তাদের কথা ভুলে গেলেই বা কিভাবে চলবে?’ ছেলে সব ছেড়েছুড়ে ব্যাবসার হাল ধরল, হাল ধরল পরিবারেরও। কুড়ি বছর বয়স ছিলো ওর, হুট করেই বড় হয়ে যেতে হোল ছেলেটাকে। সেই থেকে পরিশ্রম করে ব্যাবসাটাকে আবার টেনেটুনে ঠিক করল, সবার ধার দেনা শোধ করল, ব্যাবসা বর্ধিত করল, নিজে আরেকটা নতুন ব্যাবসা শুরু করল, যেসব কর্মচারীরা এই বিপদের দিনে আমাদের পাশে ছিলো তাদের সবার জন্য বাড়ীর পেছনে ঘর করল, এখন ওরা আমাদের পরিবারেরই অংশ। পরিবারের গায়েও আঁচড়টি লাগতে দেয়নি আমার মাসরুর। বছরের পর বছর আমরা ডাল ভাত ভর্তা খেয়ে সংসার চালিয়েছি ঋণের টাকা শোধ করার জন্য, ঈদেও একটা কাপড় কিনতে পারিনি; কিন্তু ওর বাবার চিকিৎসা কিংবা ভাইবোনদের লেখাপড়ার জন্য কখনও টাকার অভাব বুঝতে দেয়নি মাসরুর। আমার ছেলেটা সারাদিন পরিশ্রম করে এসে বাবার মাথায় হাত না বুলিয়ে, ভাইবোনদের সাথে খুনসুটি করে তাদের মুখে হাসি না ফুটিয়ে কোনদিন ঘুমাতে যেতনা। ক্লাসের প্রতিশ্রুতিশীল ছাত্র ছিলো আমার ছেলে। ব্যাবসার ফাঁকে ফাঁকে, রাত জেগে পড়ে অনার্সটা তো শেষ করল, কিন্তু মাস্টার্সটা করব করব করেও এখনো করা হোলনা’।
আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন তিনি, ‘মাগো, কেউ যখন সবার মাথার ওপর ছাতা হয়ে তাদের নিরাপদ রাখতে যায়, তখন রোদ বৃষ্টি তুফানের ঝাপ্টা সব তার ওপর দিয়েই যায়। আমার ছেলেটা সবসময় হাসিখুশি, কিন্তু ওর মনের কষ্টগুলো সে আমাকেও বলেনা; সারাক্ষণ বকবক করে, কিন্তু এর মাঝে নিজের কথা একটিও বলেনা, সব অন্যের সুবিধা অসুবিধার কথা। তুমি যদি ওর মনের গোপন কুঠুরীতে সঞ্চিত কষ্টগুলো বের করে এনে ওখানে আলোয় ভরিয়ে দিতে পারো, সেটাই হবে আমার পরম পাওয়া। তোমার কাছে আমি এর বাইরে আর কিছুই চাইনা’।
তন্ময় হয়ে শুনতে শুনতে সামিয়া খেয়ালই করেনি কখন মারযান পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। ওদের সামিয়ার রুমে গিয়ে জিনিসপত্র গুছাতে বলে আনোয়ারা বেগম বাগানে যান যেখানে তাঁর স্বামী ছেলের কাঁধে ভর দিয়ে একটা ফুটবলে লাথি মারতে পেরে আনন্দে কিশোরদের মত হুঙ্কার ছাড়ছেন!
নিজের রুমে যেতে যেতে সামিয়ার মনটা মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আসে। সে গতরাতে মাসরুরকে বলেছে, ‘আপনার ঝোঁক টাকার প্রতি, আমার পড়ার প্রতি’। অথচ এখন সে বুঝতে পারছে টাকা সে নিজের জন্য উপার্জন করেনা, বা লেখাপড়ার প্রতি ওর আগ্রহ নেই এই কথাটাও সত্য নয়। না জেনে কত বড় একটা আঘাত দিয়ে ফেলেছে সে! একজন কষ্ট হরণকারীকে কষ্ট দিয়ে ভীষণ অনুশোচনায় ভুগছে সামিয়া। কিন্তু কথাটা সে বলবে কি করে?
তিনমাস কেটে যায়। সামিয়ার শ্বশুর শাশুড়ি দেবর ননদ এমনকি প্রতিবেশীরাও ওকে ভীষন ভালোবাসে, ওদের উদারতা ওকে আপ্লুত করে। কিন্তু যাকে কেন্দ্র করে এই ভালবাসা সে পাচ্ছে তার মতিগতি সে কিছুই বুঝতে পারেনা। মাসরুর ওর সুবিধা অসুবিধা খেয়াল রাখে, বাড়ীর সবার সাথে সম্পর্ক ভালো রাখার ব্যাপারে উপদেশ উৎসাহ দেয়, বাপের বাড়ী বা কলেজে আসা যাওয়ার সব সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করে। কিন্তু এর বাইরে সে সামিয়ার সাথে কোন কথাই বলেনা, ঘুমায় অফিসরুমের সেই সিঙ্গেল খাটে। মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে, সারাদিন কাজ শেষে রাতের খাবার খেয়ে পড়তে বসে। ভোরবেলা নামাজের আগে কুর’আন পড়ে, নামাজ পড়ে ঘুমায়। সামিয়া সুযোগ পায়না কোন কথা বলার, আবার লজ্জাবোধের কারণে বলতে পারেনা ভেতরে এসে ঘুমোতে। এক অস্বস্তিকর পরিবেশে কাটতে থাকে তার দিনরাত। ঘরের কেউ কিছু টের না পেলেও মারযান বুঝতে পারে কিছু একটা অমিল হচ্ছে, কিন্তু সে ঠিক ধরতে পারেনা সেটা কি।
একদিন কলেজে গিয়ে সামিয়া জানতে পারে আজ ক্লাস হবেনা। বাসায় চলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল সে। এমন সময় একটা মেয়ের সাথে দেখা। সামিয়া আর্টসে পড়ে আর ঐ মেয়েটা সায়েন্সে। কিছু ক্লাস ওদের একসাথে হলেও অধিকাংশই ওদের দেখা হয় বারান্দায় বা মাঠে, কথা হয় কালেভদ্রে। আজ হাতে সময় আছে। দু’জনে গল্প করতে করতে হঠাৎ সামিয়া নিজের বিবাহপূর্ব স্বপ্ন থেকে বর্তমান অচলাবস্থা পর্যন্ত সবকিছু উগড়ে দেয় অকপটে। সে নিজেই অবাক হয়, যে কথা সে তার বাবামা ভাইদের বলেনি, এমনকি একসাথে থেকেও বাড়ীর কেউ টের পায়নি, তা সে কেন ওকে বলতে গেল। সম্ভবত যাদের সাথে লেনাদেনা থাকে তাদের প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে মানুষ অনেক কথাই বলতে পারেনা, কিন্তু একজন অপরিচিতের সাথে সেটা শেয়ার করা যায় নির্দ্বিধায়। নাকি কারো কারো চেহারা দেখলেই মনে হয় তাকে বিশ্বাস করা যায়? সে কথাগুলো বলল নিজেকে নির্ভার করার জন্য, কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটা ব্যাপারটাকে খুব সুন্দর করে বিশ্লেষণ করে ওকে বুঝিয়ে দিলো সমস্যাটা ঠিক কোথায় এবং এর সমাধানের ব্যাপারেও একটা দিকনির্দেশনা দিলো। সব শুনে মেয়েটির কথাগুলো ওর কাছে যৌক্তিক মনে হোল। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? বাঁধার প্রাচীর পেরোনোর জন্য কথা বলার বিকল্প নেই। কিন্তু সেই কথাই তো সে বলতে পারছেনা আজ তিনমাস ধরে!
বান্ধবীর পরামর্শমত সামিয়া প্রতি রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে লাগল। সাতদিন পর, রাতে খাবার পর যথারীতি বাবাকে রুমে দিয়ে এসে মাসরুর অফিস রুমে পড়তে বসল। ওদিকে সামিয়া আর মারযান রান্নাঘরের খাবার গুছিয়ে গল্প করতে করতে যার যার রুমের দিকে এগোলো। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে মারযান হঠাৎ সামিয়াকে প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা ভাবী, একটা প্রশ্ন করি? তুমি কিছু মনে করবেনা তো?’
সামিয়া ওর গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘তোর সাথে কি আমার কিছু মনে করাকরির সম্পর্ক? বল, কি বলবি?’
মারযান কিঞ্চিত ইতস্তত করে বলে, ‘তোমাদের বিয়ে হয়েছে তিনমাস। কিন্তু আজ পর্যন্ত ভাইয়া আর তোমাকে একসাথে থাকতে দেখিনি। তোমাদের মাঝে কি কোন সমস্যা হচ্ছে?’
প্রমাদ গোণে সামিয়া, তারপর মুখে হাসি টেনে বলে, ‘না তো! তোর ভাইয়া রাত জেগে পড়ে, আবার ভেতরে যেতে গেলে আমার ঘুমের ডিস্টার্ব হবে বলে ওখানেই শুয়ে যায়। সমস্যা না করার স্বার্থেই এই ব্যাবস্থা’।
মারযান হাসল, কিন্তু বিশ্বাস করল বলে মনে হোল না।
(চলবে ইনশা আল্লাহ)
বিষয়: বিবিধ
১৯৭৭ বার পঠিত, ৪২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
নিচেরটি আমার জন্য এডভান্স নিলাম।
এজন্যই মনে হয় আওণ টুডে ব্লগে এখন কম আসে ....
ভাল লাগার শেষ সীমা ছুই ছুই করছে অসাধারন এই লেখনী। মাঝের এক পর্ব পড়া হয়নি আমার,পড়ে নিব ইনশা আল্লাহ।
ভাল থাকার কামনা,অনেক ধন্যবাদ
আল্লাহ্ আপনাকে লিখার জন্য আরও বেশি বেশি সময় করে দিক।
দু'আ কোর আল্লাহ যেন ভাল কিছু লেখার তাওফিক দেন।
স্নেহশীলা শ্বাশুড়ির একটুখানি মমতা সামিয়ার জীবন নদীতে যেন জোয়ার এনে দিল , পালে লাগলো হাওয়া , এমনই হয় ..... আর হওয়া উচিত এটাই ! এই ধরনের পরিবার ব্যবস্থা এখন তো নেই ই , যা আছে তাও প্রায় ধ্বংসন্মুখ ! আপনার লেখাটিতে সুন্দর কিছু মুহূর্ত উঠে এসেছে , খুব উপভোগ করছি সেটা .... এবার দেখি , সামিয়ার মধুর যন্ত্রণার উপশম কিভাবে ঘটে !
আপু, স্বপ্ন দেখি এমন একটি ভালোবাসার চাদরে আচ্ছাদিত পরিবারের, তাই গল্পের মাঝেও চলে আসে। তবে এটি একটি বিরল সত্য ঘটনা, তাই ভাবতে ভালো লাগে অন্তত একটি এমন ঘটনা তো ঘটেছে! (স্বামী স্ত্রীর সমস্যার কথা বলছিনা কিন্তু )
বয়স বা সম্পর্কের দাবীতে শাশুড়িই যদি প্রথম সহনশীল আচরণ করতে পারেন তবেই সেই সংসার এক শান্তির নীড়ে পরিণত হয়।
অসম্ভব ভালো ও জ্ঞানী শাশুড়ী। কয়জনের কপালে এমন শাশুড়ী জুটে।
মাসরুরের জন্য কষ্ট হচ্ছে। সামিয়াটা কেন যে এমন এমন কথা বলে ফেললো সব কিছু জানার আগেই।
আপনার গল্পের প্রেমে পড়ে গেছি আপু। কি সুন্দর লিখেন মাশাআল্লাহ। আপনার লিখার প্রশংসা করার ভাষাও আমার জানা নেই।
যারা ছেলেদের সাথে মিশে অভ্যস্ত না তারা ভেবেচিন্তে কথা বলে অভ্যস্ত হয়না, সম্ভবত তাই :
প্রশংসা নয়, দু'আ চাই
মন্তব্য করতে লগইন করুন