ছোট ছোট বালুকণা - ৩
লিখেছেন লিখেছেন রেহনুমা বিনত আনিস ২৪ অক্টোবর, ২০১৪, ০৫:৩৯:০২ সকাল
রান্নাঘরে গিয়ে তো সামিয়া পুরাই হতভম্ব! এই ভোর সকালেই পুরো রান্নাঘর লোকে গমগম করছে। রান্নাঘরের দু’টো দরজা- একটা খাবার ঘরের সাথে, আরেকটা বাড়ীর পেছনে উঠোনে। উঠোনে বটি নিয়ে বসে একজন মুরগী কাটছে, একজন মাছ, একজন নানান জাতের সব্জী। দরজায় বসে একজন মসলা বাটছে। রান্নাঘরের ভেতর একজন রুটি বেলছে, একজন চিরল চিরল করে আলু কাটছে, দেখেই বুঝা যাচ্ছে ভাজি করা হবে। মধ্যখানে চুলোর পাশে বসে ওর শাশুড়ি এক চুলোয় রুটি ভাজছেন, আরেক চুলায় কড়াইয়ে তেল দেয়া, আলুভাজির জন্য প্রস্তুত- কিছুক্ষণ পর পর একে ওকে ডেকে কাজের তাড়া দিচ্ছেন। সামিয়াকে দেখে তিনি ভীষণ অবাক হলেন, তারপর ওর পেছনে থেকে মাসরুরকে সরে যেতে দেখে সব বুঝে নিলেন। তিনি একজনকে ডাক দিয়ে বললেন, ‘শায়লা, তোর ভাবীকে একটা মোড়া দে তো!’
সামিয়াকে বললেন, ‘শোন মা, আমার ছেলেটা বেশি বেশি করে। এটা তো তোমারই সংসার, তুমি আস্তেধীরে সব বুঝে নেবে। কিন্তু এখনই রান্নাঘরে নিয়ে আসার কি হোল? তুমি চুপচাপ বোস, আমরা কথা বলি’।
সামিয়া মোড়ায় বসে বলল, ‘মা, আম্মু কাজ করার সময় আমি সবসময় হাত লাগাতাম। সবাই কাজ করছে, এর মধ্যে আমি চুপ করে বসে থাকলে কি করে হবে? আমি অন্তত রুটিগুলো ভাজি!’
শাশুড়ি আনোয়ারা বেগম ছেলের কান্ডে যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছেন সেটা তাঁর চেহারা দেখে বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু তিনি সায়মাকে সস্নেহে বললেন, ‘মা, চল তোমাকে আগে আমাদের প্রতিবেশীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই’।
শায়লাকে রুটি দেখতে বলে তিনি সামিয়াকে নিয়ে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলেন। সামিয়া দেখল উঠোনে নানান জাতের সব্জীর বাগান আর বাড়ীর দু’পাশে ফলের বাগান, বাড়ীর সামনে ফুলের বাগান গতকাল এই বাড়ীতে ঢোকার সময়ই চোখে পড়েছে। উঠোনের ওপাশে কতগুলো ঘর দেখা গেল, একই বাউন্ডারীর ভেতর। গ্যারেজ আর দারোয়ানের ঘর বাড়ীর দু’পাশে। সুতরাং, ওগুলো কিসের ঘর সে বুঝতে পারলনা। আনোয়ারা বেগম সবাইকে প্রতিবেশী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেও সামিয়া বুঝতে পারল এরা সবাই এই বাসার কাজ করে- কিন্তু তাঁর ব্যাবহার থেকে সামিয়ার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল এদের সাথে কেমন আচরন করতে হবে, ওর খুব ভাল লাগল শাশুড়ি মায়ের এই অভ্যাসটি। সে সবার সাথে অল্পসল্প কথা বলে শাশুড়ির সাথে চুলোর কাছে ফিরে এলো। কিছু না বলেই শায়লার কাছ থেকে খুন্তি নিয়ে রুটি ভাজতে শুরু করল। আনোয়ারা বেগম আর কিছু বললেন না। তিনি ভাজির জন্য তেলে পেঁয়াজ দিলেন।
হঠাৎ কে যেন সামিয়াকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে চটাস চটাস দুই গালে চুমো দিল। সামিয়া অবাক হয়ে পেছন ফিরে মারযানকে দেখে হেসে ফেলল। ননদিনি যে কখন চুপি চুপি ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে সামিয়া টেরই পায়নি! সামিয়া আলতো করে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। এই সুযোগে আনোয়ারা বেগম ওর হাত থেকে খুন্তিটা নিয়ে মারযানকে বললেন, ‘তোরা দু’জন গিয়ে টেবিলে বস। মাসউদকে বল মাসরুরকে ডেকে আনতে, ওকে বল এত কাজ করতে হবেনা। একটা দিন হয়নি বিয়ে হয়েছে আর বৌটাকে রান্নাঘরে ছেড়ে দিয়ে পালিয়েছে!’
মারযান ভাবীকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল, ‘মা ভালই ক্ষেপেছে। ভাইয়া মনে হয় কাজ ছাড়া কিছু বোঝেনা। কোথায় বাগানে বসে তোমাকে নিয়ে গল্প করবে, আমরা চা নিয়ে যাবার ভান করে আড়ি পেতে শোনার চেষ্টা করব! বেরসিক একটা ...’
ডাইনিং রুমে এক কোণে চুপচাপ ছায়ামূর্তির মত বসে থাকা ছেলেটাকে খেয়ালই করতনা সামিয়া সে সালাম না দিলে। মারযান বলল, ‘এই নাও ভাবী, তোমার দেবর মহাশয়, মাসউদ উল হাসান। যা, এবার গিয়ে ভাইয়াকে ডেকে নিয়ে আয়’।
মাসউদকে বিয়েতে দেখেছে বলে মনে করতে পারেনা সামিয়া। বয়স চৌদ্দ হবে হয়ত, নতুন গোঁফ গজাচ্ছে, তাই হয়ত লজ্জায় কারো সামনে আসেনা, ওকে দেখেই বোঝা যার ছেলেটা খুব লাজুক টাইপের, এই ছাড়া সে যেন মাসরুরের ছোটবেলার সংস্করণ। বোনের কথামত ভাইকে ডাকতে চলে গেল মাসউদ।
মারযান বলল, ‘ভাগ্য ভাল, তুমি ছিলে। নইলে সে আমার চুল টেনে দিত হুকুম দেয়ার অপরাধে। আমি ওর তিনবছরের বড়, কিন্তু একটুও মানতে চায়না আমাকে’।
ননদের পাকা পাকা কথা শুনে হাসি পায় সামিয়ার। ভাবখানা যেন সে মাসরুরের বড় বোন!
মাসরুরের সাথে ওর বাবাও এলেন, ছেলের হাত ধরে, কিঞ্চিত ভর ছেলের গায়ে ছেড়ে দিয়ে। তাঁর চলাফেরা তেমন স্বচ্ছন্দ নয়। পেছন পেছন মাসউদ এলো বাবার উইলচেয়ার নিয়ে। মারযান সামিয়াকে কানে কানে বলল, ‘বাবার উইলচেয়ারে বসা ভাইয়ার একদম পছন্দ না। ভাইয়া থাকলে বাবা না হেঁটে পার পায়না। কিন্তু আবার বাবা উইলচেয়ার ছাড়া সাহস পায়না বলে ওটা কেউ পেছন পেছন নিয়ে আসে। বাবা ভাইয়ার উপর প্রচন্ড ক্ষেপলেও আসল কথা হোল বাবার স্ট্রোকের পর যেখানে আমরা ভেবেছিলাম বাবা বিছানা থেকেই কোনদিন উঠতে পারবেনা, সেখানে আজ বাবা হাঁটতে পারছেন!’
সামিয়ার আবছা আবছা মনে পড়ে, সম্ভবত বছর দশেক আগে সে ভাইদের সাথে লুডো খেলার সময় শুনতে পায় বাবা মায়ের কাছে আহাজারি করছেন, ‘আহারে! ছেলেটা এই বয়সেই সব হারিয়ে ফেলল! বিজনেসের লস তো তবু পোষানো যেত, কিন্তু এই বয়সে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে সে কিভাবে সংসার চালাবে? তিনটা ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে আনোয়ারা এখন কি করবে?’
সবাই খেতে বসে। সামিয়ার শ্বশুর টেবিলের মাথায়, একপাশে স্ত্রী একপাশে বড়ছেলে, স্ত্রীর পাশে ছোটছেলে, মারযান অভ্যাসবশত বড় ভাইয়ের পাশে বসতে গিয়ে জিভ কেটে উঠে দাঁড়ায়, সামিয়াকে হাত ধরে টেনে এনে বলে, ‘আরে ভাবী, এটা তো তোমার জায়গা!’ ওর আত্মত্যাগ সামিয়ার দৃষ্টি এড়ায়না। সে আপত্তি জানালে মারযান চোখ টিপে বলে, ‘টেবিলের মাথায় বসার শখ আমার বহুদিনের। তুমি আসতে দেরী করছিলে বলেই তো এতদিন বসতে পারিনি। এখনও যদি বসতে না দাও!’ আসিয়া রুটি নিয়ে সবার প্লেটে দিতে শুরু করেন, মাসরুর আলুভাজি বেড়ে দিতে থাকে। আনোয়ারা প্রথম রুটিটা দেন স্বামীকে, তারপর সামিয়াকে, তারপর ক্রমান্বয়ে তাঁর তিন সন্তানকে, সব শেষে নেন নিজের পাতে, ছেলেও তাঁকে অনুসরন করে। সামিয়া একটু লজ্জাই পায়, কিন্তু এই পরিবারে সবার পরার্থপরতা ওকে মুগ্ধ করে। খাবার বাড়া শেষ হতেই শুরু হয় গল্প। শ্বশুর সাহেব প্রথম শুরু করেন সামিয়ার বাসায় নাস্তায় কি খাওয়া হয়, ক’টায় নাস্তা খাওয়া হয় ইত্যাদি প্রশ্ন দিয়ে। উত্তর দিতে দিতে সামিয়া খেয়াল করে শাশুড়ি শ্বশুরের প্লেটের দিকে হাত বাড়াতে যাচ্ছিলেন, সম্ভবত রুটি ছিঁড়ে দেয়ার জন্য, কিন্তু মাসরুরের চোখের ইশারায় তিনি আবার হাত সরিয়ে নেন।
খাওয়া শেষে মাসরুর আর মাসউদ আগের পদ্ধতিতেই বাবাকে নিয়ে যায় সামনের আঙ্গিনায়, ফুলবাগানে হাঁটতে। মারযান বলে, ‘চল ভাবী, তোমার জিনিসগুলো স্যুটেকেস থেকে আলমারীতে তুলতে সাহায্য করি’। কিন্তু শাশুড়ি বলেন, ‘আমাকেও কিছু কথা বলার সুযোগ দিবি তো! মেয়েটা এসেই লেগে গেল রান্নাঘরে! তুই যা, নিজের রুম গুছিয়ে এসে তোর ভাবীকে নিয়ে যা’।
(চলবে ইনশা আল্লাহ)
বিষয়: বিবিধ
১৮৭৯ বার পঠিত, ৩৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এতটা খারাপ হচ্ছেনা জেনে আশ্বস্ত হলাম
অনেক অনেক ধন্যবাদ
আল্লাহ সবাইকে সবরে জামিল নসীব করুন আর তার উদ্দেশ্যে যাত্রা করা প্রিয় বান্দাটিকে সন্মান ও মর্যাদার উচ্চ আসনে আসীন রাখুন।
সুন্দর একটি পরিবারময় পর্ব পড়ার সৌভাগ্যের অংশ করলেন আমায় , আপু ! পড়তে পড়তে আমার শ্বশুরবাড়ীর বিশাল রান্নাঘরটা চোখে ভেসে উঠছিল কেবলি। অসাধারণ একটি পর্ব ........ দেখি , কি ঘটে এরপরে !
আপু, মেনে নিতে যতই কষ্ট হোক, আল্লাহ যা করেন সবকিছু কল্যাণময়। তিনি বেঁচে থাকলে কারাগারেই থাকতেন এবং কষ্ট পেতেই থাকতেন। তার চেয়ে ভালো জায়গা আল্লাহ তাঁর জন্য পছন্দ করেছেন। এজন্য কি আমাদের শুকরিয়া করা উচিত নয়? তাঁর জন্য দু'আ করতে থাকুন। এখন এটাই একমাত্র কাজে আসবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে উত্তম আমল এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি নিয়ে তাঁর সামনে উপস্থিত হবার তাওফিক দিন।
এ পর্বটাতো পড়েছি মনে আছে কিন্তু আমার কোন কমেন্ট নেই সেটা খেয়ালও করিনি।
মন্তব্য করতে লগইন করুন