এক ফোঁটা জল - তৃতীয়াংশ
লিখেছেন লিখেছেন রেহনুমা বিনত আনিস ১৬ এপ্রিল, ২০১৪, ০৮:২০:১২ সকাল
৫/
ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়েছে দু’বোন। সকালে উঠে সায়রা দেখে এখনও রুহির চোখের কোণে পানি চিক চিক করছে, ঘুমের মধ্যেও কাঁদছে সে! রুহির মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয় সায়রা, কেন যে এমন করছে মেয়েটা! দাদার ভয়েই কি’না কে জানে। ওর হাতের ছোঁয়ায় জেগে ওঠে রুহি। রাতের ঘটনা মনে পড়তেই ওর চেহারাটা আবার দুমরে মুচড়ে আসে। দ্রুত নিজেকে সামলায় সে। উঠে বসে সায়রার দু’হাত ধরে বলে, ‘লক্ষ্মী বোন আমার, গতরাতের ঘটনাটা কাউকে বলবি না, কাউকে না, চাচীকেও না, ওয়াদা কর!’
ওর চোখে গভীরভাবে তাকিয়ে সায়রা বলে, ‘আচ্ছা। কিন্তু আমাকে বলবি তুই এমন করছিস কেন?’
রুহির দু’গাল বেয়ে স্রোতস্বিনী প্রবাহিত হয়, ‘আমার বাবামায়ের কথা আমার তেমন বিশেষ কিছুই মনে পড়েনা। শুধু আবছা আবছা মনে পড়ে আমার মাথা নীচে, পা ওপরে, ভীষণ ব্যাথা সারা গায়ে, মায়ের মুখটা আমার কাছাকাছি, চোখ দু’টো স্থির নিশ্চল, আমার দিকে চেয়ে রয়েছে, পুরো মুখে রক্ত, বাবা গোঙ্গাচ্ছে, হাত বাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে আমার দিকে, কিন্তু বাবাও ঝুলে আছে আমার মত, কিছুতেই নাগাল পাচ্ছেনা আমার। সেই পাঁচ বছর বয়সে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে এতিম হয়ে আমি ঘুরতে লাগলাম একবার নানীর বাসায়, একবার খালার বাসায়, একবার মামার বাসায়। ওদের মায়া ছিল, কিন্তু সামর্থ্য ছিলোনা আমাকে প্রতিপালনের, নিজেরাই যেখানে জীবনযুদ্ধে পিছু হটে যাচ্ছে বার বার সেখানে আমার জন্য ওরা কি করতে পারত? একদিন এক মায়াবতী এলেন। তখন আমার বয়স সাত, তাই কিছু কিছু মনে পড়ে। উনি আমার নানী, খালা, মামীদের সাথে অনেক কথা বললেন, বার বার তাঁদের আশ্বস্ত করলেন, তারপর আমাকে নিয়ে এলেন এই বাড়ীতে। বাড়ীতে এসে পৌঁছনোর সাথে সাথে দাদার সে কি হুঙ্কার! মায়াবতী কোন জবাব দিলেন না, পুরো সময়টা আমাকে জড়িয়ে রাখলেন তাঁর বুকের ভেতর। এভাবেই তিনি আমাকে আগলে রেখে চলেছেন এতগুলো বছর ধরে। তাহলে আমি কিভাবে তাঁর বুকে ছুরি বসাতে পারি? তাঁর একটাই ছেলে। তাঁর অধিকার রয়েছে নিজের একমাত্র ছেলেকে নিজের পছন্দমত মেয়ে দেখে বিয়ে করানোর। এই অধিকারে আমি কিছুতেই হাত দিতে পারিনা, তাতে যার বুক ফাটে ফাটুক। তোকে আবার অনুরোধ করছি, তুই কোনভাবেই গতরাতের কথা কাউকে বলবিনা, চাচীকে তো অবশ্যই না। কি, এটুকু করতে পারবিনা আমার জন্য?’
সায়রার চোখে তখন প্লাবন, বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে সে কান্নায়, শুধু রুহিকে জড়িয়ে ধরে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলো, বলতে পারলনা কিছুই।
৬/
‘বাবা, আজ থেকে বারো বছর আগে আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন আমি কোন সাহসে মেয়েটাকে আপনার বাসায় নিয়ে এলাম। আমি কোন জবাব দেইনি। আজ বলব। আজ আমাকে বলতেই হবে। শুনবেন?’
শ্বশুরমশায় নড়েচড়ে বসেন, ‘বল।’
‘আচ্ছা বলুন তো, ফারুককে আমি কত দিনই বা দেখেছি। আমার বিয়ের বছর দুই পরেই তো সে লেখাপড়া করতে শহরে চলে গেল। গিয়ে মুনিরাকে বিয়ে করল’।
‘খবরদার!’, ধমকে ওঠেন বৃদ্ধ, ‘ঐ মেয়ের নাম আমার সামনে নেবেনা!’
পিছিয়ে যায় বড় বৌ, কিন্তু বড় ছেলে এগিয়ে আসে, ‘কেন বাবা? সে গরীবের মেয়ে বলে? সে কি একদম ফেলনা টাইপের মেয়ে ছিল? না, সে ছিল মেধাবী এবং লেখাপড়া জানা, শুধু পয়সা ছিলোনা ওদের। সে তো আমার ভাইয়ের সাথে প্রেম করেনি বাবা। ফারুক নিজেই ওর বাবার কাছে প্রস্তাব দিয়ে ওকে বিয়ে করেছে। আপনাকে জানায়নি কেন? হয়ত আপনি যদি বুঝদার হতেন সে নির্ভয়ে আপনাকে জানাতে পারত। কেন জানায়নি সেটা তো আপনি নিজেই পদে পদে প্রমান করেছেন’।
বৃদ্ধ মুখ নীচু করে রাখেন।
‘বাবা, আপনি বলুন, আপনি বিয়ের খবর শুনে কি করলেন? আপনি বললেন কেউ ওদের সাথে কোন যোগাযোগ রাখবেনা। আপনি আর কোনদিন ওদের মুখ দেখবেন না। ব্যাস, দেখলেন না। ওরা অর্থকষ্টে জর্জরিত ছিলো, আপনি জেনেও সাহায্য করেননি। ওদের সন্তান হোল, কিন্তু আপনার মন গললনা, আপনি নিজেও গেলেন না, আমাদেরও কাউকে যেতে দিলেন না। ওদের গাড়ী অ্যাক্সিডেন্ট হোল, মুনিরা ঘটনাস্থলে মারা গেল, ফারুক গুরুতর আহত হোল, হয়ত ভাল চিকিৎসা পেলে ওকে বাঁচানো যেত, কিন্তু আপনি আপনার জেদের ওপর অটল রইলেন। আমি লুকিয়ে কিছু টাকা পাঠালাম, আপনি জানতে পেরে আমার টাকাপয়সা বন্ধ করে দিলেন। যেটুকু পাঠিয়েছিলাম সেটা ওকে বাঁচানোর জন্য যথেষ্ট ছিলোনা। আমার ভাইটা মরে গেল। আপনার টাকা পথের কুকুরে খায়, অথচ আমার ভাইটা টাকার অভাবে মারা গেল’, গলা ধরে আসে তাঁর, তবু বলতে থাকেন, ‘ওদের মেয়েটার প্রতি পর্যন্ত আপনার কোন মায়াদয়া হোলনা। মেয়েটা একেকবার একেকজনের বাসায় ঘুরতে লাগল। বাবা, ওদের পয়সা ছিলোনা, কিন্তু ওদের আত্মা ছিল। ওদের সন্তানকে ওরা কষ্ট হলেও ফেলে দেয়নি’।
বাবা খোঁচাটা ধরতে পারলেন, কিন্তু কথা সত্য, সুতরাং তিনি কোন উত্তর দিলেন না।
স্বামীর রুদ্ধকন্ঠ দেখে সাহস করে বড়বৌ আবার এগিয়ে এলেন, ‘বাবা, আমি ওদের মেয়েটাকে নিয়ে এলাম দু’বছর পর। মুনিরাকে আমি কোনদিন দেখিনি, ফারুকের সাথেও আমার সেভাবে ভাব হয়নি কোনদিন। তাহলে আমি ওকে কেন নিয়ে এসেছিলাম আপনি জানেন?’
বৃদ্ধ কৌতুহলী হয়ে মুখ তুলে তাকালেন, ‘কেন?’
‘আপনার জন্য!’
শ্বশুরমশায় হা হয়ে গেলেন, ‘মানে?’
‘বাবা, ওর শরীরে আপনার রক্ত। আপনার সন্তানের শেষ স্মৃতিচিহ্ন সে। আপনি যতই অস্বীকার করুন, আপনার ওপর আমার সা’দ বা সায়রার যেমন অধিকার আছে, রুহিরও অধিকার আছে। আপনি সকাল বিকাল মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েন, বসে বসে তিলাওয়াত করেন, ‘ফাজালিকাল্লাজি ইয়াদু’উল ইয়াতীম’। তারপর ঘরে ফিরে আপনি একজন অসহায় এতিমকে বঞ্চিত করেন, তার প্রতি সামান্য সহানুভূতিও দেখান না। আপনি কি মনে করেন এর জন্য আপনাকে জবাবদিহি করতে হবেনা? আমি আপনাকে রক্ষা করার জন্য ওকে নিয়ে এসেছি। এখানে আমার কোন স্বার্থ নেই’।
বৃদ্ধের চোখের দু’কোণে অশ্রু জমে। পেছন ফিরে নিজের জীবনের দিকে তাকিয়ে তিনি শুধু টাকা আর অহংকার ছাড়া কিছুই খুঁজে পাননা। তাঁর ছেলেরা পারতপক্ষে তাঁর সাথে কথা বলতে চায়না, বৌরা লুকিয়ে লুকিয়ে থাকে, নাতিনাতনীরা থাকে দূরে দূরে। ছেলে এবং বৌয়ের দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে তিনি বুঝতে পারেন এর জন্য তিনিই দায়ী।
সত্য মনে মনে স্বীকার করে নিলেও, স্বভাব কি সহজে বদলানো যায়? তিনি চেহারায় ঈষৎ বিরক্তির ভাব এনে বড় বৌয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তাহলে বল, তুমি এখন কি মনে করে আজ এত বছর পর এই প্রসঙ্গ তুললে?’
বড় বৌ বললেন, ‘বাবা, রুহি আপনার নিজের রক্ত, অথচ এতিম বলে আপনি ওর প্রতি একটুও মায়া করেননি। আজ বারো বছরেও আপনি কোনদিন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেননি, সায়রা ওকে ভালবাসে বলে আপনি সায়রার ওপরেও বিরক্ত। ক’দিন পর মেয়েটার বিয়ে হবে। নিজের বাড়ীতেই যদি ওর কোন আদর না থাকে, শ্বশুরবাড়ীতে ওকে কতটুকু কদর করবে? আপনিই যদি ওর সাথে এমন ব্যাবহার করেন, তাহলে ওর শ্বশুরবাড়ীর লোকজন ওর সাথে কেমন ব্যাবহার করবে? ...’
দাদার ঘরে চেঁচামেচি শুনে ঘরের লোকজন তাঁর ঘরের সামনে থেকে ছুটে পালাতে থাকে, দাদা কার সাথে চিৎকার করছেন সেটা বোঝা যাচ্ছেনা, কারণ অন্য পক্ষ এত শান্ত গলায় কথা বলছে যে বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছেনা। বেশ কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে বড়চাচা আর বড়চাচী বেরিয়ে আসেন। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় দাদা মাথা নুইয়ে বসে আছেন, জানালা থেকে আলো এসে তাঁর গাল বেয়ে চুঁইয়ে পড়া অশ্রুবিন্দুতে ঠিকরে পড়ে ঝিলিক তুলেছে। এমন দৃশ্য এর আগে কেউ কোনদিন দেখেনি, তাই সবাই ভয় ভুলে চেয়ে থাকে এই অভাবনীয় দৃশ্যের দিকে।
(চলবে ইনশা আল্লাহ)
বিষয়: বিবিধ
১৮৬২ বার পঠিত, ৪১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনার প্রোফাইল ছবিটি বেশ সুন্দর! আমার ভীষণ কলমের শখ। এস এস সি পর্যন্ত আমি এমনই ফাউন্টেন পেন ব্যাবহার করতাম
দু'আ করবেন যাতে কলম না থামে আমাদের
সকলের!!
অনেক ভালো লাগলো, দাদাটা বেশি অহংকারী, কিন্তু মনে হলো তার মধ্যে অনুসুচনা তৈরি হলো।
প্রথম এসেই বিশ্লেষণমূলক মন্তব্য উপহার দেয়ার জন্য ধন্যবাদ
বরাবর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ
আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ
আমিও দেখছি রুহীর দাদার মতো নামাজী মানুষ, নিজের রক্তের সম্পর্কের উপরও চরম অন্যায় করে দুয়াকরি প্রভুর কাছে - আল্লাহ যাতে সবাইকে ইসলামকে পরিপূর্ণভাবে জেনে বুঝে মেনেচলার তৌফিক দান করেন
গতকাল ব্লগ আসছিলোনা, আজ দিয়েছি
أَرَأَيْتَ الَّذِي يُكَذِّبُ بِالدِّينِ﴾
১) তুমি কি তাকে দেখেছো৷১ যে আখেরাতের পুরস্কার ও শাস্তিকে২ মিথ্যা বলছে ?৩
১ . ' তুমি কি দেখেছো ' বাক্যে এখানে বাহ্যত সম্বোধন করা হয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে । কিন্তু কুরআনের বর্ণনাভংগী অনুযায়ী দেখা যায় , এসব ক্ষেত্রে সাধারণত প্রত্যেক জ্ঞান - বুদ্ধি ও বিচার - বিবেচনা সম্পন্ন লোকদেরকেই এ সম্বোধন করা হয়ে থাকে। আর দেকা মানে চোখ দিয়ে দেখাও হয়। কারণ সামনের দিকে লোকদের যে অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে তা প্রত্যেক প্রত্যক্ষকারী স্বচক্ষে দেখে নিতে পারে। আবার এর মানে জানা , বুঝা ও চিন্তা ভাবনা করাও হতে পারে। আরবী ছাড়া অন্যান্য ভাষায়ও এ শব্দটি এ অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন আমরা বলি , " আচ্ছা , ব্যাপারটা আমাকে দেখতে হবে। " অর্থাৎ আমাকে জানতে হবে। অথবা আমরা বলি , " এ দিকটাও তো একবার দেখো ।" এর অর্থ হয় , " এ দিকটা সম্পর্কে একটু চিন্তা করো । " কাজেই " আরাআইতা " ( আরবী -----------) শব্দটিকে দ্বিতীয় অর্থে ব্যবহার করলে আয়াতের অর্থ হবে , " তুমি কি জানো সে কেমন লোক যে শাস্তি ও পুরস্কারকে মিথ্যা বলে ৷ " অথবা " তুমি কি ভেবে দেখেছো সেই ব্যক্তির অবস্থা যে কর্মফলকে মিথ্যা বলে ৷ "
২ . আসলে বলা হয়েছে : ( আরবী ------------) । কুরআনের পরিভাষায় " আদ দীন " শব্দটি থেকে আখেরাতে কর্মফল দান বুঝায়। দীন ইসলাম অর্থেও এটি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু সামনের দিকে যে বিষয়ের আলোচনা হয়েছে তার সাথে প্রথম অর্থটিই বেশী খাপ খায় যদিও বক্তব্যের ধারাবাহিকতার দিক দিয়ে দ্বিতীয় অর্থটিও খাপছাড়া নয়। ইবনে আব্বাস ( রা)) দ্বিতীয় অর্থটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তবে অধিকাংশ তাফসীরকার প্রথম অর্থটিকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। প্রথম অর্থটি গ্রহণ করলে সমগ্র সূরায় বক্তব্যের অর্থ হবে , আখেরাত অস্বীকারের আকীদা মানুষের মধ্যে এ ধরনের চরিত্র ও আচরণের জন্ম দেয়। আর দ্বিতীয় অর্থটি গ্রহণ করলে দীন ইসলামের নৈতিক গুরুত্ব সুস্পষ্ট করাটাই সমগ্র সূরাটির মূল বক্তব্যে পরিণত হবে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে বক্তব্যের অর্থ হবে , এ দীন অস্বীকারকারীদের মধ্যে যে চরিত্র ও আচরণ বিধি পাওয়া যায় ইসলাম তার বিপরীত চরিত্র সৃষ্টি করতে চায়।
৩ . বক্তব্য যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে মনে হয় , এখানে এ প্রশ্ন দিয়ে কথা শুরু করার উদ্দেশ্য একথা জিজ্ঞেস করা নয় যে , তুমি সেই ব্যক্তিকে দেখেছো কি না। বরং আখেরাতের শাস্তি ও পুরস্কার অস্বীকার করার মনোবৃত্তি মানুষের মধ্যে কোন ধরনের চরিত্র সৃষ্টি করে শ্রোতাকে সে সম্পর্কে চিন্তা- ভাবনা করার দাওয়াত দেয়াই এর উদ্দেশ্য। এই ধরনের লোকেরা এ আকীদাকে মিথ্যা বলে সে কথা জানার আগ্রহ তার মধ্যে সৃষ্টি করাই এর লক্ষ। এভাবে সে আখেরাতের প্রতি ঈমান আনার নৈতিক গুরুত্ব বুঝার চেষ্টা করবে।
﴿فَذَٰلِكَ الَّذِي يَدُعُّ الْيَتِيمَ﴾
২) সে-ই তো ৪ এতিমকে ধাক্কা দেয় ৫
৪ . আসলে ( আরবী ----------) বলা হয়েছে। এ বাক্যে " ফা " অক্ষরটি একটি সম্পূর্ণ বাক্যের অর্থ পেশ করছে। এর মানে হচ্ছে , " যদি তুমি না জেনে থাকো তাহলে তুমি জেনে নাও " " সে - ই তো সেই ব্যক্তি " অথবা এটি এ অর্থে যে , " নিজের এ আখেরাত অস্বীকারের কারণে সে এমন এক ব্যক্তি যে ----------------"
৫ . মূলে ( আরবী --------) বলা হয়েছে এর কয়েকটি অর্থ হয়। এক , সে এতিমের হক মেরে খায় এবং তার বাপের পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকে বেদখল করে তাকে সেখান থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। দুই , এতিম যদি তার কাছে সাহায্য চাইতে আসে তাহলে দয়া করার পরিবর্তে সে তাকে ধিক্কার দেয়। তারপরও যদি সে নিজের অসহায় ও কষ্টকর অবস্থার জন্য অনুগ্রহ লাভের আশায় দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে তাকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় । তিন , সে এতিমের ওপর জুলুম করে। যেমন তার ঘরেই যদি তার কোন আত্মীয় কথায় গালমন্দ ও লাথি ঝাঁটা খাওয়া ছাড়া তার ভাগ্যে আর কিছুই জোটে না। তাছাড়া এ বাক্যের মধ্যে এ অর্থও নিহিত রয়েছে যে, সেই ব্যক্তি মাঝে মাঝে কখনো কখনো এ ধরনের জুলুম করে না বরং এটা তার অভ্যাস ও চিরাচরিত রীতি সে যে এটা একটা খারাপ কাজ করছে , এ অনুভূতিও তার থাকে না। বরং বড়ই নিশ্চিন্তে সে এ নীতি অবলম্বন করে যেতে থাকে। সে মনে করে , এতিম একটা অক্ষম ও অসহায় জীব। কাজেই তার হক মেরে নিলে , তার ওপর জুলুম - নির্যাতন চালালে অথবা সে সাহায্য চাইতে এলে তাকে ধাক্কা মেরে বের করে দিলে কোন ক্ষতি নেই।
এ প্রসংগে কাজী আবুল হাসান আল মাওয়ারদী তাঁর " আলামূন নুবুওয়াহ " কিতাবে একটি অদ্ভুত ঘটনা বর্ণনা করেছেন । ঘটনাটি হচ্ছে : আবু জেহেল ছিল একটি এতিম ছেলের অভিভাবক। ছেলেটি একদিন তার কাছে এলো । তার গায়ে একটুকরা কাপড়ও ছিল না। সে কাকুতি মিনতি করে তার বাপের পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে তাকে কিছু দিতে বললো। কিন্তু জালেম আবু জেহেল তার কথায় কানই দিল না। সে অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর শেষে নিরাশ হয়ে ফিরে গেলো । কুরাইশ সরদাররা দুষ্টুমি করে বললো , " যা মুহাম্মাদের ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) কাছে চলে যা। সেখানে গিয়ে তার কাছে নালিশ কর। সে আবু জেহেলের কাছে সুপারিশ করে তোর সম্পদ তোকে দেবার ব্যব্স্থা করবে । " ছেলেটি জানতো না আবু জেহেলের সাথে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কি সম্পর্ক এবং এ শয়তানরা তাকে কেন এ পরামর্শ দিচ্ছে। সে সোজা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পৌঁছে গেলো এবং নিজের অবস্থা তাঁর কাছে বর্ণনা করলো। তার ঘটনা শুনে নবী ( সা) তখনই দাঁড়িয়ে গেলেন এবং তাকে সংগে নিয়ে নিজের নিকৃষ্টতম শত্রু আবু জেহেলের কাছে চলে গেলেন। তাঁকে দেখে আবু জেহেল তাঁকে অভ্যর্থনা জানালো। তারপর যখন তিনি বললেন , এ ছেলেটির হক একে ফিরিয়ে দাও তখন সে সংগে সংগেই তাঁর কথা মেনে নিল এবং তার ধন - সম্পদ এনে তার সামনে রেখে দিল । ঘটনার পরিণতি কি হয় এবং পানি কোন দিকে গড়ায় তা দেখার জন্য কুরাইশ সরদাররা ওঁৎ পেতে বসেছিল। তারা আশা করছিল দু' জনের মধ্যে বেশ একটা মজার কলহ জমে উঠবে। কিন্তু এ অবস্থা দেখে তারা অবাক হয়ে গেলো। তারা আবু জেহেলের কাছে এসে তাকে ধিক্কার দিতে লাগলো। তাকে বলতে লাগলো , তুমিও নিজের ধর্ম ত্যাগ করেছে। আবু জেহেল জবাব দিল , আল্লাহর কসম ! আমি নিজের ধর্ম ত্যাগ করিনি। কিন্তু আমি অনুভব করলাম , মুহাম্মাদের ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) ডাইনে ও বাঁয়ে এক একটি অস্ত্র রয়েছে। আমি তার ইচ্ছার সামান্যতম বিরুদ্ধাচরণ করলে সেগুলো সোজা আমার শরীরের মধ্যে ঢুকে যাবে। এ ঘটনাটি থেকে শুধু এতটুকুই জানা যায় না যে ,সে যুগে আরবের সবচেয়ে বেশী উন্নত ও মর্যাদা গোত্রের বড় বড় সরদাররা পর্যন্ত এতিম ও সহায় - সম্বলহীন লোকদের সাথে কেমন ব্যবহার করতো বরং এই সংগে একথাও জানা যায় যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কত উন্নত নৈতিক প্রভাব কতটুকু কার্যকর হয়েছিল। ইতিপূর্বে তাফহীমূল কুরআন সূরা আল আম্বিয়া ৫ টীকায় আমি এ ধরনের একটি ঘটনা বর্ণনা করেছি।নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে জবরদস্ত নৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে কুরাইশরা তাঁকে যাদুকর বলতো এ ঘটনাটি তারই মূর্ত প্রকাশ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন