এক ফোঁটা জল - দ্বিতীয়াংশ
লিখেছেন লিখেছেন রেহনুমা বিনত আনিস ১৫ এপ্রিল, ২০১৪, ১২:০০:০৮ দুপুর
৩/
রুহি ছাদে এসে রেলিংয়ে বসে আকাশের দিকে তাকায় যেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়াপাখী উড়ে যাচ্ছে পুকুরের ওপাড়ে বড় শিশুগাছটার দিকে, ওটাই ওদের বাসস্থান। রুহিদের এই দোতলা বাড়ীটা অনেক প্রাচীন। সম্ভবত এই গ্রামের সবচেয়ে পুরোনো দালান এটা। এই বাড়ীর ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে দাদার অহংকারের শেষ নেই। সাত বছর বয়স পর্যন্ত শহরেই বড় হয়েছে রুহি, তবে শহরের তেমন কিছু মনে নেই ওর। কিন্তু দাদার কিছু কিছু আচরনে ওর মনে হয় বুড়োকে একবার শহর দেখিয়ে আনতে পারত! তাহলে হয়ত অহংকার কিছুটা কমত তাঁর। যাক, চাচীরা ওর জন্য পাত্র দেখছেন। যতগুলো প্রস্তাব এসেছে তাতে অন্তত একটা তো পছন্দ হওয়ার কথা। এবার যদি দাদার অহেতুক অসন্তুষ্টি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়! সা’দ ভাইয়া উদ্যোগ নিলে চাচীদের বিশৃঙ্খলা থেকে উদ্ধার করে একটা সিদ্ধান্তে আনা সহজ হত, কিন্তু দাদা মনে হয় সে পরিবেশটাই ভেস্তে দিল। সেজন্যই কি সা’দের যাবার খবর শুনে ওর বুকের ভেতর এমন দুমড়ে মুচড়ে উথাল পাথাল কান্না উঠে আসতে চাইছে? আচ্ছা, ও কাঁদল কেন? নিজেকে কেমন বোকা বোকা লাগছে রুহির।
সায়রা সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে, বিড়ালের মত নিঃশব্দ চলাফেরা মেয়েটার, কিন্তু ওর গান শুনে বুঝতে পারে ও আসছে, ‘আমি তো আমার গল্প বলেছি, তুমি কেন কাঁদলে?’ আবারও ভাবার চেষ্টা করে রুহি, সা’দ লেখাপড়া করতে বিদেশ যাবে, এটা তো ভাল কথা, তাহলে সে কেন কাঁদল? তাহলে কি সে সা’দকে হিংসা করে, দাদা ওকে ভালবাসে বলে? নাহ, দাদার ভালোবাসা পাবার শখ মরে গেছে ওর। তাহলে কি?
সায়রা ছাদে হাঁটে আর গুন গুন করে। আরেকটা সম্ভাবনার কথা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চায় রুহির মনে। কিন্তু না, এটা হতেই পারেনা। পা দিয়ে মাড়িয়ে সম্ভাবনাটাকে অন্ধকারেই কবর দিয়ে দেয় সে। এর অস্তিত্ব সম্পর্কে সে ভাবতেই চায়না।
৪/
এত রাতে ওদের দরজায় টোকা দিচ্ছে কে? সায়রা দরজা খুলে ভাইয়ার উদ্ভ্রান্তের মত চেহারা দেখে ভয় পেয়ে যায়, ‘কিরে ভাইয়া? তোর কি হয়েছে?’
সা’দ জবাব না দিয়ে বলে, ‘রুহি কোথায়?’
সায়রা আরো অবাক হয়ে যায়, ভাইয়া তো পারতপক্ষে রুহির সাথে কথাই বলেনা, আর এখন রাতদুপুরে কি এমন প্রয়োজন হোল যে এসে ওর খোঁজ করছে! মেয়েটাও সেই সন্ধ্যা থেকেই বারান্দায়, কি যে ভাবছে আনমনে, সায়রা ওকে বিরক্ত করতে চায়নি বলে বিছানায় শুয়ে গল্পের বই পড়ছিল, গল্প এখন শেষের দিকে, নায়ক নায়িকার বহু বছর পর দেখা হতে যাচ্ছে, এই সময় কিনা ভাইয়া এসে বাগড়া দিলো! সায়রা বিরস বদনে বলল, ‘বারান্দায়’।
সা’দ সায়রাকে পাশ কাটিয়ে বারান্দায় রওয়ানা দিলো। আরে ভাইয়ার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? সায়রা ভাইয়ার আগে বারান্দায় দৌড়ে গেল, গিয়ে দেখে সা’দের পায়ের শব্দ পেয়ে রুহি মাথায় ওড়না টেনে দিচ্ছে। রুহি ওকে চোখে চোখে প্রশ্ন করল, ‘কি ব্যাপার?’ সায়রা মাথা ঝাঁকিয়ে বুঝালো, ‘আমি জানিনা’। জোৎস্নালোকিত বারান্দায় দু’বোনের মধ্যখানে এসে দাঁড়ালো সা’দ। উত্তাল অনুভূতিকে দমিয়ে রাখতে ওর কি কষ্ট হচ্ছে তা ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অনুভূতির প্রাবল্যে কাঁপছে সে। রুহির দিকে তাকিয়ে সে বলে, ‘রুহি, কখনো ভাবিনি কথাটা তোমাকে বলব, সঙ্কল্প করেছিলাম বুঝতেও দেবনা। কিন্তু আজ তোমার চোখের এক ফোঁটা জল আমার সমস্ত সঙ্কল্প তছনছ করে দিল। দাদা তোমাকে বাড়ীতে আশ্রয় দিয়েছে, কিন্তু মনে স্থান দেয়নি কখনো। এটা তোমাকে কতটা কষ্ট দেয় তা তুমি মুখে না বললেও আমি তোমার চেহারা দেখেই বুঝতে পারি। তাই ভাবতাম তোমার দূরে কোথাও বিয়ে হলেই ভাল হবে, অন্তত এই জ্বালা থেকে মুক্তি পাবে তুমি। কিন্তু আজ আমার দূরে চলে যাবার খবরে যেভাবে তোমার চোখ অশ্রুসিক্ত হোল তাতে কিছুতেই মনকে বোঝাতে পারছিনা যে তোমার প্রতি আমার যে অনুভূতি, আমার প্রতি তোমার অনুভূতি তার চেয়ে ভিন্ন। এর পর আর ভাবতেই পারছিনা যে তোমার দূরে কোথাও বিয়ে হয়ে যাবে, আর দেখবনা তোমাকে। তুমি প্লিজ একবার বল তুমি আমার সঙ্গী হবে, তাহলে আমি পথ তৈরী করে নেব। কেউ ঠেকাতে পারবেনা আমাকে’।
ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় হলেও চোখের সামনে উপন্যাস রচিত হতে দেখে উত্তেজনায় দু’চোখ জ্বলজ্বল করে সায়রার। উপন্যাসের নায়িকা হিসেবে রুহিকে ওর দারুণ পছন্দ। কথা বলতে শুরু করেছে রুহি, ওর গলা আশ্চর্যজনকভাবে অনুভূতিশূন্য, ‘না ভাইয়া, তুমি ভুল করছ। সায়রার চোখে পানি দেখে আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। তোমার সহানুভূতির জন্য আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমাদের মাঝে কিছু হতে পারেনা’।
ছন্দপতনে চমকে যায় সায়রা। সা’দ আরো উত্তেজিত হয়ে যায়, ‘তুমি মিথ্যা বলছ রুহি! আমি তোমার চেহারা দেখেছি। তুমি তোমার অনুভূতি লুকানোর জন্য ওখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিলে। কিন্তু আমি তোমাকে ধরে ফেলেছি। কেন মিথ্যা বলছ? কেন স্বীকার করছ না, আমরা উভয়েই একই জিনিস চাই’।
রুহি কঠোর মুখ করে বলে, ‘ভাইয়া, আমি তো বলেছিই তোমার সহানুভূতির জন্য আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু তুমি ভুল করছ। তুমি যা ভাবছ তা হতে পারেনা’।
সা’দ প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে, ‘তুমি মিথ্যাবাদী, তুমি মিথ্যা বলছ’, বলে চিৎকার করতে করতে ওদের ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
ভাইয়ের অপমান গায়ে লাগে সায়রার, আবার রুহি কেন এমন করছে সেটাও বুঝতে পারেনা সে। মেয়েটা এত ভাল, সবার অনুভূতির প্রতি এত খেয়াল রাখে, আর সে কি’না ভাইয়াকে এভাবে ফিরিয়ে দিলো! ভাল না বাসলেও তো অন্তত একবার ভেবে দেখতে পারত!
রুদ্ধগলায় রুহি বলে, ‘সায়রা, প্লিজ দরজাটা আটকে দে’।
হায়রে, মনের দরজা আটকে এবার রুহি ঘরের দরজা আটকাচ্ছে! সায়রা ঘরের দরজা আটকে বিছানার দিকে যেতে যেতে বারান্দা থেকে চাপা কান্নার আওয়াজ শুনে ছুটে যায়। গিয়ে তো সে অবাক! রুহি কান্নার গমকে হাঁটু মুড়ে উপুড় হয়ে বারান্দার মেঝেতে হাত ঠেকিয়ে নিজেকে সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে! পাশের ঘরে মা থাকেন, মায়ের আর সায়রাদের বারান্দা দু’টো পাশাপাশি। রুহি প্রানপণে চেষ্টা করছে ওর মুখ থেকে যেন কোন শব্দ বের না হয়, চাচী যেন শব্দ শুনে জেগে না যান। সায়রা ছুটে গিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরে, ‘ওরে মুখপুড়ি, এত ভালবাসিস আমার ভাইটাকে! তাহলে মিথ্যা বললি কেন, কেন এভাবে কষ্ট দিলি ভাইয়াকে?’ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যার্থ চেষ্টায় রুহির সাথে সাথে সায়রার শরীরটাও কাঁপছে। তবু রুহি প্রচন্ডবেগে মাথা ঝাঁকিয়ে বার বার বলতে থাকে, ‘ভালবাসিনা, না, ভালবাসতে পারিনা’।
(চলবে ইনশা আল্লাহ)
বিষয়: বিবিধ
১৮১২ বার পঠিত, ৩০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ইসলামে নৈতিকতা সবার ওপরে, তাই মন চাইলেই আমরা সব করতে পারিনা।
মন্তব্য করতে লগইন করুন