শোন! - ১
লিখেছেন লিখেছেন রেহনুমা বিনত আনিস ০৬ এপ্রিল, ২০১৪, ০৬:৫৪:২৮ সকাল
এই যে আপু, শোন! হ্যাঁ, তোমাকেই বলছি। ও কি, এত তাড়াহুড়ার কি আছে? তোমার যেতে হবে? আমারও তো যেতে হবে! তবে পাঁচ মিনিট শুনেই যাওনা। কথা দিচ্ছি তোমার বেশি সময় নেবনা আমি। এস, এখানটাতে বোস, তোমার সাথে একটা জরুরী কথা আছে।
কি জরুরী কথা? না, ভয় পেয়োনা। তোমার সিদ্ধান্ত বদলাবার চেষ্টা করব না আমি। তুমি কি আমার চেয়ে কম বোঝ নাকি? আমি তোমাকে ডেকেছি আমার প্রয়োজনে। তোমাকে একটা অনুরোধ করতে চাচ্ছিলাম। আমার একটা কাজ করে দেবে ভাই? একটু পর যখন তোমার আমার প্রভুর সাথে সাক্ষাত হবে তখন জানিয়ো আমি এক্সপ্রেস মেইলে খবর পাঠিয়েছি, তিনি যেন তাঁর অগাধ ক্ষমাশীলতার নিদর্শন হিসেবে আমাকে মাফ করে দেন। এ কি? আঁতকে উঠলে কেন? আমি এমন কি কষ্টের কাজ করতে বললাম তোমায়? তুমি তো রওয়ানা দিয়েছই, তাহলে এটুকু খবর পৌঁছতে পারবেনা? আসলে হয়েছে কি, কি বলব ভাই, লজ্জাই পাচ্ছি বলতে- তিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন সর্বোত্তম অবয়বে, নাক মুখ চোখ হাত পা সব ঠিকঠাকমত বুঝে পেয়েছি, জ্ঞানবুদ্ধিও খারাপ দেননি, তবু থ্যাঙ্ক ইউ বলতে মনে থাকেনা। আমার সব প্রয়োজনের দিকে তিনি খেয়াল রাখেন, সব সুবিধা অসুবিধা দেখেন, কিন্তু তাঁর প্রতি আমার ভালোবাসার পরীক্ষা নিতে গেলেই আমি তাঁর সাথে প্রতারণা করে বসি। তিনি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, আমার প্রতি তাঁর সদাসচেতন নজর, কিন্তু আমিই কেবল ফাঁক পেলে আমার শত্রুর সাথে পরকীয়া করে বসি। কি যে করি আপু! বুঝি সবই, তবু যে কেন বারবার পা পিছলে পড়ি! অনেক ভয়ে আছি আপু, কবে তাঁর সামনে গিয়ে উপস্থিত হতে হয়, কি লজ্জায় পড়ব তখন, মরারও উপায় থাকবেনা! তুমি যেহেতু আগেভাগেই হাজিরা দিতে যাচ্ছ, ভাবলাম নিশ্চয়ই তোমার প্রস্তুতি শেষ। এরকম একটা প্রতিষ্ঠিত মানুষ পেলাম, তাই ভাবলাম তাড়াতাড়ি খবরটা পাঠাই। আমার এটুকু কাজ তোমাকে করে দিতেই হবে!
অ্যাঁ, বল কি? তোমার প্রস্তুতি নেয়া হয়নি? তাহলে হন্তদন্ত হয়ে যাচ্ছিলে কোথায়? তোমার ওড়না তো এখনো ফ্যানের শোভাবর্ধন করছে! কি? জীবনের প্রতিকুলতা সহ্য করতে পারছ না, তাই রওয়ানা দিচ্ছিলে? পাগল নাকি? কেউ কি সাময়িক জ্বালাযন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য চিরস্থায়ী জ্বালা বেছে নেয়? কেন গো আপু, এই যে এতগুলো বছর তুমি জীবনের রঙ রূপ গন্ধ স্পর্শ উপভোগ করলে, কোনদিন কি বলেছ, ‘না না, ব্যাস ব্যাস, হয়েছে, আর লাগবেনা, থ্যাঙ্ক ইউ’? তাহলে যিনি তোমাকে এত্ত এত্ত দিলেন, তিনি যদি বাজিয়ে দেখতে চান তুমি তাঁকে ভালোবাস না তাঁর উপহার সামগ্রীকে, তখন তুমি প্রেমের পরীক্ষায় ফেল মারতে চাও? এমন একজনকে কি তুমি গ্রহণ করতে যে তোমাকে নয়, তোমার আনুষাঙ্গিক বস্তুসামগ্রীকে ভালবাসে? তাহলে তুমি কি ভেবে এই অবস্থায় তাঁর সামনে উপস্থিত হতে যাচ্ছ?
শোন আপু, সহজ কথা। শরীরটা তো আর তোমার নয়, বরং একে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তোমার কাছে দেয়া হয়েছে যেন তুমি একে খাটিয়ে পরবর্তী জীবনের জন্য কিছু পাথেয় সংগ্রহ করে নিতে পারো। ব্যাঙ্ক লোনের মত ব্যাপার। ব্যাঙ্ক তোমাকে লোন দেয় কেন? তোমার পুঁজি নেই বলে। ওরা তোমাকে কিছু পুঁজি দিয়ে দেয় যেন তুমি টাকাটা খাটিয়ে লাভ করতে পারো- তোমারও কিছু লাভ হোল, ব্যাঙ্কও তার আসল ফিরে পেল। কিন্তু তুমি যদি লোনের টাকাটা মেরে খেয়ে উড়িয়ে ফেল, তাহলে ব্যাঙ্ক কি তোমাকে ছেড়ে দেবে? শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে। তোমার সৃষ্টিকর্তা তোমাকে এই শরীর দিয়েছেন বাবামায়ের সেবা করার জন্য, স্বামীর হাত ধরে জীবন গড়ার জন্য, তোমার সন্তানদের ভালোবাসার জন্য, গরীব দুস্থদের সাহায্য করার জন্য, বন্ধুদের সহযোগিতা করার জন্য, ফ্যানে ঝোলানোর জন্য ... মনে হয় না। তুমি পুঁজি নষ্ট করলে এই শরীরের সৃষ্টিকর্তা তোমাকে চিরস্থায়ী শাস্তিতে দন্ডিত করলে আমাদের কার কি বলার আছে বল? আইন ভঙ্গ করলে আইন কি শাস্তি দেয়ার অধিকার রাখেনা?
নাহ, তোমার প্রতি একটু বেশিই কঠিন হয়ে গেলাম মনে হয়। শোন আপু, আমাদের জীবনে সমস্যা হয় কেন? এগুলো তো আমাদেরই অবিবেচনা, স্বার্থপরতা, লোভ, মোহ, কাম, ক্রোধের ফল। প্রতিটা সমস্যারই সমাধান আছে। কিন্তু আমরা সমাধানের দিকে না গিয়ে বরং যে ভুল করে সমস্যায় নিপতিত হয়েছি সে ভুলকেই আঁকড়ে ধরে থাকতে চাই, আর মনে মনে আশা করি আমাদের প্রভু আলৌকিকভাবে সব পরিবর্তন করে দেবেন। আচ্ছা আপু, তুমিই বল, কারো শরীরে রোগ হলে অপারেশন করাতে হয়না? অপারেশান করলে কষ্ট হয়না? তাই বলে কি আমরা সুস্থ হবার আশায় অপারেশন না করিয়ে কষ্ট হবে বলে রোগটাকে লালন করি? তুমি ঠিকই বলছ, একটা প্রতিকুলতাকে সমাধান করতে অনেক অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়, অনেকে না বুঝে বেদনাদায়ক মন্তব্য করে, শারিরীক মানসিক প্রচুর চাপ যায়, কোন কোন সময় মনে হয় যেন আগুনের মাঝে বসবাস করছি। কিন্তু একদিন হঠাৎ ঝিরঝির করে বৃষ্টি নামে, গ্রীষ্মের দাবদাহ সরে গিয়ে চারিদিক ঘাসলতাপাতায় পরিপূর্ন হয়ে যায়, সেই সবুজের অঙ্গনে নিরাপদ ছাদের নীচে বসে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আমরা স্মৃতি রোমন্থন করি, ‘আহ, কি কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে না আমার প্রভু আমাকে পথ দেখিয়ে বের করে নিয়ে এসেছেন এই স্বর্গীয় উদ্যানে!’ ভাবতেই অবিশ্বাস্য লাগে কিভাবে সে সময় পেরিয়ে এসেছি আর আমার প্রভু আমার গায়ে আঁচড় লাগলেও মনটি রেখেছিলেন প্রশান্ত! কিন্তু আপু, এর জন্য তাঁকে মনে প্রবেশ করতে দিতে হবে তো! আমি যদি নিজেকে সর্বেসর্বা ভেবে সব দায়িত্ব নিজের ওপর চাপিয়ে নেই, তাহলে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে পর্বতপ্রমাণ বোঝা তো আমার ঘাড়েই চেপে বসবে, আমি দিশাহারা বোধ করব, যেমন এই মূহূর্তে তুমি দিশাহারা বোধ করছ।
তোমার হৃদয়ের দুয়ার খুলে দাও আপু, দৃষ্টিসীমাকে প্রসারিত কর দিগন্তের প্রতি, হাত বড়িয়ে দাও অসীমের প্রতি। একদিন আকাশের এই কালো মেঘের ঘনঘটা কেটে যাবে, আসমান হেসে উঠবে সাতরঙ্গা আলোয়। কিন্তু তুমি যদি আজ নিজেকে পরাভূত হতে দাও, তাহলে কি করে দেখেব সেই সোনালী সুদিন?
আপু, পৃথিবীটা গোল, তাই আমরা খুব বেশি দূর দেখতে পাইনা। কিন্তু তোমার চোখের সামনে যে দিগন্ত তার ওপাড়ে আরেকটা দিগন্ত আছে যেটা হয়ত আরো অনেক সুন্দর। মনের জানালাটা খুলে দাও, দরজা খুলে বেরিয়ে এসো দিগন্তের পথে, পথটা বন্ধুর হতে পারে, কিন্তু তুমি যদি তোমার প্রভুর হাত ধরে এগিয়ে যাও তাহলে হাঁটি হাঁটি পা পা করে পথের শেষে সেই দিগন্তে পৌঁছতে পারবে যা তুমি আজ কল্পনাও করতে পারছ না।
তবে কেন অল্প শোকে কাতর হয়ে নিজের জীবনটা বিলিয়ে দিতে চাইছ? কেন ভাবছনা প্রভুর সাক্ষাতে তুমি কি উত্তর দেবে, তোমার পরিবার বন্ধুবান্ধবের দুঃখের কারণ হয়ে তুমি কি কবরে শান্তি পাবে? কেন তবে শত্রুর ফাঁদে পা দিয়ে নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চলেছ? সে তো চায়ই যাবার সময় আমাদের সাথে নিয়ে যেতে। কিন্তু তুমি কেন সব বুঝেশুনে তার সাথে যেতে চাও জ্বালাযন্ত্রণার সাগরে হাবুডুবু খেতে যেখানে তুমি চিরহরিৎ আনন্দভূবনে শান্তি আর স্বস্তিতে কাটাতে পারো চিরকাল?
কি বলছ? সিদ্ধান্ত পাল্টেছ? ভাল, ভাল। চল, দেখি তোমার সমস্যার সমাধান কিভাবে করা যায়। সবাই মিলে হাল ধরলে চরে আটকা পড়া নৌকাও ঠেলে নদীতে নামানো যায়।
সব তো ঠিক আছে, কিন্তু ... আমার এক্সপ্রেস মেইলের কি হবে? থাক, থাক। সেটা না হয় রাত্তিরে এক্সপ্রেস মেইলেই পাঠিয়ে দেব!
বিষয়: বিবিধ
২০৮০ বার পঠিত, ৩৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক অনেক ধন্যবাদ
হতাশা, ক্রোধ, অভিমান, অন্ধ আবেগ হতে অনেকে সিদ্ধান্ত নেয়- লাইফটা শেষ করে দিই। কিন্তু শেষ তো হয়না। পরজীবনে যে এ আত্মহননের জন্য আরো অনেক অনেক কঠিন যন্ত্রণা অপেক্ষা করছে ক্ষণিকের উন্মাদনায় সেটা তারা ভুলে যায়। অথচ কতইনা ভাল হতো যদি তারা বিপদে হতাশ না হয়ে সর্বশক্তিমান এর কাছে কায়মনো বাক্যে সাহায্য প্রার্থনা করতো।
أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُم مَّثَلُ الَّذِينَ خَلَوْا مِن قَبْلِكُم ۖ مَّسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُوا حَتَّىٰ يَقُولَ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ مَتَىٰ نَصْرُ اللَّهِ ۗ أَلَا إِنَّ نَصْرَ اللَّهِ قَرِيبٌ [٢:٢١٤]
“তোমরা কি ভেবে নিয়েছ, এমনিতেই জান্নাতে প্রবেশ করবে? আর তোমাদের উপর এখনও সেই অবস্থা আসেনি যে অবস্থা বা প্রতিকূল পরিস্থিতি এসেছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। তাদের উপর বিপদের উপর বিপদ এসেছে, এমনকি ঐ বিপদসমূহ ভূমিকম্পের রূপ নিয়েছে, সেই প্রচ- প্রতিকূল পরিস্থিতিতে রাসূল এবং তার সাথীসঙ্গীগণ আর্তচিৎকার করে বলে উঠেছে, আল্লাহর সাহায্য কখন কোথায় কিভাবে আসবে? এহেন অবস্থায় আল্লাহর পক্ষ থেকে অভয় দিয়ে বলা হয়েছে, তোমরা জেনে নাও আল্লাহর সাহায্য অবশ্যই অতি নিকটে”। (সূরা বাকারা আয়াত ২১৪)
আল্লাহ আমাদের হেদায়াত নসীব করুন।
ধন্যবাদ
আপনার লেখাটি পড়ে ঐ সময়ের ভয়ঙ্কর স্মৃতিগুলো মনে পড়ে গেল। সময় পেলে ঐ অভিজ্ঞতা শেয়ার করব।
আপনার গল্পের অপেক্ষায় রইলাম
তবে একটু দূর থেকে পড়েছি কিন্তু!
"সবাই মিলে হাল ধরলে চরে আটকা পড়া নৌকাও ঠেলে নদীতে নামানো যায়।"
অসাধারণ লিখা আপু.
মন্তব্য করতে লগইন করুন